পীর সমাচার

সৈয়দ আশরাফ মহি-উদ্-দ্বীন
Published : 9 May 2016, 06:50 PM
Updated : 9 May 2016, 06:50 PM

নতুন একটা প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ততার কারণে অনলাইনে খুব একটা আসতে পারছিলাম না।  ফেসবুকে আজ একটা পোস্ট দেখে মনে হলো কিছু একটা লিখা দরকার। পোস্টটি করেছেন কোনো এক হুজুর (পীর সাহেব) ভক্ত অর্বাচীন ব্যক্তি।  আগে পোস্টটি দেখে নেই, তারপরে বিস্তারিত আলোচনা করব।

স্ট্যাটাস, একটি মসজিদের ছবি এবং তারপর আরও কিছু অর্বাচীনের কমেন্টস।

পোস্টের কমেন্টস গুলোর দিকে খেয়াল করলে দেখবেন, এখানে বলা হচ্ছে `মালিক পাকদের' দয়ায় উনি এই মসজিদে খেদমত করেছেন। যতটুকু জানি, মসজিদকে আমরা `আল্লাহর ঘর' হিসেবেই মানি। অথচ এই ভদ্রলোক উনার তথাকথিত হুজুরকে এই পবিত্র মসজিদের মালিক বানিয়ে ফেলেছেন। কারণ এই মসজিদটি উনার পেয়ারা হুজুরের খরিদ করা অথবা ভেট হিসেবে পাওয়া জায়গায় অবস্থিত বলে।

তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম উনি হয়ত `মালিক পাকদের' বলতে আল্লাহকেই বুঝিয়েছেন। তাতেও প্রশ্ন থেকে যায়। ইসলাম ধর্ম একেশ্বরবাদের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আর উনি এক আল্লাহকে অনেক আল্লাহ বানিয়ে ফেলেছেন।  এখানেও যুক্তি ধোপে টেকে না।

পাক শব্দটি এঁদের খুব প্রিয়। ভক্তির চরম মাত্রা বোঝাতে এঁরা উনাদের হুজুরের সবকিছুকে পাক হিসেবে মূল্যায়ন করে থাকেন। যেমন হুজুর পাক, খানকা পাক, হুজুর পাকের চেয়ার পাক, জামা পাক এমনকি হুজুরের জুতোকেও এঁরা জুতো পাক বলে থাকেন (নাউজুবিল্লাহ)। ইদানিং যেহেতু ফেসবুকে এই সব হুজুরদের কীর্তিকলাপ ছাপছেন নানাবিধ ছবি সহ, হয়ত কিছুদিন পরে এঁরা ফেসবুকের নাম বদলে `ফেসপাক' বা মার্ক যাকারবার্গ কে `পাক যাকারবার্গ ' বানিয়ে ফেলবেন।

আরেকদিন দেখলাম, কোনো এক পীর ভাইয়ের পয়দা দিবসে আরেক পীর ভাই উইশ করেছেন `মউলা পাক আপনাকে নেক হায়াত দারাজ করুন'। উল্লেখ্য মউলা পাক বলতে উনারা উনাদের বর্তমান সিংহাসনে আসীন হুজুরের পূর্বপুরুষকে বোঝান। এতদিন জানতাম হায়াতের মালিক একমাত্র আল্লাহ এখন দেখছি এঁদের হুজুর পাকরা(!) আল্লাহর সেই অধিকারও কেড়ে নিয়েছেন। (নাউজুবিল্লাহ)।

এঁরা হুজুরের অনুমতি ছাড়া কোনো কাজ করেন না। এমনকি এঁদের বাবা, মা বা ভাইবোন যদি মারাত্বক রকমের অসুস্থ হন আর হুজুর যদি এঁদের বলেন কালকে আমার বাসায় এসে আমার জুতোটা একটু পরিস্কার করে দিবেন তবে এঁরা এদের মা বাবাকে হাসপাতালে নেবার বদলে হুজুরের জুতো পাক মাথায় তুলে পরিস্কার করতে বসবেন। এঁরা এঁদের মউলা পাককে `মুশকিল কোশা' নামে আখ্যায়িত করে থাকেন। আর শিয়া মুসলিমরা হজরত আলীকে (রা:) `মুশকিল কোশা' বলে থাকেন। যার অর্থ হচ্ছে সমস্যা সহজকারী । অথচ আমরা জানি একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কোনো সহজকারী/সমাধানকারী নেই। এঁদের ধারণা নবীর (স:) শাফায়াত এঁদের প্রয়োজন হবে না, কারণ হুজুরকেই উনারা শাফায়াতকারী হিসেবে গন্য করেন।

