ছয় দফা: একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ

শামস্ রহমানশামস্ রহমান
Published : 3 Feb 2012, 01:44 PM
Updated : 6 Dec 2020, 12:35 PM

[ছয় দফা কর্মসূচির দুটি স্বতন্ত্র দিক রয়েছে। একটি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো সম্পর্কিত, অন্যটি অর্থনৈতিক। তবে, একটি অপরটির পরিপূরক। বঙ্গবন্ধুর এই কর্মসূচির লক্ষ্য ছিল 'এক দেশ, এক অর্থনীতি-ভিত্তিক' অর্থনৈতিক কাঠামোকে, 'দুই অর্থনীতি-ভিত্তিক' অর্থনৈতিক কাঠামোতে রূপ দেওয়া এবং পূর্ব বাংলার বাঙালির জন্য রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করা। ছয় দফার ভিত্তিতে 'দ্বি-অর্থনীতি থিসিসের' উত্থানে উপমহাদেশ দেখে 'দ্বি-জাতি তত্ত্বের' মৃত্যু]

ষাটের দশকের গোড়ার দিকে বঙ্গবন্ধু যখন তৎকালীন নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মণি সিং এবং খোকা রায়ের সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন, তখন তার ভাবনায় ছিল কেবল একটি ধারণা। আর তা হলো- পূর্ব বাংলার বাঙালির স্বাধীনতা। সেই বৈঠকে বঙ্গবন্ধু বলেন, "গণতন্ত্র-স্বায়ত্বশাসন এসব কোন কিছুই পাঞ্জাবিরা দেবে না। কাজেই স্বাধীনতা ছাড়া বাংলার মুক্তি নাই। স্বাধীনতাই আমার চূড়ান্ত লক্ষ্য" (সাপ্তাহিক একতা, ১৯ অগাস্ট, ১৯৮৮)।

১৯৬২ সনে আশারামবাড়ী হয়ে বঙ্গবন্ধুর আগরতলা যাওয়ার কারণও ছিল একই লক্ষ্য অর্জনে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক গ্রন্থে উল্লেখ  করা হয় যে "… the Awami League supremo Sheikh Mujibur Rahman arrived in Agartala to meet Sachindralal Singha, the chief minister of Tripura … and made it clear that "Bengalis could no longer live with honour and hope with Pakistan …" (Subir Bhaumik, The Agartala Doctrine, 2016, p. 13)।

পাকিস্তানের আধিপত্য থেকে বেড়িয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র অর্জন এবং অর্থনৈতিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি সমাজ প্রতিষ্ঠাই ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির প্রধান উদ্দেশ্য।

স্বাধীনতা যেমন একদিনে অর্জিত হয়নি, তেমনি স্বাধীনতা সংগ্রামের এ পথ কখনই মসৃণ ছিল না। সময়োপযোগী রাজনৈতিক কৌশল রচনা ও অবলম্বন এবং তার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে বাঙালি জাতিকে পৌঁছে দেন স্বাধীনতার লক্ষ্যে। ঐতিহাসিক ছয় দফা তেমনি এক কৌশল।

ছয় দফা কর্মসূচির দুটি স্বতন্ত্র দিক রয়েছে। একটি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো সম্পর্কিত, অন্যটি অর্থনৈতিক। তবে, একটি অপরটির পরিপূরক, যেখানে অর্থনৈতিক বিষয়টি ছিল ফোকাস, আর রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনই ছিল চূড়ান্ত লক্ষ্য।

ছয় দফা প্রবর্তনে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে লাহোরে পাকিস্তান সর্বদলীয় রাউন্ড টেবিল বৈঠকে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করেন। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের পিছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য যাই থাকুক না কেন, কৌশলগত দিক থেকে বঙ্গবন্ধু ছয় দফায় পূর্ব -পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝের অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণ এবং দুই প্রদেশের ফেডারেশনের মাঝে বৈষম্যের সমাধানের দিকটি প্রাধান্য দেন। একই ধারায় ছয় দফার উপর প্রথম যে প্রচারপত্রটি প্রকাশিত হয় তার শিরোনামও 'আমাদের বাঁচার দাবি: ৬-দফা কর্মসূচী'  (শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা, ২০১৭, পৃ ৩০৮-৩২০)। অনুরূপভাবে, তার কয়েক মাস পর [৭ই জুন ১৯৬৬] কারাগারে থাকাকালীন তিনি তার ডাইরিতে লিখেন – "তারা [পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ] ছয় দফা সমর্থন করে কারণ তারা মুক্তি চায়, বাঁচতে চায়, খেতে চায়, ব্যক্তি স্বাধীনতা চায়" (শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা, ২০১৭, পৃ , ৬৯)।

রাজনৈতিক স্বাধীনতার লক্ষ্যে স্থির থেকে, অর্থনৈতিক দিকটি সামনে নিয়ে আসা একটি কৌশল ছিল মাত্র। অবশ্যই বুঝতে হবে যে, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম তখনও পরিচালিত হচ্ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে। এবং বঙ্গবন্ধু ভাল করেই জানতেন, তার যে কোন একটি ভুল পদক্ষেপ পূর্ব বাংলার জনগণের বৈধ এবং ন্যায়সংগত আন্দোলনকে শাসকশ্রেণি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করবে।

