বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে স্বাস্থ্য সেবা ও শিক্ষা ধ্বংস করবেন না

মোহাম্মাদ তানভীর জালাল
Published : 29 Jan 2012, 04:28 AM
Updated : 29 Jan 2012, 04:28 AM

সরকার পর্যায়ক্রমে দেশের পুরনো কয়েকটি মেডিকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় এ রূপান্তরিত করার চিন্তা ভাবনা করছে। কিন্তু কেন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার কোন যুক্তিসঙ্গত কারন আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। সারা বিশ্বে যেখানে এইসব প্রতিষ্ঠান স্কুল হিসেবে পরিচিত সেখানে এইগুলিকে নাম সর্বস্ব বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তর করার মাধ্যমে কি, এইসব প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারি করনের প্রক্রিয়া শুরু করতে চাইছে? ঢাকা মেডিকেল সহ আরও ৬টি মেডিকেলকে বিশ্ববিদ্যালয় করার যে চিন্তা ভাবনা চলছে তা স্বাস্থ্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার জন্য কোন সুফল ত বয়ে আনবেইনা বরং তা সবার জন্য একটা বিশাল ক্ষতি ও অরাজকতা বয়ে নিয়ে আসবে।

এইসব মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল গুলো সরাসরি সরকারী অনুদানে চলে আর এখানে লাখ লাখ রোগী জরুরী সেবা সহ সব ধরনের সেবা বিনা মূল্যে পেয়ে থাকে । এই সব প্রতিষ্ঠান গুলো যে ধরনের স্বাস্থ্য সেবা দেয় তা দেশের আর কোথাও দেয়া সম্ভব নয়। এখানে ধারণ ক্ষমতার কয়েক গুন রোগী থাকে। দেশের আপামর জনসাধারনের স্বাস্থ্য সেবার শেষ আশ্রয় এইসব হাসপাতাল। বলা যায় দেশের স্বাস্থ্য সেবার মেরুদণ্ড হল এই সব প্রতিষ্ঠান। যেহেতু সরকার দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে অঙ্গিকারাবদ্ধ তাই এইসব প্রতিষ্ঠানকে কোন ভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে বেসরকারি করন বা অস্থিরতার মাঝে ঢেলে দিয়ে জনগণের স্বাস্থ্য সেবাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা সমীচীন হবে না।

এসব প্রতিষ্ঠান হল দেশের ডাক্তার তৈরির কারখানা। দেশের বেশিরভাগ ডাক্তার এখান হতে বের হচ্ছে। যেহেতু এসব হাসপাতালে বিনা মূল্যে স্বাস্থ্য সেবা পাওয়া যায় তাই এখানে রোগীর অভাব নাই। আর এই রোগীর প্রাচুর্যের কারনেই এগুলো হল আদর্শ ডাক্তার তৈরির কারখানা। তাছাড়া সর্ব স্তরের ডাক্তারদের জন্য এখানে রয়েছে ট্রেনিং এর ব্যবস্থা। এখানে শতশত ট্রেনিং পোস্ট আছে, সেই সব পোস্টে হাজার হাজার ডাক্তার ট্রেনিং নিচ্ছে। একজনের ট্রেনিং শেষ হলে তার স্থলে অন্য একজন আসছে। এভাবে পর্যায়ক্রমে সকলেই পর্যাপ্ত ট্রেনিং পেয়ে মান সম্মত ডাক্তার হচ্ছে। যদি এইসব প্রতিষ্ঠানকে বিশ্ববিদ্যালয় করা হয় তাহলে এইসব ট্রেনিং পোস্টে ট্রেনিং এর জন্য সরকারী ডাক্তাররা আসতে পারবে না। ট্রেনিং এর প্রক্রিয়াটাও বন্দ হয়ে যাবে। ডাক্তার তৈরির প্রক্রিয়া হুমকির মধ্যে পড়বে। ঠিক যেমনটি হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় এ। এই বিশ্ববিদ্যালয় এ এখন কোন সরকারী ডাক্তার কোর্স ব্যতিত ট্রেনিং নিতে পারছে না। এতে করে ডাক্তারদের বিরাট একটা অংশ ট্রেনিং থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর যদি এইসব প্রতিষ্ঠানকে নাম সর্বস্ব বিশ্ববিদ্যালয় এ পরিণত করা হয় তবে জাতি যে এক বিশাল সঙ্কটে পড়বে এতে কোনই সন্দেহ নাই।