উল্লেখ্য এঁরা পবিত্র হজব্রত পালন করার চাইতে হুজুরের খানকা শরীফ (!) জিয়ারত করাকে অধিক পুন্যের কাজ বলে মনে করেন। এঁদের হুজুর ভক্তি শুধু গদ্দিনশীন হুজুরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং তা হুজুরের বা তাঁদের বংশধরের যে শিশুটি কেবল মাত্র জন্মগ্রহণ করলো সে (দুখিত, `তিনি' `সে' বললে আবার খাতরা* হয়ে যাবে।) পর্যন্ত্য বিস্তৃত। এই শিশুটিকে পর্য্যন্ত এঁরা কদমবুসীর নামে সেজদাহ করে থাকেন।

এঁদের সেজদাহ পদ্ধতি দেখলে মোগল বাদশাদের দরবারের কথা মনে পড়ে যায়। সে কী ভক্তি, কী বিনয়, কী অর্পণ!! প্রথমে এঁরা খানকাহ পাকের অদূরে এঁদের জুতো খুলে রাখেন, তারপর দরজার সামনে রক্ষিত পাপোশে পায়ের তলা ঘষতে থাকেন (পারলে পায়ের তলার চামড়ার প্রথম স্তরটিকে তুলে ফেলেন)। এরপর নামাজের রুকুতে যাওয়ার মত কুঁজো হয়ে দুই হাত কচলাতে কচলাতে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে হুজুর পাকের কদম পাকে নিজের নাপাক মাথা খানা ঠেকান। দু'একজন আছেন যাঁরা দরজাতেই ভুলুন্ঠিত হন (যেটাকে আমরা সাষ্টাঙ্গে প্রনাম বলে থাকি)। হুজুর তাঁর কোমল মাংসল হাত দিয়ে ভক্তের মাথায় আলতো ছোঁয়া দেন। ভক্ত গদগদ হয়ে সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থ হুজুর পাকের কদম পাকে সমর্পণ করেন। এই অর্থ প্রদানের হুজুরীয় পরিভাষা হলো `নাজরানা'। ব্যস, আর ঠেকায় কে – বেহেস্ত সুনিশ্চিত।

এরপর ফিরবার পালা। দৃশ্যটাকে ভিসুয়ালায়িজ করার জন্য প্রবেশের যে দৃশ্য বর্ণনা করেছি সেটাকে রিওয়াইন্ড করে নিন, নির্ভুল দেখতে পাবেন।

এঁরা বাড়িতে বা খানকা শরীফে যে ধর্মীয় অনুষ্ঠান করেন, সেখানে উর্দু এবং ফার্সী ভাষায় বিভিন্ন কবিতা সুর করে পড়া হয় আর যখন হুজুরদের নাম নেওয়া হয় তখনই সেজদাহ করে উনাদের সম্মান জানানো হয়।  এই কবিতার পুরোটা জুড়েই থাকে হুজুর আর তাঁর বংশধরদের কেচ্ছা কাহিনী এবং বড়পীর হজরত আব্দুল কাদের গিলানী (র:) এর শানে কিছু সম্মান প্রদর্শন। (উলেখ্য আমরা সবাই গিলানী শব্দটাকে জিলানী বলে থাকি।  বড়পীর (র:) জন্মগ্রহণ করেছিলেন ইরানের গিলান নামক একটি অঞ্চলে তাই উনার নামের শেষে স্থানের নামটি সংযুক্ত করা হয়। পরবর্তিতে উনি ইরাকে চলে আসেন এবং সেখানেই মৃত্যু বরণ করেন এই মহীয়সী ব্যক্তি। যাঁর সমাধী ইরাকের বাগদাদে অবস্থিত)।  হায়রে অর্বাচীন! অথচ মুসলমানের প্রথম শর্তই হলো আল্লাহ ছাড়া কাউকে সেজদাহ করা নিষিদ্ধ।  সেজদাহ সম্পর্কে দুটি সহিহ হাদিস নিচে আপনাদের সুবিধার জন্য তুলে ধরলাম।

