রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন: কতটুকু প্রয়োজনীয়?

সৈয়দ আশরাফ মহি-উদ্-দ্বীন
Published : 15 June 2016, 05:31 PM
Updated : 15 June 2016, 05:31 PM

আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে উপদল সমূহ রয়েছে দেশ পরিচালনায় তাদের ভূমিকা কতটুকু? যদি আমাদের প্রধান দুটি দলের কথা বিবেচনায় আনি, তবে দেখতে পাব এই দুই দলের যতগুলো উপদল আছে তা মনে রাখার জন্য যথেষ্ট স্মরণ শক্তির প্রয়োজন আছে। এই উপদলগুলোকে আবার দুইটি শ্রেনীতে ভাগ করা যেতে পারে, যেমন পেশাজীবি এবং পেশীজীবি।

পেশাজীবি যাঁরা, তাঁরা ঠিক কী কারণে এই রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড় বৃত্তি করেন তা মাথায় ঢোকে না।  এঁরা সংগঠন করবেন স্বার্বজনীন ভাবে, যেখানে তাঁদের পেশার সুবিধা অসুবিধার কথা আলোচিত হবে, তাঁদের উন্নতির কিংবা পেশার মান উন্নয়নের জন্য যে দলই সরকারে থাকুক তাদের কাছে দাবি দাওয়া পেশ করবেন দলমত নির্বিশেষে। এই শ্রেনীর মধ্যে শিক্ষক, সাংবাদিক, ডাক্তার, প্রকৌশলী আরও নানাবিধ পেশার লোকজন আছেন রাজনৈতিক দলের নামের সাথে নিজেদের নাম জুড়ে দিয়ে। একজন শিক্ষক সমগ্র জাতির শিক্ষক, একজন সাংবাদিক সমগ্র জাতির মুখপাত্র, বুঝতে পারি না এঁরা কেমন করে দলীয় ভাবধারায় দুই তিন ভাগ হয়ে যান।  `এ' দল ঘেঁষা পেশাজীবিরা তাঁর পক্ষের দলের কোনো দোষ ত্রুটি দেখতে পান না অথবা `বি' দল ঘেঁষা যাঁরা, তাঁরা তাঁদের দলের সবই গুন খুঁজে পান তা তাঁদের পেশার পক্ষে বা বিপক্ষে গেলেও। আসলে সবাই কেমন যেন সুবিধাবাদী হয়ে গেছে।

এরপর আছে পেশীজীবি সংগঠন। প্রত্যেক দলের অসংখ্য উপদল, উপ-উপদল বা তারও উপদল বিদ্যমান। এদের সংখ্যা যে কত বা কত ধরনের তা হিসাব রাখা কঠিন। দিন দিন আরও কত যে নতুন ভূঁইফোঁড় সংগঠন তৈরী হচ্ছে এই রাজনৈতিক দলগুলোকে অবলম্বন করে তা বোধ হয় সয়ং মূল দলগুলোই জানেন না। এদের মধ্যে মোটামুটি ছাত্র, স্বেচ্ছাসেবক, শ্রমিক এবং যুব এই বিভাগের সদস্যগণ পেশীবহুল বলেই মনে হয় এবং যথেষ্ট ক্ষমতা ধারণ করেন।

এই অঙ্গসংগঠন গুলোর কল্যানে আমরা আর কিছু পাই বা না পাই, অগুনিত ন্যাতা পেয়েছি। পাড়ায় মহল্লায় ন্যাতা, অলিতে গলিতে ন্যাতা, পথে, ঘাটে, হাটে সবখানে ন্যাতা গিজগিজ করছে। যে ছেলের কালকেও নাক টিপলে দুধ বের হত, গোটা তিনেক মিছিল করে তিনিও আজ ন্যাতা। `ন্যাতাদের' ভিড়ে আজকাল `নেতা' আর খুঁজে পাই না।

ছাত্ররা শিক্ষা তথা শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে সরকারের সাথে আলোচনা করবে, দেন দরবার করবে প্রয়োজনে আন্দোলন করে ন্যায্য অধিকার আদায় করে নিবে। অথচ তারা শুধুই দলীয় লেজুরবৃত্তিতে নিয়োজিত থেকে নিজেরা হানাহানি, খুনোখুনিতে ব্যস্ত। লেখাপড়া বন্ধ করে হলদখল, ক্যাম্পাস দখল খেলায় মত্ত। ছাত্র সমাজের নেতৃত্বে আবার এক দুই সন্তানের পিতার নামও দেখা যায়।

সেচ্ছাসেবক নামে সংগঠনটি, স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় কী সেবা যে দেশ ও জাতিকে দিয়ে যাচ্ছে তা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ বলতে পারবে বলে হয় না। শ্রমিক সংগঠনটির নেতারা মোটামুটি ভালই দিন গুজরান করেন আর যখনই তাঁর মূল দলের কোনো সভা সমাবেশ হয়, তখন মূল দলের বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে কিঞ্চিত অংশ সাধারণ শ্রমিকদের দিয়ে ওই সভায় লোক সমাগমের ব্যবস্থা করেন। এঁরাও দেশ ও জাতির কোন কল্যানে লাগেন তা বোধ করি কেউ বলতে পারবে না।

