বর্তমান সময়ে চা পান করেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। সকালে ঘুম থেকে উঠে এক কাপ গরম চা না হলে আড়ষ্টতা কাটানো অনেকের জন্য বেশ মুশকিল। অতিথি আপ্যায়নেও চায়ের জুড়ি নেই। ছেলে বুড়ো সকলেই চায়ের ভক্ত। আজকাল তো চায়ের নানা ধরণ আছে। স্বাদের ভিন্নতা, গন্ধের ভিন্নতা এমনকি চা বানানোরও আছে আলাদা আলাদা স্বকীয়তা। দেশ অথবা জাতিভেদে পরিবেশনাও ভিন্ন। অনেকের আবার সবার বানানো চা মুখে রুচে না। কেউ বলেন মায়ের হাতের চাই ভালো, কেউ বলেন আমার স্ত্রী চমৎকার চা তৈরী করে। কারো কারো চা আবার বিস্বাদ লাগে। সন্ধে বেলায় বারান্দাতে আরাম কেদারায় বসে এক কাপ ধূমায়িত চা কিন্তু বড়ই রোমাঞ্চকর। চা এখন জীবনের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। আজ না হয় চায়ের ইতিহাস নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। চা কবে থেকে এলো, কেমন করে এলো কিংবা কোথা থেকে এলো? জানা যাক এর পথ পরিক্রমা।
চীনা সম্রাট শেন নাং
খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৩৭ সালের কথা, চীনা সম্রাট শেন নাং তাঁর ভৃত্য পরিবেষ্টিত হয়ে জঙ্গলে গেছেন আনন্দ ভ্রমণে। ভৃত্যরা সম্রাটের জন্য খাদ্য প্রস্তুতে ব্যস্ত। হঠাৎ অজান্তে এক নাম না জানা অচেনা পাতা ফুটন্ত পানির মধ্যে পড়ে গেলো। সম্রাটকে যখন সেই পানীয় পরিবেশন করা হলো, সম্রাট তার স্বাদ পেয়ে তো মহা খুশী। সঙ্গে সঙ্গে আদেশ দিলেন অধিকতর তদন্ত করার জন্য যে, এই পাতা কী? কোথায় মিলবে এবং আর কিভাবে এর ব্যবহার করা যাবে? জন্ম হলো এক নতুন পানীয়র। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই চা এর ঔষধী গুণাবলীর স্বীকৃতি পেলো যা পরবর্তীতে চীনা পন্ডিত কর্তৃক অমরত্বের স্পর্শমনি হিসাবে বর্ণিত হয়েছিল।
চীনাদের চা পরিবেশন
খ্রিষ্টাব্দ ৪০০ শতকে চীনা অভিধানে চা স্থান পায় `কুয়াং ইয়া' নামে। সেইসাথে বর্ণনা দেওয়া হয় চা তৈরীর পদ্ধতি। ৪০০ থেকে ৬০০ খ্রিষ্টাব্দ, এই সময় কালে চীনারা শুরু করে নানা রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা। এরা চায়ের সাথে আদা, নানা রকম মশলা এবং কমলার রস মিশিয়ে চাকে আরও সুস্বাদু করার চেষ্টা করে। সেই সময় থেকে চীনারা বিশ্বাস করতে শুরু করে, চা হচ্ছে রোগ নিরাময়ে এক মহৌষধ।
