আমার শহরে রবীন্দ্রনাথ!

তন্ময় সাগর
Published : 13 March 2018, 09:16 PM
Updated : 13 March 2018, 09:16 PM

পাঁচ মাস বয়সের পর থেকে পুরো শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের উন্মেষকালটি কেটেছে নিরুত্তাপ ও শান্তিপ্রিয় কিন্তু দারুন সব আন্তরিক মানুষদের শহর নীলফামারীতে। নিজের শহর বলতে এখনো তাই নীলফামারীকেই বুঝি। বয়স যখন বাইশ তখন ছাড়তে হয়েছে নীলফামারী। আমার জীবনের সবচে সেরা সময় কেটেছে নীলফামারীতে। আমার জীবনের সবচেয়ে করুণ কষ্ট নীলফামারী থেকে চলে আসাটা।

জীবনের প্রায় সব প্রথমগুলো পেয়েছি নীলফামারীতে। পড়াশুনার হাতেখড়ি, রাজনীতির প্রথম পাঠ, পৃথিবীকে দেখা আর প্রথম ভালবাসা। সব। সবকিছু। বাবার চাকরির সুবাদে নীলফামারীতে গেলেও একেবারে প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই বসবাসের কারনে শহরটিতে নিজেকে আগুন্তক মনে হয়নি কখনো। আমি যে 'আমি' তার বোধটিও তো এই শহরেই তৈরি! নীলফামারীতে বড় পাওয়া ছিল সব সাদা মনের মানুষদের সঙ্গ। নীলফামারীর প্রায় সবাই সাদা মনের মানুষ।

নৃতাত্ত্বিকভাবে নীলফামারীর স্থানীয় বা ভূমিপুত্রদের শহরে বসবাস কম ছিলো বা এখনো তাই হয়ত। শহরটাতে পাবনা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, চাঁদপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, টাঙ্গাইল, বগুড়া, বিক্রমপুর, সিরাজগঞ্জসহ ভারত থেকে ভূমি বিনিময় করে এদেশে আসা লোকজনেরই সংখ্যাধিক্য। শহরে পাবনাপট্টি নামে পাড়াই আছে একটা। একদম মাঝ শহরে। শহরে স্থানীয় ভূমিপুত্রের বসবাস খুবই কম।

আমাদের সবার প্রিয় বাকের ভাই, আমাদের শ্রদ্ধেয় সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী যাকে আমরা আসাদুজ্জামান নূর বলে চিনি, আদতে যিনি আসাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলী, তিনি ও তাঁর পরিবার – আত্মীয়রা এসেছিলেন ওপারের জলপাইগুড়ি থেকে। বিএনপির নেতা বাবলু প্রধান তাঁরাও এসেছিলেন ওপার থেকে, সম্ভবত জলপাইগুড়ি থেকেই। শহরটির ব্যস্ততম মোড় মড়াল সংঘ মোড়ের মড়াল সংঘের উল্টোদিকের বাড়িটা সুমনদের, যারা আমার বন্ধু প্রদীপদের প্রতিবেশি তাঁরাও এসেছিলেন ওপার থেকে বিনিময় করে।

প্রদীপরাও এসেছিলো টাঙ্গাইল থেকে। জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি এ্যাডভোকেট রামেন্দ্র বর্দ্ধণ বাপ্পী কাকারাও এসেছেন সেই পাবনা থেকে। শহরে যত 'কুন্ডু' সব এসেছেন পাবনা বা সিরাজগঞ্জ থেকে। বড় ব্যবসায়ী আলাউদ্দিন তাঁরাও এসেছেন বাইরে থেকে, পাবনা থেকে। বিশ্বজিৎ ভৌমিকরাও ভূমিপুত্র ছিলেন না। বাকের ভাই মানে মাননীয় সংস্কৃতি মন্ত্রীর ফুফু শ্রদ্ধেয় এল এন রোকেয়ার বাড়িতে বহুবার গিয়েছি, গল্প শুনেছি, খেয়েছি। জলপাইগুড়ির নারীরা কত সাহসী কত আগুয়ান সেই গল্প অনেক শুনেছি তাঁর মুখে। তাঁর ছেলে অর্থাৎ নূর ভাইয়ের ফুফুতো ভাই আহসান রহীম মঞ্জিলকে আমরা, বাবার সাথে পরিচয়ের সূত্র ধরে কাকু বলে ডাকতাম, ডাকি এখনো।

মঞ্জিল কাকুর কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো আজীবন। কাকু জানেও না কাকুকে আমি কতটা ভালবাসি, শ্রদ্ধা করি। পরিচয়ের পর থেকেই দেখেছি মঞ্জিল কাকু সিপিবি করতো। কালীবাড়ি মোড়ের শ্রীদাম দাস কাকা সভাপতি আর মঞ্জিল কাকু সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সিপিবির নীলফামারী শাখার। তখনো মঞ্জিল কাকু সম্মিলীত সাংস্কুতিক জোট নীলফামারী শাখার সভাপতির দায়িত্বে।

