বিষাক্ত শহর হালাবজা

সৈয়দ আশরাফ মহি-উদ্-দ্বীন
Published : 6 March 2019, 11:19 AM
Updated : 6 March 2019, 11:19 AM


হালাবজা শহীদদের স্মৃতিসৌধ

নতুন জায়গা, নতুন মানুষ, নতুন পরিবেশের সাথে পরিচিত হওয়ার লোভ আমার চিরদিনের। কিন্তু এবারের যাত্রায় সেই আনন্দ নেই, উচ্ছ্বাস নেই। একটি বিষাক্ত নগরীতে যাচ্ছি, যেখানে আজ থেকে তিরিশ বছর আগে দম বন্ধ হয়ে মৃত্যু ঘটেছিল মানবতার।

ইরান সীমান্ত থেকে মাত্র এগারো কিলোমিটার দূরেই  ইরাকের কুর্দিস্তানের ছোট্ট নগর হালাবজা। কুর্দিস্তানের রাজধানী এরবিল থেকে এর দূরত্ব ২৮৩ কিলোমিটার। এরবিল থেকে সুলাইমানিয়া হয়ে হালাবজা পৌঁছুতে প্রায় সাড়ে চার ঘন্টা লেগে গেল।

১৯৮৮ সালের আগে বিশ্বের কাছে তেমন পরিচিতি ছিল না হালাবজার। আর যেদিন থেকে চিনলো, সেদিনটি  মানব সভ্যতার এক কলঙ্কিত দিন।

১৬ই মার্চ ১৯৮৮। প্রতিদিনের মতো সেদিনও হালাবজাতে সূর্য উঠেছে। স্থানীয়রা কাজে বেরিয়েছে। শিশুরা স্কুলের মাঠে আনন্দে মেতে আছে। রাস্তার ধারে দোকানিরা পসরা সাজাচ্ছে। তখনো কেউ জানে না আর কিছুক্ষণ পরেই হালাবজার আকাশে উড়ে আসবে তাদের মৃত্যুদূত।  ফুসফুস ভরে উঠবে বিষাক্ত গ্যাসে।

ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে কুর্দিদের খুব একটা সুসম্পর্ক ছিল না। অন্যদিকে ইরানের সাথে ছিল দা-কুমড়ো সম্পর্ক। হালাবজা ইরানের সীমান্ত ঘেঁষা কুর্দি অধ্যুষিত শহর। সাদ্দাম হোসেন মনে করতেন, এই শহরে বসে ইরানিরা ইরাকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে; আর  হালাবজার কুর্দিরা তাতে সায় দিয়ে যাচ্ছে।  সুতরাং এদের একটা বিহিত করা দরকার।

সাদ্দামের জেনারেল আলী হাসান আল-মজিদ ছিলেন আরো এক কাঠি সরেস। সাত পাঁচ না ভেবে সেনাবাহিনীকে আদেশ দিয়ে দিলেন হালাবজাতে রাসায়নিক বোমা ফেলতে। তার এই কলঙ্কিত আদেশের কারণে বিশ্ব এই জেনারেলকে  'কেমিক্যাল আলী' নামেই চেনে।


হালাবজায় পতিত রাসায়নিক বোমার শেল

হালাবজার আকাশে ধেয়ে এলো ইরাকি সেনাবাহিনীর বোমারু বিমান। প্রথমে একটা রাসায়নিক বোমার শেল হালাবজার মাটিতে বিস্ফোরিত হলো। বাতাসে ছড়িয়ে গেলো বিষাক্ত গ্যাস।  এই ঘটনার প্রথম সাক্ষী কয়েকজন ফটো সাংবাদিক। এরাই একের পর এক ছবি তুলে ঘটনার বিবরণ দেন বিশ্ববাসীকে। ততক্ষণে মানুষের ফুসফুস ভরে গেছে বিষাক্ত গ্যাসে। অসহ্য যন্ত্রনায় মানুষ ছুটছে দিগ্বিদিক।

দ্বিতীয় বোমাটি যখন মাটি স্পর্শ করে তখন তা বিস্ফোরিত হয়নি; কিন্তু কুর্দি পেশমার্গা (কুর্দি সেনাবাহিনী) যখন বোমাটিকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টায় ছিল তখনই তা বিস্ফোরিত হয়।

এরমধ্যে ইরাকি সেনাবাহিনীর একটি বিমান ভূপাতিত হয়।  তবে একদিনে এক ঘন্টারও কম সময়ের অপারেশনে একটি শহরের পাঁচ হাজারের বেশি মানুষের পৃথিবী থেকে অহস্য যন্ত্রনা নিয়ে বিদায়ের এই ঘটনায় বিশ্ববাসীর হৃদয়ে গভীর  দাগ কাটলো হালাবজা।


