নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ডিঙ্গাপোতার হাওড় ভ্রমণ

সৈয়দ আনোয়ারুল হক
Published : 16 Sept 2015, 07:11 AM
Updated : 16 Sept 2015, 07:11 AM

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হাওড় হল 'হাকালুকি হাওড়'। এছাড়া শনির হাওড় সহ বাংলাদেশের বড় বড় হাওড় গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হাওড় হল 'ডিঙ্গাপোতার হাওড়' এটির অবস্থান হল নেত্রকোণা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলায়। গত ঈদুল ফিতর সপরিবারে উদযাপন করেছি নেত্রকোণায়। এই সুযোগে সবাই মিলে ডিঙ্গাপোতার হাওড়ে ভ্রমণটা হয়ে গেল। হাওড়ের পাড়ে শিয়াদার গ্রামে পল্লি বিদ্যুতের অফিসার আমার ভায়রা শাহিন সাহেবের বাড়ি। সেই আমাদেরকে হাওড় ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এই সুবাদে জীবনের প্রথম তাঁর বাড়িতে যাওয়া এবং হাওড় ভ্রমণ।

এই হাওড়ে ১২ মাসেই প্রচুর মাছ ধরা হয়। এখান থেকে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকার মাছ ঢাকায় রপ্তানি করা হয়। এছাড়া বরো ধান চাষের অন্যতম ক্ষেত্র হিসাবে পরিচিত। হাওড়ে বেড়ানোর জন্য একটি বড় নৌকাসহ যা যা লাগবে তা শাহিন প্রস্তুত করে রেখেছে আগে থেকেই। হাওড়ে যাওয়ার কথাটা আমার স্ত্রী খুকী আমাকে আগের দিন জানিয়েছে। সে বলল, " নাবিলা-নাদিয়া ওদের সাথে হাওড়ে যেতে চায়।" আনি শুনেই থমকে উঠলাম এবং বললাম, "ওরা সাঁতার জানেনা, হাওড়ে যাওয়ার দরকার নেই।" এ কথা শুনে আমার দুই কন্যা খুব মন খারাপ করল। আমি চিন্তায় পরে গেলাম, কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ পর সবাই মিলে আমাকে ধরল, আমাদের সাথে আপনারা সবাই চলেন। পরে চিন্তা করলাম আমরাসহ ছোট-বড় মিলে ২৫ জন যাবে । অর্ধেকেই সাঁতার জানেনা, যে কোন ধরণের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই আমি যাবো বলে মতামত দেয়ার পর সবাই খুশি হলো। সিদ্ধান্ত হলো ট্রেনে যাবো মোহনগঞ্জ, পরের ৬ মাইল যাবো রিক্সা,অটোরিক্সা অথবা টমটমে। নেত্রকোণা বড় স্টেশন থেকে ইন্টারসিটি হাওড় এক্সপ্রেসে উঠে মোহনগঞ্জ স্টেশনে নামলাম। আমরা সবাই স্টেশনের এক জায়গায় জড় হয়ার পর গুনে দেখলাম ২৫ জন আছে। একটু সামনে গিয়ে অটো রিক্সা পেলাম। চারটি অটো রিক্সা নিয়ে ২৫ জন চড়লাম । বাজারে গিয়ে চালককে বললাম,"ভাল মিষ্টির দোকানে রিক্সা থামাবে।" একটু যাওয়ার পর মিষ্টির দোকানে রিক্সা থামল, ৪ কেজি মিষ্টি, এক কেজি নিমকি ও পাঁচ কেজি আম নিলাম। রাস্তা তেমন ভাল ছিল না , প্রচন্ড ঝাঁকির মধ্যেও আধা ঘণ্টায় চলে গেলাম শিয়াদার ।

