সাধের বসন্ত…!

তন্ময় সাগর
Published : 16 Feb 2018, 02:25 AM
Updated : 16 Feb 2018, 02:25 AM

প্রাচীন আমল থেকেই বাংলায় বসন্ত উৎসব পালিত হওয়ার খবর আমরা পাই। যদিও ঢাকায় বা সারাদেশে এখন যেভাবে আনুষ্ঠানিকতার সাথে বসন্ত বরণ হয় তার চল বঙ্গাব্দ ১৪০১ থেকে।

ঋতুরাজ বসন্তের আগমন উদযাপনের সাথে প্রাচীন আমল থেকেই ভালোবাসার বা নর-নারীর পারস্পারিক সৌহার্দ্য প্রকাশের খবরও আমরা পাই। আর এখন তো, যে বেশে এই দিনে রাজপথ ও গলিপথ তরুণ-তরুণীরা দখলে রাখে এতে করে দিনটি কেবলমাত্র তাদেরই দেয়া-নেয়ার মনে হয় বৈকি। ১ ফাগুন তাই বাংলা ভাষাভাষীদের ভালোবাসা জানান দেবারও দিন হয়তোবা।

বসন্ত বরণের মত বর্ণিল একটি দিনের ঠিক পরের দিনই দেশে ১৪ ফোব্রুয়ারি ভ্যালেইন্টাইন দিবস পালন হওয়াটা বিরাট একটা মরিচীকা! কর্পোরেট প্রপঞ্চ বটে। ভ্যালেন্টাইনের চাইতে বহুগুণে বর্ণিল, দেশজ ও একান্তই আপন একটি দিবস বসন্ত বরণের অর্থাৎ ১ ফাল্গুন। ভালোবাসা জানান দেবারও বিস্তর সুযোগ আছে বসন্তের এই প্রথম দিনটিতে। তাহলে ১৪ ফেব্রুয়ারির ভ্যালেন্টাইন দিবস আমদানির প্রয়োজনের হেতুটা কী?

আমরা তো ইতিহাস বিমুখ। আমি নিজেও তাই। এরশাদ সরকারের আমলে কুখ্যাত মজিদ খান শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে ১৪ ফেব্রুয়ারি জীবন আত্মত্যাগ করেছিল জাফর-জয়নাল-দিপালী। তাঁদের আত্মত্যাগের বিষয়টা তো আমরা প্রায় ভুলেই গেছি। জাতীয়ভাবে কোন কর্মসূচী এ দিন অর্থাৎ ১৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হয় কি না বা হলেও তার খবর এদেশের সংবাদ মাধ্যমে পাই না। যতটা পাই সাড়ম্বরে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন দিবস পালেনর খবর।

১৪ ফেব্রুয়ারি এদেশে ভ্যালেন্টাইন দিবস যে মাত্রায় পালিত ও সংবাদ মাধ্যমে যে মাত্রায় খবরা-খবর প্রকাশিত হয়, এতে মনে হতে পারে এদিনটি গুরুতর এক আন্তর্জাতিক দিবস। সারা বিশ্বে খুব ঘটা করে পালিত হয়। আদতে ১৪ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৩৮ টি দেশে ভ্যালেন্টাইন দিবস হিসেবে পালিত হবার খবর আমরা পাচ্ছি। আগামি বছর নাকি সেটা কমে ৩৫ এ নামবে!! বিশ্বের ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন তারিখে ভ্যালেন্টাইন দিবস অর্থাৎ ভালবাসার দিন উদযাপনের নজিরও পাওয়া যাচ্ছে। কেতাদুরস্থ ও ইনটেলেক্ট ইউরোপেও নাকি তিনটি ভিন্ন ভিন্ন তারিখে ভ্যালেন্টাইন অর্থাৎ ভালবাসা দিবস উদযাপিত হয়।

সারা (?) বিশ্বে ভ্যালেন্টাইন দিবস উদযাপনের একটা তথ্যবহুল চিত্র আমরা সাপ্তাহিক শারদীয়া সম্পাদক ও কাব্যলোক ক্রিয়েটিভস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল্লাহ মাসুম শ্রদ্ধয়ের লেখা থেকে পাই-