ভূপাতিত ইরাকি বোমারু বিমান

হালাবজার বাসিন্দা রায়ার ওয়াফিক তওফিক মুখে শুনছিলাম সেদিনের ঘটনা। ওইসময় পাঁচ বছরের শিশু রায়ার বড় হতে হতে ঘটনা শুনেছেন তার বাবা-মায়ের কাছে। রায়ার আমাকে নিয়ে গেলেন হালাবজার শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধে। এই সৌধের পিছনেই রয়েছে শহীদদের কবর, যেখানে শায়িত রয়েছেন প্রায় পাঁচ হাজার শহীদ।


হালাবজায় শহীদদের কবরস্তান

সৌধকে ঘিরে তৈরি হয়েছে একটি  জাদুঘর। সাপ্তাহিক ছুটি থাকার কারণে জাদুঘরের ভেতরে প্রবেশ করা গেলো না। কিন্তু বাইরে রয়েছে সেই ভূপাতিত বিমানের ধ্বংসাবশেষ, বোমার শেল, ধ্বংস প্রাপ্ত একটি পিক আপ ভ্যান, যাতে করে মুমূর্ষু মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল সেদিন।  একটি মাত্র ভ্যান, সবাই চায় তাতে উঠে নিরাপদ জায়গায় সরে যেতে। শোনা যায় একটি মাত্র শিশু বেঁচে ছিল সেই ভ্যানের যাত্রীদের মধ্যে যে সকল মানুষের নিচে চাপা পরে ছিল।


উদ্ধারকারী বিধ্বস্ত পিকআপ ভ্যান

জাদুঘরের প্রবেশ মুখে রয়েছে কয়েকটি ভাস্কর্য। প্রথমেই রয়েছে হাওকার আলী মর্দানের তৈরি ভাস্কর্য। প্রথম যে কয়জন সাংবাদিক এই কলংকিত ঘটনার ছবি তুলেছিলেন সেই ফটো সাংবাদিকের একজন ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন পরবর্তী  প্রজন্মকে জানানোর জন্য যে কী হয়েছিল সেইদিন এই সুন্দর, শান্ত, শীতল নগরে।

একটু এগোলেই আরেকটি ভাস্কর্য। এক পিতা ছোট্ট সন্তানকে নিজের দেহ দিয়ে আড়াল করে আছেন। নিজেকে আগে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে সন্তানকে কয়েক মিনিটের বেশি আয়ু দান করেছেন এই পিতা।


হাওকার আলী মর্দানের তৈরি ভাস্কর্য

রাসায়নিক বোমা ফেলার পরে প্রথম যে কয়জন ফটো সাংবাদিক হালাবজাতে ছুটে এসেছিলেন সাসান মুয়াইদি তাদের একজন। তেহরানে কর্মরত ইরানি এই সাংবাদিক তার নিজের জবানিতে বর্ণনা করেন সেদিনের অবস্থা। ঘটনার তেরো ঘন্টা পরে প্রথম ফ্লাইটেই মুয়াইদি হালাবজাতে পৌঁছেন। আটচল্লিশ ঘন্টা অবস্থান করে তিনি হালাবাজার অলিগলিতে ঘুরে ঘুরে ছবি তোলেন। ওই সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে মুয়াইদি বলেন, "আমি কিচ্ছু করতে পারিনি, কিচ্ছু না। আমার সামনে শুধুই মৃতদেহ। বয়স্ক মানুষের, যুবকের, শিশুদের মৃতদেহ। আমার চোখের সামনে আমার নিজের সন্তানের ছবি ভেসে উঠে। আমি সহ্য করতে পারিনা।"

ওমারি খাওয়ার নামে এক পিতার উপুড় হয়ে শিশুপুত্রকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টাকে ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন মুয়াইদি। তার তোলা সেই ছবি বিশ্বকে সেদিনের কুর্দি গণহত্যার নির্মমতা জানান দেয়।


সন্তানকে বাঁচাতে পিতার প্রচেষ্টা

সময় তার প্রতিশোধ সময় মতোই নিয়ে থাকে।  দীর্ঘ ২২ বছর পরে ২০১০ সালে হালাবজা ট্র্যাজেডির হোতা সেই কেমিক্যাল আলীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃতুদণ্ড দেওয়া হয়। সাদ্দাম হোসেনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় ২০০৬ সালেই। পশ্চিমা বিদ্বেষী, আরব জাতীয়তাবাদী, সাহসী রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে কারো কারো কাছে সাদ্দাম হোসেনের যেমন গ্রহণযোগ্যতা আছে তেমনি হালাবজার এই ঘটনা সাদ্দাম হোসেনের চরিত্রে ভয়ঙ্কর দিক।

