বর্তমান সরকারের স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বা দলীয় মনোনয়নের বিষয়টি নিয়ে নানা রকম বিতর্ক হতে পারে। তবে আমি মনে করি স্থানীয় এই নির্বাচনকে মিনিপ্যাকে প্রবেশ করানো হয়েছে। সাধারণ মনুষকে আবারও ধান আর নৌকা ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে। আসলে প্রতীক সম্পর্কে বাংলাদেশের সব এলাকায় আঞ্চলিক ভাষায় একটা প্রবাদ আছে সেটা হলো, ‘আমগো এলাকায় নৌকা/ধানের শীষ প্রতীক থেকে আন্ধা মানুষ দাঁড়াইলেও পাস করব।’ অর্থাৎ আমরা কতটা রাজনৈতিক সচেতন তা আরও একটু স্পষ্ট হয়ে যায় এই কথায়। আসলে আমাদের দেশের জনগণ এখনও যে রাজনৈতিক সচেতন তা বলা যাবে না। মানুষের যোগ্যতা এখানে বিবেচ্য বিষয় নয়, বিবেচ্য হলো পরিচিত প্রতীক, বাপ দাদাদের ভোট দেয়া বংশ পরম্পরার প্রতীক। আর তাই এই সুযোগগুলো কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় আসে দলগুলো। আসলে এর কোনো মানেই হয় না।
আমাদের দেশ এখনও বহুদলীয় গণতন্ত্রের রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়নি। কার্যত মানুষকে দুটো দলই করতে হয়, আওয়ামী লীগ নয়ত বিএনপি। অর্থাৎ রাজনীতি করার বাধ্যবাধকতায় আটকে পড়েছি আমরা। বিকল্প চিন্তা করার মতো সুযোগও দেয়া হচ্ছে না এই মানুষজনকে। তবে আমরা সেই বাধ্যবাধকতায় আটকাতে চাই। আর এর জন্য চাই সুষ্ঠু নীতিমালা। দুটি বড় দল যেহেতু প্রতিষ্ঠিত সেহেতু তারাই ম্যান্ডেট পাবে, বিজয়ী হবে। এটা কোনো নিয়ম হতে পারে না যে, বিএনপি বা আওয়ামী লীগের ছক ধরেই হাঁটতে হবে এদেশের মানুষকে। আর বর্তমানে যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে করে কোনো ধরনের রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়া ছাড়া নিজের এলাকায় নিরাপদে বসবাস করাটাও কঠিন হয়ে গেছে।
আমরা বিএনপি-জামায়াত আমলেও অনিরাপদ ছিলাম, এখনও ঢের নিরাপত্তাহীনতায় আছি। আসলে স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের বিরোধিতা করে কথাটা শুরু করা যাক। প্রথমেই বলে রাখি আমি কিছু যৌক্তিক কারণে এই জাতীয় প্রতীকের নির্বাচন পদ্ধতিকে সমর্থন করি না। আমাদের দেশের জেলা, উপজেলা বা স্থানীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে এলাকার সবচেয়ে ভাল মানুষ বা বাছাই করা মানুষই নির্বাচিত হন। আর এর জন্য তাদের বড় দলগুলোর চামচামি করতে হয় না। তিনি ব্যক্তি ইমেজেই পাস করেন। আর এসব লোক সাধারণত কোন দলের লেজুড়বৃত্তি প্রকাশ করেন না অথবা তিনি কোন দলের লেজুড়ে পরিণত হন না। কিংবা তিনি কোন দলীয় পরিচয় দিতেও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। আসলে এর কারণ দলগুলোর প্রতি মানুষের তিক্ত অভিজ্ঞতা।
আমি রাজনৈতিক দলগুলোকে কোনোভাবে খাটো করে দেখছি না। তবে স্থানীয় নির্বাচনে যে সব ভাল মানুষ অংশ গ্রহণের সুযোগ পেয়েছে এখন আর দলীয় নির্বাচনে এই মানুষজন নির্র্বাচন করার সুযোগ পাবে না। আর রাজনীতির গরম পুকুরে নেমে স্থানীয় ঐ ভাল মানুষের পক্ষে নির্বাচন করাও সম্ভব নয়। কারণ যে মানুষ বৃহৎ রাজনৈতিক দলের বাইরে থেকে জনসেবা করার চর্চা করে এসেছে তারা রাজনৈতিক প্রভাবের ফলে কোণঠাসা হয়ে পড়বেন।
