চোখ খুলুন মাননীয় মন্ত্রী

কাজী তাহসিন আহমেদ
Published : 11 Sept 2015, 05:34 AM
Updated : 11 Sept 2015, 05:34 AM

সকাল তখন সাড়ে নয়টা। সিদ্ধেশ্বরীতে অবস্থিত একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। দশটা থেকে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা। পরীক্ষা শুরু হতে আর আধা ঘন্টা বাকি অথচ শতাধিক স্টুডেন্ট লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে রেজিস্ট্রার অফিসের সামনে। আর্থিক অনটনে তারা এই সেমিস্টারের টিউশন ফি এখনো দিতে পারেনি। অস্থায়ী এডমিট কার্ড / পরীক্ষা দিতে বসার পারমিশন নেয়ার জন্য তারা এখনো লাইনে দাঁড়িয়ে।

মহাখালির প্রাইভেট ভার্সিটি স্টুডেন্টদের মেস পাড়া। স্যাঁতস্যাঁতে পুরনো বাড়ির দোতলার মেসে কয়েকজন ছাত্র মিলে বাস করে। তারা প্রতিদিন দু'বেলা ভরপেট খাবার খায়। আর সকালে আর বিকেলে শুধু টোস্ট বিস্কিট। তাদের কারো দুটোর বেশি জামাকাপড় নেই। ক্যাম্পাসে যাবার সময় সবাই সবার ড্রেস শাফলিং করে পড়ে। এত অনটনের কারন এই মেসের সবাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হলেও আদতে প্রত্যেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের একই এলাকার কৃষকদের সন্তান। তাদের টিউশন ফি যোগাড় হয় কখনো ধান বেঁচে তো কখনো জমি। আর ঢাকায় থাকার খরচ তারা নিজেরা যোগায় ইন্সুরেন্স এজেন্ট / কল সেন্টার / সেলসম্যান / টিউশনি করে।

বনানির ক্যাম্পাস পাড়া। প্রাইভেট ভার্সিটির একটি মেয়ে তার ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান এর কাছে এসেছে টেস্টিমোনিয়াল নিতে। আরো একবছর বাকি তার পড়াশুনা শেষ হতে। কিন্তু মায়ের কিডনিতে অসুখ ধরা পড়ায় চিকিৎসায় অনেক খরচ যাচ্ছে। এ অবস্থায় আপাতত টিউশনি ফি দিয়ে তার আর পড়া সম্ভব না। সে তাই এক বছরের গ্যাপ নিচ্ছে। বাবার পক্ষে এখন সম্ভব না সন্তানের টিউশন ফি'র যোগান দেয়ার। মেয়ের ভবিষ্যত পড়াশুনা এখন অনিশ্চিত।

বারিধারার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে একটি ছেলে এক বছর ধরে প্রতি সেমিস্টারে মাত্র একটি করে সাব্জেক্ট নিচ্ছে। তার বাবার চাকরি চলে যাওয়ায় পারিবারিক অনটন চলছে। ক্যাম্পাসের পার্ট টাইম জব এর বেতন মিলিয়ে প্রতি সেমিস্টারে এক সাব্জেক্টের বেশি নেয়া তার জন্য আপাত কস্টকর। কস্ট করে হলেও সে লেখাপড়া শেষ করতে চাচ্ছে। উত্তরার একটি প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ। এক ভদ্রলোক তার মেয়ের টিউশন ফি জমা করে এসে নিজের চোখ মুছলেন। ভদ্রলোক তার দুইটি দোকানের একটি আজকে বিক্রি করে দিয়েছেন সন্তানের ডাক্তারি পড়ানোর খরচ যোগানোর জন্য। ভদ্রলোকটির মা মারা যান মাঝরাতে, তিনি তখন ডাক্তার খুঁজে পাননি। তখন থেকে তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে নিজের এক সন্তানকে তিনি ডাক্তারি পড়াবেন। তা যত কষ্টই হোক।