ঠিক সেটাই ঘটলো। ছয় দফার অর্থনৈতিক দিকের প্রতি গুরুত্ব এবং তার  বিশদ ব্যাখ্যা দেওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো ছয় দফায় পূর্ব -পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝের বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্য নয়, শুধুই রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতাবাদীর গন্ধ পায়। যেমন, তদানিন্তন প্রেসিডেন্ট জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খান নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে মন্তব্য করেন যে, ছয় দফা ফর্মুলা একটি 'successionist move' যা তিনি প্রয়োজনে শক্ত হাতে প্রতিহত করবেন বলে শাসান। ১৯৬৬ সনের মার্চে, ঢাকায় নিজ রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ (কনভেনশন)'এর এক সভায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন– "if necessary the government of Pakistan would use the 'Language of Weapon' against those elements who would talk of the Six Point Programme" (Moudud Ahmed, Bangladesh: Constitutional Quest for Autonomy 1950-1971, p.87)।

আইয়ুব খানের মত জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানও মনে করেন – "Six Point Programme is nothing, but an unjust plan to divide the country" (Hasan Zaheer, The Separation of East Pakistan: The Rise and Realization of Bengali Muslim Nationalism, 1994,  p.127)। তখন জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিউপিলস্‌ পার্টি অব পাকিস্তান (পিপিপি) পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দল।  ভুট্টো আগাগোড়াই ভাবতেন যে ছয় দফা ভারতের কারসাজি। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে প্রকাশিত তার লেখা গ্রন্থে তিনি মন্তব্য করেন – "… the well and long planned conspiracy with India that came to light after 25th [March]" (Zulfikar Ali Bhuto, The Great Tragedy, 1971, p. 57)। নির্বাচনের পর ১৯৭১-এ আলোচনার সময়ও ভুট্টো বিশ্বাস করতেন যে- "the Awami League was moving in fact toward independence" (Salauddin Ahmed, Bangladesh – Past and Present, 2004, p.160)। এ বিষয়ে সালাউদ্দিন আহাম্মেদ তার এই গ্রন্থে একটি উল্লেখযোগ্য দিকের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি জানান – "in order to diffuse the appeal of the Six Point Programme, Bhutto wanted to influence Maulana Bhashani behind Mujib's back. He impressed upon the Maulana that the Six Point Programme had the backing of the American authorities in order to reduce the growing friendship between Pakistan and China"।

উল্লেখ্য যে, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তখন পিকিং-পন্থি (আজগের বেজিং-পন্থি) ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সভাপতি। ভুট্টোর কথায় মওলানা ভাসানী কতটুকু প্রভাবিত হয়েছিলেন তা আমাদের অজানা, তবে বঙ্গবন্ধু ২ জুন ১৯৬৬ সনে কারাগারে বসে লিখেন– "মওলানা ভাসানী সাহেবও ছয় দফার বিরুদ্ধে বলেছেন, কারণ দুই পাকিস্তান নাকি আলাদা হয়ে যাবে" (শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা, ২০১৭, পৃ ৫৭)। রংপুরের মশিয়ুর রহমান যাদু মিয়া তখন মওলানা ভাসানীর ডেপুটি। ছয় দফার উপর মন্তব্য করে তিনি বলেন – "ছয় দফা কর্মসূচী কার্যকর হইলে, পরিশেষে উহা সমস্ত দেশে এক বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব জাগাইয়া তুলিবে" (শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা, ২০১৭, পৃ ৫৭)। সেই সাথে আরও যোগ করেন যে, তিনি যদি প্রেসিডেন্ট হতেন তা হলে ছয় দফা বাস্তবায়িত হতে দিতেন না। যাদু মিয়ার এ বিবৃতি ফলাও করে  প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সনের ২ জুনে 'মর্নিং নিউজ' পত্রিকায়। দুঃখের বিষয়, যে ছয় দফা ভিত্তিক আন্দোলনের মাঝে ধাপে ধাপে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার দ্বার প্রান্তে পৌঁছা্য়, সেই  কর্মসূচি সম্পর্কে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের তথাকথিত প্রগতিবাদী কিছু দলের মনোভাব ও রাজনৈতিক অবস্থান আর পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন শ্রেণির মনোভাবের তেমন কোন তফাৎ ছিল না।

ভাসানী ন্যাপ ছাড়াও ছয় দফা পরিকল্পনার প্রতি অন্যান্য দলের মনোভাবও একই রকম ছিল। যেমন, জামায়াতে ইসলাম ছয় দফাকে 'বিচ্ছিন্নতাবাদীতার নকশা' হিসাবে চিহ্নিত করে; নিজাম-ই-ইসলাম এই পরিকল্পনাকে মুজিবের পক্ষে 'একতরফা, একনায়কতান্ত্রিক' পদক্ষেপ হিসাবে বাতিল করে এবং কাউন্সিল মুসলিম লীগ ছয় দফা দাবিকে ফেডারেশন নয়, 'কনফেডারেশনের' দাবি হিসেবে বর্ণনা করে (Raunak Jahan: Pakistan: Failure in National Integration, 1994, pp. 139-140)।

পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনেতিক, সেই সাথে কিছু সংখ্যক পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থান্বেষী রাজনীতিকদের ছয় দফা কর্মসূচির প্রতি বিরোধী প্রতিক্রিয়া বা বৈরি মনভাব শুধুই ছয় দফার বলিষ্ঠতাই প্রমাণ করে । বলাবাহুল্য, ঐতিহাসিক ছয় দফা একটি সুচিন্তিত ও সুনির্দিষ্ট দাবিমালা, যার মাঝে অন্তর্নিহিত ছিল পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, যা ছিল বাঙালি জাতির আত্ননিয়ন্ত্রণের পথে এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ।

