ভারতীয় উপমহাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের জন্ম: চলচ্চিত্র কিভাবে মুম্বাই এলো

সৈয়দ আশরাফ মহি-উদ্-দ্বীন
Published : 13 Dec 2016, 07:09 AM
Updated : 13 Dec 2016, 07:09 AM

আজকের এই দিনে বলিউডের শাহরুখ খান, সালমান খান কিংবা আমাদের ঢালিউডের শাকিব খান, রিয়াজ, ফেরদৌস এঁরা যথেষ্ট জনপ্রিয় এবং কারো কারো অনুকরণীয়ও বটে। কত সহজেই আমরা ভারতীয় এবং বাংলাদেশের চলচ্চিত্র উপভোগ করি। আধুনিক টেকনোলজি আর বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে এই সব চলচ্চিত্র যেমন আয় করে প্রচুর অর্থ তেমনি দর্শক উপভোগ করেন এর সমস্ত আনন্দ। কিন্তু এই উপমহাদেশে চলচ্চিত্রের আগমন এতো সহজ ছিল না।  যাঁদের কল্যানে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প আজকের এই অবস্থানে আসতে পেরেছে তাঁদের কয়জনের নাম আমরা জানি কিংবা কেমন ছিল এর শুরুর ইতিহাস? `হীরালাল সেন' সেই অগ্রনায়কদের একজন যাঁর জন্ম আমার এই বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ জেলায়। ভারতীয় চলচ্চিত্রের সেই ইতিহাস নিয়ে আজকের এই রচনা।

হীরালাল সেন ১৯১৭ সালের অক্টোবরে যখন অসুস্থ, দেউলিয়া এবং মৃত্যুর ঠিক কয়েকদিন বাকি ঠিক সেই সময় তাঁর কাছে এলো বেশ কিছু দুঃসংবাদ। তাঁর ভাইয়ের ওয়্যার হাউসে আগুন লেগে সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, ফলশ্রুতিতে একজন চলচ্চিত্রকার হিসেবে হীরালাল সেনের কর্মজীবনের প্রায় পুরোটাই আগুনে পতিত হলো। এই ওয়্যার হাউসে ছিল রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানীর সমস্ত প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, সেন ভাইদের তৈরী এবং আমদানিকৃত চলচ্চিত্র যা তাঁরা বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে কলকাতায় তৈরী করেছিলেন এবং কলকাতার মানুষদের দেখাতেন।  এই অগ্নী দুর্ঘটনা সেনের চলচ্চিত্র ধ্বংস করার সাথে সাথে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম দিককার সিনেমা ইতিহাসের অনেক প্রমানকেও ধ্বংস করেছে।

হীরালাল সেন

জন্ম: ১৮৬৬, মানিকগঞ্জ, তৎকালীন পূর্ববঙ্গ, ব্রিটিশ ভারত

মৃত্যু : ১৯১৭, কলকাতা, পশ্চিম বাংলা, ব্রিটিশ ভারত

ভারতীয় চলচ্চিত্রের শতবর্ষীয় উদযাপন অনুষ্ঠানে দাবি করা হয় যে, ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাস শুরু হয় ১৯১৩ সালে, কিন্তু এটা মূলত সত্য নয়।  ব্রিটিশ জাদুঘরের ইমেজ কিউরেটর ল্যুক ম্যাককার্নান এর মতে, ১৯১৩ সালের পূর্বের ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাস একটি খণ্ডিত অংশ কিন্তু তাই বলে তা কম আকর্ষণীয়ও নয়।  এই ইতিহাস এখনো পুরোপুরি বোধগম্য যেমন নয় তেমনই উপেক্ষিতও বটে'। আমরা সেইসব সিনেমা আজ দেখতে পারিনা কারণ ধারণা করা হয় ভারতীয় নির্বাক সিনেমার প্রায় ৯৯ শতাংশ হারিয়ে গেছে কিন্তু আমরা যা জানতে পারি তা হলো ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসেরও একটি পুরোনো ইতিহাস আছে।

