কোটা ব্যবস্থা ও আমাদের দেশ

প্লানার সুজন
Published : 3 July 2012, 07:17 AM
Updated : 3 July 2012, 07:17 AM

কোটা ব্যবস্থা! কোটা শব্দটি ইংলিশ শব্দ যার বাংলা অর্থ হল অংশ। খুব হাস্যকর একটি কথা বলে ফেললাম। অনেকে ইতিমধ্যে হেঁসে ফেলেছেন নিশ্চয়। কিন্তু আমি খুব গম্ভীর ভাবেই বিষয়টি বলছি। আমাদের দেশের অনেক সাধারণ সরকারী চাকুরী প্রার্থীর কাছে শব্দটা অনেকটা গলার কাঁটার মতো। যেটা গলা দিয়ে নামতে ও চায় না আবার বের হতেও চায় না, শুধুই পীড়া দেয়। আমার মনেহয় অনেকে ইতিমধ্যে ভেবেই বসেছেন আমি কোটার ঘোর বিরোধী কেউ। তবে আসুন না আমি যে ভাবে চিন্তা করি সে ভাবে না হয় আপনি কিছু সময় চিন্তা করবেন। হতে পারে আমার পুরো ধারনাটাই ভুল। তবে শুধরে দেবার জন্য না হয় কিছুটা সময় আমার সাথে থাকুন।আর বেশি ভূমিকা দিব না, এবার আসি আসল কথায়।

একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি, আপনার কাছে দুটি লোক সাহায্য চাইতে এসেছে। এদের দুজনকে আপনি সাহায্য করতে চান। একজনের তুলনায় অন্যজনের অবস্থা খারাপ। তখন আপনি সাহায্য করতে গিয়ে যার অবস্থা খারাপ তাকে করুনার বসে একটু বেশিই সাহায্য দিলেন। এতে করে একজন হল খুশি, একজন হলেন নারাজ আর আপনি হলেন বিব্রত। যদি এটি না করে সমভাবে চিন্তা করতেন তবে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো কি? কারণ দুজনের চাহিদায় হয়তোবা সমান ছিল। তাহলে আমার প্রশ্ন তবে কি আমার দেশ কোটাভূক্তদের করুনা করছে, আর দেশকে করছে বিব্রত? যেখানে আমাদের সকলের চাহিদা প্রায় সমান।প্রশ্নটা থাকলো সবার কাছে? এই যদি হয় আমাদের নৈতিকতা, তবে কি সেটা ভাল কিংবা সন্মানজনক আমার-আপনার কাছে?