ছয় দফা পরিকল্পনার রচয়িতা

কোথা থেকে এসেছে ছয় দফা? কে রচনা করেছে এই কর্মসূচি? এ ব্যাপারে অনেকে অনেক কথাই বলেন। তবে ঐতিহাসিক সত্যটি হলো – এটি বঙ্গবন্ধুর 'ব্রেইনচাইল্ড'। মূল দাবিগুলি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ফসল।  এই সত্য উদ্ঘাটনে বিষয়টি দুইভাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এক, মনস্তাত্ত্বিক বিবেচনায়; দুই, ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণে। প্রথমে মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা যাক।

প্রথম প্রকাশিত প্রচারপত্রে ছয় দফা কর্মসূচির (আমাদের বাঁচার দাবি: ৬-দফা কর্মসূচী) দাবিগুলি বঙ্গবন্ধু এক এক করে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করার সময় 'first-person' (প্রথম পুরুষ) ব্যবহার করেন। যেমন, তিনি, বলেন, "এই দফায় আমি প্রস্তাব করিতেছি যে ……" (শেখ মুজিবুর রহমান, আমাদের বাঁচার দাবি: ৬-দফা কর্মসূচী, পৃঃ ৬)। তিনি বলতে পারতেন – "পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রস্তাব করিতেছে যে …"। তা বলেননি। শুধু একবার নয়, তিনি প্রকাশিত প্রচারপত্রে বহুবার "আমি প্রস্তাব করিতেছি যে …" পুনরাবৃত্তি করেন। সেই সাথে, প্রচারপত্রের অনেক জায়গায় এই পরিকল্পনাকে তিনি "আমার ৬-দফা কর্মসূচি" হিসেবে উপস্থাপন করেন (শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা, ২০১৭, পৃঃ ৩১৮)। দাবিগুলি যে তারই রচনা, তা প্রমাণিত হয় তার প্রকাশের দৃঢ়তা থেকে। যদি অন্য কেউ রচনা করে থাকতো, কিংবা যদি কোন গোষ্ঠির সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল হত, যারা বঙ্গবন্ধুর স্বভাব-চরিত্রের সাথে পরিচিত, তারা নিশ্চয়ই একমত হবেন যে, তিনি অবশ্যই তাদের যথাযোগ্য সম্মান এবং অবদানের যথাযত স্বীকৃতি দিতেন। যখন কেউ কোন কিছু একান্ত নিজের বলে ধারণ করে, সে তখন তাকে আঁকড়ে থাকে। তার সাথে আপস করে কদাচিৎ। বঙ্গবন্ধু শেষ দিন পর্যন্ত ছয় দফার সাথে আপস করেননি।

এবার ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণে বিষয়টি মূল্যায়ন করা যাক।

চল্লিশ দশকের মাঝামাঝি সময়ে একজন তরুণ ছাত্র রাজনীতিক হিসাবেও বঙ্গবন্ধু অবিভক্ত ভারতের রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। ১৯৪৬ সালে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলির সাথে আলোচনার জন্য ব্রিটিশ সরকার ভারতে একটি প্রতিনিধি দল পাঠায় । উদ্দেশ্য, ভারতের স্বাধীনতার সমাধান খোঁজা। এই প্রতিনিধি দল 'ক্যাবিনেট মিশন' নামে পরিচিত। তারা ১৯৪৬ সালের ২৩ মার্চ ভারতে পৌঁছান। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্নজীবনী থেকে এটা স্পষ্ট যে তিনি ছাত্র রাজনীতিক হিসেবেও ভারত বিভাগে মিশনের প্রস্তাবগুলি জানতে ও বুঝতে আগ্রহ দেখান। তিনি লিখেন: "আমরা দলবল বেঁধে শহীদ [সোহরাওয়ার্দী] সাহেবের কাছে যেতাম, তাকে বিরক্ত করতাম, জিজ্ঞেস করতাম, কি হবে?" (শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্নজীবনী, ২০১২, পৃঃ ৪৯)। সেই সময়, ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে সাংবিধানিক সমস্যা সমাধানে ও ভারতীয় ঐক্য বজায় রাখার জন্য কেন্দ্রীয় ও রাষ্ট্র সরকারের মধ্যে মিশনের ক্ষমতা বণ্টনের প্রস্তাব সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু অবগত হন। এই প্রস্তাব কেন্দ্রিয় সরকারের হাতে পররাষ্ট্রীয়, প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগ – এই তিনটি বিষয় ন্যাস্ত করে। মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেস উভয়ই মিশনের প্রস্তাবগুলি মেনে নেয়। ছয় দফার প্রসঙ্গ টেনে বঙ্গবন্ধু যুক্তি দেন যে: "ইহা হইতে এটাই নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হইয়াছে যে, ব্রিটিশ সরকার, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সকলের মত এই যে, এই তিনটি মাত্র বিষয় কেন্দ্রের হাতে থাকিলেই কেন্দ্রীয় সরকার চলিতে পারে" (শেখ মজিবুর রহমান,  কারাগারের রোজনামচা, পৃঃ ৩১১)।