১৮৯৬ সালের ৭ জুলাই বোম্বেতে এসেছিলো প্রথম চলচ্চিত্র। লুমিয়ের ব্রাদার্স, মারিয়াস সেস্টার নামে এক ভদ্রলোককে দিয়ে তাঁদের তৈরী কিছু শর্ট ফিল্ম পাঠিয়েছিলেন যা দেখানো হয়েছিল সোয়াঙ্কি ওয়াটসন হোটেলে এবং প্রদর্শনীটির বেশিরভাগ দর্শক ছিলেন ব্রিটিশ। হীরালাল সেন সেখানে উপস্থিত ছিলেন না কিন্তু দুই বছর পরে এই সিনেমাগুলো তিনি কলকাতায় বসে দেখেছিলেন।  স্থানীয় ফটোগ্রাফার হরিশ্চন্দ্র ভাতাব্দেকার (যিনি সাভে দাদা নামে পরিচিত) মুম্বাইয়ের সেই প্রথম প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলেন – এবং উনি তাৎক্ষণিক ভাবে তাঁর নিজের জন্য ইংল্যান্ড থেকে একটি ক্যামেরা আনার অর্ডার দেন।

হরিশচন্দ্রের এবং কোনো ভারতীয় চলচ্চিত্রকারের প্রথম চলচ্চিত্র  ধারণ করা হয় ১৮৯৯ সালে। এটি ছিল একটি কুস্তি প্রতিযোগিতার ধারণকৃত অংশ যা মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত হয়। যদিও এই ছবির রীল ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়েছিল প্রসেস করার জন্য তথাপী এটা ছিল হরিশচন্দ্রের ফিল্ম ক্যারিয়ারের এবং ভারতীয় সিনেমার সূচনা। ইতোমধ্যে `দি রেসলার' ইংল্যান্ড থেকে তৈরী হয়ে মুম্বাইয়ে প্রদর্শনীর জন্য ফেরত আসে। এই চলচ্চিত্রের সাথে তিনি আমদানি করেন একটি প্রজেক্টর এবং কিছু বিদেশী চলচ্চিত্র যা তখন প্রদর্শিত হতো । যখন ভারতীয় গণিতশাস্ত্র পন্ডিত আর. পি. পরাঞ্জপে কেমব্রিজ থেকে ফেরত আসেন, হরিশ্চন্দ্র সেই সময়কার দৃশ্য ধারণ করেন এবং সম্ভবত এটিই ছিল ভারতের প্রথম নিউজ ফুটেজ।  হরিশ্চন্দ্র ১৯০০ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তাঁর ফিল্ম প্রোডাকশন চালু রাখেন যখন তিনি তাঁর ক্যারিয়ারকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেন মুম্বাইয়ে একটি থিয়েটার কোম্পানি কিনে নিয়ে। এই থিয়েটারটি তিনি তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত চালু রাখেন অত্যন্ত সুন্দর এবং সফল ভাবে।

হরিশ্চন্দ্র সাখারাম ভাতাব্দেকার

জন্ম: ১৮৬৮, বোম্বে, ব্রিটিশ ভারত

মৃত্যু: ১৯৫৮

হরিশ্চন্দ্র ভাতাব্দেকারের প্রথম ছবি `দ্য রেসলার' এর পোষ্টার

এদিকে হীরালাল সেনের ক্যারিয়ার চলছিল উলটো পথে।  তখন তিনি শুরু করেন আমদানিকৃত ফিল্মের প্রদর্শনী এবং স্থানীয় পত্রিকাগুলো তার ভূয়সী প্রশংসা করে নিবন্ধ ছাপতে থাকে – `এটা কোনো লাইভ সার্কাসের সত্যিকারের মানুষের অভিনয়ের চাইতে হাজার গুন্ ভালো। তাছাড়া এটা তেমন ব্যয়বহুলও নয় ……'।  অবাক করার মতো বিষয় হলো অতিদ্রুত তিনি নিজের নামকে পরিচিত করে ফেললেন আলিবাবা এবং চল্লিশ চোর নাটকের দৃশ্বায়ন করে।  ১৯০৪ সালের পরে তিনি নিউজ ফুটেজের পুরোধা হয়ে ওঠেন কিন্তু যতই দিন যাচ্ছিলো তিনি দেখতে পেলেন যে আমদানিকৃত বিদেশী ছায়াছবির সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে।  এক পর্যায়ে তিনি তাঁর ব্যবসায় বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন এবং সব যন্ত্রপাতি বিক্রি করে দেন।

