হতাশ হয়ে পড়ছেন রাষ্ট্রায়ত্ব বানিজ্যিক ব্যাংকের হাজার হাজার তরুণ কর্মকর্তা

রিপন অাবু হাসনাত
Published : 12 August 2015, 05:49 AM
Updated : 12 August 2015, 05:49 AM

রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক অর্থাৎ সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক যখন লোকসানের ভারে ডুবতে বসেছিল তখন এই ব্যাংকগুলোকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানীতে রূপান্তরিত করা হয় ২০০৭ সালের নভেম্বর মাসে। এছাড়া, ভূতপূর্ব বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থাকে একীভূত করে ২০০৯ সালে গঠন করা হয় বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড। শতভাগ রাষ্ট্রমালিকাধীন এই পাবলিক লিমিটেড কোম্পানী তথা ব্যাংকগুলোকে সংকটময় অবস্থান থেকে উত্তোরণের লক্ষ্যে নিয়োগ দেয়া হয় প্রচুর সংখ্যক তরণ কর্মকর্তাকে। তারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ব্যাংকের শাখাগুলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রকার সেবামূলক কাজে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে দেশ ও জাতির সেবা করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। কিন্তু, এসব তরুণ কর্মকর্তার সাথে চলছে প্রতিনিয়ত প্রতারণা। পাবলিক লিমিটেড হবার পর ব্যাংকের অভ্যন্তরে আনা হয় অনেক পরিবর্তন।

পাবলিক লিমিটেড কোম্পানী হবার পরে যে সকল কর্মকর্তারা ব্যাংকে নিয়োগ পান তাদেরকে পেনশন সুবিধার আওতার বাইরে রাখা হয়। অর্থাৎ তারা রিটায়ার করার পরে অন্যান্য সরকারি চাকুরিজিবীদের মত পেনশন সুবিধা পাবেন না। ফলে, তাদের ভবিষ্যত জীবনের অবলম্বনের রাস্তা রুদ্ধ করে ফেলা হয়। বিনিময়ে তাদের জন্য প্রচলন করা হয় গ্রাচুইটি নামক ব্যবস্থা যা অন্যান্য বেসরকারী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে প্রচলিত।

একজন জিপিএফ (জেনারেল প্রোভিডেন্ট ফান্ড)/ পেনশন সুবিধার আওতাধীন কর্মকর্তা ও একজন সিপিএফ (কন্ট্রিবিউটরি প্রোভিডেন্ট ফান্ড)/ গ্রাচুইটির আওতাধীন কর্মকর্তার মাঝে যে বৈষম্য পরিলক্ষিত হয় তা মোটামোটি এরকম-

১। একজন জিপিএফ/ পেনশন ভোগী মূল বেতনের ১০ -৩০ শতাংশ ভবিষ্য তহবিলে জমা করতে পারেন, এখানে ব্যাংক কোন অনুদান প্রদান করে না। কিন্তু কর্তৃপক্ষ চাকুরী শেষে তাকে সমুদয় অর্থ মুনাফাসহ প্রদান করে থাকে। অন্যদিকে একজন সিপিএফ/ গ্রাচুইটি ভোগী কর্মকর্তা ভবিষ্য তহবিলে তার মূল বেতনের ১০% জমা রাখতে পারেন; এক্ষেত্রে ব্যাংকও ১০% অর্থ অনুদান হিসেবে প্রদান করে।

২। ২৫ বছর নিয়মিত চাকুরী শেষে একজন জিপিএফ/ পেনশন ভোগী কর্মকর্তা আনুতোষিক বাবদ ৮০ মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ প্রাপ্ত হন। অন্যদিকে একজন সিপিএফ/ গ্রাচুইটি ভোগী কর্মকর্তা সার্ভিস লাইফের দিগুন (২৫ বছর চাকুরী হলে ৫০, ৩০ বছর চাকুরী হলে ৬০) মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ আনুতোষিক বাবদ প্রাপ্ত হবেন। যা একজন জিপিএফ/ পেনশন ভোগী কর্মকর্তা তুলনায় অনেক কম। অর্থাৎ একজন সিপিএফ/ গ্রাচুইটি ভোগী কর্মকর্তা ২০-৩০ মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ কম প্রাপ্ত হবেন।

