আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, মধ্যবিত্তের কান্না এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম

সৈয়দ আশরাফ মহি-উদ্-দ্বীন
Published : 21 Feb 2016, 08:18 PM
Updated : 21 Feb 2016, 08:18 PM

বছর শেষ হয়ে নতুন বছরে যখন পদার্পণ করি, হাজারো শুভেচ্ছা, আশার বাণী আর ভালো ভালো শব্দে ভরে উঠে পত্রিকার পাতা, টেলিভিশনের পর্দা আর ফেসবুকের দেয়াল। অথচ একটু খেয়াল করলেই দেখবেন আমাদের বছর শুরু হয় দুশ্চিন্তা আর হাহাকার দিয়ে।  বিশেষ করে মধ্যবিত্ত পরিবারে যাদের দু'একটি সন্তান স্কুলে পড়াশোনা করে, তাদের তো কপালের ভাজ সহজেই দৃশ্যমান হয়।

ছেলে মেয়ে নতুন ক্লাসে উঠেছে, আবার নতুন করে ভর্তি হতে হবে। আপনার সন্তান কী ভুলটাই না করেছে লেখাপড়া শিখতে এসে। বাবা মাকে কেউ এমন বিপদে ফ্যালে? কোনো স্কুল যদি একটু নাম করে ফেলেছে তো আর রক্ষা নেই। কম করে হলেও দশ হাজার টাকা লাগবে ভর্তি হতে। আপনার তো মাথায় হাত ! বেতন যা পান তার পঞ্চাশ ভাগ চলে যায় বাড়ি ভাড়ায় আর বাকি পঞ্চাশ ভাগ দিয়ে কোনো রকমে টেনে টুনে সারা মাস খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকেন।  বছরে দু'বার বোনাস নামক সোনার হরিন দেখা দেয় তা দিয়ে ছেলেমেয়েদের দেশীয় সংস্কৃতির পোশাক কিনে দিয়ে বউকে বোঝাতে হয় আমাদের বুড়োবুড়ির আর ঈদ! এই বাড়তি দশ হাজার (যদি একটি সন্তান হয়) কোত্থেকে আসবে?

আমরাও লেখাপড়া করেছি, আমাদের বাবা মাকে এত দুশ্চিন্তা করতে হয়নি।  কারণ আমরা স্কুলে পড়তাম আর আমাদের যাঁরা পড়াতেন তাঁরা ছিলেন শিক্ষক। এখন কোনো স্কুল নেই – আছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।   কোনো শিক্ষক নেই – আছেন বেনিয়া।  শিক্ষা এখন পণ্য। এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন হয় মার্কেটিংয়ের, প্রমোশনের, বিজ্ঞাপনের। সেকি বাহারী বিজ্ঞাপন – টিভিতে, রেডিওতে, পত্রিকায়।  আগে দেখতাম স্কুলের গভর্নিং বডির সভাপতি হচ্ছেন এলাকার শিক্ষিত, মার্জিত, রুচিশীল মানুষ।  শিক্ষক ছাত্রের সম্পর্ক ছিল পিতা পুত্রের।  আর এখন? একটু ভেবে দেখেন কেন আজকে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর এই দুরাবস্থা।  স্কুলের সভাপতি হন এলাকার সংসদ সদস্য। গভর্নিং বডির সদস্য হন রাজনৈতিক দলের বা তাদের অঙ্গ সংগঠনের মহান নেতারা। লক্ষ্য করবেন এদের কারোরই শিক্ষাগত যোগ্যতা বলার মত না।  বেশির ভাগই তাঁদের নমিনেশন ফর্মে লিখে থাকেন স্বশিক্ষিত। নির্বাচনে দাঁড়ানোর আগে একবার হজ করে এসে নামের আগে বড় বড় অক্ষরে আলহাজ লিখে নিজেকে ধার্মিক এবং সৎ প্রমানের চেষ্টা করেন। উদ্দেশ্য – এই বিশেষনকে পুঁজি করে নিজেদের আখের গোছানো। আগে তাঁদের দুর্নীতির ক্ষেত্র ছিল জমি দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডার, রাস্তা ঘাট বানানো এইসব ।