এই সব ব্যবসায়ীক প্রতিদ্বন্দ্বীর একজন ছিলেন জামশেদজি মদন, যিনি ছিলেন এলফিনস্টোন বায়োস্কোপ নামের একটি  থিয়েটারের পরিচালক।  এই বায়োস্কোপ কোম্পানী ছবি তৈরী, পরিবেশনা এবং প্রদর্শনীর আয়োজন করতো। জামশেদ মদন প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন এই সমস্ত সিনেমা থেকে এবং বিদেশী সিনেমার প্রদর্শনীর স্বত্ব কিনে নিয়ে এবং ১৯০৭ সালে কলকাতায় প্রথম প্রেক্ষাগৃহ 'এলফিনস্টোন পিকচার প্যালেস' নির্মাণ করে।

জামশেদজি মদন

জন্ম: ১৮৫৬, বোম্বে, ব্রিটিশ ভারত

মৃত্যু: ১৯২৩, কলকাতা, ব্রিটিশ ভারত

জামশেদজি মদন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত থিয়েটার হল 'এলফিনস্টোন পিকচার প্যালেস'

শুধু বিদেশী চলচ্চিত্রই নয়, বিদেশী চলচ্চিত্র  নির্মাতারাও ভারতে আসতে শুরু করেন মূলত ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরী করতে, যা পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী দেখানো হতো।  ম্যাক কারন্যান ব্রিটিশ চলচ্চিত্র  পরিচালক চার্লস আরবানকে ভারতে নিয়ে আসেন, যাঁর যন্ত্রপাতি দেশীয় চলচ্চিত্র  নির্মাতারাও ব্যবহার করতেন এবং ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম দিকে তিনি তাঁর ক্যামেরাম্যানদের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করতেন। তিনি যেসব চিত্র ধারণ করেছিলেন তার মধ্যে ভারতের রাজা রাণীদের কাহিনী ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৯১১ সালে নির্মিত তাঁর `দ্য গ্রেট করোনেশন অফ দিল্লি দরবার' (রাজা পঞ্চম জর্জ এর রাজ্যাভিষেক উদযাপন) চলচ্চিত্র , যা আন্তর্জাতিক বক্স অফিসে হিট হয়েছিল।

১৯০০ থেকে ১৯১০ সময়কালে এইসব আমদানিকৃত ছবিগুলো ভারতীয়দের সিনেমা সমন্ধে যথেষ্ট অভিজ্ঞ করে তোলে যা পরবর্তীতে ফিল্ম তৈরীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বস্তুত এই ধরণের প্রদর্শনীর একটি ছিল ভারতীয় চলচ্চিত্রের `ইউরেকা মোমেন্ট' যা ফটোগ্রাফার দাদা সাহেব ফালকের হাত দিয়ে শুরু হয়েছিল।  ফালকে বাইবেল অনুসরণে নির্মিত একটি একটি বিদেশী চলচ্চিত্র  দেখছিলেন, যেখানে যীশু খ্রীষ্টের চরিত্র চিত্রায়িত হয়েছিল।  এই ছবি দেখার পর তিনি বলেছিলেন `যখন যীশু খ্রীষ্টের জীবন আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো, আমি মনে মনে দেখতে লাগলাম আমাদের ভগবান শ্রী কৃষ্ণকে, শ্রী রামচন্দ্রকে এবং তাঁদের গোকুল আর অযোধ্যাকে। ভারতীয় চলচ্চিত্রের জনক পরবর্তীতে লিখেছিলেন `আমরা, ভারতের সন্তানেরা কি কখনো পর্দায় আমাদের ভারতীয়ও চিত্রকে দেখতে পাবো'?