৪৭৯ খ্রীষ্টাব্দের দিকে চায়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পরে তুরস্ক পর্যন্ত এবং শুরু হয় চায়ের ব্যবাসায়ীক লেনদেন। ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে চায়ের ইতিহাস ছড়িয়ে পরে চীন থেকে জাপান পর্যন্ত যেখানে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা চা পানে আসক্ত হয়ে পড়েন। এই জাপানি ভিক্ষুরা প্রায় তাঁদের ভ্রমণের সময় চায়ের বীজ বহন করার স্বাক্ষী হয়ে আছেন।
৬৪৮ থেকে ৭৪৯ খ্রিষ্টাব্দ, এই সময়কালে গোয়োকি নামে এক জাপানি ভিক্ষু ৪৮ টি বৌদ্ধ মন্দিরে চা বাগান করার স্বীদ্ধান্ত নেন। সেই সময় জাপানের সাধারণ মানুষ চা সমন্ধে কিছুই জানতো না। চা পান সীমাবদ্ধ ছিল শুধুমাত্র উচ্চ পর্যায়ের ভিক্ষু এবং সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে।
জাপানিদের চা পরিবেশন
৭২৫ খ্রিস্টাব্দে চীন সম্রাট সরকারী ভাবে এই পানয়ীর নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম করেন `চা' যা আজকে পৃথিবীর অনেক দেশে একই বা কাছাকাছি নামে পরিচিত। আমরা বাঙালিরা বলি চা; হিন্দি, উর্দু, ফার্সি, কুর্দি, বসনিয়ান, আজারবাইজান, তুর্কি এবং আরও অনেক ভাষায় বলে চায়ে, আরবীতে যেহেতু চ বর্ণ নেই তাই তারা বলে শায়ে। আর জাপানিরা বলে `অচ্চা'।
৭২৯ খ্রীষ্টাব্দের দিকে জাপানিরা তৈরী করে গুঁড়ো চা, জাপানি ভাষায় যাকে বলা হয় `হিকি অচ্চা'। এই গুঁড়ো চা বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং জাপান সম্রাটের কাছে অতি প্রিয় পানীয় বলে বিবেচিত হতো। ৭৮০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে চা পুরো চীনে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে এবং চীন সম্রাট জনগণের উপর চা কর প্রবর্তন করেন।
৭৮০ খ্রিস্টাব্দে তাং রাজবংশের সময় চীনা কবি লু ইউ, চা নিয়ে সর্ব প্রথম একটি প্রবন্ধ লিখেন `চা জিং' (চা ক্লাসিক) নামে। তখন থেকে প্রতি বসন্তে চীনা কৃষক কর্তৃক সম্রাটকে তাদের উৎপাদিত সর্বোৎকৃষ্ট চা উপহার দেয়ার প্রচলন শুরু হয়। তখনকার দিনে পরিবহনের সুবিধার্থে চা পাতাকে দুই ইঁটের মাঝখানে ফেলে টুকরো করা হতো। তারপর সুবিধামতো এই চা পাতার টুকরো গুলোকে গুঁড়ো করা হতো।
চায়ের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে তাং রাজবংশের লু তাং লিখেছিলেন :
"প্রথম পেয়ালা ভেজায় আমার ওষ্ঠ এবং কণ্ঠ;
দ্বিতীয় পেয়ালা ঘোঁচায় আমার একাকীত্ব;
তৃতীয় পেয়ালা খুঁজে ফিরে আমার অনুর্বর রন্ধ্র আর তুলে আনে সহস্র ভুলে যাওয়া স্মৃতি;
চতুর্থ পেয়ালা করে কিঞ্চিৎ ঘর্মাক্ত আর জীবনের ভুলগুলো বেরিয়ে যায় লোমকূপ দিয়ে;
পঞ্চম পেয়ালায় হয়ে যায় শুদ্ধ আমি;
ষষ্ঠ পেয়ালা আমায় ডেকে নেয় অমরত্বের রাজ্যে।
সপ্তম পেয়ালা – আহ্ !, আর তো পারি না সইতে আমি !
