পদ্মা সেতুতে দেশিয় অর্থায়ন ও আমাদের ভাবনা

প্লানার সুজন
Published : 9 July 2012, 10:11 AM
Updated : 9 July 2012, 10:11 AM

বেশ কিছুদিন যাবত পদ্মা সেতু নিয়ে অনেক চিন্তা ভাবনা চলছে। আর এ চিন্তা ভাবনার উদ্যোগ ঘটলো বিশ্বব্যাংকের পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন না দেয়ার সিদ্ধান্তের ঘটনা প্রকাশের পর। বিশ্বব্যাংকের সেতুতে অর্থায়ন না দেয়ার মূল যে কারণ ছিল, সেটি হল "দুর্নীতি"। এ সম্পর্কে তারা দুর্নীতির চিত্র প্রকাশ পূর্বক অনেক প্রমাণ বাংলাদেশ সরকারের কাছে প্রকাশ করেছে। সেগুলোর কোন নথিই বাংলাদেশ সরকার দেশের মানুষের কাছে প্রকাশ করেনি। বিশ্বব্যাংক বলল, পদ্মা সেতু প্রকল্পে নাকি দুর্নীতি হয়েছে। প্রত্যুত্তরে সরকার শুধু মৌখিকভাবে দেশবাসীকে জানালো যে, সেখানে কোনরূপ দুর্নীতি হয়নি। এরপর দেশবাসী দেখলো দেশের যোগাযোগ মন্ত্রীর হঠাৎ করে রদ-বদল। দেশবাসীর বুঝবার আর কিছু বাকি থাকলো না পদ্মা সেতু তৈরিতে কি ঘটতে চলেছে। তারপরও সরকার বললেন সেখানে কোনোরূপ দুর্নীতি হয়নি। এমনকি সরকার ও বদলী-যোগাযোগ মন্ত্রী তাদের দুর্নীতির প্রমাণ দেখানোর জন্য চ্যালেঞ্জে ছুড়ে দিলেন। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির নথি তুলে ধরলো সরকারের কাছে। এরই প্রেক্ষিতে দেশের দুর্নীতি দমন কমিশন একটি তদন্ত করলো। পরবর্তীতে সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানা গেল যে, সেখানে দুর্নীতির কোন সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। দেশের মানুষ এটাকে কিভাবে নিয়েছে, তা বুঝার ক্ষমতা নিশ্চয় সরকারের আছে? কিছুদিন পূর্বে বিশ্বব্যাংক বিবিসি সংবাদ মাধ্যম দিয়ে দেশসহ সারা বিশ্ব কে জানিয়ে দিলো যে, দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার কারণে পদ্মা সেতুর অর্থায়নে তারা বাংলাদেশর সাথে আর চুক্তি বহাল রাখছে না। আর এতদিন দুদক কিংবা বিশ্বব্যাংক যে নথি সরকারের কাছে তুলে ধরেছে তাও সরকার দেশবাসীর কাছে প্রকাশ করেনি। কিন্তু এবার দেশবাসীর কাঁধের উপরই সরকার চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন পদ্মা সেতুর বোঝা আর তাই শুরু হল এক নতুন নাটক!

গতকাল দেশবাসী জানতে পারলো যে, সরকার বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নকে পাশে ঠেলে দেশের মানুষের সাহায্যে পদ্মা সেতু তৈরি করবে। নিঃসন্দেহে এটি সরকারের এক মহতী উদ্যোগ। সেক্ষেত্রে আমাদের সরকার প্রধান জানালেন যে, চলতি বাজেটে বরাদ্দ করা উন্নয়ন বাজেটের অর্থ দিয়ে, সারচার্জ বসিয়ে এ অর্থ যোগাড় করা সম্ভব। তিনি আরও জানালেন তার সাথে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ এ সেতুতে অর্থায়ন করতে চান। তিনি বলেছেন প্রবাসীরা অর্থায়নের কথা অর্থাৎ রেমিটেন্স এর কথা, বলেছেন স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা টিফিনের টাকা দিতে রাজি হওয়ার কথা; আরও উল্লেখ করেছেন গরিব কৃষকের অর্থায়নের কথা । মাননীয় স্পিকার প্রস্তাব করলেন, মোবাইল কল থেকে টাকা কর্তন করার। আমাদের সংসদ উপনেতা বললেন একবেলা কম বাজার করার কথা। এ সবগুলোই মহতী উদ্যোগ। আমরা সাধারণ জনগনও সম্পৃক্ত হতে পারি এ মহতী উদ্যোগের সাথে। কিন্তু কিছু প্রশ্ন তো থেকেই যায়। যেগুলোর উত্তর জানতে আজ দেশবাসী উদগ্রীব। আমাদের সরকার কি প্রশ্ন গুলোর উত্তর দিতে পারবে?