সাধারণ মানুষ ভাল-মন্দের চেয়ে নৌকা আর ধানের শীষ বেশি চেনেন। আর তাই তাদের কাছে নৌকা আর ধান ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রতীক সর্বস্ব নির্বাচন কতটা যৌক্তিক তা এখনই ভাববার সময়। আর দলীয় প্রভাবও সেখানে সুস্পষ্ট। ইতোমধ্যে প্রায় সব পৌর এলাকায় এমপি-মন্ত্রীদের আস্থাভাজন ভাই-বেরাদরদের প্রতীক দেয়া হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে স্ত্রীকেও। কয়েকটি উদাহরণ দিলে এই প্রতীকী নির্বাচনের সারমর্ম সবার কাছে পরিষ্কার হবে, রূপগঞ্জের সাংসদ গোলাম দস্তগীর গাজীর স্ত্রীকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে, নোয়াখালীর বসুরহাটে সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ভাই আবদুল কাদের মনোনয়ন পেয়েছেন, আড়াইহাজারের সাংসদ নজরুল ইসলাম বাবুর বোনজামাইকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। এমন অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে।
আসলে রাজনীতির সরল মাঠ থেকে সরল মানুষকে নির্বাসিত করা হচ্ছে দলীয় প্রতীকের মাধ্যমে। অনেকের কাছ থেকে প্রশ্ন আসতে পারে, যারা বড় দলের রাজনীতি করেন না তারা কেন নির্বাচন করেন? আসলে আমাদের দেশে রাজনীতি বা নির্বাচন সবই আখের ঘোচানোর জন্য করা হয়, মুষ্টিমেয় কিছু লোক সেদিকে যায় না। তবে প্রতীকী পদ্ধতি বা দলীয় প্রতীক যেভাবেই বলি বিষয়টা বিএনপি আর আওয়ামী লীগকে বোঝায়। আমাদের দেশের পুরো রাজনীতির ভবিষ্যতকে একটি সংকীর্ণ পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এতে করে তৃতীয় শক্তির উত্থান বা আসার পথটাকে অঘোষিতভাবে বন্ধই করে দেয়া হলো। যে যাই বলুক এদেশে রাজনীতিও একটি বড় পেশা। একবার নির্বাচিত হতে পারলে কয়েক প্রজন্ম পায়ের ওপর পা তুলে খেতে পারে। অর্থাৎ দুর্নীতি এখানে স্পষ্ট। তারপরও আমরা নিশ্চিতভাবেই নিজের দেশ আর সম্পদকে তুলে দেই লুটেরাদের হাতে।
গ্রুপ ক্যাপ্টেন ফজলুল হক বলেছেনঃ
দলীয় প্রতীকে, দল ভিত্তিক বা নির্দলীয় নির্বাচন সমস্যা নয়। সমস্যা হলো জনগণের সমর্থনে ও অংশ গ্রহনে রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সংস্থাগুলো পরিচালিত না হওয়া। যার ফলে নির্বাচিত সকল সংস্থা স্বৈরাচারী ও আমলাতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হয়। জাতীয় সংসদ, মন্ত্রী পরিষদ ও বিচার ব্যবস্থার কোন কার্যক্রমে জনগণের অংশগ্রহন বা মতামত দেয়ার পদ্ধতিগত ব্যবস্থা নেই। ফলে আইন প্রণয়ন হয় আমলতান্ত্রিকভাবে; নির্বাহী সকল কাজ চলে আমলাদের দ্বারা, মন্ত্রীগণ সেখানে নিমিত্ত মাত্র এবং বিচার ব্যবস্থা চলে পুলিশী তদন্ত ও পক্ষে বিপক্ষের উকিলী বাহাসের মর্জি মাফিক। কোথাও জনগণ বা তাদের মতামতের অস্তিত্ব নেই। মিডিয়া ও সভা সেমিনারে যে টুকু আলোচনা বা সমালোচনা প্রকাশ পায় তাও সীমিত এবং বিশেষ বিশেষ শ্রেণীর মতামত; সার্বিক জনগণের মতামত সেখানে অনুপস্থিত। তা ছাড়া মিডিয়া ও সভা সেমিনারের মতামত গ্রহনের কোন বৈধ পদ্ধতি না থাকায় সে সকল মতামত গ্রহন করা সরকারের সদিচ্ছা নির্ভর হয়।
স্থানীয় প্রতিষ্ঠান যেমন ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদ এবং পৌরসভা/ সিটি করপোরেশন ইত্যাদির অবস্থা আরও করুণ। এখানে নির্বাহী বিভাগের (পরিষদ) জবাবদিহিতার জন্য কোন নির্বাচিত সংসদ নেই এবং বিচারের জন্য স্থানীয় আদালত নেই; এসব কেন্দ্রের অধীন। ফলে সেখানে আমলাতন্ত্র প্রবল প্রতাপশালী। জনগণ বা জনগণের মতামত শুধুমাত্র ভোটদান; তারপর আল্লাহ ভরসা। সবকিছুর মালিক প্রতিনিধিগণ।
সুতরাং সমাধান পেতে হলে স্থানীয় সংসদ ও স্থানীয় বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে জনগণের ক্ষমতায়ন করতে হবে।
সৈয়দ ঋয়াদ বলেছেনঃ
গ্রুপ ক্যাপটেন আপনি ভাল বলেছেন, আসলে আমি যেটা বলতে চেয়েছি তা হয়তো থোরাই লিখতে পেরেছি। তবে বিষয়টা আপনি আরও পরিষ্কার করেছেন।তবে কেন্দ্র যখন সব নিয়ন্ত্রণ করে তখন আর জনগনের নিয়ন্ত্রনে কিছুিই থাকে না। যেমন প্রভাবশালী সাংসদদের ভাই বেরাদর, স্ত্রী, পুত্র, জামাতা সবাই ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন। সে ক্ষেত্রে রাজনীতির নির্ণায়ক আর তৃণমূল থাকে না।