অনেকে ভাবছেন কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে,এটাত অনেক ভালো হচ্ছে। সবার আপগ্রেড হবে, সেবার মান বাড়বে, রিসার্চ হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা অনেকেই জানিনা যে এইসব মেডিকেল কলেজ গুলো কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় এরই অংশ। এখানকার ছাত্ররা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র। যেমন ঢাকা মেডিক্যাল হল ঢাকা ইউনিভার্সিটি এর মেডিসিন ফ্যাকাল্টি এর অংস। এইসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই এমবিবিএস কোর্সের সনদ দেয়। তাই এখানে আপগ্রেড হওয়ার কোন প্রশ্ন নাই বরং সার্টিফিকেট থেকে যখন এইসব বিশ্ববরেণ্য প্রতিষ্ঠানের নাম মুছে যাবে তখন নাম সর্বস্ব এইসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে সারা বিশ্বের কাছে গ্রহন যোগ্যতা হারাবে। আমাদের রিসার্চ হল রোগী নিয়ে যত বেশী রোগী তত বেশী রিসার্চ এর সুযোগ। বিশ্ববিদ্যালয় এর সাথে রিসার্চ এর তেমন সম্পর্ক নাই। সেবার মান বারানোর সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন সম্পর্ক নাই। মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় এই কনসেপ্টটাই একটা ভুল কনসেপ্ট। সারা বিশ্বে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এর সংখ্যা নগণ্য। আর এগুলো ভালো কোন প্রতিষ্ঠানও নয়। আসলে এই রকম একটি বিষয় নিয়ে কখনও বিশ্ববিদ্যালয় হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় মানেই সেখানে থাকবে সব বিষয়ের মিলন কেন্দ্র।

ডাক্তারদের অনেক দিনের দাবি ছিল একটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় এর। যদিও আসলে এই দাবিটি একটি ন্যায্য দাবি নয়। কারন একটি বিষয় নিয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয় এটা অনেকটা হাস্যকর। তারপরও অনেক দাবি দাওয়ার পর ১৯৯৮ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার আইপিজিএমআর কে বিএসএমএমইউ নাম দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করে। যদিও অনেকের দাবি ছিল আলাদা একটি বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু তা হয়নি। তারপরও সবাই খুশি হল যে যাক একটা বিশ্ববিদ্যালয়ত হল। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয় তেমন কোন সুফল বয়ে আনেনি। এখানে ঘটেছে নির্ভেজাল দলীয়করন , সাধারন জনগণের সেবার খাতকে করা হয়েছে সঙ্কুচিত, সেবা পেতে যে টাকা আর লাইন দিতে হয় তাতে অনেক রোগীই অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হন। সরকারী দল সব সময় এটাকে দলীয় সম্পদ মনে করে দলীয় লোকের নিয়োগ, প্রমোশন, অন্য দলের লোকদের ছাটাই এইসব করে বেড়ায়। এই বিশ্ববিদ্যালয় হওয়াতে দেশ,জাতি, রোগী বা সাধারন ডাক্তারদের কোন লাভ হয়নি। বরং সব দিক দিয়ে ক্ষতি হয়েছে। শুধু দলীয় কিছু ডাক্তার এর লাভ হয়েছে। এখন আবার কিছু সংখ্যক দলীয় ডাক্তার ও প্রফেসর আরও কিছু মেডিক্যাল কলেজ কে বিশ্ববিদ্যালয় নাম দিয়ে ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। এইসব প্রতিষ্ঠানকে বিশ্ববিদ্যালয় নাম দিয়ে দলীয়করণ করে দেশের স্বাস্থ্য সেবা ও শিক্ষাকে ধ্বংস করা কোন ভাবেই উচিৎ নয়। সচেতন নাগরিক হিসেবে কেওই এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাতে পারে না। আমাদের আসলে মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি এর কোনই প্রয়োজন নাই। দেশের আপামর জনসাধারন এর স্বাস্থ্য সেবাকে হুমকির মুখে ফেলে, ডাক্তার তৈরি কারখানা গুলকে অকেজো করে, সারা বিশ্বে স্বীকৃত এইসব প্রতিষ্ঠানকে না মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় এ রূপান্তরিত করে দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার কোনই প্রয়োজন নাই। যদি বিশ্ববিদ্যালয় করতেই হয় তাহলে নুতন ভাবে করা হোক। এতে সবারি উপকার হবে, কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।