আমার দুই বাহু ছুঁয়ে যাওয়া শীতল বাতাসের নিঃস্বাস টের পাই কেবলই।
দিব্যধাম কোথায়? এই মৃদুমন্দ বাতাসে আমাকে উড়িয়ে নাও সেথা আর আর ছিটিয়ে দাও এর শীতলতা"।
১৬১৮ সালে রাশিয়া সর্বপ্রথম চায়ের সাথে পরিচিত হয়। চীনা রাষ্ট্রদূত রাশিয়ার জার এলিক্সারের জন্য উপহার হিসেবে নিয়ে যান চা এবং জার তা প্রথমে গ্রহণ করলেও এর মূল্য না জানার কারণে তা ফেরতও দেন।
১৬০০ শতকে চা পা রাখে পশ্চিমাদের উঠোনে। তখন কেবল সুগন্ধীযুক্ত সবুজ চাই ছিল তাঁদের তৃষ্ণা নিবারণের উপায়। এখনকার মতো মোটা দানার কালো চা বা ব্ল্যাক টি তখনও আবিষ্কার হয়নি। এই শতকেই শুরু হয় চায়ের একচেটিয়া বানিজ্যিকরণ। বেনীয়া গোষ্ঠী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ১৬৬৪ সালে ব্রিটিশ রাজা এবং রানীর জন্য উপহার হিসেবে নিয়ে আসে চা। ১৬৬৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী সরকারকে বুঝিয়ে, সকল চা আমদানীকারককে নিষিদ্ধ করাতে রাজি করে এবং নিজেরা একচেটিয়া আমদানিকারক হিসেবে আবির্ভুত হয়। ১৭০০ শতাব্দীতে একজন ইংরেজ বছরে গড়ে দুই পাউন্ড চা পান করতো যা পরবর্তী দশ বছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল পাঁচ গুণ।
বোস্টন (তৎকালীন ব্রিটিশ আমেরিকা) শহরে চা উৎসব
১৮০০ শতকের মাঝামাঝি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী চীনের সাথে তাদের চায়ের বাণিজ্য সম্পর্ক হারায় তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্লস গ্রে কর্তৃক প্রণীত একটি আইন দ্বারা। পরবর্তীতে চার্লস গ্রে আর্ল গ্রে উপাধি প্রাপ্ত হন এবং চায়ের একটি ব্লেন্ডও তৈরী হয় আর্ল গ্রে নামে।
চীনের সাথে বাণিজ্য হারানোর পর ব্রিটিশরা রবার্ট ফরচুন নামে একজন ব্যক্তিকে চীনা পোশাক পরিয়ে নিষিদ্ধ চা অঞ্চল চীনে পাঠায়। রবার্ট ব্যাটা খুবই সতর্কতার সাথে চীনে চা উৎপাদন পর্যবেক্ষণ করে এবং যথেষ্ট পরিমান চায়ের বীজ নিয়ে ব্রিটিশ ভারতে ফেরত আসে। ১৮৩৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ভারতের আসাম অঞ্চলে চা রোপন এবং উৎপাদন শুরু করে। এবং ১৮৩৯ সালে তারা মোটামুটি উন্নত প্রজাতির কালো চা বা ব্ল্যাক টি উৎপাদন করতে সক্ষম হয়। ব্ল্যাক টি'র একটি নতুন বাজার তৈরী হলো যা ভারতে উৎপাদিত এবং যা ছিল চীনের চাইতে উন্নত মানের মোটা দানার কালো চা। যদিও এই উৎপাদন একটি সাফল্য বলে বিবেচিত হয়েছিল কিন্তু এই কালো চায়ের স্বাদ ছিল চীনে উৎপাদিত কালো চায়ের চাইতে কিছুটা তিক্ত, ফলে এর স্বাদ বৃদ্ধিতে প্রয়োজন ছিল আরও গবেষণা।
সময়ের সাথে সাথে চা আরও মিহি হতে থাকলো এবং ব্রিটিশ রাজের প্রথম চা লন্ডনে বিক্রি হলো ১৮৩৯ সালে। দিনে দিনে ভারতের চা আরও উন্নত হতে থাকলো এবং ১৮৮৬ সাল নাগাদ ব্ল্যাক টি'র বাজার দখল করে নিলো। ঠিক এই বছরেই চীন তার কালো চায়ের মুকুট হারালো।
চায়ের বিখ্যাত ব্র্যান্ড `লিপ্টন'