আমাদের দেশের সর্বোচ্চ সন্মানিত চাকুরী হল বিসিএস ক্যাডারের চাকুরী (অনেকের মতে)। সেখানে সাধারণ প্রার্থীদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ৪৪% আসন আর বাকি ৫৬% আসন রয়েছে কোটায়। যার মধ্যে ৩০% মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদেরসহ তাদের নাতি-নাতনিদের কোটা, ৫% উপজাতি কোটা, ১০% মহিলাদের কোটা, ১০% জেলা কোটা। এছাড়াও বাংলাদেশ কর্মকমিশন হতে প্রকাশিত গত ২৮-০৩-২০১২ইং তারিখ এর এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রতিবন্ধিদের জন্য ১% কোটা বরাদ্দ করে। প্রথমে আসি মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিষয়ে। মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন, আর তাদের মাঝে যারা এখনো বাংলার বুকে বিচরণ করছেন তারা সকলে আমাদের মাথার তাজ। তাদের মহান অর্জনের জন্য আজ আমি ও আমরা এদেশের নাগরিক হতে পেরেছি। ফলে তাদেরকে জাতি সন্মানের উচ্চ শিখরে তুলে রেখেছে এবং রাখবে আজীবন। ৩০% কোটা তাদের সন্তানদেরকেসহ তাদের নাতি-নাতনিদের দেয়াকে করুনা বলছি না, বলবো তাদের অর্জিত সন্মান। যদি সেটা হয় সাধারণ প্রার্থীর মেধার সমতুল্য, যা অনেকাংশে হয় না। এ ৩০% কোটা তাদের জন্য সন্মান স্বরূপ। আর এটা পাওয়ার ক্ষেত্রে তারাই যোগ্য উত্তোসুরী। সাধারণ ছাত্র যে নম্বার পেলে এ পরীক্ষায় টিকে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানসহ অন্য কোটার প্রার্থীর তদাপেক্ষা কম নম্বর পেয়ে যদি কোটার বদৌলতে টিকে তবেই এটাকে বলবো করুণা। যদি সে যোগ্যতা ও মেধাসম্পন্ন প্রার্থী হয়ে থাকে তবে কেন তাকে করুণা দেখিয়ে অসন্মান করা হচ্ছে। তাকেও সাধারণ প্রার্থীর মধ্যে থেকে চিনাতে এবং চিনাতে হবে যে, সে করুণার পাত্র নয়। তার যোগ্যতা আছে বলেই সে ঐ স্থান দখল করেছে। তাহলে সে দেশের সাথেও প্রতারণা করবে না। দেশও খুঁজে পাবে যোগ্য চালককে। যেখানে বিসিএস ক্যাডারদের হাতে থাকে দেশকে গড়ে তোলার মুল চাবিকাঠি। তখন ৩০% কোটা! সংখ্যাটা অনেক বড়। এর সম্পূর্ণটা পাওয়ার যোগ্যতা আছে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের। তাহলে তারা যোগ্যতা প্রমান করে একবার নয়, দুই বার নয়, তিন অথবা তদাপেক্ষা বার চেষ্টায় একটি গ্রহণযোগ্য সর্বজনগ্রাহী নিয়মের মাধ্যমে আসুক সাধারণ প্রার্থীর যোগ্যতার কাতারে। গ্রহন করুক তাদের প্রাপ্ত সন্মান। তবেই থাকবেনা কোন প্রশ্ন। কিন্তু কোটাভূক্ত যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ার দরুণ যদি ঐ স্থানটি খালি রাখাহয় কিংবা নিয়োগ কে বারবার বিলম্বিত করে স্বল্প মেধাসম্পন্ন প্রার্থীকে দিয়ে স্থানটি পুরন করা হয় অথবা অন্যান্য দুর্বল নিয়মের মধ্যে যদি কম যোগ্যতা সম্পন্ন প্রার্থীর হাতে তুলে দেয়া হয় দেশের হাল, তবে কি দেশ সেই হালে পানি পাবে? ঠিক এরুপ কথায় বলবো কোটার অন্য অংশের প্রতি। কোটা ব্যবস্থার বিপক্ষে গিয়ে নয় কোটা ব্যবস্থার স্বপক্ষে গিয়ে বলছি, এ সিস্টেমে কোটার অংশ কমাতে হবেনা শুধু সিস্টেমকে একটু বিশ্লেষণ পূর্বক নতুন করে ভাবতে বলছি আমাদের বুদ্ধিজীবী ও দেশের নীতিনির্ধারকদেরকে। যখন বার বার প্রচেষ্টার পর ও কোটা ভুক্ত প্রার্থীর সাধারণ প্রার্থীর সমপর্যায়ে আসতে পারছে না বা পারে না, তবে কেন সাধারণ প্রার্থীর যোগ্যতাকে পাশে ঠেলে একজন কোটা ভুক্ত অযোগ্য (অনেক ক্ষেত্রে) প্রার্থীর হাতে তুলে দিবেন দেশের হাল? অথবা থাকবে কেন দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদটি থাকে খালি পরে কোটার যোগ্য প্রার্থীর অভাবে? প্রশ্নটা রয়েই গেল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিকট?
আমাদের দেশের মেয়েরা আর আজ দুর্বল না। দেশ পরিচলনার ভার-ই আমরা দিয়ে রেখেছি তাদের কাছে। আজ দেশের পুরুষ-নারীর অনুপাত ১০০.৩ঃ১০০ এবং সাংবিধানিক ভাবে পুরুষ নারীর অধিকারও সমান। তবে কেন সমান সমান অবস্থান থেকে আমাদের নারীরা কোটার দুর্বল ব্যবস্থাকে আঁকড়ে ধরবে। একজন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী স্বাভাবিক শিক্ষার্থীকে দেয়া হয় একটু বেশি সময় বিভিন্ন বোর্ড পরীক্ষাতে তার সামর্থ্যকে স্বাভাবিক শিক্ষার্থী সামর্থের সমান করতে। এখানে থাকেনা তার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন। কারণ উত্তর পত্র যাচাই কারক শিক্ষক জানেন না যে সে স্বাভাবিক না প্রতিবন্ধী। তাহলে এখানেও তাকে আর দশটা সুস্থ মানুষের মতো চিন্তা করতে দিন। তার যোগ্যতাই সে সফলতার সুউচ্চ সিঁড়িতে উঠতে সক্ষম হবে, এতেই তার তৃপ্তি। আবার সাংবিধানিকভাবে যেখানে দেশের সকল মানুষের মৌলিক অধিকারের সমান । তবে কেন জেলা কোটা আমার বোধগম্য নয়? তবে কি দেশের প্রতিটা জেলার মানুষের জন্য আলাদা আলাদা করে মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন ছিল না? কথা প্রসঙ্গে আরও বলতে হয় বোর্ড পরীক্ষার উত্তরপত্র নিরীক্ষণকারী শিক্ষকটি ও জানেননা এবং জানার প্রয়োজনও নেই যে, কে কোন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অথবা তাদের নাতি-নাতনি, কিংবা কে মেয়ে কে ছেলে অথবা কে কোন জেলার। ফলে করুণা বিষয়টি এখানে অকল্পনীয়। ফলপ্রকাশের পর অন্য সকল শিক্ষার্থীর ন্যায় সে বা তারা ও ভাল ফলাফল করে। এটা কি তার বা তাদের প্রকৃত যোগ্যতা নয়?

