তথ্যের অবাধ প্রবাহ: সীমারেখা জরুরী

সৈয়দ আশরাফ মহি-উদ্-দ্বীন
Published : 6 Oct 2016, 03:51 PM
Updated : 6 Oct 2016, 03:51 PM

সময়ের পরিবর্তন হচ্ছে সময়ের নিয়মে। আমরা ইচ্ছে করলেই এই পরিবর্তন ঠেকাতে পারবো না। ঠেকাতে চাইও না। সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হচ্ছে মানুষের জীবনাচার, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ।  তথ্যের অবাধ প্রবাহ মানুষকে প্রতিনিয়ত হালনাগাদ করে তুলছে।  আর এই তথ্য প্রবাহের বর্তমান প্রধান উৎস হচ্ছে ইন্টারনেট।  এই ইন্টারনেট বা ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব পুরো পৃথিবীর মানুষকে জড়িয়ে ফেলেছে একটি জালের মধ্যে।  এই ইন্টারনেট এর যেমন অবাধ বিচরণ রয়েছে তেমনি সমাজ বা রাষ্ট্রীয় ভাবে রয়েছে এর নিয়ন্ত্রণও।

তথ্য অবাধ হওয়ার যেমন প্রয়োজনীয়তা আছে তেমনি এর নিয়ন্ত্রণেরও প্রয়োজন আছে বয়স এবং অবস্থান ভেদে। নইলে এর অপব্যবহারের আশংকা রয়ে যায়।  ভুল তথ্য মানুষ তথা সমাজ এবং রাষ্ট্রকে নিয়ে যায় ভুল পথে, পরিণামে ক্ষতি বৃদ্ধি হওয়ার সমূহ সম্ভবনা থেকে যায়।  সব তথ্য সবার জন্য নয় এই বিষয়টি আমাদের বুঝতে হবে নিজেদের স্বার্থে।

বর্তমান সময়ে শুধু বাংলাদেশ নয় বরং সমস্ত পৃথিবী জুড়ে খুন, রাহাজানি, জঙ্গীবাদ, ধর্ষণ ইত্যাদি অপরাধ বেড়েছে বহুগুনে। অনেকে হয়তো বলবেন, এগুলোকি আগেও ছিল না?   ছিল, তবে এইরকম মহামারী আকারে নয়।  এখন প্রতিদিনের খবরের কাগজ খুললেই ভালো খবরের তুলনায় এইধরণের খবরের আধিক্যই নজরে আসে।

ইন্টারনেটে তরুণ সমাজ এখন সহজেই জেনে যায় সন্ত্রাসের নতুন নতুন কৌশল।  অতি সাধারণ জিনিস দিয়ে কিভাবে বোমা বানানো যাবে এই বিষয়টি জানতে যদি একবার গুগলে গিয়ে সার্চ দেন দেখবেন হাজার হাজার লিংক চলে এসেছে আপনার চোখের সামনে। একটি মিথ্যা এবং বানোয়াট তথ্য কোনো রকম যাচাই না করে মানুষকে করে তোলে হিংস্র, শুরু হয় ধর্মীয় এবং জাতিগত বিদ্বেষ-সহিংসতা ।

ধর্মের অপব্যাখ্যা খুব সহজেই পৌঁছে দেয়া যায় সব শ্রেণীর মানুষের কাছে, যে লোকটা শুধু মাত্র লিখতে বা পড়তে পারে কিন্তু কোনো জ্ঞান বা সাধারণ বুদ্ধি নেই এমন মানুষ ওই ব্যাখ্যাটাকে আঁকড়ে ধরে স্বর্গ লাভের উদ্যেশ্যে আকৃষ্ট হয় জঙ্গীবাদের দিকে।

ইন্টারনেটের আরেকটি ভয়াবহ দিক হচ্ছে সেক্স বা যৌনতা।  পাঁচ বছরের একটি শিশুও এখন জানে যৌন মিলনের কলাকৌশল। আমার খুব মনে পরে আশির দশকে আমরা যখন কিশোর ছিলাম, সেই সময় বাংলাদেশ টেলিভিশনে মাসে একবার বাংলা সিনেমা দেখানো হতো। রাজ্জাক শাবানার আলিঙ্গন দৃশ্য আমাদের অপ্রস্তুত করতো মা বাবার সামনে। আর আজকে বলিউড কিংবা হলিউড মুভিতে যেসব ঘনিষ্ট দৃশ্য দেখানো হয় তা কোনো ভাবেই পরিবারের সকলে মিলে দেখার যোগ্য নয়, অথচ আমরা আজ তা গোগ্রাসে গিলছি।

হয়তো অতি প্রগতিবাদীরা একে স্বাভাবিক ভাবেই নিবেন এবং এর বিরুদ্ধে কিছু বললে মৌলবাদী তকমা লাগিয়ে দিবেন। কিন্তু একবারও ভেবে দেখেছেন কি আপনার সন্তানের ভবিষ্যতের কথা?  কয়েকদিন আগে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠন পর্নোগ্রাফী নিয়ে একটি রিপোর্ট করেছে, যাতে বলা হচ্ছে বাংলাদেশে স্কুলগামী শিশুদের প্রায় ৭৭ শতাংশ নিয়মিত পর্নগ্রাফি দেখছে। এই শিশু কিশোররা যখন তরুণ হবে তখনকার পরিস্থিতি একবার চিন্তা করুন।