"বিশ্বের কয়েকটি দেশে ভ্যালেন্টাইন দিবস পালন রীতিমতো অপরাধ- যেমন ইন্দোনেশিয়া, ইরান, মালয়েশিয়া…. আবার সব দেশে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন দিবস পালন করা হয় না, তাদের নিজ নিজ দেশের সংস্কৃতির সাথে মিল রেখে ভালবাসা দিবস পালন করে থাকে। ইউরোপেই তিনটি ভিন্ন ভিন্ন দিবসে পালিত হয় দিবসটি। ওয়েস্টার্ন ক্রিস্টিয়ান চার্চের অনুসারীগণ ১৪ ফেব্রুয়ারি, ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চের অনুসারীগণ দুটি ভিন্ন ভিন্ন দিনে, ৬ জুলাই এবং ৩০ জুলাই পালন করে ভ্যালেনটাইন ডে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ কলাম্বিয়া এ বছর ভালবাসা দিবস পালন করবে ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ সালে ওরা একই দিবস পালন করবে ২১ সেপ্টেম্বর। ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশে ভালবাসা দিবস পালিত হতো ২২ ফেব্রুয়ারি, ১২ মার্চ ও ১৩ জুন। কোনো কোনো দেশে একেক বছর একেক দিনে ভ্যালেন্টাইন ডে পালিত হয়। এ বছর বিশ্বের মাত্র ৩৮টি দেশ ১৪ ফেব্রুয়ারি এই দিবস পালন করবে। আগামী বছর করবে ৩৫টি দেশ।"

এদেশে ১৪ ফেব্রুয়ারি আন্দোলন ও আত্মত্যাগের দিনটিতে ভ্যালেন্টাইন দিবস হিসেবে উদযাপনটা আমাদানি হয় সম্ভবত 'লাল গোলাপ' ও 'যায় যায় দিন' খ্যাত শফিক রেহমান এর হাত ধরে। শফিক রেহমান পশ্চিমা বহু কিছুর সাথে এদেশের জনগণকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। ১৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে ভ্যালেন্টাইন দিবসের আমদানি এই শফিক রেহমানের নিছক স্বভাবজাত কর্ম , নাকি নেপথ্যে জটিল ও কুটিল রাজনীতি এবং কর্পোরেট মুনাফার প্রশ্ন জড়িত সেটা সম্ভবত আরো বিশ্লেষণের দাবি রাখে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন দিবস আমদানি সত্যিই সচেতন অপচেষ্টা আন্দোলন- আত্মত্যাগ বিস্মৃত করবার!

ইতিহাস বিমুখ ও বিস্মৃত জাতি হিসেবে দীপালিদের আত্মত্যাগ ভুলতে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেনটাইন দিবস উদযাপন আমদানীর নেপথ্যের কারণ হিসেবে ইতিহাস-আত্মত্যাগ ভুলিয়ে দেবার সচেতন অপচেষ্টা আমাদের দরকার হয়না। একটা মাত্র উপলক্ষ্য বা বলা ভালো ছুতো পেলেই হলো আমাদের। তাই নয় কি?

১৪ ফেব্রুয়ারি আন্দোলন-আত্মত্যাগ স্মরণের জায়গায় ভ্যালেন্টাইনের মত ঠুনকো দিবস আমদানি কী তবে এক ঢিলে দুই পাখি শিকার? গৌরাবান্বিত ইতিহাস ভোলানো আবার বাণিজ্যে বসতি করা!! এদেশে তো বেনিয়াগিরিও সহজ কর্ম। বেনিয়াদের দ্বারা প্রতারিত হতে আমরা সুখ পাই সবসময়।

আসছে বছর ১ ফাগুনে নিজেকে ও ভালোবাসার মানুষটিকে আরো বেশি করে রাঙান ফাগুনের আগুনে। দেশের সোদা মাটির গন্ধে। প্রতারিত হতে হবে না। ইতিহাস বিস্মৃতির দায়ও নিতে হবেনা।