ইতালীয় ভাষায় পেঁয়াজ, মানব মূঢ়তা এবং কোভিড-১৯ থেকে বিজ্ঞান শেখা

Published : 15 Jan 2012, 03:39 AM
Updated : 25 April 2020, 04:04 PM

ইতালির পাভিয়া শহরে ১৯২২ সালে জন্ম নেয়া কার্লো চিপোল্লা একজন অর্থনীতির ইতিহাসবিদ। তিনি হাই স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের ইতিহাস এবং দর্শন পড়ানোর মনোবাঞ্ছা নিয়ে পাভিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু তাঁর নিজের প্রফেসর ফ্রাঙ্কো বরলান্ডি বুঝতে পারেন এই ছাত্রের অর্থনীতির ইতিহাস নিয়ে পড়ালেখার একেবারে আবেগপুর্ণ সদিচ্ছা আছে। প্রফেসর ফ্রাঙ্কো বরলান্ডি ছিলেন মধ্যযুগের অর্থনীতির পণ্ডিত। তাঁর প্ররোচনাতেই কার্লো চিপোল্লা শেষ পর্যন্ত লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সে পড়তে আসেন। ধীরে ধীরে চিপোল্লা ইতালির নানান শহরে পড়িয়ে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকায় আসেন এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে ক্যাম্পাসে ভিজিটিং প্রফেসর থেকে রীতিমতো ফুল প্রফেসর হয়ে যান। চিপোল্লার কিন্তু গবেষণা এবং লেখালেখি ছিল মধ্যযুগে গোল মরিচ নামের মশলাটি কীভাবে অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলেছিল তা নিয়ে। তিনি দেখান এই গোল মরিচ শুধু খাবারে মশলার কাজ করেনি, বরং একটি কামোদ্দীপক উপাদান হিসাবে কাজ ক'রে মধ্যযুগের জনসংখ্যা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল, একে বলা হয় আফ্রোদিজিয়াক ইফেক্ট অব ব্ল্যাক পেপার (Aphrodisiac effect of black pepper)  যা মধ্যযুগের অর্থনীতিতেও ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল।

কার্লো চিপোল্লা নিয়ে আমার উৎসাহের কারণ যদিও এটা না। তাঁর দ্বিতীয় প্রবন্ধটি খুবই কৌতূহলোদ্দীপক; প্রবন্ধের শিরোনাম-  দ্য বেইসিক ল'জ অব হিউম্যান স্টুপিডিটি  বা মানব মূঢ়তার মৌলিক নীতিমালা। সেই নীতিমালায় যাওয়ার আগে আগ্রহের কারণেই কার্লো চিপোল্লার নাম নিয়ে কৌতূহল হল। ইতালিয়ান ভাষা ইউরোপের রোমান্স ভাষার অন্তর্ভূক্ত। এই ভাষায় 'লা চিপোল্লা'  অর্থ হলো পিঁয়াজ। ব্যাপারটা ভাবতেই কেমন একটা মজার ইমাজারি বা দৃশ্যকল্প মাথায় আসে। ইতালির সংস্কৃতির মধ্যে ভাল রান্না করা, পারিবারিক পরিবেশে খাওয়া দাওয়া একটি অতি পরিচিত দৃশ্য। বাবা মা কি আদর করে সেই সংস্কৃতির ধারক পিঁয়াজ নাম রেখেছিলেন যিনি আবার বড় হয়ে মধ্যযুগে গোল মরিচের  কামোদ্দীপক প্রভাব নিয়ে লিখে খ্যাতিমান হয়েছিলেন? যা হোক, এইসব ধারণা মনে উদয় হলেও কার্লো চিপোল্লার দ্য বেইসিক ল'জ অব হিউম্যান স্টুপিডিটি  বা মানব মূঢ়তার মৌলিক নীতিমালাগুলো যথেষ্ঠ ভাবগাম্ভির্যের সঙ্গেই দেখি; চিপোল্লির মতে স্টুপিড বা মূঢ় লোকদের ক্ষতিকর দিক মানুষ খুব আন্ডার-এস্টিমেট বা অবমূল্যায়ন করে থাকে। মানুষ বোঝে না এরা মাফিয়াদের চেয়েও ভয়ঙ্কর (বলাই বাহুল্য ইতালিয় কেউ মাফিয়ার কথা বললে আমি বিশ্বাস করি কারণ, ওরাই পৃথিবীর সেরা মাফিয়াদের গডফাদার) এবং ভয়ঙ্কর সম্বনয়তার সঙ্গে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। চিপোল্লা বলেন মূঢ়তার পাঁচটি মূল সূত্র বা মৌলিক নীতি  আছে:

এক-  প্রতিবার এবং অবধারিতভাবে সবাই মূঢ়দের সংখ্যার প্রবাহকে অবমূল্যায়ন করে

দুই-  কোন একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তির মূঢ়তার সম্ভাবনা ঐ ব্যক্তির অন্যান্য বৈশিষ্ঠ্য নিরপেক্ষ বা অন্যান্য বৈশিষ্ঠ্যের ওপরে নির্ভরশীল নয়।

তিন-  মূঢ় ব্যক্তির মূঢ়তা অন্যদের ক্ষতির কারণ হয়, নিজে লাভবান হয় না এমনকি, নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

চার- বুদ্ধিমানেরা সবসময় মূঢ়দের ক্ষতিকারক ক্ষমতাকে অবমূল্যায়ন করে থাকে; বিশেষ করে, বুদ্ধিমানেরা সচারচর ভুলে যায় যে প্রতিটি ঘটনায়, প্রতিটি জায়গায়, যে কোন পরিস্থিতিতে    মূঢ়েদের সঙ্গে সংশ্রব বা লাগতে-যাওয়ার পরিনতি মূল্যবান খেসারত দেয়া।

পাঁচ- মূঢ় ব্যক্তি হলো সবচাইতে বিপদজনক ব্যক্তি

চিপোল্লা আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন, কোন ব্যক্তি যাকে এক সময় খুব যুক্তিপূর্ন এবং বুদ্ধিদীপ্ত মনে করবেন এক সময় দেখা যায় তিনিই নির্লজ্জ মূঢ়তম কাজটা করছেন। তৃতীয় সূত্রটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে চিপোল্লা মানুষ কে চারটি মৌলিক দলে ভাগ করেন; একদল হেল্পলেস বা সাহায্যশূন্য (এইচ) , অন্যদল ইনটেলিজেন্ট বা বুদ্ধিমান (আই) , আরেকদল স্টুপিড বা  মূঢ় (এস) আর অন্যদলটি বান্ডিত বা ডাকাত (বি)। নাম থেকে দলগুলোর বৈশিষ্ঠ বুঝতে পারা যায়। চিপোল্লা বলেন, বেশিরভাগ মানুষই ধারাবাহিকতার সঙ্গে আচরণ করে না। যেমন, বুদ্ধিমান কিছু পরিস্থিতে বুদ্ধিমানের মতো আচরণ করেন; কিন্তু অন্য সময়ে হয়তো হেলফলেসের মতো আচরণ করেন। কিন্তু মূঢ়দের বেলায় সকল সময়ে, সকল পরিস্থিতে তাঁরা মুর্খতার ধারাবাহিকতা রাখেন। বুদ্ধিমান কখনো কখনো মূঢ় হয়ে যান যতোই তাঁর বিদ্যার দৌড় বা ডিগ্রী থাকুক না কেন। ডাকাতেরা সুযোগ পেলেই ডাকাত কিন্তু অন্য আচরণও করতে পারেন।