১. কেন পদ্মা সেতু তৈরিতে দুর্নীতির অভিযোগ তুলল বিশ্বব্যাংক?
২. বিশ্বব্যাংকের প্রেরিত দুর্নীতির প্রমাণ কেন সাধারণ মানুষের নিকট প্রকাশ করা হলো না?
৩.যদিও প্রশ্নটা হাস্যকর, যোগাযোগ মন্ত্রীকে কি পদ্মা সেতুর দুর্নীতির কারণে বদল করা হল অন্য মন্ত্রণালয়ে?
৪. বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন কিরূপে বিশ্ব ব্যাংকের অভিযোগের তদন্ত করল? কোথায় তাদের তদন্তের সে নথি?
৫. বিশ্ব ব্যাংক দুর্নীতির জন্য কিছু নাম জানা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করার পর ও তাদের দুর্নীতির তদন্ত কেন করা হলো না? কিংবা এবং কি করলেও সে নথি কেন প্রকাশ করা হলো না?
৬. যদি দেশবাসী অর্থায়ন করে তবে সে অর্থের সঠিক ব্যবহারের স্বচ্ছতা কে প্রদান করবে?
৭. দেশবাসী টাকা দিলেও কি যাদের নামে অভিযোগ তারাই কি আবার মূল দায়িত্ব থাকবে?
৮. দেশবাসীর অর্থায়নের পরও যে দুর্নীতি হবে না, সে হিসাব কে দিবে?
৯. দেশবাসীর অর্থায়নের পর ও কি তারা তৈরিকৃত পদ্মা সেতুতে বিনাশুল্কে অথবা নামেমাত্র শুল্কে সেতু ব্যবহার করতে পারবে?
১০. দেশবাসী কাছ থেকে অর্থায়ন মানে কি শুধু সাধারণ আয়ের মানুষ গুলোর কাছ থেকে অর্থ নেয়া হবে, আর দেশের রাঘব বোয়াল গুলো থাকবে ধরা ছোঁয়ার বাইরে?
১১. সাধারণ দেশবাসীর অর্থায়নের পরও কি সেটা রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হবে?
১২. পদ্মা সেতুতেও কি যমুনা সেতুর মত ফাটল ধরবে অথবা বর্তমান তৈরীকৃত প্লান ব্যতিরেকে যেনতেন প্লানে পদ্মা সেতু তৈরি করা হবে?
১৩. দেশবাসী কাছ থেকে অর্থায়ন নিয়ে অথবা অন্য বিভিন্ন খাত থেকে অর্থায়ন করার পর কি দেশের অন্যান্য উন্নয়ন খাত গুলো অনুন্নত থেকে যাবে? নাকি সেগুলোর উন্নয়ন একই সাথে চলবে?
১৪. দেশবাসী কাছ থেকে অর্থায়ন নিয়ে অন্যের পেট ভরানো হবে কি?

এগুলো এখন প্রতিটা সচেতন মানুষের প্রশ্ন। আমরা বাঙ্গালী অনেক আবেগি জাতি। এটা আমাদের কাছে যেমন গর্বের অপরদিকে তেমনি ক্ষতিকরও। যেখানে আবেগ বেশি সেখানে আবেগকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে আমরা অনেক ভুল ও দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছাই। আর সেক্ষেত্রে আমাদের অনেক সিদ্ধান্তই হয় ভুল এবং পরবর্তীতে আমরা সেই সিদ্ধান্তের জন্য পস্তাই। আবেগের বসে এখন আমরা যদি পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নের বাইরে নিজ অর্থায়ন করি সেক্ষেত্রে কি সম্পর্কের অবনতি হবে না, এ জবাব কে দিবে? সে ক্ষেত্রে আমাদের কি আগে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে যেসব দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে সেগুলোর তদন্ত করে উপযুক্ত ব্যক্তিদেরকে শাস্তির সম্মুখীন করতে পারিনা? এরপর না হয় আমরা নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরির উদ্যোগ নিই? সে ক্ষেত্রে সাপ ও মরবে আর লাঠিও ভাঙ্গবে না। আমরা সাধারণ জনতা খুঁজে পাব আমাদের প্রশ্নের উত্তর? এ সকল প্রশ্নের একটিরও যদি সঠিক উত্তর প্রমাণ ব্যতিরেকে উত্তর দেয়া হয়, তবে সেটি হবে শুভঙ্করের ফাঁকি? আমরা সে ফাঁকিতে পড়তে চাইনা? চাইনা বিশ্ব ব্যাংকের মত দাতা সংগঠন আমাদের কে এভাবে অপদস্থ করুক এবং পরবর্তীতে অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজ থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত রাখুক। ভবিষ্যতে হয়ত এই দুর্নীতির অভিযোগকে পুঁজি করে অন্যান্য বন্ধু দাতা সংগঠন আমাদের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে রাখতে পারে । তবে কি সমস্যার সমাধান হওয়ার দরকার নাই? আমরা স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশের জনতা আমাদের আছে এ সকল প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানার অধিকার। সরকারকে বলব আমাদের জনগনকে এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করবেন না। সরকার ও সাধারণ জনতাকে আবার বলছি আপনারা আবেগের বসে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে বিরত থাকুন। পদ্মা সেতু হবে জনতারই সেতু, হবে হয়ত সেটা জনতার অর্থায়নেই, কিন্তু আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে সরকারকে।