আলো না অন্ধকারের পথে আমরা?

তানজির খান
Published : 27 May 2015, 06:08 AM
Updated : 27 May 2015, 06:08 AM

কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন "আমরা যদি না জাগি মা/কেম্‌নে সকাল হবে ?/তোমার ছেলে উঠলে গো মা/রাত পোহাবে তবে"।এখন আর কারো এই আকুতি নেই। তরুণ নব প্রাণ আজ আর জাগতে চায় না।এই সমাজ তাদেরকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে ধূতরা ফুল খাইয়ে। সমস্ত পথ আগলে ধরেছে অন্ধকার। জানার ইচ্ছে নেই, বোঝার ইচ্ছে নেই রহস্য।স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে অপরিপক্ক জ্ঞান নিয়ে। যুক্তিহীন ভাবে দাসত্ব করছে অন্ধকারের। ভয়াবহ ব্যাধির মত অনাচার আর যৌন নিপীড়ন চলছে শহর,নগর,গ্রামে। আর কাউকে আমরা পাচ্ছি না সমাজের মুক্তির দূত অথবা পথপ্রদর্শক হিসেবে। একটি জাতি গড়ে উঠছে ভিত্তিহীন জ্ঞানের উপর। কেউ সমস্যার সরূপ উৎঘাটনের চেষ্টা করছে না।

আমাদের দেশের অনেকেই মনে করেন যৌন নির্যাতনের কারন নারীর পোষাক। এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা  বলি। আমার এক মেসমেট পাসের ঘরে থাকেন এসে কথা  বলছিল আমার সাথে। বলছে ভাই সমাজ নষ্ট হয়ে গেলো। তার মূল কথা ছিল যে মেয়েরা খারাপ জামা-কাপড় পরে সমাজের সব নষ্ট করে দিচ্ছে আর এই জন্যেই ধর্ষণ হচ্ছে। পুরুষের দোষ দিয়ে কি লাভ,মেয়েদের কারনেই এটা হচ্ছে। আমি বললাম আর কি মনে হয় আপনার এই বিষয়ে। সে বলছে আমি পুরুষের দোষ দেই না, এই দায় খারাপ পোষাকের আর বেহায়াপোনার। নারীরা উলঙ্গ হয়ে থাকে বলেই এমন হয়।আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম আমরা সবাই যে কোন ব্যাপার খারাপ বলি নির্দিষ্ট যুক্তির ভিত্তিতে, এখন আপনি বলেন যে ওই ধরণের পোষাক কেন আপনার কাছে খারাপ লাগে? তাকে বললাম যে কোন ঘটনা খরাপ তো লাগতেই পারে নানান কারনে কিন্তু কি কারনে আপনার খারাপ লাগে? উনি বোধহয় ঠিক বুঝতে পারছিলেন না আমার প্রশ্ন। তখন পাসে থেকে আরেকজন তাকে সাহায্য করে বললেন উনি হয়তো বলতে চাচ্ছেন আমাদের ধর্মে শরীর বের হয় এমন পোষাকের অনুমোদন নাই, তাই খারাপ লাগে। তখন ওই ব্যাক্তি বললেন হ্যা সেটাই বলছি আমাদের ধর্মে অনুমোদন নাই তাই খারাপ লাগে আমার। আমি বললাম ঠিক বলেছেন।এটা যথার্থ কারন হতে পারে ওই ধরণের পোষাক খারাপ লাগার বা সমর্থন না করার। জিজ্ঞেস করলাম তার মানে আপনি নিশ্চই ধর্মীয় অনুশাসন মানেন? তার উত্তর ছিল হ্যা। তাকে বললাম, আমিও ধর্মীয় অনুশাসন মানি। তারপর তাকে জিজ্ঞেস করলাম আমাদের ধর্মে কি কোথাও লেখা আছে কোন নারী অশ্লীল পোষাক পরলে বা উলঙ্গ হয়ে থাকলে তাকে ধর্ষণ করা বৈধ? সে বলল না, কোথাও বলা নেই এই কথা।আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম পুরুষের দৃষ্টি সংযত রাখতে কি মহান আল্লাহতালা নির্দেশ দেন নাই? উনি বললেন হ্যা দিয়েছেন। আমি তাকে আবারো জিজ্ঞেস করলাম কোন যৌন উত্তেজক পোষাক পরিহিত নারীকে ধর্ষণ করলে কি ধর্ম পুরুষের শাস্তির বিধান রাখে নাই? সে কি মাপ পাবে এই অপরাধের? উনি বললেন হ্যা শাস্তির বিধান রেখেছে এবং সে মাপ পাবে না। তখন তাকে বললাম তাহলে বলেন নারী নির্যাতনে পুরুষের দোষ আছে কি না? পোষাকের দায় দিয়ে কি কোন বক ধার্মিক ব্যাক্তি মাপ পাবেন কিনা? তখন তিনি আমার সাথে আবার যুক্তিহীন বিতর্কে জড়াতে চাইলেন। আমি তাকে বললাম আমি ধর্মীয় অনুশাসন মানি,আমাদের ধর্ম যে পোষাক অনুমোদন করে না এবং আমাদের আবহমান বাঙ্গলার ঐতিয্যের সাথে যে পোষাক মেলে না তেমন  পোষাক আমিও পছন্দ করি না। তাই বলে কি, যে নারী শরীর বের হওয়া পোষাক পরে আছে তাকে ধর্ষণ করব? আমি পছন্দ করি না সেটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার।আপনি বা আমি,আমাদের পরিবার বা কাছের মানুষদের অশ্লীল পোষাক না পরার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে পারি, ইসলামের বাণী পৌছিয়ে দিতে পারি ঘরে ঘরে। এটা না করে ধর্ষণ করে ইসলাম কিভাবে প্রচার করা যায় আমার জানা নেই। আমি তাকে বললাম আপনি ইসলাম প্রচার করতে চাইলে করেন কিন্তু ধর্ষণ করতে পারেন না কোন নারী ইসলামিক পোষাক পরেনি এই দোহাই দিয়ে। সারা পৃথিবীতে ইসলামের প্রকৃত আলো পৌছেদিন,শান্তির বাণী নিয়ে যান ঘরে ঘরে কিন্তু কাউকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে,ধর্ষণ করে ইসলামকে ছোট করবেন না।

