কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও আমার দিনলিপি

তানজির খান
Published : 22 Dec 2015, 05:37 PM
Updated : 22 Dec 2015, 05:37 PM

ঘড়ির কাটায় সাড়ে এগারোটা বাজে, ঘর থেকে বের হলাম। গন্তব্য কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, দ্বিতীয় দিনের মত যাচ্ছি। রাস্তায় ইশারা করতেই রিক্সাওয়ালা গম্ভীর মুখে হাজির। বুঝলাম না বাহিরে এত রোদ অথচ এই ব্যাটার মুখে হাসি নেই কেন। একটু অস্বস্তি লাগছে কটকটে লাল জ্যাকেট পরে আছি বলে। একে এত রোদ তারপর লাল রঙ বিরক্ত লাগছে।যদিও জ্যাকেটটি গত ছয় বছরের সঙ্গী। কোনদিন এটা আমার পছন্দ ছিল না,এমনকি এটা আমি কিনি নাই। এক বিপদে ছয় বছর আগে এটা আমার সঙ্গী হয়েছিল কোন এক পৌষের রাতে। এখন অবশ্য এটার প্রতি অনেক মায়া জমেছে! সে ওই সময় গেছে বলে। রিক্সা যায়, আমি তাকিয়ে থাকি চারপাশে। কোথাও নিশ্চয়ই আমার প্রিয় কেউ লুকিয়ে আছে ভিড়ের মাঝে। এক সময় ক্ষান্ত দেই, জানি কেউ নেই আমার। হাসপাতাল থেকে কিছুদূর আগেই নামতে হলো। রিক্সা যায় না হাসপাতাল অবধি। হেটে হেটে হাসপাতাল পৌছালাম। কি চমৎকার পরিবেশ। সব যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা। নিট এন্ড ক্লিন বলে ইংরেজিতে যে বাক্য আছে তা এই হাসপাতাল অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণ করে।

হাতে ব্লাড টেস্ট এর রশিদ নিয়ে দোতলায় উঠছি। গতদিন ব্লাড পরীক্ষা করতে দিয়ে গিয়েছিলাম সেই রশিদ। খোঁজ করতেই পেয়ে গেলাম সব রিপোর্ট। ডাক্তারের কাছে গেলাম, উনি চেম্বারে নেই ওয়ার্ডে গিয়েছেন। একজন দাঁড়িয়ে থাকা রোগী বললেন মাত্রই গেছেন, পাঁচ-দশ মিনিটের মাঝেই ফিরবেন বলে রোগীদের বলেছেন ডাক্তার। মোটামুটি বড় একটা লাইন। অসীম ধৈর্য্য নিয়ে দাঁড়ালাম। বাঁচতে হলে দাঁড়াতে হয়! কথা সত্য পাঁচ মিনিটের মাঝেই ডাক্তার ফিরলেন। প্রায় আধা ঘন্টা পড়ে সেই সময় আসলো। ঘরে ঢুকতেই ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন এখন কেমন আছেন? জী একটু ভাল মনে হচ্ছে। উনি নিপাট ভদ্রলোক, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ, দেখে কেন যেন মনে হয় না সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার তিনি।

রিপোর্টগুলো হাতে নিয়ে আঁকিবুঁকি করছেন। একটা রিপোর্ট হাতে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। তারপর মৃদু হেসে বললেন সব ঠিক আছে, তবে আপনাকে একটা আল্ট্রাসোনো করাতে হবে। একটু ভিন্ন জিনিষ খেয়াল করছি। আশাকরি সন্দেহ ঠিক হবেনা।গত দুই দিন যাবৎ কেন যেন ভয় হচ্ছিলো আমার। সেটা এখন পাকাপোক্ত হল। উঠার সময় বললাম আপনার একটা ভিজিটিং কার্ড দিন। ডাক্তার হেসে বললেন আমি বাহিরে কোথাও বসি না। বললাম দুদিন আসলাম অথচ আপনার নামটাও জানতে পারলাম না। হেসে বললেন আমার নাম তারেক। আসার আগে আরও বললেন এই ঔষধ গুলো খাবেন। পরে আল্ট্রাসোনো নিয়ে আসবেন। হাসপাতালে যেখানে আল্ট্রাসোনো করায় সেই লোক বলল সকালে যদি কিছু না খান তবে এখনি করে দিচ্ছি নইলে আগামী নয় তারিখ আসতে হবে।

প্রচুর সিরিয়ালের চাপ, আজ হঠাৎ ফাঁকা তাই পারতাম করে দিতে। অগত্যা কি আর করা, নয় তারিখেই রাজী হলাম। খরচ মাত্র ২১০ টাকা, বুঝলাম সিরিয়ালের রহস্য,এত সস্তা আর ভাল ডায়গোনোসিস হয় যে সবাই এখানে করাতে চায়।গতদিন যখন চারটি ব্লাড টেস্ট করালাম তখনই দেখলাম সব পরীক্ষাই অনেক কম টাকায় এখানে করানো হয়।এর মাঝে দুটি পরীক্ষা খুবই এক্সপেনসিভ হত যদি বাহির থেকে করা্নো লাগতো।অদ্ভুত ব্যাপার হাসপাতাল থেকে আসার সময় সম্পূর্ণ ফ্রী ঔষধ দিয়ে দিচ্ছে প্রতিদিন অথচ ঔষধ গুলো প্যারাসিটামল বা স্যালাইন নয়, রীতিমত হাই পাওয়ারের এন্টিবায়োটিক যা আমার ইনফেকশন এর জন্য ডাক্তার ব্যবস্থাপত্রে লিখেছেন। দেশের বাকী সব হাসপাতালে কি রকম ঔষধ চুরি হয় তা সহজেই অনুমেয় এই ঘটনায়। এবার হাসপাতালের গেট থেকে বি.আর.টি.সি বাসে উঠলাম।বাসের গেটে একগাদা স্কুলের ছেলেপেলে, আমি ওদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি ভিড়ের মাঝে। খুব হাসাহাসি করে স্কুল থেকে ফিরছে ওরা। সম্ভবত ক্লাস নাইনের ছাত্র হবে। সেটের অংকের গল্প করছে। স্যার নাকি বোঝাতে যেয়ে একটা মেয়েকে দেখিয়ে বলেছে ধর ও তোমাদের পাঁচ জনের সাথে প্রেম করে তাহলে ও তোমাদের পাঁচ জনের জন্য কমন কিন্তু ও একজন ( বলেই পাঁচ ছয় জন বন্ধু মিলে হাসি)। মেয়েটা নাকি লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল। স্যার নাকি বুঝতে পেরে এদের মাঝে অন্য একটা ছেলেকে দিয়ে উদাহরণ দিয়েছে পড়ে। তখন নাকি আরো হাসিতে ফেটে পরেছিল ওরা। গন্তব্যে চলে এসেছি, বাস থেকে নামলাম। কেন যেন পা চলছে না, আমার উপর কি মৃত্যুভয় চেপে বসল! মনের অজান্তে ভিড়ের মাঝে কি যেন, কাকে যেন খুঁজে চলেছি। না কেউ নেই আমার যাকে খোজা যায়, কাকে খুঁজবো? কোথাও কেউ নেই।

তানজির খান
কবি,ব্লগার ও নাগরিক সাংবাদিক
ইমেইলঃ mtanzirkhan@gmail.com