সিনেমার ‘কণ্ঠ’

তন্ময় সাগর
Published : 13 Jan 2020, 02:03 PM
Updated : 13 Jan 2020, 02:03 PM

"শুধু কথা বলা হয়নি বলে কত সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে/ শুধু কথা বলা হয়নি বলে কত মানুষ আমাদের থেকে দূরে চলে গেছে", কণ্ঠ সিনেমার কথা।

মানুষ আসলে কথা বলতে চাওয়া প্রাণী। নিজেকে ব্যক্ত করতে চাওয়া প্রাণী। যে মানুষটা সারাদিন চুপ করে থাকে অথবা যে মানুষটা সারাদিন গোমড়া মুখে থাকে, সেও আসলে কথা বলতে চায়, নিজেকে ব্যক্ত করতে চায়। হয়ত সেটা নিজের মত করে, নিজের ভাষায়।

মানুষ শুধু কথা বলতে চাওয়া, ব্যক্ত করতে চাওয়া প্রাণীও নয়। মানুষ সংযোগ স্থাপন করতে চাওয়া প্রাণীও। কারণে-অকারণে যার-তার সাথে সংযোগ স্থাপন করতে চাওয়া প্রাণী মানুষ। অনেকের সাথে যোগাযোগ কেন হয়েছিলো ভাবলে  কারণ ছাড়াই যোগাযোগ হয়েছিল এমন পাওয়া যাবে ঢের। কথা বলা যোগাযোগ স্থাপনের জন্যই। মানুষে মানুষে সংযোগ তো আমরা হরদমই করি। যারা কথায় অভ্যস্ত, যারা কথায় কথায় সুতো বুনতে অভ্যস্ত, তাদের আশেপাশের মানুষের সাথে যোগবিয়োগ হয় কথায় কথায়।

প্রচুর না হোক, অল্পই কথা বলেন। কিন্তু বলেন। হয়ত হিসেব করে মেপে কথা বলেন। এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলেন সেই পরিমিত হিসেবি কথাটুকুও বলতে পারছেন না। শব্দই বেরুচ্ছে না গলা দিয়ে। কন্ঠ রুদ্ধ। কেমন লাগবে তখন?

ঘুম থেকে উঠেই আদরের সন্তানকে ততোধিক আদুরে গলায় কাছে ডেকে নিতেন,আদর করতেন। কিন্তু পারছেন না। পারছেন না ডাকতে। কন্ঠে শব্দই বেরুচ্ছে না। কেমন অসহায় লাগবে তখন? অথবা আপনার আদরের সন্তানের কন্ঠই রুদ্ধ হয়ে গেলো হঠাৎ। আপনাকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা আদুরে গলায় বাবা বা মা ডাকতে পারছে না।

এমন পৃথিবী কল্পনা করাও অকল্পনীয়। এমনটাই ঘটেছে একজন রেডিও জকির জীবনে। তুমুল জনপ্রিয় রেডিও অনুষ্ঠানের জকি অর্জুনের কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে যায় ক্যান্সারে। কেটে ফেলে দিতে হয় তার ভয়েস বক্স। অর্জুনের কাছে তার কন্ঠটাই জীবন। মানুষ তাকে চেনেই তার কন্ঠের জন্য। তার কন্ঠ শুনে মানুষ বিমোহিত হয়। আনন্দিত হয়। আত্মহত্যা করতে যাওয়া অতি আবেগী টিনেজকেও বাঁচিয়ে দেয় এই কন্ঠ। সেই মানুষটারই কন্ঠ নাই হয়ে যায়। স্লেট, চক দিয়ে কথা বলতে হয় তাকে।

কন্ঠ মানুষের লড়াই সংগ্রামের বয়ান। মানুষ শ্বাসনালী ব্যবহার করে কথা বলে এটা তেমন ভাবে জানা ছিল না। বলা ভাল এসব নিয়ে ভাবনা বা সচেতন কোনো চিন্তা কখনোই কাজ করেনি। কন্ঠ স্বভাজাতভাবেই পাওয়া গেছে, তাই হয়ত এসব নিয়ে সচেতন কোনো চিন্তা কাজ করেনি। তবে খাদ্যনালী দিয়ে কথা বলা যেতে পারে সেটা প্রথম জানলাম 'কন্ঠ' দেখেই।

কন্ঠ বন্ধ হয়ে যাওয়া যেমন ভয়াবহ বিপর্যয়ের, খাদ্যনালী দিয়ে কথা বলার বিশেষ এই পদ্ধতি বা ব্যবস্থা ততটাই স্বস্তিদায়ক হয়ত সেই সব মানুষদের কাছে যাদের ভয়েস বক্স হারাতে হয়েছে নানাবিধ কারণে। অনেক চড়াই-উৎড়াই লড়াই শেষে অর্জুন জিতে যায়। কথা বলে অর্জুন৷ আবারো ফিরে আসে রেডিও অনুষ্ঠানে। পরিবার ও একজন ভাল চিকিৎসকের সান্নিধ্য যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ কন্ঠ সেটা আবার বোঝাবে আপনাকে। পরিবারের সহযোগ সবচে গুরুত্বপূর্ণ, মানুষের যে কোনো ইস্যুতে।

ভারতের বিশেষত কলকাতার বুদ্ধিদীপ্ত চলচ্চিত্রগুলো একটা পর্যায়ে দাঁড়িয়ে গেছে। কন্ঠ আপনাকে সেই কথাটাই আবার মনে করিয়ে দেবে। কন্ঠ একটানা দেখে যাবেন। উঠতে পারবেন না আশা করি। অর্জুনের লড়াই, নিজের লড়াই মনে হতে পারে এক সময়। পৃথা, রমিলা সবাইকে আপন, কাছের ও আন্তরিক মনে হবে। দেখতে দেখতে সিনেমাতে ঢুকে যাবেন নিঃসন্দেহে।

অর্জুন হিসেবে শিবপ্রসাদ, পৃথায় পাওলি আর রমিলায় জয়া আহসানই বোধহয় সেরা বাছাই ছিলো। ভাল লেগেছে। কন্ঠ দেখুন। নিজের কন্ঠের গুরুত্ব বুঝুন। মানুষে মানুষে সংযোগের গুরুত্ব দিন। গুরুত্ব বুঝুন। আর কন্ঠ চলুক অবিরাম। সব সময়।