বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে নারীর সবচেয়ে বড় বাঁধা কী?

তানজির খান
Published : 20 Jan 2016, 05:38 AM
Updated : 20 Jan 2016, 05:38 AM

বাংলা সাহিত্যে শরৎচন্দ্র চট্রোপাধ্যায়, হুমায়ূন আহমেদ বা সমরেশ মজুমদার এর মত জনপ্রিয় নারী উপন্যাসিক আসে নাই কেন? যাদের বই প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে পাঠক হুমড়ি খেয়ে পড়বে, এক বই মেলায় একের পর এক সংস্করণ আসবে সপ্তাহ না ঘুরতেই। নিঃসন্দেহে অনেক বড় বড় লেখিকা আমরা পেয়েছি কিন্তু কেন তদের মত তুমুল জনপ্রিয় উপন্যাসিক পাই নাই? অথচ আমরা দেখি অনেক উচুমানের নারী উপন্যাসিক আমাদের ছিল সব সময়ই। তাহলে কেন সেই অতটা জনপ্রিয়, পাঠক নন্দিত, প্রকাশকের কাঙ্ক্ষিত লেখিকা পাই নাই? এখানে পাঠকের বা পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গির দায় কতটুকু?

শুধু সাহিত্য মান নিয়ে আমি বলছি না। আমি বলছি সাহিত্যমানের সাথে পাঠকপ্রিয়তা নিয়েও। তুখোড় সাহিত্য মান সমৃদ্ধ লেখা নিয়েও অনেকে উপরের উল্লেখিত লেখকেদের জনপ্রিয়তা ছাড়িয়ে যেতে পারে নাই। অনেকেই জেনে আশ্চর্য হবেন  রবীন্দ্র যুগেও উপন্যাসিক হিসাবে শরৎ এর জনপ্রিয়তা ছিল শীর্ষে। এ কালের হুমায়ূন আহমেদ এর কথাই ধরুন, তার লেখার সাহিত্যমান নিয়ে অনেক সাহিত্য বোদ্ধা গাইগুই করলেও কিন্তু উনার চেয়ে জনপ্রিয় সাহিত্যিক  শরৎ এর পরে আর কেউ আসে নাই, এটাই সত্য। এমন কি কেউ কেউ তাকে শরৎ এর চেয়েও বেশী জনপ্রিয় বলে থাকেন।

বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অনেক অবদান রয়েছে। অনেক বড় বড় লেখিকাও পেয়েছি। যেমন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, সুফিয়া কামাল, আশির দশকে পাওয়া গেছে তসলিমা নাসরিন,কৃষ্ণা বসু এবং মলি­কা সেনগুপ্ত কে। এছাড়াও রয়েছেন আশাপূর্ণা দেবী, মহাশ্বেতা দেবী , নবনীতা দেব সেন। কিন্তু কেউ কি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌছেছেন? অনেকেই তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন এটা সত্য। বর্তমানে যারা আছেন তাদের মাঝে তসলীমা নাসরিন অন্যতম। উনার তুমুল জনপ্রিয়তা রয়েছে কিন্তু বিগত কোন সময়েই উনি বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয়তায় শীর্ষে অবস্থান করেন নি।

জনপ্রিয়তা আর সাহিত্যমান আলাদা এটা সত্য। কিন্তু সাহিত্যের পুরো ইতিহাসে কেন একজন লেখিকাকেও পাওয়া যাবেনা শীর্ষে বা কাছাকাছি। আমার এই জিজ্ঞাসার মাঝে আমি যেটা জানতে চাই তা হল পাঠক হিসাবে আমাদের কোন দায় আছে কিনা তা জানা, সমাজের কোন দায় আছে কিনা তা জানা। বাঙালী পুরুষ শাসিত ভোগবাদী সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি কি এই জন্য দায়ী?  এই প্রশ্ন প্রাসঙ্গিকভাবেই আসে কারন টেলিভিশন বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে বিলবোর্ড পর্যন্ত কারনে অকারনে নারীকে দেখা যায়। যে পণ্যের সাথে নারীর কোন দূরতম যোগাযোগও নেই সেখানেও নারীকে উপস্থাপিত হতে দেখা যায়। তাহলে কি আমরা নারীর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ দেখতে চাই না?

আমার কাছের এক বন্ধুর প্রেমিকা একটি নাম করা মেডিকেল কলেজে পড়ত। বন্ধুটি তার প্রেমিকাকে জিজ্ঞেস করেছিল এমবিবিএস শেষ করার পর তুমি কোন ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ হতে চাও পরবর্তী পড়াশোনার মাধ্যমে। সেই প্রেমিকা বলেছিল বাংলাদেশে মেয়েদের পথ দুইটা, নয় গাইনি বিশেষজ্ঞ হওয়া নতুবা শিশু বিশেষজ্ঞ হওয়া। সে কারন জিজ্ঞেস করতেই মেয়েটি বলেছিল বাংলাদেশে কেউ নারী ডাক্তারের কাছে আসে না এই দুটি ছাড়া। তার মানে মেডিসিন, কিডনি আরো কত বিশেষজ্ঞ আছে সেই সকল ডাক্তার পুরুষ না হলে কেউ যায় না? সে মেয়েটি নাকি বলেছিল যায় না বললেই চলে। আমি নিজে অবশ্য সত্য মিথ্যা অতটা জানিনা। তবে নিজের জীবনে মেডিসিনের অনেক ডাক্তার কে দেখিয়েছি সেখানে একজন ব্যাতিত সকল ডাক্তার পুরুষ ছিল। আমি ইচ্ছে করে নারী ডাক্তার দেখাই নাই সে রকম নয়, যাদের কাছে ভাল মেডিসিনের ডাক্তারের রেফারেন্স চেয়েছি তারা সবাই কোন না কোন পুরুষ ডাক্তারের নামই বলেছে। হয়তো ওই বন্ধুর প্রেমিকার কথাই ঠিক, কোন রুগী আসেনা তাই সেই ভাবে অন্যসব ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারও খুব বেশী গড়ে উঠেনি।

বুদ্ধি বৃত্তিক বিকাশে নারীর সবচেয়ে বড় বাধা কি তাহলে পুরুষ শাসিত সমাজের দৃষ্টিভঙ্গী? এই সমাজ কি নারীকে আজও ভোগের বস্তু  মনে করে? শুধুমাত্র টিভি সিনেমার পর্দায় নারী কাঙ্ক্ষিত আর কোথাও কি এই সমাজ নারীকে দেখতে চায় না?

তানজির খান
কবি,ব্লগার ও নাগরিক সাংবাদিক
ইমেইলঃ mtanzirkhan@gmail.com
https://www.facebook.com/tanzir.khan.3