তার বেশ কয়েক বছর পর, ১৯৫৪ সনে, অনুরূপ একটি প্রস্তাব যুক্তফ্রন্টের ২১-দফা ইশতেহারের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়, যে ইশতেহার গঠনে দলের সাধারণ সপাদক হিসেবে বঙ্গবন্ধু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পররাষ্ট্রীয়, প্রতিরক্ষা এবং মুদ্রা (কেবিনেট মিশনের 'যোগাযোগ' বিষয়ের পরিবর্তে 'মুদ্রা') – এই তিনটি বিষয় কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ার ভুক্ত হবে বলে ইশতেহারে প্রস্তাব করে। শুধু 'মুদ্রা' বিষয়টিকে বাদ দিয়ে অনুরূপ একটি দাবি বঙ্গবন্ধু তার ছয় দফার অংশ  হিসেবে (দফা নং ২)  অন্তর্ভুক্ত করেন। কেবিনেট মিশনের প্রস্তাবে 'মুদ্রা' অথবা 'কর ও রাজস্ব' – এর কোনটাই কেন্দ্রিয় সরকারের হাতে ন্যস্ত করা হয়নি। বঙ্গবন্ধু যুক্তি দেন যে, যদি মুসলিম লীগ কেবিনেট মিশনের প্রস্তাব মেনে নিতে পারে, তাহলে, বর্তমান মুসলিম লীগ-ভিত্তিক সরকারের [আইয়ুব সরকার] কাছে তার দাবি কেন অগ্রহণযোগ্য হবে? 'মুদ্রা' এবং 'কর ও রাজস্ব' ধার্য ও সংগ্রহ – এই বিষয়গুলি ছয় দফা কর্মসূচির যথাক্রমে দফা নং৩ এবং দফা নং ৪ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য মিলিশিয়া বা প্যারা-মিলিটারি ফোর্স গঠনের বিষয়টি অযৌক্তিক বা নতুন নয়। এ বিষয়টি ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ২১-দফা ইশতেহারের একটি মৌলিক দাবি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল।  শুধু তাই নয়, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম মেনিফেস্টোতেও এর উল্লেখ আছে। রশিদুজ্জামান Asian  Survey'তে এক নিবন্ধে [M. Rashiduzzaman, The Awami League in the Political Development of Pakistan, Asian Survey, Jul., 1970, vol. 10, no. 7, p. 581] উল্লেখ করেন – "the first manifesto of the Awami League clearly stated that it stood for 'the right of self-determination of the regional units', and had also demanded that East Pakistan should have its own defense forces" (শামসুল হক, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলীম লীগ খসড়া ইস্তাহার, পৃ ১৩, ১৭)।

এখানেই শেষ নয়। ১৯৫৭ সালের কথা। বঙ্গবন্ধু তখন পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের সদস্য এবং  মন্ত্রি। ৩ এপ্রিল, ১৯৫৭ পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্তশাসন সহ অর্থনৈতিক বিষয়াদীর দাবি তোলেন। স্পিকারকে উদ্দেশ্য করে বলেন – "স্বায়ত্তশাসনের দাবি আমাদের বাঁচামরার দাবি। প্রদেশের বিক্রয় করের টাকা আমরা পুরাপুরি পাই না। অর্থের অভাবে উন্নয়ন কাজ করা যায় না। বৈদেশিক মুদ্রার পুরা অংশ আমরা পাই না। অবস্থা হচ্ছে- 'আপন ধন পরকে দিয়ে / দৈবজ্ঞ মরে কাঁথা বয়ে'।" (পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ, ১৯৫৭)।

সুতরাং, এটা পরিষ্কার যে, ছয় দফা রাতারাতি তৈরি হয়নি। এ কর্মসূচি দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতার ফলাফল। প্রশ্ন হচ্ছে কার অভিজ্ঞতা? ১৯৪৬ থেকে ১৯৬৬ সাল – এই কুড়ি বছর বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং সাংবিধানিক সংকট প্রত্যক্ষ করেন; আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বৈষম্যে সাধারণ জনগণের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের কৌশল নিরূপণ করেন; ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকে ঘাত-প্রতিঘাতে বাস্তবতার নিরিখে সমাধান খোঁজেন। ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচির উদ্ভাবন তার সেই অভিজ্ঞতারই ফসল।

ছয় দফা কর্মসূচি- জনগণের গ্রহণযোগ্যতা

পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ছয় দফা পরিকল্পনাকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানায়। ৭ জুনের [১৯৬৬] স্বতস্ফূর্ত হরতালই এর প্রমাণ। বঙ্গবন্ধু বলেন, "আমার প্রস্তাবিত ৬-দফা দাবীতে যে  পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে পাঁচ কোটি শোষিত-বঞ্চিত আদম সন্তানের অন্তরের কথাই প্রতিধবনিত হইয়াছে, তাতে আমার কোন সন্দেহ নাই" (শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা, ২০১৭, পৃ ৩০৯)।

তিনি আরও বলেন- "ছয় দফা যে পূর্ব বাংলার জনগণের প্রাণের দাবি পশ্চিমা উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল পশ্চিম পাকিস্তানের শোষকশ্রেণি যে আর পূর্ব বাংলার নির্যাতিত গরীব জনসাধারণকে শোষণ বেশি দিন করতে পারবেনা, সে কথা আমি এবার জেলে এসেই বুঝতে পেরেছি" (শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা, পৃ ৭৩) –  আর এই আত্মবিশ্বাসের কারণে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের শেষ দিন পর্যন্ত ছয় দফা কর্মসূচীর সাথে আপস করেননি। তিনি ছয় দফার উপস্থাপনের সময় (১৯৬৬ সন) বলেন- "ছয় দফাই হলো নিম্নতম কর্মসূচি। কোন আপস নাই।" (শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা, পৃ ১৩৩) । এমনকি ভুট্টোও উপলব্ধি করেন বঙ্গবন্ধু কখনো ছয় দফার সাথে আপস করবেন না। ভুট্টো বলেন – "Sheikh Mujibur Rahman took the position that the Six Point formula [have become] 'the property of the people of Bangla Desh' and there could be no question of compromise on it" (Zulfikar Ali Bhuto, The Great Tragedy, 1971, p. 18) । ছয় দফায় মুজিবুর রহমানের বাণী ছিল 'Parity, not charity', মন্তব্য করেন বিশিষ্ট বামপন্থি তাত্ত্বিক নেতা ও কর্মী তারিক আলী (Tariq Ali, Can Pakistan Survive? The Death of State, Great Britain 1983, p. 80)।