৩। একজন জিপিএফ/ পেনশন ভোগী তার প্রাপ্ত মাসিক পেনশন যা এককালীন জমা করলে ৪০ মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ প্রাপ্ত হন। অন্যদিকে একজন সিপিএফ/ গ্রাচুইটি ভোগীর ক্ষেত্রে পেনশনের কোন সুবিধাই রাখা হয়নি। ফলে একজন সিপিএফ ভোগী ৪০ মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ কম প্রাপ্ত হবেন।

৪। একজন জিপিএফ/ পেনশন ভোগীর ক্ষেত্রে সুপার এনুয়্যেশন তহবিলে ৩০% সঞ্চিতি রাখা হয়। অন্যদিকে একজন সিপিএফ/ গ্রাচুইটি ভোগীর ক্ষেত্রে গ্রাচুইটি তহবিলে ১৫% সঞ্চিতি রাখা হয়। এক্ষেত্রে ১০% অনুদান সহ হিসেব করলে মোট ৫% সঞ্চিতি কম রাখা হয়।

সার্বিক বিবেচনায় দেখা যায় যে, একজন সিপিএফ/ গ্রাচুইটি ভোগী একজন জিপিএফ/ পেনশন ভোগীর তুলনায় ২৫-৩০ বছর চাকুরী শেষে দেড়গুণ কম আর্থিক সুবিধা প্রাপ্ত হন যা প্রত্যক্ষ বৈষম্য।

এতে করে দেখা যায় রিটায়ার করার পরে একজন সিপিএফ/ গ্রাচুইটি ভোগী কর্মকর্তা যে আর্থিক সুবিধা পাবেন তা একজন সরকারী কর্মকর্তা বা জিপিএফ/ পেনশন ভোগীর তুলনায় অনেক গুণ কম। শর্ত ছিল, পাবলিক লিমিটেড কোম্পানীতে রূপান্তরিত হবার পরে এই সকল কর্মকর্তাদের সুবিধার্থে ব্যাংকের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো চালু করা হবে। রাষ্ট্রায়ত্ব বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রবিধানমালাতেও স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে, ব্যাংকগুলোতে স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো চালু করা হবে। ফলে তরুণ ব্যাংকারগণ আর্থিকভাবে লাভবান হবেন। একজন বেসরকারী ব্যাংক কর্মকর্তার সাথে তুলনা করলে দেখা যায় যে, একই ধরনের নিয়মের আওতায় থাকা সত্বেও একজন বেসরকারী ব্যাংক কর্মকর্তা যেখানে একই শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে মাসে ৫০০০০ টাকা বেতন পান-প্রতি মাসে ভবিষ্য তহবিলে জমা রাখতে পারেন প্রায় ৫০০০ টাকা- সেখানে রাষ্ট্রায়ত্ব একজন কর্মকর্তা বেতন পান মাত্র ১২০০০ টাকা- আর ভবিষ্য তহবিলে জমা রাখেন মোটে ৮০০ টাকা। অথচ তারা শিক্ষাগত যোগ্যতা বা অন্যান্য দিক দিয়ে কোনভাবেই একজন বেসরকারী ব্যাংকের কর্মকর্তার চেয়ে কোন অংশে কম নন।