আমি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মাইক্রো ইকোনমিক্স বা ব্যষ্টিক অর্থনীতি পড়তে গিয়ে নানান  গেইম থিওরি পড়েছিলাম যা আমাকে খুবই আকৃষ্ট করেছিল এবং সেগুলো কীভাবে স্বাস্থ্যখাতেও ব্যবহার করা যায় তা নিয়ে কাজ করেছি। যেমন, প্রিজনারস ডাইলেমা এবং মনোপলি, স্ট্যান্ডার্ড গ্যাম্বলিং ইত্যাদি। কার্লো চিপোল্লির এই –  দ্য বেইসিক ল'জ অব হিউম্যান স্টুপিডিটি  বা মানব মূর্খতার মৌলিক নীতিমালা করোনা ভাইরাস, কোভিড-১৯ বিশ্বমারীতে নতুন করে বিশ্লেষণ ও উপলব্ধির জন্ম দিয়েছে। মুঢ়দের দল যে শক্তশালী হতে পারে তা কিন্তু পৃথিবীর অন্যতম পরাশক্তি আমেরিকার নির্বাচনগুলোতে দেখা যায়। দেখা যায়  অন্যত্রও। কিন্তু কোভিড-১৯ নিয়ে নিদেনপক্ষে তিনজনের কথা বিশেষভাবে বলতে চাই-

প্রথমজন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্র্যাম্প। যে কেউ বলবেন আরে এই লোক তো প্রতিদিনই মূঢ়দের মতো কথা বলছেন। কিন্তু তিনি কি বুদ্ধিমান নন? যারা তাঁকে বুদ্ধিমান মনে করেন না আমি তাদেরকেই বোকা বলবো। তিনি বুদ্ধিমান বলেই আমেরিকার মূঢ়দের একত্রিত করে সবচেয়ে শক্তশালী রাজনীতিবিদ ক্লিনটন পরিবারকে হারিয়ে আজকে ক্ষমতায়। আমি বরং তাঁকে চিপোল্লার ডাকাত বা বান্ডিত ক্যাটেগরিতে ফেলবো। কিন্তু ডোনাল্ড ট্র্যাম্পও চিপোল্লার মুঢ়দের দলে যোগ দিয়েছেন। নিজে চিকিৎসক না, কিন্তু বিশেষ করে কোন রকমের বৈজ্ঞানিক প্রমাণ, নিরীক্ষা ছাড়া বলে দিলেন ম্যালেরিয়া, লুপাসের ওষুধ হাইড্রক্সি ক্লোরোকুইন এবং এযিথ্রোমাইসিন গেইম-চেঞ্জার চিকিৎসা কোভিড-১৯ এর জন্যে। এখন রোগীর মৃত্যু, নাইজেরিয়ায় হাইড্রক্সি ক্লোরোকুইন এবং এযিথ্রোমাইসিন গণহারে ব্যাবহারের ফলে ব্যাপকহারে বিষক্রিয়া দেখা দিয়েছে, এবং সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে এতে কাজ হবার চেয়ে ক্ষতিই বেশি হচ্ছে। কোভিট নিয়ে ডামাডোল শেষ হোলে ট্র্যাম্পের বিরুদ্ধে যে ক্লাস একশন ল'স্যুট বা সম্মিলিত মামলা হবে না এ নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। সম্প্রতি ব্লিচ বা ডিজইনফেক্ট্যান্ট বা বীজঘ্ন শরীরে ইনজেকশনের কথা বলে সেই স্টুপিডিকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে গেছেন। হ্যাঁ, এখানে ট্র্যাম্প সত্যিকার মূঢ়দের আচরণ করেছেন। যেহেতু তাঁর টাকা আছে, এটা মূঢ়তার খেসারত হয়তো টাকা দিয়ে হলেও দিতে হবে, প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে যাওয়ার পরও তা তাড়িয়ে বেড়াবে।