একসময় ইংলিশ চা ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠলো এবং ইংল্যান্ডের অনেক পরিবার চায়ের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়লো শুধু ইংল্যান্ডের চায়ের বাজারকে কেন্দ্র করে। এই পরিবার গুলোর মধ্যে প্রসিদ্ধ কয়েকজন হলো – টুইনিংস পরিবার, দ্য জ্যাকসন্স অফ পিকাডিলি পরিবার এবং সর্বশেষ স্কট থমাস লিপ্টন পরিবার। এই প্রত্যেকটি পরিবারের নাম এখন একেকটি বিখ্যাত ব্র্যান্ড। লিপ্টন এবং সিলন নামটি মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে গেলো। লিপ্টন ছিলেন একজন সাধারণ মুদি দোকানী যিনি শুধু সিলন (বর্তমানে শ্রীলংকা) থেকে চা আমদানী করে নিজের নাম কে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায় এবং বাকিটা এখন কেবল ইতিহাস।
সেকালের টি ব্যাগ
একালের টি ব্যাগ
আজকাল টি ব্যাগের ব্যাপক প্রচলন হয়েছে। এই টি ব্যাগের উদ্ভব নিয়েও আছে একটি মজার ঘটনা। ১৯০৮ সালের কথা, নিউ ইয়র্কের চা ব্যবসায়ী থমাস সুলিভ্যান ছোট ছোট সিল্কের কাপড়ে তৈরী পুঁটুলিতে করে চায়ের নমুনা তাঁর কোনো এক ক্রেতার কাছে পাঠান। ক্রেতা ভদ্রলোক চা সমেত ওই সিল্কের পুঁটুলি গরম পানিতে দিয়ে চা বানানোর চেষ্টা করেন। এই শুনে সুলিভ্যান সাহেবের মাথায় চলে আসে টি ব্যাগের ধারণা।
ভারতে চা উৎপাদিত হলেও তখনকার ভারতীয়দের কিন্তু চা পানের অভ্যেস ছিল না। কথিত আছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী নাকি পথে পথে বিনামূল্যের চায়ের দোকান বসিয়ে আমাদের চায়ের প্রতি আকৃষ্ট করে তুলে। আর আজ রাস্তায় দাঁড়িয়ে এক কাপ চা খেতে আমরা অর্থ ব্যয় করি বিনা দ্বিধায়।
ভারতের আসাম ছাড়াও আমাদের বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ববঙ্গ) সিলেট অঞ্চলে শুরু হয়েছিল চায়ের উৎপাদন। বাংলাদেশ আজ অন্যতম ভালো চা উৎপাদনকারী দেশের একটি। ১৯১০ সাল নাগাদ ভারতের পাশাপাশি সুমাত্রা, ইন্দোনেশিয়াও শুরু করে চায়ের উৎপাদন এবং রপ্তানী। এছাড়াও কেনিয়া এবং আফ্রিকার কিছু কিছু অংশ চা উৎপাদন এবং রপ্তানীর সাথে জড়িত।
চায়ের জনপ্রিয় কয়েকটি ব্র্যান্ড
যেকোনো মৌসুমেই চা একটি সুস্বাদু পানীয় তা সে বরফ শীতল কিংবা গরম যেমনই হোক। আর এর উপকারিতা আপনার দেহ এবং মনকে চাঙ্গা করা ছাড়াও আরও বিস্তৃত। বেশ কিছু গবেষণা থেকে জানতে পারি, চা পান আপনার স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্যও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
এইবার দেখে নেই বিশ্বের বিশটি বৃহৎ চা পানকারী দেশের নাম এবং জনপ্রতি চা পানের বাৎসরিক পরিমান-
অবাক করার মতো বিষয় হলো উপরের বিশ দেশের তালিকায় চীন, জাপান আর ভারতের নাম নেই। এই রিপোর্ট অনুযায়ী জাপানের অবস্থান হলো ২৪ নম্বরে (০.৯৯ কেজি), চীন ৩৩ নম্বরে (০.৮২ কেজি), ভারত ৪৩ নম্বরে (০.৭০ কেজি) এবং আমাদের বাংলাদেশের অবস্থান ৬৫ নম্বরে (০.৩৬ কেজি)।
মানচিত্রে চা পানকারী দেশ সমূহ
আবিস্কারের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত, চা মানুষের জীবনে জটিল ভূমিকা রেখে চলেছে এবং নিজেই নিজের ইতিহাস তৈরী করেছে। চায়ের ইতিহাস হচ্ছে মজার মজার তথ্যে ভরপুর এবং কখনো তা ম্লান হবার নয়।
আশাকরি চায়ের ইতিকথা পড়তে খারাপ লাগেনি। আর যদি ভালো না লেগে থাকে তবে এক কাপ চা নিয়ে আবার বসে যান পড়তে। চায়ের প্রতিটি চুমুক আপনার আনন্দ এবং সুস্বাস্থের জন্য উৎসর্গকৃত।
___________________________________________
সূত্র সমূহ:
ছবি: গুগল থেকে সংগৃহিত