কাকুর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের শুরু 'নীলফামারী সাধারণ গ্রন্থাগার' এ যাতায়াত শুরুর মধ্য দিয়ে। আনুমানিক প্রায় সাত বা সাড়ে সাত হাজার বিভিন্ন বহু বিচিত্র বিষয় ও চিন্তার বই ছিলো সেখানে বা আছে এখনো। সেই গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিকের দায়িত্বটিও পালন করতেন মঞ্জিল কাকু। বই নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে, পরিবার নিয়ে, দেশ বিদেশ নিয়ে এমনকি ব্যক্তিগত জীবনযাপন নিয়েও বহু গল্প আড্ডা হত কাকুর সাথে। কাকুই বলতেন আমি তাঁর জুনিয়র ফ্রেন্ড। শব্দটিও সেই সময়ে প্রথম শোনা। ছোট ছিলাম। কী যে ভাল লাগতো আড্ডা দিতে!

কাকু সিপিবি করা লোক তো, নিজেও ব্যাপক পড়াশুনা করতেন। প্রচুর বই পড়েছি সেই সময়গুলোতে। সন্ধ্যায় শুরু করে সারারাত ধরে বই পড়ে ভোর সকালে শেষ করতাম ৭০০-৭৩০ পৃষ্ঠার বই। বই পড়ার সে কি আনন্দ! কত বিচিত্র বিষয় পড়েছি সেই সময়। কি সব দিন ছিল! সময়টা ফিরে পাওয়া গেলে সবচে খুশি হতাম। বইয়ের নাগাল পাওয়ার পাশাপাশি আমার দিক থেকে প্রথম ভাললাগার মানুষটিরও দেখা ওই গ্রন্থাগারটিতেই পাই। সে আমার চাইতে বড় বই পড়ুয়া ছিলো বা আছে এখনো হয়ত। শহর থেকে বেশ খানিকটা সুদুর হতে এসে বই পড়তো, বই নিতো। তার সাথেও বহু আড্ডার সূচনা এই গ্রন্থাগারটিতেই।

আমার বন্ধু, সেই সময়ের ডিয়ার বাউ রাজার ছেলে রিয়াদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। রিয়াদ এখন চিকিৎসক। রিয়াদ আমাকে গ্রন্থাগারটিতে নিয়ে যায়। সদস্য হই। আমার বই পড়ার শুরু। এক অনিন্দ্য আনন্দের দুনিয়ায় প্রবেশের দ্বার মুখের নাগাল রিয়াদ আমাকে পাইয়ে দেয়। কি সুখ! রিয়াদ নিজের অজান্তেই আমার জন্য একটি অন্যরকম দুনিয়ার খোঁজ এনে দেয় আমাকে।

আরেকজন আছেন যিনি আমার মানস গঠনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেন। নীলফামারীর ভূমিপুত্র, শহর হতে বেশ ক'মাইল দুরের লক্ষীচাপ ইউনিয়নের অধিবাসী স্মরণী কান্ত বিশ্বাস স্যার। টিউশনি পড়াতেন আমাকে ও আমার ছোটবোনটিকে। ছাত্রজীবনে যে রাজনীতি আমাকে দুনিয়া চিনিয়েছে, পৃথিবীকে দেখার দর্শন পাল্টে দিয়েছে যে রাজনীতি সেই রাজনীতির প্রথম পাঠ সহজ সরল নির্বিবাদী এই স্মরণী স্যারের হাতে। দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে প্রভাব বিবেচনায় স্মরণী স্যারের প্রভাবই সূদুর প্রসারী ও গভীরতর।

নীলফামারীর মানুষ অসম্প্রদায়িকই। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যদিও বড় ক্ষতের দেখা আমরা পাই। আমাদেরও জন্মের বহু আগে নীলফামারীতে জাসদের রাজনীতির ক্ষত ছিলো। ৯৬ তে রাজনীতির উন্মাদনায় সাংবাদিক বড় ভাই কামরুল ভাই পুলিশের গুলিতে নিহত হন আর এর পর গত সাধারন নির্বাচনের বিরাট ক্ষত। গত নির্বাচনের আগ দিয়ে সারা দেশেই বড় বড় রাজনৈতিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। অনেকের মূল্যায়নে সেসব হয়ত রাজনৈতিক সংঘর্ষ। নীলফামারীর রামগঞ্জে ২০১৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর সংস্কৃতি মন্ত্রীর নির্বাচনী গাড়ি বহরে প্রাণঘাতি হামলায় ৪ জন নিহত হন। শান্ত ও অসাম্প্রদায়িক নীলফামারীতে এটা স্মরণকালের ভয়াবহ অশান্তি।