দ্বিতীয়জন আমেরিকান-বৃটিশ-সাউথ আফ্রিকান-ইজরাইলি নোবেল পুরস্কার পাওয়া জৈব পদার্থবিদ মাইকেল লেভিট যিনি রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান ২০১৩ সালে। সাউথ আফ্রিকায় জনম নিয়ে, বৃটেনে পড়ালেখা করে, ইসরাইলি স্ত্রী এবং সবশেষে আমেরিকায় প্রফেসরশীপ নিয়ে তিনি চারটি দেশের নাগরিক। যারা জানেন না, মলিউকিউলার বায়োলজি, ডিএনএ নিয়ে গবেষণার সঙ্গে কম্পিউটার যুক্ত করার প্রথম প্রযুক্তি তাঁর আবিষ্কার। তিনি যে কেমন মেধাবী এবং ক্ষুরধার বুদ্ধি রাখেন তা বুঝতে কারো বাকি থাকে না। তিনি মার্চের ১৬ তারিখে পত্রিকায় বললেন মানুষর প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি এবং সংক্রমণের সংখ্যা কমে আসছে। এই বিশ্বমহামারী শেষ হবার পথে। যে কেউ বুঝতে পারছেন তাঁর এই কথা ঠিক না। এখানে অবশ্যই বলা যায় তিনি বিজ্ঞানী এবং নানা বিষয় থেকে অনুমান করেছেন; যে কোন বৈজ্ঞানিক অনুমানের মতো সব সময় তা ঠিক হবে এমন তো কথা নেই। তা অবশ্যই বলা যায়। কিন্তু তিনি কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে নিজের বায়োলজিক্যাল মডেলের কথা বলেছেন যা আমার মতো সামান্য গণস্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞও বলতে পারবে একেবারেই অপ্রতুল এবং ভুল প্রেমিজ বা প্রতিজ্ঞায় ভরা। তাহলে তিনি যা করলেন, তাঁর ক্যালিবারের বুদ্ধিমত্তার তুলনায় মূঢ়তা, চিপোল্লির তত্ব অনুসারে।

তৃতীয়জন আমেরিকার রকেফেলার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন এপিডেমিওলজিস্ট ও বিভাগীয় প্রধান ডক্টর ভিটকাউস্কি। যিনি বলেছেন সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং এবং লকডাউনের ফলে লোকজন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে না এবং হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হচ্ছে না,  সুতরাং সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং এবং লকডাউনের ধারণা বাতিল করো। আমার ক্ষুদ্র এপিওডেমিওলজি জ্ঞান থেকে হার্ড ইমিউনিটি কী তা ব্যাখ্যা করিঃ

যখন কোন সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে, মহামারী হয়, তখন মানব শরীরের এন্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। এটা দু'ভাবে হতে পারে; এক, রোগ মানব দেহে সংক্রমিত হয় প্রাকৃতিক উপায়ে; অন্যটি হলো ভ্যাক্সিন দিয়ে কৃত্রিম উপায়ে এন্টিবড়ি তৈরি করা। আর যদি এই দুই উপায়ের সংমিশ্রণে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষের শরীরে এন্টিবডি তৈরি করা যায় তাহলে বাকিদের আর রোগ আক্রমণ করতে পারে না। এই যে বাকিদের সংক্রামক রোগ ধরতে পারছে না তাকেই বলে হার্ড ইমিউনিটি (খুব সাধারণভাবে বুঝালাম)। এই হার্ড  ইমিউনিটি কতভাগ মানুষের শরীরে এন্টিবডি তৈরি হবার পরে হয়? এটাও নানান বিষয়ের ওপরে নির্ভর করে। সাধারণত শতকরা ৭০-৯০ ভাগ লোকের শরীরের এন্টিবডি থাকলে বাকী শতকরা ১০-৩০ ভাগের আর সেই রোগটি হবে না।