আবদ বিন হামিদ তাঁর `মসনদ' গ্রন্থে উল্লেখ করেন – ইমাম হাসান বসরী (রা:) বর্ণনা করেন যে, একজন সাহাবী নবী করিম (স:) এর কাছে জানতে চাইলেন `আমরা যেভাবে একে অন্যকে শুভেচ্ছা জানাই আপনার ক্ষেত্রেও তাই করি।  আমরা কি আপনাকে সেজদাহ করতে পারি না ?' রাসুল্লাহ (স:) উত্তর দিলেন – `না'। তোমরা তোমাদের নবীকে সম্মান কর কিন্তু সেজদাহ কেবল আল্লাহ'র অধিকার। সেজদাহ শুধু তাঁকেই কর কেননা তাঁর পাশে অন্য কাউকে সেজদাহ অনুমোদিত নয়।  

অপরটি হচ্ছে –

হযরত আবু হুরায়রা (রা:), বর্ণনা করেন, রাসুলাল্লাহ (স:) বলেছেন যে, "আমি যদি সৃষ্টির কাউকে সেজদাহ করতে বলতাম তবে আমি একজন মহিলাকে তাঁর স্বামীকে সেজদাহ করার আদেশ দিতাম"  (মিশকাত শরীফ পৃষ্ঠা . ২৮১)

পবিত্র কুর'আনের সুরা হাজ্জ এর ৭৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন –

`তোমরা যারা বিশ্বাসী, রুকু ও সিজদাহ কর শুধুমাত্র আল্লাহকে, ইবাদত কর একমাত্র আল্লাহর এবং সৎ কাজ কর। এতেই তোমরা সফলতায় পৌঁছুবে'

অতএব, উপরের দুটি হাদিস থেকে পরিস্কার বোঝা যায় যে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে সেজদাহ করা যাবে না। পবিত্র কুর'আনে আল্লাহ নিজে বলেছেন যে, সিজদাহ পাওয়ার অধিকার একমাত্র তাঁর আর কারো নয়। যেখানে সয়ং রাসুল্লাহকে (স:) সেজদাহ করা নিষেধ, সেখানে আপনি কত বড় `পাক' যে আপনাকে সেজদাহ করতে হবে?

এই হুজুরদের মধ্যে আবার পারিবারিক দন্দ আছে।  রাজতন্ত্রের দন্দ। যতটুকু জেনেছি, এঁদের পূর্ব পুরুষের কোনো এক আব্বা হুজুরের মৃত্যুর পর (সরি, মৃত্যু বলা যাবে না, খাতরা হবে।  বলতে হবে ওফাত পাকের পর) তাঁর অসিয়ত অনুযায়ী তাঁর দ্বিতীয় বা তৃতীয় শাহজাদাকে (সন্তান) উত্তরসুরী নির্বাচিত করা হয় কিন্তু বড় জনের দাবি জ্যেষ্ঠতার বিচারে তিনিই সিংহাসনের অধিকারী। ব্যস, শুরু হয়ে গেল সংঘাত। সালতানাত দুই ভাগ হয়ে গেল।  মুরীদ নামক দুই পক্ষের পেয়াদারা একে অপরের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালো।  এরপর বংশ পরম্পরায় দুটি স্বাধীন `খানকা পাক' নিজ নিজ অবস্থানকে পোক্ত করার চেষ্টায় নিয়োজিত হলো। দুই তিন পুরুষ পরেও এখনো এই দুই পরিবারের মধ্যে দন্দ বিদ্যমান। এঁরা এখনো একে অপরের সাথে সম্পুর্ন্য সম্পর্ক ছিন্ন করে চলেছেন। অথচ এটা রাসুল (স:) এর হাদিসে পরিস্কার ভাবে বর্ণিত আছে, যা ইমাম বুখারী এবং মুসলিম বর্ণনা করেছেন `আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী কখনই বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না'