দাদা সাহেব ফালকে

জন্ম: ১৮৭০, বোম্বে, মহারাষ্ট্র, ব্রিটিশ ভারত

মৃত্যু: ১৯৪৪, বোম্বে, মহারাষ্ট্র, ব্রিটিশ ভারত

অতঃপর ১৯১৩ সালে ফালকের সেই কথার ফল পাওয়া গেলো, তাঁর এবং ভারতের প্রথম চলচ্চিত্র  `রাজা হরিশ্চন্দ্র' এর মাধ্যমে। হিন্দু দেবতাদের গল্প নিয়ে তৈরী এই চলচ্চিত্র যেন পুরোপুরি বিদেশী মানের হয় সে জন্য ফালকেকে তাঁর বাড়ি ছেড়ে অনেক দূর যেতে হয়েছিল। প্রথমে তিনি গেলেন লন্ডনে ইংরেজ ফিল্ম ডিরেক্টর সেসিল হেপওয়ার্থ এর কাছ থেকে ফিল্ম বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে এবং যন্ত্রপাতি কিনতে। ফেরার পরে তিনি একটি ভাড়া করা বাংলোতে স্থাপন করলেন তাঁর ষ্টুডিও আর জোগাড় করলেন সংশ্লিষ্ট ক্রু ও পাত্র পাত্রী। ফালকের তথা ভারতে নির্মিত এই প্রথম সিনেমাটি একটি মহাকাব্যের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না এবং এটিই ছিল ভারতের বেড়ে ওঠা চলচ্চিত্রের প্রথম চারাগাছ, যদিও এটা ছিল একটি পরীক্ষামূলক কাজ। ফরাসি চিত্র পরিচালক জর্জ মেলিয়েস দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি ভারতের পৌরণিক বিষয়গুলোকে ক্যামেরা ট্রিকের মাধ্যমে প্রকাশ করেন। ৯ই মে ১৯১৩ সালে রাজা হরিশ্চন্দ্র সিনেমার প্রিমিয়ার প্রদর্শিত হয় আর এই সিনেমার মার্কেটিং হয়ে ছিল `ভারতে তৈরী প্রথম সিনেমা' এই স্লোগানে।

রাজা হরিশ্চন্দ্র চলচ্চিত্রের দৃশ্য

আমরা জানি যে `রাজা হরিশ্চন্দ্র' সিনেমাকে ভারতের সিনেমা শিল্পের যুগান্তকারী সাফল্য হিসেবে ধরা হয় না কিন্তু আমরা কোনো পুরোনো রেকর্ডস কিংবা সংবাদপত্রের সূত্র থেকে এও জানতে পারিনা যে ভারতের চলচ্চিত্রের সঠিক প্রবক্তা কারা ছিলেন, কারণ ঔপনিবেশিক যুগে ইঙ্গ সংবাদ মাধ্যমগুলো ভারতের চলচ্চিত্র বা এর নির্মাণের খবরকে তেমন গুরুত্ব দিতো না।  এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, অন্তত সবাক যুগের আগে পর্যন্ত ফালকে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে তাঁর সাফল্যের ভিত্তি তৈরী করেছিলেন বিভিন্ন নির্বাক চলচ্চিত্র বানিয়ে।  ১৯১৭ সালে, যে বছর হীরালাল সেনের ওয়্যার হাউস আগুনে পুড়ে গিয়ে তাঁর সমস্ত যন্ত্রপাতি এবং ফিল্ম ধ্বংস হলো সেই বছর রুস্তমজী ধোতিয়ালা নামে এক পরিচালক জামশেদজি মদনের এলফিনস্টোন বায়োস্কোপ কোম্পানির জন্য রাজা হরিশচন্দ্রের রিমেক তৈরী করেন।

বেশিরভাগ ঐতিহাসিকগণ এই ইতিহাসকেই বিশ্বাস করেন কারণ দাদা সাহেব ফালকের আগে ভারতীয় প্রথম চলচ্চিত্রের খোঁজ করা আর ভুতের পিছনে ছুটে চলা একই কথা।

————–

সূত্র: নিবন্ধটি পামেলা হাচিসনের লেখা `The birth of India's film industry: how the movies came to Mumbai' এর ভাবানুবাদ। মূল ইংরেজী রচনাটি ইংরেজী দৈনিক `thegurdian' এ ২০১৩ সালের ২৫শে জুলাই ছাপা হয়েছিল।

ছবি: গুগল থেকে সংগৃহিত