গতকাল সোশাল মিডিয়ায় আমার এক ছাত্র যুক্তিহীনভাবে আমার এবং আমার কিছু বন্ধুর সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিল।তার কথা শুনে আমি থ হয়েগেছি। সে বলেছিল "সব শিয়ালই মুরগির স্বাধীনতা চায়"। আমি অবাক হয়ে গেলাম মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব তাকে সে তুলনা করছে বুদ্ধি,জ্ঞানহীন শেয়াল আর মুরগির সাথে।পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই কত মহামানব,মানবী এসেছেন জ্ঞান,বিজ্ঞান ও ধর্ম প্রচারের জন্য। তারা তো কেউ কোনদিন এমন কথা বলেননি।তাহলে কি সেই ছেলে বা তার মত পুরুষই মহামানবদের একজন আর সেই সব মহামানব-মানবী আজকে যারা যৌন নিপিড়নের প্রতিবাদ করছেন  তাদের মতই শিয়াল আর মুরগি ছিলেন তার মতে? তারাও তো সব ধরণের নিপীড়নের বিরুদ্ধে ছিলেন। আমার ওই ছাত্রের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আমাকে হতাশ করেছে।

এভাবেই আমাদের তরুণ সমাজ অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।এই চিত্রের মাধ্যমেই পর্যায়ক্রমে বেড়ে উঠছে জঙ্গি তৎপরতা এবং তৈরী হচ্ছে জঙ্গি। চাপাতি নিয়ে মাঠে নেমে খুন করছে একের পর এক। অথচ ইসলাম কোনভাবেই এমন হত্যাকে সমর্থন করে না।এই ধরনের কর্ম সুস্পষ্টভাবে ইসলামের বিধান লঙ্ঘন করছে।