এবার একটু ইতিহাস ঘাঁটা যাক। কিভাবে এই হুজুরদের আবির্ভাব হলো আমাদের এই বঙ্গ মুল্লুকে? বড়পীর হজরত আব্দুল কাদের গিলানী (র:) এর বংশধরেরা ইসলাম প্রচারের জন্য আমাদের এই উপমহাদেশে আগমন করেন। তাঁরা মানুষকে ইসলামের ছায়াতলে আনার জন্য নিজেদের সুখ সমৃদ্ধি পরিত্যাগ করে দিন রাত মানুষের তথা ইসলামের সেবা করে গ্যাছেন। তাঁরা যে পদ্ধতি বা নিয়মের মধ্যে ইসলাম প্রচার তথা মানব কল্যানের কাজ করে গ্যাছেন তা ছিল সত্যি অনুকরনীয়। পরবর্তিতে তাঁদের দুই তিন পুরুষও একই পথ অবলম্বন করে কাজ করে গ্যাছেন।  কিন্তু যুগের এবং সংস্কৃতিগত পরিবর্তনের কারণে এই মহাপুরুষদের পরবর্তী বংশধরগণ হয়েছেন দিকভ্রান্ত এবং ধর্মকে নিয়ে গ্যাছেন ব্যবসায়ীক আঙ্গিকে। এই পরিবর্তনের কারণ গুলো আমি এই লেখার পরবর্তী অংশে কিছুটা বর্ণনা দেয়ার চেষ্টা করব।

একই ভাবে এই উপমহাদেশে এসেছিলেন শাহ জালাল (র:), শাহ ফারহান (র:)(শাহ পরান নামে পরিচিত), শাহ আলী (র:), বায়োজিদ বোস্তামী (র:) এবং আরও অনেকে। তাঁরা সবাই চির স্মরনীয় হয়ে আছেন তাঁদের কীর্তির মাধ্যমে। এই সমস্ত মহা মনীষীরা কেউই কোনো জাঁক জমকতার ধারে কাছে ছিলেন না। অতি সাধারণ জীবন যাপন করেছেন। পরবর্তিতে কিছু ধর্ম ব্যবসায়ী এই সব মহাপুরুষদের পুঁজি করে মাজার কেন্দ্রিক ব্যবসায় ফেঁদে বসেছেন।

আর বর্তমানে আমাদের দেশে যে সমস্ত পীর সাহেব দেখা যায়, এদের আবির্ভাব কিভাবে হলো আমার জানা নাই। এঁরা তো নিজেদের প্রচারে যে জৌলুসময় অনুষ্ঠান করেন তাতে যে অর্থ ব্যয় হয় সেটা কি আদৌ ইসলাম সম্মত? একবার ভেবে দেখবেন, প্যান্ডেল, মাইক আর আলোকসজ্জার পিছনে এই অর্থ ব্যয় না করে দরিদ্র মানুষের উপার্জনের কাজে সহায়তা করলে মহান আল্লাহ কি বেশি খুশি হবেন না?

এতো গেল হুজুরদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার সামন্ততান্ত্রিক প্রথার বিবরণ। এবার কিছুটা ব্যবসায়ীক দৃষ্টি ভঙ্গি  দিয়ে আলোচনা করা যাক। প্রতিটি ব্যবসারই মৌসুম থাকে, যেমন পোশাক ব্যবসায়ীদের থাকে ঈদ কিংবা পূজা মৌসুম, মাছ ব্যবসায়ীদের থাকে বর্ষা মৌসুম ঠিক সেই রকম এই ধর্ম ব্যবসায়ীদের থাকে আরবী মাসের হিসাব অনুযায়ী নানা মৌসুম।  এঁদের উপার্জনের পুরোটা জুড়েই থাকে মানুষ ঠকানো।  মানুষের বিশ্বাস এবং ধর্মীয় ভীতি প্রদশর্নকে পুঁজি করে অর্থ উপার্জন। নাজরানা হচ্ছে ডেইলি ইনকাম যা বাত্সরিক উপার্জনের একটি ক্ষুদ্র অংশ। মূল উপার্জনটা থাকে বছরে দুই একটি ওরস এর নামে বিশাল আয়োজন, সেখানে ভক্তরা ক্যাশ এবং কাইন্ড ফরম্যাটে নানা রকম ভেট প্রদান করে থাকে। হুজুরের উপার্জনকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করতে পারি একটা হলো ডাইরেক্ট ইনকাম আর অপরটা হলো ইনডাইরেক্ট ইনকাম। নজরানা, ওরস, তাবিজ ইত্যাদি হলো ডাইরেক্ট ইনকাম আর বেনামে মোমবাতি, আগরবাতি, তেল, বোতল, তদ্বির ইত্যাদির ব্যবসায় হল ইনডাইরেক্ট ইনকামের অন্তর্ভুক্ত।

মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে হুজুরের ইনকামের ইনক্রিমেন্ট হয় কিভাবে?  খুবই সহজ হিসাব –

হুজুরের ভক্তদের মধ্যে ধনী, গরিব, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত সব ধরনের মানুষই আছে।  যারা দরিদ্র অথবা অশিক্ষিত তারা তাদের ধর্ম ভীতি কিংবা অজ্ঞতার কারণে হুজুরের মুরিদ হন আর যারা ধনীক শ্রেণীর তাঁরা বেশির ভাগই দুর্নীতি পরায়ন। একদল ভয় পান পরকালের আর অন্যদল ইহকালের। হুজুর কিন্তু এই দুই দলেরই ইনস এন্ড আউটস সব জানেন। আপনি দরিদ্র ভক্ত, হুজুরের পায়ে পড়ে গেলেন একটি চাকুরীর আশায় দশ টাকা নজরানা দিয়ে।  হুজুর আপনাকে দোয়া করে দিলেন, মাথায় ফু দিয়ে দিলেন এবং বললেন `যা বেটা এক মাহিনার মধ্যে চাকুরী হয়ে যাবে'। এইবার কোনো উচ্চপদস্থ দুর্নীতিবাজ ভক্তকে বলে আপনার চাকুরীর ব্যবস্থা করে দিলেন পনের দিনের মধ্যে।  (আপনি কিন্তু ওই ধনী ভক্তকে চিনেনও না, কারণ হুজুর দর্শনের সময় কিন্তু আপনার সময় থেকে ভিন্ন, সব সময়)। আপনার চাকুরী হয়ে গেল।  মাসে বেতন দশ হাজার টাকা।  গতকালও আপনার এক পয়সা উপার্জন ছিল না।  আপনি তো মহা খুশি, আপনার ভক্তি বেড়ে গেল দশ হাজার গুন। আগে দিতেন দশ টাকা এখন প্রতিমাসে নজরানা দেবেন পাঁচশ টাকা।  আপনার বেতন বাড়বে, হুজুরের নজরানাও বাড়বে।  সহজ হিসাব। এতো গেল ক্ষুদ্র ইনকাম।  এইবার ধরেন কোনো এক দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী ভক্ত ট্যাক্স ফাঁকি দিবে দুই কোটি টাকা। নো প্রবলেম, হুজুর আছেন। আছেন আয়কর বিভাগের কোনো এক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা যিনিও কিনা হুজুরের মুরীদ।  বাকিটা মনে হয় বলতে হবে না, বুঝে গ্যাছেন। এই হুজুরদের কিন্তু আবার ব্র্যান্ড ভ্যালু আছে। যে ব্র্যান্ড এর প্রচার এবং প্রসার বেশী তাঁর ইনকামও তত বেশী।

একটু পড়াশোনা করলেই কিন্তু জানা যায় সত্যিকারের পীর বা আলেম কেমন হবেন। সাহাবায়ে কেরাম, খোলাফায়ে রাশেদীন, হজরত আব্দুল কাদের গিলানী, ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালেকি, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম হাম্বলী এই রকম আরও অগনিত মনিষীদের জীবনী কিংবা তাঁদের লেখা বইগুলো পড়লেই আপনার আর এইসব বর্তমান পীরদের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন পড়বে না।  তাঁরা কেউ হয়ত মেষ চড়িয়ে, কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসা করে আবার কেউ কৃষিকাজ করে ইসলামের সেবা করেছেন, মানুষকে আল্লাহর দিকে নিয়ে গ্যাছেন। কেউ টাকার বিনিময়ে ওয়াজ নসিহত করেননি, ওরস করেননি। মুরীদের শ্রেনী বিন্যাস করেননি অর্থ কিংবা ক্ষমতার মাপকাঠিতে।  তাঁরা ছিলেন প্রচার বিমুখ, নিভৃতে সাধনা করে গ্যাছেন আর মানুষকে শিখিয়েছেন কিভাবে আল্লাহ আর তাঁর রাসুল (স:) কে ভালবাসতে হয়।