এরপর আসে ১৯৭০–এর সাধারণ নির্বাচন। নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের পর, ৩ জানুয়ারী ১৯৭১ নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের ছয় দফার উপর শপথ গ্রহণ করান এই বলে যে, "… they would never betray the masses who had entrusted them to realize the six-point program" (Nurul Islam, Making of a Nation – Bangladesh, an Economist's Tale, 2005, p. 96)।

বঙ্গবন্ধু জানতেন, আপস নিরর্থক; দীর্ঘ সংগ্রামে জাগ্রত জনগণের স্বাধীনতার বোধটিই কেবল হারিয়ে যাবে।

ছয় দফা কর্মসূচির বিশ্লেষণ   

আগেই উল্লেখ করেছি যে ছয় দফা কর্মসূচীর দুটি দিক – একটি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো সম্পর্কিত, অন্যটি অর্থনৈতিক। প্রথম দুই দফা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাঠামো বিষয়ক; বাকি চার দফা অর্থনৈতিক বিষয়ক।

শাসন ​​ও দায়িত্বের পলিটিকো-প্রশাসনিক কাঠামো

ছয় দফা কর্মসূচির প্রথম দুই বিষয় হচ্ছে: পাকিস্তান একটি সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় ফেডারেশন হিসেবে গঠিত হবে। ফেডারেল সরকারের এখতিয়ারে কেবল প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রীয় বিষয় থাকবে এবং অবশিষ্ট সমস্ত বিষয় প্রদেশগুলির হাতে থাকবে।

জেনারেল আইয়ুব খান প্রবর্তিত 'বেসিক গণতন্ত্র (Basic Democracy)' পদ্ধতির স্থলে প্রাপ্তবয়স্কদের সরাসরি ভোটে সংসদীয় সরকার গঠনই প্রথম দফার উদ্দেশ্য। ১৯৫৮ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায়  এসে আইয়ুব খান 'বেসিক গণতন্ত্র' নামে এক নির্বাচনী পদ্ধতি চালু করেন যা মূলত একটি 'top-down' মডেল। পদ্ধতিটি পাকিস্তানের মিলিটারি ও তার প্রধান কর্তৃক রচিত এবং স্থানীয় আমলাতন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। মজার ব্যাপার– পদ্ধতিটি না 'বেসিক', না 'গণতান্ত্রিক'। কোন সন্দেহ নেই এটা গণতান্ত্রিক নীতিমালা বহির্ভুত এক পদ্ধতি । গবেষকদের মতে "The whole system was very strongly associated with corruption and it greatly strengthened the power of the oppressive landlords in the country-side" (Hamza Alavi, 'The  state in crisis', H. Gardezi & J. Rashid (Eds), Pakistan: The roots of dictatorship: The political economy of a praetorian state,1983, p.85)। পলের মতে, "Ayub Khan's 'Basic Democracy' system was a cunning model designed to legitimize military control while at the same time providing the illusion of public participation" (T. V. Paul, The warrior state: Pakistan in the contemporary world , 2014, p.253)। 'বেসিক গণতন্ত্র' পদ্ধতিতে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ব্যবস্থারও গন্ধ মেলে।  ফারা ইয়ান বলেন – "Ayub kept the Army in the barracks and ruled through the civil services, structurally homogeneous to the British viceroy during the colonial era" (Farah Jan, Pakistan: A struggling nation-state, Democracy, and Security, V.6. No. 3, 2010, p। 241).

বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সামরিক-নিয়ন্ত্রিত কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার স্থলে ওয়েস্টমিন্সটার স্টাইলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা স্থাপন করা। দেশে যে গণতন্ত্র ছিল না, আর মিলিটারির ছত্রছায়ায় যে গণতন্ত্র, তা যে প্রকৃত গণতন্ত্র নয়, এই সত্য উপলব্ধি করতে পাকিস্তানের বৃহত্তর সমাজ এবং সামরিক শাসকদের আরও প্রায় অর্ধ শতাব্দী লেগে যায়। এক কালের শক্তিশালী সামরিক জান্তা এবং পাকিস্তানের প্রসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফ তার In the Line of Fire: A Memoir'তে বলেন- '[a] brief political history of Pakistan shows how we have failed to create a true democracy'(Pervez Musharraf, In the Line of Fire: A Memoir, London 2006, p.156)।

ফেডারেশন গঠন এবং তার অধীনস্ত কী কী বিষয় থাকবে তা ওঠে আসে ২ নং দফায়। ফেডারেশনের কন্সেপ্ট নতুন কিছু নয়। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের নিরিখে বিভিন্ন দেশেই এই ব্যবস্থা চালু হয়েছে। ফেডারেশন হিসেবে গঠিত এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত দেশের উদাহরণ কেবল যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া অথবা জার্মানি নয়, বাংলাদেশের পাশের দেশ ভারতও।