আমি মনে করি প্রত্যেকটি মানুষের প্রতিটি বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের অধিকার আছে।  তবে তা যেন সে যোগ্য শিক্ষক এর কাছ থেকে পেয়ে থাকে।  যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণের মতো অপরাধকে কমিয়ে আনতে আমাদের সন্তানদের এই সম্পর্কে সঠিক শিক্ষা প্রদান করতে হবে বয়স উপযোগী করে।  এগারো বছরের শিশু যদি সানি লিওনির কাছ থেকে যৌন শিক্ষা গ্রহণ করতে যায় তবে পরিণতি কী হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পর্নোগ্রাফী আজ একটি ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে এবং দিনদিন এটি ক্যান্সারে রূপ নিবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।  ধর্মীয় গ্রন্থ এবং ইতিহাস থেকে জানা জানা যায়, বিকৃত যৌন আচরণ কিভাবে বিভিন্ন জাতিকে ধ্বংস করেছে।  আমরা যদি এখনই সঠিক ব্যবস্থা না নিতে পারি তবে আমাদেরও ধ্বংস অনিবার্য।

আমি কোনোভাবেই বলছিনা যে, ইন্টারনেট ব্যবহার বন্ধ করে দিতে হবে কিংবা তথ্যের প্রবাহকে রোধ করতে হবে। বরং রাষ্ট্রীয় ভাবে বিপদজনক সাইট গুলোকে চিহ্নিত করে তা ব্লক করা উচিত বলে আমি মনে করি। যে সব তথ্য আমার সামাজিক এবং পারিবারিক মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক,  মানুষকে সন্ত্রাস বা জঙ্গীবাদের দিকে আকৃষ্ট করে, হত্যা, ধর্ষণের মতো অপরাধকে আরও সমৃদ্ধ করে সেই সব সাইট রাষ্ট্রীয় ভাবে বন্ধ করে দেয়া উচিত যত দ্রুত সম্ভব। পৃথিবীর বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র আছে যারা এইসমস্ত সাইটগুলো ইতোমধ্যে বন্ধ করেছে।  আবার অনেক রাষ্ট্র তা বন্ধ করতে গিয়েও পারেনি অতি প্রগতিবাদীদের আন্দোলনের মুখে।  ভারত সম্প্রতি আটশোরও বেশী পর্নোগ্রাফিক ওয়েব সাইট বন্ধ করেছিল, কিন্তু সে দেশের কিছু সংখ্যক প্রগতিবাদীদের আপত্তিতে তা তুলে নিতে বাধ্য হয়।

ফ্রিডম অফ ইনফরমেশনের নামে যাঁরা গলা ফাটাচ্ছেন তাঁরা কি ইনফরমেশনের ভালো মন্দ দিকগুলো নিয়ে কখনো চিন্তা করেছেন? আপনাদের প্রতি পূর্ণ সম্মান রেখে বলি, আপনাদের শিশু পুত্রের হাতে সুস্থধারার খেলনার বদলে তুলে দিন স্টেনগান কিংবা রিভলবারের রেপ্লিকা আর কন্যাকে দিন বার্বি ডলের বদলে সেক্স টয়স। আমার কোনো আপত্তি নেই আপনার চিন্তাধারায়। কিন্তু আপনার চিন্তাধারা যদি গোটা সমাজের জন্য ক্ষতিকারক হয় তবে আমি তা মানতে নারাজ।  আপনার সন্তান বড় হয়ে রবীন্দ্রনাথ হবে নাকি রসময় গুপ্ত হবে তা আপনার এবং আপনার সন্তানের স্বাধীনতা ।

আমি চাই আমার সন্তান এমন তথ্য গ্রহণ করুক যা থেকে সে শিখবে মানবিক মূল্যবোধ, সামাজিক শিষ্টাচার।  ইতিহাসের তথ্য থেকে সে শিক্ষা নিবে শান্তির, সম্মৃদ্ধির। আমি চাই না আমার সন্তানের কাছে এমন তথ্য পৌঁছে যাক যা থেকে সে শিখবে বোমা বানানোর কারিগরি বিদ্যা, মানুষ মারার নির্মম কৌশল, পশুর সাথে যৌনাচার।

আমার সন্তান যেন ভবিষ্যতে দাউদ ইব্রাহিম না হয়, চার্লস শোভরাজ না হয়, না হয় সানি লিওন কিংবা এদের মতো কেউ। এমন তথ্যের অবাধ প্রবাহ চাই যাতে থাকবে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শেক্সপিয়র, শেলী, চে গুয়েভারা, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, তিতুমীর, সুভাষ চন্দ্র, ইবনে সিনা, নিউটন ।  জানবে সব ধর্মের প্রবর্তকের জীবনী, তাঁদের কর্ম, তাঁদের উপদেশ।  শিখবে ইতিহাস, ভূগোল, সভ্যতা, বিজ্ঞান।

পরিশেষে, সংশ্লিষ্ট মহলের নিকট অনুরোধ জানাই তাঁরা যেন সেই সমস্ত সাইট গুলো বন্ধ করার উদ্যোগ নেন যেগুলো মানুষকে সন্ত্রাস শিক্ষা দেয়, মানুষ মারার বিদ্যা শিক্ষা দেয়, বিকৃত যৌনাচার শিক্ষা দেয়। আর দয়া করে বন্ধ করবেন না মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা, তথ্যের স্বাধীনতা, যদি না তা অন্যের কিংবা সমাজের জন্য ক্ষতিকারক হয়।