এবার দেখি সার্স করোনা ভাইরাস-২ যা দিয়ে এই কোভিড রোগের বিশ্বমহামারী হচ্ছে তার ক্ষেত্রে অবস্থা কেমন। প্রথমত এই রোগের এখন পর্যন্ত কোন ভ্যাক্সিন নেই। যার অর্থ হলো কৃত্রিম উপায়ে মানব শরীরে এন্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধ তৈরি করা যাবে না। সুতরাং সবাইকে রোগটি হতে দিতে হবে, মানে সংক্রমিত হতে দিতে হবে। সবচেয়ে রক্ষণশীল বিচারেও এই সবাই হলো কমপক্ষে শতকরা ৬০-৮০ ভাগ মানুষের সংক্রমণ হ'তে দিতে হবে। সংক্রমণ হলেই কি সবার এন্টিবডি তৈরি হয়ে দীর্ঘ মেয়াদি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হবে? কভিদের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত কোন নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায় নি; এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে কোন কোন রোগীর দ্বিতীয় দফা সংক্রমণ হতে দেখা গেছে। তবু যুক্তির খাতিরে ধরে নিই একবার সংক্রমণের পরে এন্টিবডি তৈরি হবে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হবে। তারপরও আমাদের পরিসংখ্যান কী বলে? ধরা যাক, বাংলাদেশের কথা। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ১৬ কোটি ৪৩ লাখ ৮২ হাজার ৩৫০ জন মানুষ আছে ( ওয়ার্ল্ড মিটারের লাইভ তথ্যানুসারে)। হিসাবের সুবিধার জন্যে সাড়ে ষোল কোটি ধরলাম। সাড়ে ষোল কোটির শতকরা ৬০ ভাগও যদি ধরি (রক্ষণশীলভাবে কম ধরলাম) তাহলে লোক সংখ্যা হবে ৯ কোটি ৯০ লাখ। তাহলে ৯ কোটি ৯০ লাখ মানুষের করোনা সংক্রমণ হতে হবে। এখন পর্যন্ত গড়ে এই নভেল করোনার মৃত্যুর হার বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার মতে গড়ে ৩.৪%। এখানেও ধরলাম ৩%। তাহলে ২৯ লাখ সত্তর হাজার মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি নিতে হবে। এই হার্ড ইমিউনিটি নিয়ে যারা সুইডেন কিম্বা জার্মানির উদাহরণ টানছেন তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন যে সেখানে হার্ড ইমুনিনিটির জন্যে সংক্রমণ বন্ধ হয় নাই; কারণ, সেখানে মাত্র ১৫-২০ ভাগ মানুষ সংক্রমিত হয়েছে। সেখানে জনসংখ্যার কম ঘন বসতি, জীবন যাপনের মান উন্নত, পরিবেশ এবং পরিচ্ছন্নতা উন্নত, সর্বোপরি স্বাস্থ্য-চিকিৎসা ব্যাবস্থা অসাধারণ, এমন কি আমেরিকার চেয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থা বা হেলথ সিস্টেম উন্নত। তাই যারা এই দাবি করেন যে হার্ড ইমিউনিটি দিয়ে সুইডেন কিম্বা জার্মানি রক্ষা পেয়েছে তাঁরা সত্যের অপলাপ করছেন।

এখন প্রশ্ন আসে এই যে বিশ্বখ্যাত পণ্ডিত এঁরা কেন এমন মন্তব্য করছেন?  এখানে বলে রাখা ভাল যে কোন বৈজ্ঞানিক বা বিজ্ঞানভিত্তিক অনুমানেই কিছু অনিশ্চয়তা থাকে। তাই যে কারও অনুমান ভুল হতে পারে, বা ভুল না হলেও পুরোপুরি নাও ফলতে পারে। কিন্তু আমি যে হিসাব দিলাম তার মধ্যে অনিশ্চিয়তার সম্ভাবনা খুব কম যদি না  বিসিজির মতো কোন ভ্যাক্সিনের বা অন্য কোন বড় কারণের প্রভাবে রোগ প্রতিরক্ষা থাকে। তাই বাংলাদেশের মতো দেশে সবাইকে সংক্রমিত হতে দিলে কমপক্ষে ২৯ লাখ সত্তর হাজার মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি নিতে হবে। যদি শতকরা এক ভাগও সত্যি হয় তাহলেও প্রায় ১০ লাখ মানুষের জীবনের ঝুঁকি নিতে হবে। এটা কীভাবে ভাল বৈজ্ঞানিক বা বিজ্ঞান ভিত্তিক উপদেশ হলো? যদিও আরেকটি সম্ভাবনাকে আমলে নিতে হবে, তা হলো, অনেক সময় অর্থনৈতিক কারণে  দুর্ভিক্ষ বা অন্য কারণে বেশি মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকলে ট্রেড অফ চিন্তা করা যেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে এমন অবস্থা হয়েছে বলে মনে হয়না, যদিও প্রান্তিক মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে বা বাড়ছে দিনে দিনে।