বর্তমান সরকার ২০১০ সালে প্রথম রাষ্ট্রায়ত্ব বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়নের উদ্যোগ নেন। কিন্তু বাংলাদেশের আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সেটা আটকে যায়। সর্বশেষে অর্থমন্ত্রী নিজে একটা বেতন কাঠামোর প্রস্তাবনা তৈরি করে সচিব কমিটির অনুমোদনের জন্য পাঠান। সৌভাগ্যক্রমে সচিব কমিটি সেই বেতন কাঠামোতে কিছুটা পরিবর্তন করে অনুমোদন করে। এরপর সেটা অর্থমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যায় এবং প্রধানমন্ত্রীয় সেই বেতন কাঠামো অনুমোদন করে বাস্তবায়নের জন্য অর্থমন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠান। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। যখন স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর ঘোষণা আসবে আসবে করছে ঠিক তখনই ৫ই জানুয়ারীর নির্বাচনকে অজুহাত হিসেবে দাড় করিয়ে মন্ত্রনালয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তা হিংসার বশবর্তী হয়ে আইনের দোহাই দিয়ে এই বেতন কাঠামো আবার আটকে দেয়। আইনে আছে, নির্বাচনী তফসিল ঘোষনা করার পর নির্বাচনে দ্বায়িত্ব পালন করবেন এমন কাউকে কোন আর্থিক সুবিধা বা আর্থিক সুবিধার ঘোষনা প্রদান করা যাবেনা। নির্বাচন গেল, সরকারেরও প্রায় দুই বছর হতে চলল, স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর ফাইলও চাপা পড়ে গেল। আর এভাবেই রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের তরুণ কর্মকর্তাদের সাথে প্রতিনিয়ত প্রতারণা করা হচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকে ২০০৭ সালের পরে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আর্থিক সুবিধাদীর ধরন বেসরকারী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মত হলেও তাদেরকে বেতন পেতে হয় সরকারী স্কেলে যা তাদের ভবিষ্যতকে তিলে তিলে অন্ধকারের মাঝে ঠেলে দিচ্ছে। আর এর ফলে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের তরুণ কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়ছেন যা এই লিমিটেড ব্যাংকগুলোর ভবিষ্যতের জন্য কখনও সুফল বয়ে আনবে না।

বেসিক ব্যাংক সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের আইনগত ভিত্তি অভিন্ন হলেও বেসিক ব্যাংকের কর্মকর্তাগণ তাদের তিনগুন বেতন ভাতাদি প্রাপ্ত হচ্ছেন। প্রাইভেট ব্যাংকগুলো ভাল বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে সরকারি ব্যাংকের প্রশিক্ষিত জনবল নিয়ে গেলেও সরকারের কিছু করণীয় থাকছে না। ধরে রাখতে পারছে না এসব মেধাবী জনবল। ব্যাংককে প্রতিযোগিতা করতে হয় অন্য ব্যাংকের সাথে। যেখানে প্রাইভেট ব্যাংকগুলো ৪০/৫০ হাজার টাকা বেতন দিয়ে কর্মী নিয়োগ দেয় সেখানে পাবলিক লিমিটেড ব্যাংকগুলোতে দেয়া হয় সরকারি স্কেলে বেতন ( ১২-১৫ হাজার টাকা)।

আইএমএফ কর্তৃক মনোনীত সরকারী ব্যাংক সমূহের সংস্কার কার্যক্রমের জন্য যে প্রস্তাবনা সমূহ উল্লেখ করে উপদেশ প্রদান করে সেগুলোর মধ্যে উন্নত বেতন কাঠামো ছিল অন্যতম। কিন্তু,তা না করে ঘোড়ার আগে গাড়ী চালিয়ে আবারও ধ্বংসের দিকে এগিয়ে দেয়া হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত বানিজ্যিক ব্যাংকসমূহকে। কোটি কোটি টাকার শ্রাদ্ধ হবে ঠিকই কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হবে না। মেধা নির্বাসন আর দূর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে এই ধ্বংসকে আরও ত্বরান্বিত করা হবে।

ব্যাংকারদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর বিরুদ্ধে যেসব সরকারী কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময়ে অবস্থান নিয়েছেন, এখনো নিচ্ছেন এবং ভবিষ্যতেও নিবেন তাদেরকে এটুকু বলতে চাই যে, আমরা রাষ্ট্রায়ত্ব লিমিটেড কোম্পানির ব্যাংকাররা চাকুরী শেষে আর্থিক সুবিধা আপনাদের চেয়ে অনেক কম পাব। আপনারা মাসে মাসে পেনশন ভাতা পাবেন আর আমরা পাবনা। তাই, দয়া করে, না বুঝে স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের বিরোধিতা করবেন না। বিষয়টি অনেক স্পর্শকাতর এবং মানবিকও। আমরা রাষ্ট্রায়ত্ব লিমিটেড কোম্পানীর তরুণ ব্যাংকাররা দ্রুত স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন চাই।

লেখক: একজন ব্যাংকার।