সবচেয়ে ভয়াবহ কথা হলো এই চিত্র শুধু দুই একটা না। সমাজে এমন মানসিকতায় আমাদের প্রচুর ছেলে মেয়ে গড়ে উঠছে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,বুয়েট,নর্থ সাউথ সহ দেশের প্রায় সব নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাঝে মাঝেই খবর আসছে কোন না কোন ছাত্র নিষিদ্ধ ঘোষিত ইসলামিক চরমপন্থী দলের সদস্য।এর আগে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ জন ছাত্র জঙ্গি তৎপরতার কারনে পুলিশের হাতে ধরা পরেছিল। তারা সবাই ব্লগার রাজীব খুনের কথা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছিল। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উগ্রবাদী আচরণের নিদর্শন এটাই প্রথম নয়। এর আগে কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিস নামে্র ছেলেটি নিউইয়র্কে বোমা হামলা করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল।সেই ছেলেটিও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল বাংলাদেশে থাকা অবস্থায়।একটা সময় ভাবা হতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দরিদ্র ছেলেমেয়েদের লক্ষ্য করে বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠি তাদের কর্মকান্ড চালনোর চেষ্টা করে। কারন সেই সব ছেলেমেয়েদের স্বাভাবিক পড়াশোনা বিঘ্ন ঘটে অর্থভাবে তাই তারা সহজেই জঙ্গি গোষ্ঠির ফাদে পা দেয়। কিন্তু নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যলয়ের ঘটনা প্রমান করে জোঙ্গি গোষ্ঠি আরো শক্তিশালী হয়েছে সময়ের সাথে সাথে। সদস্য সংগ্রহ চলছে আরো বেশী দক্ষ ব্রেইন ওয়াসের মাধ্যমে। এ কাজ করার জন্য তারা যেমন নানান প্রলোভন দেখাচ্ছে তার সাথে সাথে ধর্মের নানান অপব্যাখ্যা দিচ্ছে।বুয়েটের জঙ্গি সংশ্লিষ্ট ছাত্রদের ঘটনাও আমরা জানি ইতোমধ্যে। শুধু তাই নয় বুয়েটের অনেক শিক্ষকের নামেও জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠছে।

বিপদ্গামী এই তরুণেরা কিন্তু দাবী করছে যে তারা ঠিক পথেই আছে। তার অর্থ হচ্ছে যে তারা সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র হয়েও নিজেদের ভুল বুঝতে পারছে না ব্রেইন ওয়াসের কারনে। যারা সুযোগ নিচ্ছে এই তরুণ মেধাবী প্রজন্মের তারা কিন্তু খুবই সুসংগঠিত।

তাহলে কি আমরা অন্ধকারের দিকেই ক্রমাগত এগুতে থাকব? ভোর কি হবে না? আমরা কি জাগব না? এর প্রতিকারে আমাদের সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে।শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে হবে,তা না হলে এই ধারা অব্যহত থাকবেই বলে মনে হয়। নৈতিক শিক্ষার ভিত্তি গড়তে পরিবারের পাশাপাশি রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। দ্রুত অপরাধের বিচার করতে হবে।এ ক্ষেত্রে ধর্মিয় প্রতিষ্ঠানেরও ভূমিকা রয়েছে।ধর্মিয় প্রতিষ্ঠানকে ধর্মের প্রকৃত আলো ছড়াতে হবে।সমাজের সকল স্তরের মানুষকে ধর্ম ব্যবসায়ীদের হাত থেকে বাচাতে হবে। যাতে কেউ ধর্মের অপব্যাখ্যা দিতে না পারে।

একটি সুখি,সমৃদ্ধ বাংলাদেশের কামনায় এই লেখা শেষ করছি।

তানজির খান
লেখক ও সাহিত্যিক
ই মেইলঃ tanzirrkhan@gmail.com