এবার দেখি বিজ্ঞানের পেছনে কীভাবে রাজনীতি কাজ করে এবং বিজ্ঞানের বিষয়কে রাজনীতির হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হয়। যারা এই মুহূর্তে মানুষের মৃত্যুর পরও অর্থনীতি ঠিক রাখতে চায় তাঁরা অন্য ধরনের রাজনীতিবিদ। যেমন টেক্সাসের একজন রাজনীতিবিদ, লেঃ গভর্ণর ড্যান প্যাট্রিক বলেন বয়স্ক লোকদের স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করা উচিত দেশের অর্থনীতি বাঁচাতে। কথাটার অনেক গুরুত্ব আছে। এই জাতীয় রাজনীতিবিদেরা সত্যিকার অর্থেই বয়স্কদের জীবন বৃদ্ধি চায় না। কারণ, বয়স্করাই  স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং স্বল্প জীবন বাঁচাচ্ছে। এই বিষয়টা খোলাসা করি; আমরা যারা স্বাস্থ্যখাতের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ করি তার মধ্যে কস্ট-ইফেক্টিভনেস এবং কষ্ট-বেনেফিট এনালিসিস নামে দুটি পদ্ধতি আছে যেখানে জীবনের দীর্ঘতা বা লংজিভিটি আর মানুষের জীবনের দামও ডলার ভ্যালুতে ধরা হয়। হ্যাঁ, অবাক হবেন না। প্রতিটি দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক  ক্রয়ক্ষমতার ওপরে এই মূল্যমান নির্ধারিত হয়। সেখানে একজন শিশুর জীবন বাঁচানো, একজন সত্তর বছরের বৃদ্ধের জীবন বাঁচানোর চেয়ে অনেক বেশি সাশ্রয়ী (Cost-effective)। এইরকম ধারণা থেকেই এমন কথা বলা হয় যার নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। পৃথিবীতে এমন মানুষও আছে যারা মনে করেন প্রাকৃতিকভাবে যারা দুর্বল তাঁরা মরে যাক, মানুষের সবল গোষ্ঠী টিকে থাকবে। এখানে নিজের বিজ্ঞাপন দিতে চাই না, কিন্তু লীথী নামের একটি কল্পবিজ্ঞান উপন্যাসে লিখেছিলাম কীভাবে মানুষের মধ্যে এই আলট্রা সুপার, সুপার, আর মানুষ– এই তিনটি শ্রেণী তৈরি হয়ে যায়। মানুষ হলো দোষেগুনে ভরা, কিন্তু সুপার, আল্ট্রাসুপার একেবারে জিনেটিক্যালি খাঁটি, অতি বুদ্ধিমান, রোগমুক্ত ইত্যাদি। আজকে এইসব মানুষদের কথায় অবাক হবেন না, হিটলারও মনে করেছিল জার্মানরা খাঁটি নীল রক্তের মানুষ, শ্রেষ্ঠতম মানুষ যাদের অধিকার আছে দুনিয়াকে শাসন করার। আর সেই চিন্তার জোগান দিয়েছিল  আলফ্রেড রোজেনবার্গ যারা এমনকি দার্শনিক নীটশের ধারণাকেও ব্যবহার করতে কুণ্ঠিত হয়নি।