ইতিহাস  পর্যালোচনায় দেখা যায়,  বৃটিশ ভারতে ফেডারেশনের দাবি মুসলিম লীগই প্রথম তোলে। সে ১৯২১ সালের কথা। তখন মওলানা হযরত মোহানী অবিভক্ত ভারতের মুসলিম লীগের সভাপতি। ১৪তম সর্ব ভারতীয় মুসলিম লীগ সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে তিনি বলেন – "Gentlemen! from the Muslim point of view, it is not enough that we should stand for complete independence alone. It is necessary to decide upon the form that it should take; and in my opinion it can only be an Indian Republic or on the lines of a United States of India (Presidential Address at the 14th Annual Session of the AIML Ahmedabad, 30 December 1921)। তিনি আরও বলেন – 'The fear of Hindu majority can be removed, if an Indian Republic can be established on federal basis similar to that of United States of America' (শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা, ২০১৭, পৃ ১৪১)। তারপর ১৯২৯ সালে দিল্লীতে অল ইন্ডিয়া মুসলিম কনফান্সে একই দাবি উঠে। সে সম্মেলনে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দাবি করেন – ' ….  no constitution for the future government of India will be acceptable to Muslims until and unless it is based on federal principles with residuary powers vested in the province' (Reddy, Krishna, Indian History, p. c218, 2011)। এক কথায়, ফেডারেল শাসনতন্ত্রই ছিল ভারতের মুসলমানদের একমাত্র দাবি, যেখানে প্রদেশগুলি পেত পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন।

মজার ব্যাপার, বৃটিশ ভারতে মুসলমানরা সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম লীগ ভারতের মুসলমানদের জন্য ফেডারেল শাসনতন্ত্রের দাবি করে, আর, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের পক্ষ থেকে ফেডারেলিজমের দাবি তোলেন। বৃটিশ ভারতে মুসলিম লীগের যে দাবি যুক্তি সংগত ছিল, আওয়ামী লীগের সেই একই দাবি পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগের কাছে বিচ্ছিন্নতাবাদীর দাবি বলে বিবেচিত হয়।

কেবিনেট মিশনের উদ্ধৃতি দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন যে কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব ও ক্ষমতা সীমিত মানে একটি দুর্বল পাকিস্তান নয়। বরং এর মাঝ রাষ্ট্র প্রদেশকে কার্যকর ও শক্তিশালী হয়ে গড়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি করবে। বঙ্গবন্ধু পুনরুক্তি করেন যে "… "… what makes a Federation strong is not heaps of subjects under it [Central government]. A Federation becomes strong by loyalty and affection …. The happy and strong people represented through efficient and strong units [provinces] that make the Federation are the real source of its strength …" (Sheikh Mujibur Rahman, Prison Diaries, Dhaka 2018, p. 328-329)।

তবে, পাকিস্তান সরকার এবং শাসকশ্রেণি দেখে ভিন্নভাবে। তাদের বিবেচনায় কেন্দ্রিয় সরকারের হাতে শুধু দুটি বিষয় (প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক বিষয়) থাকা মানে একটি দুর্বল কেন্দ্রিয় সরকারে পরিণত হওয়া। আর, দুর্বল কেন্দ্রিয় সরকার মানে, দুর্বল পাকিস্তান। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ড. হুদা স্পষ্ট করেই বলেন যে: "This program [six-point plan] really aims at setting up a weak national government, which means a weak Pakistan" (Pakistan Observer, 24 June 1966)। আসলে, ছয় দফা দাবি উন্মোচিত করে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর আসল অভিপ্রায়। তারা চেয়েছে একটি 'শক্তিশালী কেন্দ্রিয় সরকার', 'শক্তিশালী পাকিস্তান' নয়।

কেন্দ্রিয় সরকারের ভূমিকা সীমিত করা যে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণেরও সার্থে, বঙ্গবন্ধু সে বিষয়টির উপরও গুরুত্ব দেন। তিনি উল্লেখ করেনঃ " …. আমাদের মতো দরিদ্র পশ্চিম পাকিস্তানেও অনেক আছেন। আমার ৬-দফা কর্মসূচীতে পশ্চিম পাকিস্তানীদের দাবীও সমভাবে রহিয়াছে। এ দাবী স্বীকৃত হইলে পশ্চিম পাকিস্তানীরাও সমভাবে উপকৃত হইবে" (শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা, ২০১৭, পৃ ৩১৮)।  এখানে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে 'anti-thesis' তত্ত্বের মাঝে 'unity in diversity' ধারণাকে সামনে নিয়ে আসেন।

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের শাসক শ্রেণিকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, "ছয় দফা জনগণের দাবি। পূর্ব পাকিস্তানের বাঁচা মরার দাবি। এটাকে জোর করে দাবান যাবে না। দেশের অমঙ্গল হবে একে চাপা দেবার চেষ্টা করলে। …… আমাদের শাসকগোষ্ঠীও ভুল করতে চলেছেন। যখন ভুল বুঝবে তখন আর সময় থাকবে না" (শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা, ২০১৭ পৃ ১৪২)।

বঙ্গবন্ধুর সেদিনের সেই ভবিষ্যৎবাণী বাস্তবে রূপ নিতে সময় লাগে মাত্র পাঁচ বছর।

অর্থনৈতিক মূল্যায়ন – এক অর্থনীতি থেকে দু অর্থনীতিতে

ছয় দফার দ্বিতীয় দিক অর্থনৈতিক। দফা নং ৩, ৪, ৫, এবং ৬ এই বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত। সংক্ষেপে, এই দফাগুলি হলো:

প্রতিটি প্রদেশের জন্য পৃথক, তবে অবাধে রূপান্তরযোগ্য মুদ্রা থাকবে। অথবা, যদি একক মুদ্রা ব্যবহার করা হয়, সেক্ষেত্রে এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে মুদ্রা হস্তান্তর রোধ করার উপায় থাকতে হবে (দফা নং ৩);