'৪৭ সালের দেশভাগে সাম্প্রদায়িকতার শিকার হয়ে ওপার বাংলা হতে নীলফামারীতে আসাদের সাম্প্রদায়িক হবার সুযোগ তুলনামুলক বেশি। যেহেতু তাঁরা সাম্প্রদায়িকতার নির্মম বলি হয়েই বাপ দাদার ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য হয়ে নীলফামারীতে এসেছিলেন। নীলফামারীতে বসবাসকালে দেশভাগের শিকার হওয়াদের সাম্প্রদায়িক আচরণ করতে দেখিনি। পাইনি। বরং উল্টোটা পেয়েছি। চমৎকার মানুষ, সংস্কৃতি মন্ত্রী বাকের ভাইকে পেয়েছি আমরা।

রামগঞ্জের দুর্ঘটনাতে নীলফামারীর ভূমিপুত্রদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে বলে জানা নেই। নীলফামারীর শান্ত পরিবেশ বিনষ্টে দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আগতরাই প্রায় সর্বাংশে দায়ি। রামগঞ্জসহ পুরো জেলাটাতেই দেশের অন্যান্য অঞ্চলের আগতরা সংখ্যায় বেশ। শান্তি ও অসাম্প্রদায়িকতা বিনষ্টে এদের ভূমিকা আছে বৈকি। উল্টোটাও আছে নিশ্চিতভাবে। কিন্তু শান্তি ও সম্প্রীতি বিনষ্টের কোন ঘটনাতেই ভূমিপুত্রদের কোন সংশ্রব আমার জানামতে পাওয়া যায়নি কখনোই।

আমরা যখন বুঝতে শিখছি। এক রাস্তার শহরটার এমাথা-ওমাথা হেঁটে দৌড়ে ছোটাছুটি করছি তখন থেকেই নীলফামারীতে সংস্কৃতি চর্চার একটা ধ্বসের অনুযোগ বিদ্ব্যৎজনের কাছ থেকে আমরা জানতে পারি। উন্মুক্ত মঞ্চটাতে কালেভদ্রে অনুষ্ঠান হত। সাংবাদিক বারী ভাইরা ক'জন মিলে নাটকের মহড়া করত যা এখন পরিত্যক্ত।

আমরা যখন প্রাথমিকে তখন হুমায়ূন আহমেদসহ 'অয়োময়'র প্রায় সবাই নীলফামারীতে আসেন। বলাবাহুল্য নূর ভাইয়ের বদৌলতে। সবার অটোগ্রাফ নিয়েছিলাম মনে আছে। আরেকবার সম্ভবত ২০০১ -এ। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ভ্রাম্যমান টিমের সাথে ট্রাষ্টি বোর্ডের আলী যাকের, হাসান ইমাম আর আক্কু চৌধুরীরা সবাই। ২১ ফেব্রুয়ারিতে ভোরে খালি পায়ে প্রভাত ফেরি করেছি, করতে দেখেছি ছোটবেলায়। যত বড় হয়েছি তত কমেছে এসব। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের দারুন কাজ ছিল একটা সময় পর্যন্ত। সেটাও আমাদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে ক্ষয়ে যেতে দেখেছি।

২০০৪ এর শেষার্ধ থেকে শহরটাতে অনুপস্থিত। এখনকার পরির্তনগুলো তাই ততটা নাগালে নেই। ২০০৪ -এ বাবার চাকুরি সুবাদেই নীলফামারী ছাড়তে হয়। নীলফামারী ছেড়ে যেদিন রংপুরের মিঠাপুকুরের বাসায় উঠি সেদিন রাত তো বটেই আরো বহু রাত মাঝরাতে দম বন্ধ হয়ে ঘুম থেকে উঠে একা একা কেঁদেছি। আমি নীলফামারীতে নেই এটা আমি কোনভাবেই সহ্য করতে পারছিলাম না। কি যে হাহাকার! কি যে কষ্ট! সন্তান তো মায়ের নাড়ি ছেড়া ধন। নীলফামারী থেকে চলে আসাটাও আমার জন্য নাড়ি ছেড়ার মতই। মনে আছে, যে কোন সুযোগেই নীলফামারী যেতাম ঘন ঘন।

প্রিয় শহর। আমার শহর নীলফামারীতে শুরু হয়েছে ৩৭তম জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মেলন। বলা বাহুল্য, সংস্কৃতি মন্ত্রী শ্রদ্ধেয় জনাব নূরের বদৌলতেই। শহরটা রাঙ্গানো হয়েছে 'রাঙ্গাও তোমার শহর' নামের একটা কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে। নীলফামারীর জন্য অপার আনন্দ আর উৎসব চলছে। থাকতে পারলে দারুন প্রাপ্তি হত। দূর থেকেই অংশ নিচ্ছি। কিন্তু বুকের চিনচিন ব্যাথাটা বিদায় করতে পারছিনা। খুব মজা করছিস না রে কনক? রুবেল ভাই? তিতু, তোরা বোধহয় বুদ হয়ে আছিস গানে, রঙ্গে, আনন্দে?

নীলফামারীকে ভালবাসি। লিখছি আর কাঁদছি। বহুদিন পর কাঁদতে পারলাম তোমার জন্য নীলফামারী। আমি তোমায় ভালবাসি নীলফামারী।