মোদ্দা কথা ফিরে আসি সেই চিপোল্লার মূঢ়তার তত্ত্বে। কিছু বিরাট প্রতিভাও মূঢ় আচরণ করেন, যখন যুক্তি এবং বিজ্ঞান মানবতা থেকে সরে গিয়ে  ক্ষমতার হাতিয়ার হয়, কিম্বা যুক্তি এবং বিজ্ঞান নিয়ন্ত্রিত হয় অন্য কিছু দিয়ে, যেমন অতীতে হয়েছে ধর্ম দিয়ে। যে কোন দিক থেকে হোক মূঢ়দের দল শক্তিশালী, সঙ্ঘবদ্ধ, এবং তারা ধারাবাহিকতার সঙ্গে আচরণ করে। এই কোভিট বিশ্বমারী তাই বিজ্ঞান শিক্ষার একটি মোক্ষম সুযোগ করে দিয়েছে। লক্ষ্য করুন সোশ্যাল মিডিয়ায় দু' রকমের প্রচারণা চলছে। একদল বলছে,

বিজ্ঞান লড়ে একা

মোল্লা, পুরুত, যাজক, র‍্যাবআই

তবু কথা বলে ব্যাঁকা।

শাঁখের করাত দুদিকেই কাটে

লোটে দুদিকের ফল

মানুষ একাই লড়েছে, জিতেছে

বাকি সব নিষ্ফল।

অন্যদিকে আরেকদল প্রচার চালাচ্ছেন এভাবে,

যদি ক্ষমা পাও  এবারের মতো,

কেটে যায় যদি ভয়াল দিন

জেনো বিজ্ঞান অসহায় হয়ে

প্রভুকে ডেকেছে অন্তহীন

বাস্তবতা কি? বিজ্ঞান এক মুহূর্তের জন্যেও থেকে থাকেনি, এক মুহূর্তের জন্যে কোন মন্দির, মসজিদ, প্যাগোডা বা গীর্জায় গিয়ে হাত পাতেনি। বরং নিরলসভাবে কাজ করছে রোগের গতিপ্রকৃতি বুঝতে, ওষুধ আবিষ্কার করতে, ভ্যাক্সিন বা প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে। বিজ্ঞান সবকিছু করছে যুক্তি দিয়ে, পরীক্ষা, নিরীক্ষা দিয়ে। হয়তো এই ভ্যাক্সিন বা ওষুধ আবিষ্কার হবে কোন বিধর্মীর হাতে, কোন নাস্তিকের হাতে বা কোন বিশ্বাসীর হাতে, তাতে বিজ্ঞানের কিছুই যায় আসে না। আসলে বিজ্ঞানকে যারা ধর্মের প্রতিপক্ষ বানাতে চেষ্টা করে বিজ্ঞানের সুফল শতভাগ নেয়ার পরও, তাঁরা আসলেও চিপোল্লার মূঢ়দের দলের মানুষ। এরা দলে ভারি, শক্তিশালী, সংঘবদ্ধ, ধারাবাহিকভাবে কাজ করে এবং ভয়ঙ্কর।

আমি অবশ্য জানি না, এই লেখাটি লিখে নিজে কী মূঢ়তার কাজ করলাম!!

সাধারণ তথ্যসূত্র

  1. The basic laws of human stupidity, by Carlo Cipolla, Publisher: Il Mulino, 2011
  2. Cipolla, Carlo M. Before the Industrial Revolution: European Society and Economy, 1000–1700. London: Methuen, 1976.
  3. Cost-effectiveness in Health and Medicine, Edited by Joanna E. Siegel, Oxford University Press, 1996.
  4. Science Policy, Ethics and Economic Methodology: by K. S Shrader-Frechette, Reidel Publishing Co. 1985.
  5. Cost-benefit analysis of difficult decisions, by Erik Schokkaert, Ethical Perspectives. Vol.2, 1995.