হুজুরের কদম পাকে পড়ে না থেকে ইসলামের মূল বিষয় গুলো জানুন, পালন করুন আর মানুষের সেবা করুন তাতেই ইনশাআল্লাহ বেহেস্তবাসী হবেন,  আল্লাহর সাথে শিরক করে নয়। যে সময়টুকু খানকা শরীফে দিবেন তার বদলে দয়া করে পড়ুন এবং জ্ঞান অর্জন করুন দেখবেন বেহেস্ত আপনার জন্য অপেক্ষা করবে।  আপনারা তো আবার পড়তে চান না, শুধু তেল মালিশ করে শর্টকাট পথ পেতে চান।

এবার আসা যাক ধর্ম প্রচার এবং আচার পালনে আমাদের এই পরিবর্তনের কারণ আলোচনায়। প্রথমেই বলে নেই আমি কোনো আলেম নই, বিশিষ্ট জ্ঞানী ব্যক্তি নই। অতি সাধারণ একজন মানুষ এবং তার চেয়েও সাধারণ একজন মুসলমান। যদিও ধর্ম পালন অথবা মানুষ হওয়ার জন্য আলেম কিংবা মহাজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। আমি যা বলছি তা সম্পূর্ণ আমার নিজের ক্ষুদ্র জ্ঞান এবং কিঞ্চিত পড়াশোনা থেকে। কোনো ধর্ম বা ধর্মাবলম্বীকে আঘাত করা আমার লেখার উদ্দেশ্য নয়। যিনি যে ধর্ম গ্রহণ করেছেন তিনি সেই ধর্মের আচার পালন করবেন, কাউকে অপমান না করে। এটাই আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস।

মুসলমানরা আসার আগে আমাদের এই উপমহাদেশের পুরোটাই একসময় হিন্দু সংস্কৃতির ধারক ছিল। এই উপমহাদেশে এখন যারা মুসলমান তাঁরা প্রায় সবাই ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান। ফলে আমাদের ধর্মীয় পরিচয় পরিবর্তিত হলেও সংস্কৃতিগত কিছু বিষয় থেকে আমরা বের হতে পারি নাই।  যে সমস্ত আরব বা পার্সিয়ান মনীষী এই উপমহাদেশে এসেছিলেন ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে তাঁরা বা তাঁদের পরবর্তী দুই তিন পুরুষ পর্যন্ত্য সঠিক ইসলাম পালন হয়েছে। তারপর, মুসলমানরা ধীরে ধীরে তাদের ধর্মের সাথে স্থানীয় সংস্কৃতি এবং ধর্মের কিছু কিছু আচারের মিশ্রণ ঘটাতে শুরু করলো।

যেহেতু আমি অনেকদিন ধরে দেশের বাইরে আছি এবং মূলত ইসলাম প্রধান দেশে আমার অবস্থান, যেখানে অন্যান্য মুসলিম দেশের বন্ধুদের সাথে আমার ধর্ম নিয়ে কিছু আলোচনা হয় এবং আমি নিজ চোখে যা দেখতে পাই তার সাথে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের ইসলামের ব্যপক পার্থক্য দেখি। একটু খেয়াল করলেই পার্থক্যগুলোর ধরন এবং কারণ আমাদের কাছে পরিস্কার হবে।

এক:

ভারতীয় মুসলমানরা দেখলো হিন্দুদের সন্যাসী আছে অতএব আমাদের পীর বানাতে হবে। হিন্দুরা সন্যাসীদের যেমন ভগবানের মত শ্রদ্ধা করে, ভারতীয় মুসলমানরাও (বিশেষ করে পশ্চিম বঙ্গ এবং পূর্ব বঙ্গের কিছু অংশে) তেমনি তাদের পীরকে আল্লাহর রিপ্রেজেন্টেটিভ বানিয়ে ফেলল। অথচ অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রে আমাদের মত পীর প্রথা বিরাজ করে না।