এখন এঁরা এঁদের পরিধি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত বিস্তৃত করেছেন। বেশ ভালো পরিচ্ছন্ন সেক্টর।  ব্যপকতাও যথেষ্ট – ভর্তি ফীর নামে চাঁদাবাজি, মাসের বেতন আকাশ ছোঁয়া, কথায় কথায় পরীক্ষার নামে ফী, ডোনেশন, শিক্ষকদের কোচিং সেন্টার বানিজ্য, শিক্ষক নিয়োগ আরও কত কী ! আগে দেখতাম যোগ্যতা দেখে স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হত, এখন দেখবেন এলাকার যে রাজনৈতিক ভাই গভর্নিং বডির মেম্বার হয়েছেন তাঁর শালা, ভাই, বোন্ বা স্ত্রী স্কুলের শিক্ষক হয়ে যাচ্ছেন, মাননীয় সংসদ সদস্যকে খুশি করে শিক্ষক হয়ে যাচ্ছেন।  যখন যে দল রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকেন তাঁর মদদপুষ্ট শিক্ষক প্রধান শিক্ষক হচ্ছেন অন্য সিনিয়র শিক্ষকদের ডিঙিয়ে।  সেই প্রধান শিক্ষক আবার মাননীয় সংসদ সদস্যর জোরে সিনিয়র শিক্ষকদের সাথে দুর্ব্যবহার করে ক্ষমতার বহিপ্রকাশ করেন।  আগে শুনতাম শুধু রাজনীতিবিদরাই বিদেশে তাঁদের আরেকটি নিরাপদ আশ্রয় ঠিক করে রাখেন এখন এইসব শিক্ষকরাও সেই পথ ধরেছেন।  তাঁরাও জানেন তাঁর দল যে প্রতিবারই ক্ষমতায় আসবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।  তাই নিজের পিঠ বাঁচাতে এই সাবধানতা।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, দেশের সকল রাজনীতিবিদই দুর্নীতিগ্রস্ত নন, এখনো অনেক সৎ নিবেদিত প্রান নেতা সব দলেই আছেন, না হলে দেশ এতদিনে ধংস হয়ে যেত। কিন্তু এইসব দুর্নীতিগ্রস্ত লোকেদের কারণে পুরো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের উপর এর দায় ভার চলে আসে।  গুটিকয়েক অশুভ ব্যক্তির কারণে পুরো দল বদনামের অংশীদার হচ্ছে ।

কয়েকদিন আগে পত্রিকায় দেখলাম জনৈক সহকারী প্রধান শিক্ষক পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপের পুরো টাকা দিতে না পারায় তাঁর ছাত্রীকে দেহ ব্যবসায় নামতে বলেছেন (আমাদের সময় ২৩/১২/২০১৫)।   ধিক্কার জানানোরও ভাষা নায় এইসব শিক্ষক নামের কুলাঙ্গারদের জন্য।

প্রশ্ন হচ্ছে এই সব দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষকদের কাছ থেকে কী শিখবে আমাদের সন্তানেরা? তারা ছোটবেলা থেকেই দেখছে যে তাদের শিক্ষকরা বিনা রশীদে মিথ্যা কথা বলে অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছেন, শিক্ষকরা এমন সব লোকদের সাথে চলাফেরা করেন যাদেরকে সমাজের সাধারণ লোকেরা ভয় করে, ঘৃনা করে।  একদম ছোট বাচ্চারা হয়ত বোঝে না কিন্তু যারা একটু উপরের ক্লাসের তারাতো বোঝে যে, তাদের লেখাপড়া করাতে তাদের বাবা মাকে কী অমানুষিক কষ্ট করতে হয় শুধু এই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির কারণে।  যে শিশুরা এই পরিবেশে মানুষ হচ্ছে যেখানে নৈতিকতা নেই, নিয়ম নেই, আদর্শ নেই তারা কি করে ভবিষ্যতে দেশ গড়বে, হবে সমাজ সংস্কারক?

এখানে একটা কথা না বললেই নয় যে, এই সব শিক্ষক সমাজের বাইরে এখনো অনেক শিক্ষক আছেন যাঁরা সৎ, যোগ্যতা সম্পন্ন, এবং দুর্নীতি মুক্ত কিন্তু তাঁরা বড়ই কোনঠাঁসা অবস্থায় আছেন, ঐসব শিক্ষকদের অত্যচারে তাঁরা নিরুপায় এবং পত্রিকায় পড়ে জেনেছি যে গ্রামের অনেক শিক্ষক তাঁদের পাওনা বেতন নিতে যখন শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে জুতোর তলা ক্ষয় করেন তখন ঘুষ ছাড়া কোনো ফাইল নড়ে না। এঁরা চিরকালই নিগৃহীত থেকে যাবেন অথচ এঁরাই হচ্ছেন মানুষ গড়ার সত্যিকারের কারিগর।

সবশেষে, সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে আকুল আবেদন দয়া করে অন্তত শিক্ষা ব্যবস্থাটাকে রাজনীতি মুক্ত করে আমাদের সন্তানদের সত্যিকারের মানুষ হওয়ার পথটাকে মসৃন করে দিন।  শিক্ষাকে পণ্য না করে অধিকারে রূপান্তর করুন। গত পঁয়তাল্লিশ বছরে দেশ অনেক এগিয়েছে, এই এগোনোর পথটাকে কন্টকমুক্ত করে ভবিষ্যত প্রজন্মকে এমন জায়গায় নিয়ে যান যেন তারা অর্থলিপ্সু না হয়ে, মানুষ হয়ে আমাদের বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির শিখরে নিয়ে যেতে পারে।