কুর্দিস্তানের মানুষ আজও সেই দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারেনি আর তাই তো প্রতি বছর পুরো কুর্দিস্তান জুড়ে ১৬ই মার্চ পালন কারণ হয় `হালাবজা দিবস'। এইদিন সব মানুষ ঘর থেকে, অফিস থেকে, স্কুল-কলেজ থেকে একই সময়ে বের হয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। হাতে হাত রেখে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে কয়েক মিনিট। চেষ্টা করে দেখে দম বন্ধ করে বেঁচে থাকা যায় কি না।

হালাবজা থেমে থাকেনি। অতীতের দুঃস্বহ স্মৃতিকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে।  হালাবাজার প্রতিটি নাগরিকই আজ এক একজন পেশমার্গা; অর্থ্যাৎ যারা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে।  শহরের প্রতিটি মোড়ে, ট্র্যাফিক সিগন্যালে, সড়ক দ্বীপে এক একটি পেশমার্গার ভাস্কর্য আর তাকে লেখা `হামু মান পেশমাৰ্গা'। এর অর্থ আমরা সবাই পেশমার্গা। ২০১৪ সালের আগ পর্যন্ত হালাবজা ছিল কুর্দিস্তানের সুলাইমানিয়া প্রভিন্সের একটি জেলা। ২০১৪ সালের মার্চ মাসে একে গভর্নরেট মর্যাদায় উন্নীত করা হয়।


হামু মান পেশমার্গা

আজকের হালাবজাতে অবকাঠামোগত পরিবর্তন এসেছে। তৈরি হয়েছে সুন্দর সুন্দর রাস্তাঘাট, বহুতল বাসভবন।  প্রসার ঘটেছে ব্যবসা-বাণিজ্যের। লক্ষ্য করলাম গ্রামের দিকেও  বড় বড় সুপার মল তৈরি হয়েছে, শহরে তৈরি হয়েছে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে হালাবজা বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম।

১৬ মার্চ ২০১০ কুর্দিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রপতি বারহাম আহমেদ সালিহ ইউনিভার্সিটি অব হালাবজার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন।  বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইটি ক্যাম্পাস রয়েছে হালাবাজাতে। এছাড়াও রয়েছে হালাবজা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।


হালাবজা বিশ্ববিদ্যালয়


হালাবজা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

কুর্দিস্তানের অন্যান্য শহরের তুলনায় হালাবজাতে মসজিদের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো। আধাঘন্টার শহর পরিভ্রমণের মধ্যেই প্রায় চার-পাঁচটি মসজিদ চোখে পড়লো। সেই তুলনায় এরবিল, দুহক, জাখো, আক্রে কিংবা সুলাইমানিয়ার মতো বড় বড় শহরে এতো মসজিদ দেখা যায়না। অবশ্য কুর্দিস্তানে ইচ্ছা করলেই আমাদের দেশের মতো মসজিদ বানাতে পারেনা। মসজিদ বানাতে হলে উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে সরকারের অনুমতি নিতে হয়। অবশ্য এখানকার মসজিদগুলোর শতকরা ৯৯ ভাগ নির্মাতাই জনহিতৈষী পয়সাওয়ালা লোকজন।


হালাবজার মসজিদ


হালাবজার মসজিদ

আগেই শুনেছি অতিথিপরায়ন হিসেবে হালাবজার লোকজনের সুনাম আছে। রায়ার তার প্রমান দিলো। তার সাথে অফিসের কাজ শেষ হলে, নিজে আমাকে নিয়ে শহর দেখতে বের হয়েছিল। এরপর তার বাড়িতে না নিয়ে আমাকে বিদায় জানানো নাকি অসম্ভব ব্যাপার। অতিথি আসছে তা রায়ারের স্ত্রী আগে থেকেই জানতেন মনে হয়। দরোজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন আমাদের অপেক্ষায়।

কাবাব, রুটি, দুম্বার মাংসের বিরিয়ানি আর দোখ দিয়ে আপ্যায়িত হলাম। দোখ হলো টকদই দিয়ে তৈরি এক ধরনের পানীয়। অনেকটা আমাদের দেশের বোরহানি আর মাঠার মাঝামাঝি স্বাদ।

রাতে থেকে যাবার আবদার ফিরিয়ে দিয়ে এবং ইরানি সীমান্ত দেখার লোভ সামলে নিয়ে রায়ারের পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিলাম।

রাতের বেলা গাড়ি ছুটে চলেছে হালাবজা থেকে সুলাইমানিয়া; সুলাইমানিয়া থেকে রানিয়া; তারপর রানিয়া থেকে এরবিল। রাস্তার উজ্জ্বল আলোকে পাশ কাটিয়ে পিছনে ফেলে এলাম এক করুণ ইতিহাসের ক্ষত বয়ে বেড়ানো জনপদকে।