এরপর আছে যুব সমাজ। বছরের পর বছর এদেশের যুব সমাজ শুধুই ব্যবহৃত হয়েছে `এ' অথবা `বি' দলের রাজনৈতিক ক্রীড়ানক হিসেবে। যুব সমাজ তাদের মন এবং মেধা বিক্রি করেছে ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে। এদের নিজেদের বিবেক বা বুদ্ধির কোনো অস্তিত্ব ছিল বলে মনে হয়নি। মূল দলগুলোর তোষামোদ করে কেবল নিজেদের আখের গোছানোতে ব্যস্ত ছিল। এই যুব, সেচ্ছাসেবক, ছাত্র কিংবা শ্রমিক সংগঠনগুলি কেবল ব্যস্ত টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, মাস্তানি আর প্রতারণার ধান্দায়। আর ভোটের সময়, মারামারি, কাটাকাটি, কেন্দ্র দখল ইত্যাদিও এদের কর্মকান্ডের অন্তর্ভুক্ত। দেশ চালাবে সরকার তার রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে দিয়ে, সেখানে একটি রাজনৈতিক দলের এত অঙ্গ সংগঠনের অনুমোদন প্রদান কতটা যুক্তিযুক্ত তা হয়ত রাজনীতিবিদরাই বলতে পারবেন।  বাংলাদেশের মত এত অঙ্গসংগঠন সম্ভবত পৃথিবীর অন্য কোনো সভ্য দেশে বিরাজ করে না।

যুব সমাজের রাজনীতি বিমুখ অংশ কখনই তেমন ভাবে সোচ্চার হয় নাই জাতীয় কোনো বিষয়ে এবং এরা সর্বদা ধরি মাছ না ছুঁই পানি অবস্থাতেই দিন কাটিয়েছে শুধু হা হুতাশ আর বিষোদ্গার করে। এরা চেষ্টা করেছে কোনরকমে লেখাপড়া শেষ করে হয় প্রবাসী হতে নতুবা দেশে কোনো একটা গতানুগতিক চাকুরী যোগাড় করে ঘর গেরস্থ করতে।   গত কয়েক বছর ধরে যুবসমাজের একটি অংশ প্রতিবাদের সূত্রপাত করেছে, রাষ্ট্রীয় এবং রাজনৈতিক সংস্কারের দাবি তুলেছে, বিচার হীনতার বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে তাদের লেখনীর মাধ্যমে। এই প্রতিবাদে কোনো শারীরিক বলপ্রয়োগ নেই, ভাংচুর নেই, ভীতি প্রদর্শন নেই।  কিন্তু আছে প্রবল শক্তি যা ঐসকল মাস্তান যুব শক্তির চেয়ে কার্যকর।

তথ্যের অবাধ প্রবাহ এই সকল চিন্তার দ্রুত বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে এবং সাধারণ মানুষের কাছে ধীরে ধীরে অনেক কিছু পরিস্কার হয়ে যেতে থাকে। মানুষ বুঝতে শেখে এবং ভালোকে গ্রহণ ও মন্দকে বর্জন করতে সচেষ্ট হয়, যা কিনা অনেকের চক্ষুশুলের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সবসময় সচেষ্ট এই উত্থান ঠেকাতে।  তা সে দেশী কিংবা অন্যদেশের রথী মহারথীরা যেই হোন না কেন। ক্ষমতা এমন এক নেশা, যা মানুষের বিবেক, মনুষত্ব সবকিছুকে নিঃশেষ করে দেয়।  যারা এতদিন এই সব যুবসমাজকে নিজেদের আস্তিনের মধ্যে ভরে রেখেছিল, তাদের মনে ভয় ধরে গেল।  অতএব, এই উত্থানকে ঠেকাতে শুরু হলো নানা ধরনের খেলা।  ভাঙ্গন শুরু হলো বিভিন্ন রাজনৈতিক রসায়নে।  নতুন এই যুবসমাজের কেউ কেউ দেশী এবং বিদেশী ফাঁদে পা দিল নিজেদের ভবিষ্যত গড়ার লক্ষ্যে। ধর্মীয় উস্কানিমূলক বক্তব্য কিংবা লেখনীর মাধ্যমে নিজেকে প্রমান করার চেষ্টা করলো অতি প্রগতিবাদী। বিশ্ব মাতব্বররা আশ্বাস দিলেন তাদের ভয় নেই, উনারা পাশে আছেন, প্রয়োজনে সকলকে তাঁদের দেশে আশ্রয়ের সুযোগ করে দিবেন।  সুতরাং ধর্মের নামে বিষোদ্গার রুপান্তরিত হলো খিস্তি খেউড়ে। অপরদিকে একই শক্তি পিছনের দরজা দিয়ে উস্কে দিল ধর্মীয় দল গুলোকে।  তারপর নিজেরা মেতে উঠলাম উত্থান এবং দমনের খেলায়। এ খেলা চলছে তথাকথিত সভ্যতার শুরু থেকে তবে এর শেষ কোথায় জানা নেই।

আশার কথা হলো, এই স্বার্থান্বেষী লোকগুলো সংখ্যায় নগন্য এবং পাশাপাশি সচেতন যুবসমাজ এখনো তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে পরিবর্তনের লক্ষ্যে। এই পরিবর্তন শীঘ্র না ঘটলেও অদূর ভবিষ্যতে যে ঘটবে না, সে কথা নিশ্চয় করে বলা যাবে না। স্রোতের বিপরীতে পাল তুলেছে যে যুবক, তার নৌকার হালটাকে শক্ত ভাবে ধরবার জন্য দরকার একজন সবল, নিষ্ঠাবান মাঝির। যে হবে নতুন প্রজন্মের কান্ডারী, বদলে দেবে সমাজ এবং রাষ্ট্রকে। অপেক্ষায় আছি কোনো এক নতুন নিস্বার্থ নেতার আবির্ভাবের। নেতা কি আসবে?