তখন ঘরিতে বাজে সকাল ১০টা। শাহিনের বাড়িতে ১০ মিনিট বিশ্রাম নেয়ার পর আপ্যায়ন করলঃ সরবত, গ্রামের পিঠা-পুলি,মিষ্টি ও আম। শাহিনের ছোট ভাই আকিক এসে বলল, "দুলাভাই সব রেডি,চলেন নৌকায় উঠি।" তখন ছিল প্রচণ্ড রোদ। আকিককে জিজ্ঞাসা করলাম, "নৌকায় ছই আছে?" সে বলল,"না দুলাভাই,তবে আমি ত্রিপল দেয়ার চেষ্টা করেছিলাম,কিন্তু বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যায়।" রোদের কথা চিন্তা করে আকিকের কাছ থেকে একটি ছাতা নিলাম। এ সময় হাওড়ে পানি কম থাকায় নৌকা অনেকটা দূরে ছিল। নোঙ্গর ফেলেছে পানিতেই । হাঁটু পানির উপরে গিয়ে নৌকায় উঠতে হয়েছে। ছোটদেরকে কোলে করে এবং মহিলাদেরকে হাত ধরে টেনে নৌকায় উঠাতে হয়েছে। নৌকাটি বেশ বড়, প্রায় আশি জনের মত লোক উঠতে পারবে। আমরা ২৫ জন ও শাহিন সহ তাদের বাড়ির আরও ছিল ৮ জন, মোট ৩৩ জন লোক,তাই ভয়ের কোন কারণ ছিল না । শাহিনের চাচাত ভাই কেরুল ও ঋষি আমাদের সাথে ছিল। কেরুল তার গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক । সে এলাকার জনপ্রিয় নেতাও বটে। অভিজ্ঞ লোক হিসাবে সে হাওড়ে বেড়ানোর নেতৃত্বের দায়িত্ব নিয়েছে। আমরা হাওড়ের উত্তর কিনারা থেকে নৌকায় উঠলাম। দক্ষিণ কিনারার দিকে তাকিয়ে ধুধু পানি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না। ইঞ্জিন চালু দিয়ে নৌকা দক্ষিণ দিকে ছাড়ল। সারেং আমাদেরকে হাওড়ে যাওয়ার নিয়ম-কানুন বুঝিয়ে দিল। দেড় ঘণ্টা ট্রলারে যাওয়ার পর হাওড়ের মাঝখানে গেলাম । এর মাঝখানের দৃশ্য ছিল অত্যন্ত মনোরম। চতুর্দিকের দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছিল গ্রামগুলো পানির মধ্যে ভাসছে। উত্তর দিকে তাকিয়ে দেখি আরো চমৎকার দৃশ্য। পানিতে ভাসমান গ্রাম, তার পাশে ভারতের নীল পাহাড়ের গায়ে ভাসছে সাদা মেঘ,আকাশে উড়ছে অসংখ্য গাংচিল, মাঝে মাঝে পানি থেকে ছোঁ মেরে মাছ ধরে নিয়ে যাছে গাংচিল । এমন মনকাড়া দৃশ্য বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই। পানির মধ্যে পানককৌড়ি সহ নাম না জানা অন্যান্য হাঁস জাতীয় পাখির মাছ ধরার দৃশ্য এখনো স্মৃতিপটে আঁকা আছে। আরো একঘণ্টা যাওয়ার পর প্রায় হাওড়ের দক্ষিণ কিনারে চলে আসলাম। এখন সাঁতারের পালা , কেরুল বলল, "কম পানি যেখানে আছে সেখানে সাঁতার কাটতে হবে।" তার কথামত সারেং নোঙ্গর ফেলল। যে জায়গাটিতে আমরা নামলাম সেখানে কোমর পানি, হাঁটু পানি,বুক পানি। আমরা যারা সাঁতার জানি তারা একটু গভীরে গিয়ে সাঁতার কেটেছি। পরিষ্কার পানিতে হাল্কা স্রোত এবং পানি কুসুম গরম থাকায় সাঁতরনোর মজাই ছিল অন্য রকম। তবে শাহিন,আকিক,কেরুল,ঋষি ও সারেং সারাক্ষণ সতর্ক দৃষ্টি রাখছিল আমাদের দিকে যাতে কোন দুর্ঘটনা ঘটতে না পারে। এর মধ্যেও অদিত একটু গভীরে যাওয়ায় ডুবে যাচ্ছিল, তার বাবা দেখে তাকে ধরে ফেলল। আমরা কিন্তু যার যার সন্তানদের চোখে চোখে রাখছিলাম। এতক্ষণ যে বর্ণনা দিয়েছি তার অধিকাংশই ক্যামেরা বন্দী হয়েছে ভিডিও এবং ছবিতে । প্রায় আধা ঘণ্টা সাঁতরানোর পর নেতার কথামত সবাই ট্রলারে উঠে পরলাম। এখন সিদ্ধান্ত হলো আরও দক্ষিণে লেইপসা বাজার পর্যন্ত যাবো। এটি মোহনগঞ্জ থানা ছাড়িয়ে খালিয়াজুড়ি থানায় পড়েছে।

