পাশের দেশ ভারতের সিনেমার বাজার দুনিয়াব্যাপী। রাজনৈতিক বা স্রেফ ধর্মের কারণে চরম ভারত বিদ্বেষী এদেশের মানুষ ভারতীয় হিন্দি, বাংলা এবং গত দশক থেকে দক্ষিণী সিনেমা দেখতে দেখতে বেড়ে উঠছে।
ভারতীয় সিনেমা দেখার ইস্যুতে এদেশের বাম ডান সকলকেই একাট্টা পাই আমরা। অভিযোগ আছে হিন্দিভাষী সিনেমাগুলো বাইরের সিনেমার নকল বা দক্ষিণের সিনেমার রিমেক মাত্র। এক সময় কলকাতার বাংলাভাষী সিনেমা হিন্দিতে রিমেক হত, এখন যেমন দক্ষিণের সিনেমাগুলো হিন্দিতে হয়।
বাংলাদেশ ভারতের বাজার বটে। আলাদা করে শারীরীক দখল এ যুগে অচল চিন্তা। বাজার দখল তো দেশ দখল। সেই অর্থে বাংলাদেশ ভারতের দখলে।
ভারতের চাঁদে নামার সফলতা ব্যর্থতায় যেমন প্রতিক্রিয়াই দেখাই না কেন ভারতের সিনেমা গান দেখা চাই চাই। আর সব কিছুর মত এ জায়গাতেও ভারতকে অক্ষম গালাগালি করা ছাড়া নিজেদের সক্ষমতা বাড়াবার কোনো চেষ্টাই আমাদের নেই, হালের দুয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া।
ধর্মাশ্রয়ী বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর হিন্দি সিনেমাও ধর্মাশ্রয়ী বা উগ্র জাতীয়তাবাদে আক্রান্ত। বিজেপির আগের আমলেও এমনটা দেখেছি। ফ্যান্টম, রাজী, পোখরান, সার্জিক্যাল স্ট্রাইকসহ আরো অনেক সিনেমা কথিত ভারতীয় শৌর্য দেখাবার সিনেমার। জঙ্গি-জেহাদি মারতে পাকিস্তানের ভিতরে গোপন সফল মিশন বা মিলিটারি অপারেশন দেখানো আরো বহু সিনেমা এখন ভারতে তৈরি হচ্ছে এবং ধারণা করা যায় বিজেপি যতদিন ক্ষমতায় আছে, এই প্রবণতা চলতেই থাকবে বলিউডে। বলাবাহুল্য এসব সিনেমার প্রত্যেকটাই আরোপিত বা ফরমায়েশকৃত।
আমাদের ছোটবেলায় আমরা বিটিভিতে দেখানো 'ম্যাকগাইভার' এর দারুণ ভক্ত ছিলাম। কোনোভাবেই মিস করতে চাইতাম না ম্যাকগাইভার। ম্যাকগাইভার পরে বাংলা ডাবিং করেও দেখানো হইছে। ম্যাকগাইভার আসলে স্নায়ুযুদ্ধের আমলের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে বানানো মার্কিন প্রোপাগান্ডার অংশ ছিল মাত্র। ম্যাকগাইভারের প্রত্যেকটা অপারেশন প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ছিল এবং ম্যাকগাইভারে দেখানো বয়ান মোতাবেক অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই ছিল সেটা। আর সেই গোপন ও রোমাঞ্চকর লড়াইয়ে স্বভাবতই শুভ শক্তি অর্থাৎ এক্ষেত্রে মার্কিনীদের জয় হত। মার্কিন জনগণ বা বিশ্বের দু'ভাগে ভাগ হওয়া মানুষদের একভাগকে উজ্জীবিত রাখতে মার্কিনীরা এভাবে টিভি পর্দাও দখলে রাখতো।
ভারতের উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে বানানো ইদানীংকার সিনেমাগুলোও তাই। এই সিনেমাগুলো নির্জলা পাকিস্তান বিরোধীতা ও উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদকে প্রমোট করে আদতে। কারণ ও উপযোগীতা ভিন্ন হলেও বলাবাহুল্য, আপাদমস্তক জেহাদি রাষ্ট্র পাকিস্তান এদিক দিয়েও পিছিয়ে ভারতের কাছে, যেমনটা পিছিয়ে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন।
চাঁদে যান পাঠানো যদি ভারতের উন্নতির মাপকাঠি হয় তাহলে 'আর্টিকেল ফিফটিন' এ দেখানো চিত্র ভারতের সমাজের হাজার বছর পিছনে আটকে থাকার যথাযথ উদাহরণ।
জাতপাতে বিভক্ত ভারত সমাজের বস্তনিষ্ঠ বয়ান এই সিনেমাতে পাই। জাতপাত নিয়ে রাজনীতি, প্রশাসনযন্ত্রের ভূমিকা, হাজার বছরের লালিত অমানবিক অভ্যাস যে কত নৃশংস হতে পারে তা বেশ ভাল করেই উঠে এসেছে এই সিনেমাতে।
'আর্টিকেল ফিফটিন' এ যেমনটা দেখানো হয়েছে তাতে সিনেমাটা তৈরিতে এর নির্মাতারা শতভাগ নির্মোহ ও সৎ থাকার চেষ্টা করেছে বলেই মনে হয়। কিছু জায়গা ছাড়া।
সিনেমাতে দেখানো রাজনীতিকের মুখে নমঃশুদ্র ও ব্রাহ্মণকে এক কাতারে আসতে বলার রাজনৈতিক বয়ানটা উদ্দেশ্য প্রণোদিতই হয়তবা। হিন্দুত্বের স্বার্থে জাতপাত ভূলে উঁচুনিচু সব হিন্দুকে সমান হতে বলা হচ্ছে যবন মানে মুসলমান ঠেকাতে না কি সত্যিকার অর্থেই ধর্মের পরিচয়ের উর্দ্ধে উঠে মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার চেষ্টায়?
তরুণ আইপিএস অফিসার লোক দেখানো না, মনে প্রাণে ভারতের সংবিধান ধারণ করে সমাজে অন্তত ধর্মীয় জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে স্বীয় দায়িত্ব পালনে আন্তরিক থাকার চেষ্টা করতে দেখি আমরা। তরুণ আইপিএস অফিসার ব্যক্তি জীবনে খুবই আধুনিক মনস্ক। দুটো কাজ হয়েছে এতে, ভারতের সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব ও আধুনিকতা দেখানো হয়; আবার ভদ্র ভারত নির্মাণে রাষ্ট্রযন্ত্র আন্তরিক সেটাও দেখানো হয়।
আর্টিকেল ফিফটিনে দেখানো পথে হোক বা যেভাবেই হোক, চাঁদে যান পাঠানো ভারতের সমাজ কলুষ মুক্ত হোক। হাজার বছরের নির্মম অপ্রয়োজনীয় নৃশংস প্রথা থেকে ভারতের মুক্তি ঘটুক।