রাজস্বের দায়িত্ব প্রদেশের হাতে থাকবে (দফা নং ৪);

প্রতিটি প্রদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের জন্য পৃথক অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে (দফা নং ৫), এবং;

প্রতিটি প্রদেশকে মিলিশিয়া বজায় রাখার অনুমতি দেওয়া হবে ((দফা নং ৬)।

দফা নং ৬ মিলিশিয়া ও প্যারা-মিলিটারি সম্পর্কিত। অর্থনীতির সাথে সরাসরি জড়িত নয়। তবে, প্রতিরক্ষা এবং প্রতিরক্ষা অবকাঠামো উন্নয়ন খাতের ব্যয়ের (যা non-development expenditure বলে ধরা হয়) multiplier effect -এর কারণে অর্থনীতির উপর পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলে। সে কারণে এই বিশ্লেষণে দফা নং ৬'কে অর্থনৈতিক বিষয় হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়।

ছয় দফা কর্মসূচির অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য অনুধাবনের জন্য, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণের বিশ্লেষণ এবং শোষণের ফলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে যে অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি হয় তা বোঝা বিশেষ প্রয়োজন।

১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক অর্থনৈতিক সহায়তা পায়, যা মূলত পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হয়। ফলে, সেখানে ব্যাপক শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সাধিত হয়। এই উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে মূলত সামঞ্জস্যহীনভাবে আর্থিক বরাদ্দের কারণে। পরিসংখ্যানেই তা বোঝা যাক।

১৯৫০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানে উন্নয়ন ও রাজস্ব, উভয় খাতেই ব্যয় পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয়ের চেয়ে শতকরা ৬০ শতাংশ বেশী (Planning Commission, Government of Pakistan, Report of the Advisory Panel for The Fourth Five Year Plan, Islamabad, July 1970)। ফলে, দুই প্রদেশের প্রবৃদ্ধি ভারসাম্যহীন ভাবে বৃদ্ধি পায়, আর যার প্রভাব পড়ে মাথাপিছু আয়ের বৈষম্য সৃষ্টিতে। যেমন, ১৯৫৯-৬০ থেকে ১৯৬৯-৭০- এই দশ বছরে পশ্চিম পাকিস্তানে মাথাপিছু আয় যেখানে বাড়ে শতকরা ৪২ শতাংশ, সেখানে, পূর্ব পাকিস্তানে বাড়ে মাত্র শতকরা ১৭ শতাংশ। ১৯৫৯-৬০'এ পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় শতকরা ৩২ শতাংশ বেশি, যা বেড়ে ১৯৬৯-৭০'এ এসে দাঁড়ায় শতকরা ৬১ শতাংশে (Planning Commission, Government of Pakistan, Report of the Advisory Panel for The Fourth Five Year Plan, Islamabad, July 1970)।

অন্যান্য সূচক, যেমন নিত্য প্রয়োজনীয় মাথাপিছু খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং বাসস্থানের সুবিধা, এ সবে পূর্ব-পশ্চিমের মাঝে যে বৈষম্যের সৃষ্টি হয় তা আরও শোচনীয়। যেখানে ১৯৬৪/৬৫ থেকে ১৯৬৮/৬৯ – এই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানে মাথাপিছু খাদ্যশস্যের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পায় শতকরা ৮.৭ শতাংশ, সেখানে পূর্ব পাকিস্তানে তা হ্রাস পায় শতকরা ৩.১ শতাংশ (Griffin Keith and Azizur Rahman Khan (eds), Growth and Inequality in Pakistan, UK 1972)। সেই সাথে, পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে এক বিশাল পরিমাণ সম্পদ পূর্ব থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে ট্রান্সফার হয়, যার পরিমান ৩১ বিলিয়ন রুপি বা ২.৬ বিলিয়ন ডলারের অধিক (Zillur Rahman Khan, 'March movement of Bangladesh: Bengali struggle for political power', The Indian Journal of Political Science, vol. 33, no. 3, 1972)।

পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝে বৈষম্য়ের সৃষ্টি মোটেই অসচেতন ভাবে প্রয়োগিত উন্নয়ন-কৌশলের ফলাফল নয়। নিছক তাদের স্বার্থেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সচেতনভাবেই সৃষ্টি করে এই বৈষম্য। অর্থনীতিবিদদের মতে, "the growth of inequality in Pakistan was not the unintended or unconscious by-product of Pakistan's development strategy, [rather] Pakistan's policymakers actively pursued policies which promoted inequality" (Nurul Islam, 'Foreign Assistance and Economic Development: The Case of Pakistan', The Economic Journal, March,1972, p.519)। ফলে, পশ্চিম পাকিস্তানের নীতিনির্ধারক, এমন কি নাগরিক সমাজ, কেউই এই বৈষম্যকে সেদিন স্বীকার করেনি। উল্টো, ছয় দফা কর্মসূচিকে একটি 'dangerous agenda' হিসেবে আখ্যায়িত করে। অবশ্য সম্প্রতি তাদের মন মানসিকতার কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। শোষণ আর বৈষম্যের চিত্রকে  ধীরে ধীরে স্বীকৃতি দিচ্ছে। পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জেনারেল মোশাররফ বলেন – "The main themes of the discontent were economic disparities between eastern and western Pakistan, the concentration of wealth in twenty-two families, an acute sense of deprivation and alienation in East Pakistan, and a general political suffocation of the public" (Pervez Musharraf, In the Line of Fire: A Memoir, London 2006, p. 157)। বিষয়টি খুব সহজ ভাষায় সম্প্রতি পাকিস্তানের এক কলামিস্ট শাকির লাখানি লিখেন – "The people of that province [East Pakistan] were as good of Pakistanis as we in West Pakistan were, yet to our eternal shame, they were denied what was rightfully theirs" (Shakir Lakhani, ''Udhar tum, idhar hum': When Bhutto pushed Bangladesh to the edge of Pakistan', The Express Tribune, December 17, 2018).