আমরা এখন ডিঙ্গাপতার হাওড় ছাড়িয়ে সুরমা ও মেঘনা নদীর দুটি শাখা নদীর মিলিত শাখা নদী মেঘনা নদী দিয়ে দক্ষিণ দিকে ল্যাইপসা বাজারে পৌছেছি। নদীটি দেখে মনে হলো এটি একটি বড় বাণিজ্যিক নৌপথ । কিছুক্ষণের মধ্যে দেখতে পেলাম কয়েকটি বড় বড় মাল বোঝাই কার্গো আসা-যাওয়া করেছে। বাজার পর্যন্ত আসতে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় লাগল। এখন প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছে। আমার শ্যালিকা লাকী বলল, "দুলাভাই পিঠা খান।" গোগ্রাসে দুটি পোয়াপিঠা খেলাম। আমার ছোট কন্যা নাদিয়া বাজারে যেতে চাইলো।তাকে বাজারে নিয়ে তার পছন্দমত ১০টি চিপস কিনে দিলাম। ট্রলারে গিয়ে নিজে একটি রেখে বাকীগুলো অন্য বাচ্চাদের দিয়ে দিল। একটু পরে সজিব বাজার থেকে দৌড়ে এসে বলল, "দুইশ টাকা দেন ফুফা,আমার কাছে এক হাজার টাকার নোট, ভাঙ্গানো যাচ্ছে না।" আমি পকেটে হাত দিয়ে খুচরা একশ টাকার একটি নোট পেলাম তাই দিলাম। এর পর দেখি আকীক এক ছড়ি পাকা চাম্পা কলা ও অনেকগুলো বাটারবন, পাউরুটি,বিস্কুটের প্যাকেট নিয়ে আসল । শিশু ও মহিলারা এগুলো দিয়ে নাস্তা করে বাকীগুলো রেখে দিল মাঝিদের জন্য। এখানে দুপুর দু'টা বেজে গেল। সবাইকে গুণে গুণে ৩৩ জন ট্রলারে উঠলাম। আগের চেয়ে ইঞ্জিনের গতি আরও বাড়িয়ে বাড়ির দিকে রওনা করলাম । সবাই আবদার করলো আবার সাঁতরাবে । নেতা অনুমতি দিল এবং আগের জায়গায় আবার সবাই সাঁতরালাম । এখন মাত্র ১৫ মিমিট সাঁতার চলল। আবার কাউন্ট করে সবাই ট্রলারে উঠালাম ।

এখন অনুভুতি,অভিজ্ঞতা,কার কেমন লাগল,ফটোসেশন,ভিডিও ইত্যাদি করতে করতে হাওড়ের উত্তর পাড়ে চলে গেলাম। নৌকা নোঙ্গর ফেলল। শাহিন সাহেবের বাড়িতে গিয়ে দেখি মহা আয়োজনে খাবার প্রস্তুত। খাবার শেষে দেখি প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এলো। প্রচণ্ড গরমে এতগুলো মানুষ নিয়ে থাকা সম্ভব হবেনা । আমার ও শাহিনের পরিবার ছাড়া বাকী সবাই তাড়াহুড়ো করে চলে গেল। তারা কেউ গেলো বাসে এবং কেউ গেলো অটো রিক্সায় । আমি চলে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। শাহিন আমাকে বলল, "আমিও চলে যাবো দুলাভাই।" শুনে ভালই লাগল, একসাথে যাওয়া যাবে। আমরাও বেরিয়ে পরলাম। বাজারে গিয়ে দেখি টমটম ছাড়া আর কিছুই নেই। আমরা ৮ জন,একটি টমটম রিজার্ভ করে নিলাম। ৪০ মিনিটের মধ্যে মোহনগঞ্জ চলে এলাম। সেখান থেকে বাসে এক ঘন্টার মধ্যে নেত্রকোণায় চলে আসলাম। জীবনের প্রথম এতগুলো মানুষ নিয়ে এত বড় হাওড় ভ্রমণ আর কোনদিন হবে কিনা জানিনা।