শৈশবে দুরন্তপনা-১

সৈয়দ আনোয়ারুল হক
Published : 1 Nov 2015, 06:29 PM
Updated : 1 Nov 2015, 06:29 PM

আমার বয়স যখন ১৩ বছর এবং সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। গ্রামের দুরন্ত বালক হিসেবে অনেক কাজ করতে পছন্দ করতাম। তার মধ্যে বড়দের সাথে গিয়ে ইসলামি ওয়াজ মাহফিল শোনা, দলের গান শোনা, যাত্রাপালা শোনা, আর বিশেষ আকর্ষণ ছিলঃ "সাধের পাগলা ঘোড়ারে কই থাইক্যা কই লইয়া যায়! খাল-বিল, নদী-নালা, পাহাড়-সাগর পার হইয়া রে ঘোড়া শূন্যে উড়া মারে……! অর্থাৎ কদ্দুস বয়াতির কিচ্ছা শুনতে। এসব অনুষ্ঠান হত রাত্রে। কিন্তু ওয়াজ মাহফিল শুরু হত আসরের নামাজের পর, শেষ হত রাত বারটায়।

আমার মামার বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দক্ষিণে। দুটি নদী পার হয়ে যেতে হয়। আজ মামার বাড়িতে ওয়াজ মাহফিল। মাঘ মাস, প্রচণ্ড শীত। আমি, আমার ছোট ভাই সোহাগ, আমার বড় ভাই, ভাগিনা দুলাল, ভাতিজা ইউসুফ ও মিয়াচান, চাচাত ভাই সোলাইমান,ফুফাত ভাই জুনাইদ। আমরা আটজন দুপুরে খাওয়ার পর শীতের কাপড় পরে মাহফিলে চলে গেলাম। প্রাইমারি স্কুলের মাঠে মাহফিল। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বক্তারা মাহফিলে ওয়াজ করবেন। হাজার হাজার লোক জমায়েত হয়েছে। আত্মীয় ও মেহমানদের জন্য রাতে খাওয়ার আয়োজন হয়েছে। রাত ৯টার দিকে নানীকে বলে ফাঁকে রাতের খাবার খেয়ে আসলাম। মাহফিল শেষ হল রাত একটায়। প্রচণ্ড শীতে বাড়ি যাওয়ার চিন্তা বাদ দিলাম। বক্তাগণ সহ গুরুত্বপূর্ণ মেহমানদের জন্য শোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা ছিলাম গণনার বাহিরে।

আটজনে পরামর্শ করে এমন এক জায়গায় শুয়ে পরলাম যাতে কেউ ডিস্টার্ব করতে না পারে। এমন জায়গায় রাতে মানুষ ঘুমাতে পারে তা ভাবা যায় না। কিন্তু আমরা রাতে আরামেই ঘুমিয়েছি। সকালে চিৎকার ও চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। জেগে দেখি অনেক লোক আমাদেরকে ঘিরে ঝটলা করছে । ছোট মামা বলছে, "তোরা এত মানুষ এখানে শুয়েছিস! এটা শোয়ার জায়গা হল? আমাকে বললে তোদের শোয়ার জায়গা করে দিতাম।" আমি বললাম, সমস্যা হয়নি, ঘুম ভালই হয়েছে। মামা বললেন, " সমস্যা না হলে কি আমরা এত মানুষ সকালে এখানে জমা হয়েছি? তখন বুঝতে পারলাম একটা কিছু ঘটেছে।

যে ঘটনাটি ঘটেছে তা হলঃ রাত্রে আমরা কোথাও শোয়ার জায়গা না পেয়ে গোয়াল ঘরে চলে আসি। অনেক বড় টিনের গোয়াল ঘর। ৪০ থেকে ৫০টি গরু রাখা হয় এ ঘরে। মাঝখানে খড় দেয়ার জন্য ছয়টি চাড়ি আছে। আয়তাকার লম্বা লম্বা পাকা করা চাড়ি। প্রতি চাড়িতে দুই পাশে মোট আটটি গরু বাঁধা থাকে। রাতে চাড়ি ভর্তি করে খড় দেয়া হয়। সারারাত গরু এগুলো খেয়ে পেট ভরে। আমরা প্রতি চাড়িতে চার জন করে শুয়ে পরলাম। দুইজন উত্তর দিকে আর দুইজন দক্ষিণ দিকে মাথা দিয়ে শুইলাম। দুই চাড়িতে আটজন শুইলাম। শোয়ার কিছুক্ষণ পর মিয়াচান চিৎকার দিয়ে উঠে বসে পড়ল। আমরা জিজ্ঞাসা করলে বলল, " গরু মাথায় কামড় মেরেছে।" মানে খড় খাওয়ার সময় চুল ও খড় একসাথে কামড় দিয়ে টান দিয়েছে। পরে সবাইকে বললাম, "শাল দিয়ে মাথা ভাল করে ঢেকে শুইতে।" এর পর আর কোন সমস্যা হয়নি । আমাদের সবার গায়ে ছিল জামা, সুয়েটার,শাল ও মাপলার, আর নিছে হল খড়। শীত আমাদের নাগাল পায়নি। আরামে ঘুমিয়েছি কোন সমস্যা হয়নি।

সকালবেলা দুই কামলা গোয়াল ঘরে আসল, গরু ছেড়ে মাঠে নেয়ার জন্য। গরু ছাড়ার সময় দেখে কাপড় দিয়ে মোড়ানো খড়ের মধ্যে অনেক লাশ পরে আছে। এক কামলা চিৎকার দিয়ে বলে, " চাড়িতে লাশ…লাশ…।" অন্য কামলা এসে দেখে সেও চিৎকার দেয়, " লাশ…লাশ…।" এদের চিৎকার শুনে অনেকেই ঘুম থেকে উঠে দৌড়ে এসেছে। তখণ মামা ফজরের নামাজ পড়ে মসজিদে বসেছিল। সাথে অনেকেই ছিল। । কমলারা প্রথম বাড়ির ভিতরে গিয়ে মামাকে চিৎকার দিয়ে ডেকে বলল, "কাকা তাড়াতাড়ি উঠেন, গোয়াল ঘরে লাশ—লাশ। নানী বের হয়ে বলল, "তোর কাকা মসজিদে, তাড়াতাড়ি ডাক দে। তারা দৌড়ে মসজিদে গিয়ে মামাকে ডেকে লাশ…লাশ…বলে চিৎকার …করছে। এর মধ্যে বাড়ির অধিকাংশ লোক জেগে উঠেছে। সবাই যখন গোয়াল ঘরে ঢুকে হৈচৈ শুরু করল তখন আমাদের ঘুম ভাঙল। তারা সবাই গোয়ালে এসে দেখল কোথাও কোন লাশ নেই। অর্থাৎ আমরা সবাই উঠে গেছি। পরে কামলারা তাদের বিভ্রান্তির কথা সবাইকে বলল। ঘটনাটি নিয়ে সবাই তখন অনেক মজা করেছে।