মাননীয় মন্ত্রী,
এই ধারনা বদলান যে বড়লোকের সন্তানরাই শুধু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। কোন এক কালে বিভিন্ন নাটক আর বিজ্ঞাপন, বিশেষ করে কোন এক মোবাইল কোম্পানি তাদের বিজ্ঞাপনে ডিজুস, জোস, আরে মাম্মা, আবার জিগায় প্রভৃতি শব্দ দিয়ে প্রাইভেটের স্টুডেন্টদের অনেক বোকা অনেক অনর্থক আর অনেক বড়লোক ট্যাগ লাগিয়ে দিয়েছিল। প্রাইভেটের শিক্ষার্থীদের বিলাস জীবন নিয়ে তৈরী হওয়া ভ্রান্ত এসব ধারনা থেকে বের হোন। সামগ্রিক বিচারে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সিংহভাগ শিক্ষার্থীই মধ্যবিত্ত পরিবারের, শুধুমাত্র সন্তানের ভবিষ্যত এর জন্য যারা কষ্ট করে টিউশন ফি ম্যানেজ করে এবং প্রতিটা টাকা তাদের জন্য দামি, হোক দশ টাকা বা দশ হাজার। বিশ্বাস না হলে আপনি জরিপ চালিয়ে দেখতে পারেন।

মাননীয় মন্ত্রী,

এত কিছু লিখে দেখালাম আর বৃত্তির ব্যাবস্থা না করে উল্টো আপনি কিনা বলেন যারা ৪০-৫০ হাজার টাকা টিউশন ফি দিতে পারে তাদের জন্য নাকি ৭.৫% ভ্যাট কিছু না।

মাননীয় মন্ত্রী,

যেখানে সাত লাখ শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয় আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সিট মাত্র পঞ্চাশ হাজার, সেখানে কিনা ছাত্রদের ভতুর্কি না দিয়ে আপনি নাকি ভ্যাট চাপানো যৌক্তিক মনে করেন।

মাননীয় মন্ত্রী,
তেল গ্যাস বিদ্যুৎ থেকে অতিরিক্ত পাওয়া হাজার কোটি টাকা আর পাশাপাশি কত কত হলমার্ক টাইপ দুর্নীতি / অর্থকেলেংকারীর রিপেয়ারযোগ্য ফুটো, তবু আপনার নাকি দেশ চালাতে প্রাইভেট ভার্সিটির ৭.৫% ভ্যাট এর টাকাটাই মুখ্য।

মাননীয় মন্ত্রী,

অন্য কাউকে বোঝাতে এত কিছু বলতে হয়না। শুধু আপনার জন্য এতকিছু লেখা। নইলে অন্য যে কেউ বোঝে যে শিক্ষায় আবার ভ্যাট কি? শিক্ষা পন্য হলো কবে থেকে?? তর্কের খাতিরে ধরে নেই প্রাইভেট ভার্সিটির প্রত্যেক শিক্ষার্থী কোটি টাকার মালিক। তবু শিক্ষায় কেন ভ্যাট হবে? পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে এমন অপমানজনক ও সরকার প্রদত্ত বিভাজন কেন টানা হবে?

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কে না আইনগতভাবে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান বলা হয়? এই ভ্যাট দেয়া কি শিক্ষাকে পন্য আর বিশ্ববিদ্যালয়কে ফ্যাক্টরি ইমেজে দাঁড় করাচ্ছে না? আপনি কি ভুলে গেছেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেসরকারি হলেও উপাচার্য হচ্ছেন স্বয়ং রাষ্ট্রপতি?

মাননীয় মন্ত্রী,
রাষ্ট্র যখন এত এত শিক্ষার্থীর জন্য উচ্চশিক্ষার ব্যাবস্থা করতে পারেনি, তখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এর প্লাটফর্ম তৈরি হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমস্যা নয়, সমাধান। এদেশের বাঘা বাঘা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান দেখুন বা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি, অথবা আমেরিকা, জার্মানি কিংবা অস্ট্রেলিয়ায় গবেষনারত বাংলাদেশি, বা আজকের সফল বিসিএস ক্যাডার, সবখানেই আপনি হাজার কষ্টেও সরকারের সাহায্য ছাড়া পড়াশুনা শেষ করে, গৌরবে মাথা উঁচু করে রাখা প্রাইভেট ভার্সিটির শিক্ষার্থী খুঁজে পাবেন।

চোখ খুলুন মাননীয় মন্ত্রী।

( facebook.com/auspicious.praise )