এগুলোতেই যদি শেষ হয়ে যেত তবু না হোক ৪৪% চাকুরী জুটত সাধারণ প্রার্থীদের। কিন্তু সেখানেও থাকে কিছু অলিখিত কোটা, যেমন রাজনৈতিক কোটা, আত্মীয় কোটা, মামা-চাচা কোটাসহ আর অনেক কোটা। তাই নজরুলের মতো বলতে হয় খুদ-ঘাঁটা ও সাধারণ প্রার্থীদের অনেকাংশে অনেকসময় জোটেনা। অনেকে কোটার বিপরীতে কথা বলতে গিয়ে বলে থাকেন যে, অনেক উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে কোটা ব্যবস্থা নেই তবে আমাদের দেশে এ ব্যবস্থা কেন? তাদের কে বলি ব্যপারটা এভাবে চিন্তা না করে ভাবুন আমারা অনেক উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মতো একটি পজেটিভ চিন্তা থেকে আমরা উপযুক্ত লোকদেরকে সন্মানিত করছি? অনেকেতো অনেক ভাবে সন্মান প্রত্যাশীদের সন্মানিত করে। সেরুপ আমরাও আমাদের সন্মানিত ব্যক্তিদেরকে এই উপায়েই নাহয় সন্মানিত করছি। তবে আমাদের সিস্টেমে গলদ রয়েছে। সিস্টেমর এ গলদ দূর করতে পারলে সন্মানিত ব্যক্তিগণ তাদের প্রাপ্ত সন্মান সাথে সাথে দেশ পাবে দক্ষ পরিচালক আর থাকবে না কোন কিন্তু আমার কিংবা আপনার মধ্যে। আর এরকম আরও যেখানে যে ধরণের দুর্বল সিস্টেম আছে সেগুলোকে একইভাবে নিয়মের মধ্যে আনতে হবে। আমার সীমাহীন ভুলত্রুটির জন্য দুঃখিত, ভুল হয়ে থাকলে বুঝিয়ে বলুন বুঝবো, দেখিয়ে দিন দেখবো; শিখিয়ে দিন শিখবো। গণতান্ত্রিক দেশ বিধায় ভুল কথা যদি বলেও থাকি তবুও রয়েছে শান্তি, যেখানে আপনার সাথে মন খুলে বিষয়টি শেয়ার করতে পারছি। এ দেশ আমার ও আমাদের সকলের।আমাদের দেশ সোনার দেশ, সোনায় পরিচালনা করুক শ্যামল দেশ। এই প্রত্যয় থাকল আপনাদের সকলের কাছে।