দুই:

হিন্দুরা তাদের মৃত সন্যাসীর আখড়াকে ধর্মশালা বানিয়ে নানা রকম পূজা অর্চনা করে, গান বাজনা সহযোগে প্রার্থনা করে। অতএব মুসলমানরাও মৃত পীরের কবরকে মাজার আখ্যা দিয়ে সেখানে চাদর চড়ানোর নামে ইবাদত করতে শুরু করলো, কাওয়ালী নাম দিয়ে গান বাজনাকে ইসলামিক করে ফেলা হলো।

তিন:

কথায় আছে হিন্দুদের বারো মাসে তেরো পূজা, কিন্তু মুসলমানের বারো মাসে কেবল দুইটা ঈদ।  সুতরাং আমাদেরও উত্সবের সংখ্যা বাড়াতে হবে।দীপাবলীর আদলে আমরা শবে বরাত শুরু করলাম। আমাদের উপমহাদেশের মত শবে বরাত কোনো মুসলিম রাষ্ট্রে উদযাপিত হয় না। সেখানে মানুষ জন নিজেদের ঘরে কিংবা মসজিদে ইবাদত করে। কোনো বাজি ফোটানো, তারাবাতি, মোমবাতি জালানো অথবা ইবাদত না করে একগাদা খাবার বানানো আমি কোথাও দেখিনি বা শুনিনি।

চার:

জন্মাষ্টমী, ভগবান কৃষ্ণের জন্মদিন। বিশাল বড় উত্সব তাই আমরাও আমাদের পীরদের জন্মদিন পালন করতে শুরু করলাম জাঁক জমক ভাবে। যদিও ইসলামিক দৃষ্টিতে জন্মদিন কিংবা মৃত্যুদিনকে ঘিরে অতিমাত্রার আনন্দ বা শোক পালন করা নিষিদ্ধ। আমরা অবশ্যই মহাপুরুষদের স্মরণ করব আমাদের নিজস্ব আবেগ দিয়ে, লোক দেখানো উত্সবের মধ্যে নয়। তাঁদের বানী এবং কাজগুলো অনুসরণ করে তাঁদের মতাদর্শকে সম্মুনত রাখায় হবে তাঁদের প্রতি প্রকৃত ভালবাসা।

পরিশেষে বলতে চাই, আসুন আমরা সত্যিকারের ইসলামকে জানি, বুঝি এবং তারপর ধর্ম পালন করি। ধর্ম ব্যবসায়ীদের হাত থেকে আমরা নিজেরা যদি সরে না আসি তবে তাদের বিস্তার রোধ করা সম্ভব নয়।  কোনো দোকানে যদি ক্রেতা না যায় তবে কিছুদিন পর ওই দোকান বন্ধ হতে বাধ্য। কোনো তথাকথিত হুজুরের বাখ্যায় ধর্ম বুঝতে যাবেন না, যদি না সত্যিকারে হুজুর পান। সত্যিকারের হুজুরদের বিজ্ঞাপন লাগেনা, নসিহত করার জন্য কন্ট্রাক্ট করতে হয় না।  এঁরা আছেন আমাদেরই আশে পাশে, নিরবে, নিভৃতে। খুঁজে নেওয়ার দায়িত্ব আপনার, আমার।  আর সব থেকে বড় কথা নিজে পড়ুন এবং বুঝুন কারণ আমাদের নবীর (স:) উপর প্রথম যে শব্দটি নাজিল হয়েছিল তা হলো `ইক্করা' মানে `পড়ুন'।

আল্লাহ আমাদেরকে শিরক থেকে রক্ষা করুন এবং সঠিক পথ দেখান। আমীন।

——————————–

*খাতরা – আরবী শব্দ خطر (খতর), যার আভিধানিক অর্থ বিপদ। এঁরা মনে করেন হুজুর এবং তাঁদের পূর্ব কিংবা পরবর্তী পুরুষের কারো শানে কিঞ্চিত অসম্মান কিংবা বেয়াদবি করলে দুনিয়া এবং আখেরাতে সমূহ বিপদের সম্ভবনা আছে)