সন্দেহ নেই যে, পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে সামঞ্জস্যহীনভাবে আর্থিক বরাদ্দের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক ক্ষমতার বৈষম্যের কারণে ঘটে। তবে, তারা তাদের সিদ্ধান্তের পক্ষে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারের বিষয়টা অস্বীকার করে, দাঁড় করান অর্থনৈতিক যুক্তি। তাদের যুক্তি- বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত সেখানেই হবে, যেখানে জাতীয় মোট আয় বৃদ্ধি পাবে বেশি। বলাবাহুল্য, ক্লাসিক্যাল অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি অকাট্য যুক্তি!  তবে এখানে ধরে নেওয়া হচ্ছে যে, পাকিস্তান একটি একক অর্থনীতির দেশ। বাস্তবে মোটেই তা নয়। এক প্রদেশ অন্য প্রদেশ থেকে ষোল শ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে অবস্থিত। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই, পূর্ব পাকিস্তানি শ্রমের পশ্চিম পাকিস্তানের সম্প্রসারিত শ্রম বাজারে অংশ নেওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। এক কথায়, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী দেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে  'immobility of labour'এর তাতপর্য পুরপরি উপেক্ষা করে। উপেক্ষিত হয় পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে পণ্য পরিবহণের অধিকতর ব্যয়ের বিষয়টিও (Muhammad Waseem, Politics and the State in Pakistan (National Institute of Historical and Cultural Research, Centre of Excellence, Quaid-i-Azam University, Islamabad 1994)। সেই সাথে, দুই প্রদেশে দুটি পৃথক মজুরি কাঠামো গড়ে ওঠে। ফলে, পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝে  আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সমস্ত বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও, তা অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। ফলে, পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্বৃত্ত উৎপাদনের এক 'ক্যাপ্টিভ বাজারে' পরিণত হয় এবং তুলনামূলকভাবে কম দামে আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যাদি পাওয়া গেলেও তা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে চড়া দামে কিনতে হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে তৈরি পণ্য। অর্থনীতির এইসব দিকগুলি সামনে রেখেই রচিত হয়েছে অর্থনৈতিক বিষয়ক দফাগুলি যার বাস্তবায়নে পাকিস্তানের 'এক দেশ, এক অর্থনীতি'-ভিত্তিক অর্থনৈতিক কাঠামো রূপান্তরিত হত, 'দুই অর্থনীতি-ভিত্তিক' অর্থনৈতিক কাঠামোতে।

উপরে বর্ণিত বিরাজমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু তার ছয় দফা কর্মসূচি প্রস্তাব করেন। মজার ব্যাপার, পাকিস্তানের কেন্দ্রিয় সরকার থেকে শুরু করে প্রায় প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল এই কর্মসূচিকে 'বিচ্ছিন্নতাবাদী নকশা' হিসেবে চিহ্নিত করে এবং তার সমালোচনা ও বিরোধিতা করে। কিন্তু কেন করে, সে সম্পর্কে কেউ কখনো কোন বিশদ ব্যাখ্যা দেয়নি। প্রকৃতপক্ষে, ছয় দফার বিরোধিতা করার মত তাদের না ছিল রাজনৈতিক, না ছিল অর্থনৈতিক ভিত্তি। পাকিস্তানের ভৌগলিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ছয় দফার ভিত্তিতে আত্মপ্রকাশ করে 'দ্বি-অর্থনীতি থিসিস'। বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ন্যায্য পাওনা আদায়ের একমাত্র উপায় কেন্দ্রিয় সরকারের দায়িত্ব ও ক্ষমতা সীমিত করা। সুতরাং, প্রথমত, ছয় দফা কর্মসূচি অকাট্য যুক্তিতে এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক একচেটিয়া আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে। দ্বিতীয়ত, পূর্ব পাকিস্তানের রপ্তানি আয় পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ভবিষ্যতে যাতে ব্যবহৃত হতে না পারে তার পদ্ধতিগত বাঁধা নিশ্চিত করে। তৃতীয়ত, বৈদেশিক সাহায্য যাতে একচেটিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পদ হতে না পারে তার ব্যবস্থা প্রণয়ন করে। চতুর্থ, ভবিষ্যতে, পূর্ব পাকিস্তান যেন পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্বৃত্ত শিল্পজাত দ্রব্যের 'ক্যাপ্টিভ বাজারে পরিণত না হয়, তা নিশ্চিত করে। এক কথায়, প্রথমত, ছয় দফা কর্মসূচী বাস্তবায়নের মাধ্যমে 'এক দেশ, এক অর্থনীতি-ভিত্তিক অর্থনৈতিক' কাঠামোকে 'দুই অর্থনীতি-ভিত্তিক অর্থনৈতিক' কাঠামোতে রূপান্তরিত করা; এবং দ্বিতীয়ত, পূর্ব বাংলার বাঙালির জন্য চূড়ান্ত রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করা।

বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে 'দ্বি-অর্থনীতি থিসিসের' উত্থানে উপমহাদেশ দেখে 'দ্বি-জাতি তত্ত্বের' মৃত্যু।