ইসলামে শবে বরাত আছে কি নাই এবং শবে বরাতের সাথে হালুয়া রুটির সম্পর্ক কি এমন বিতর্ক গতকাল থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি। যারা শবে বরাত ও হালুয়া রুটির বিরুদ্ধে আছে তারা নিজেদেরকে সহি মুসলিম হিসাবে দাবী করছে, যারা পালন করছে তারা কিছুটা বিব্রত। কিন্তু গোপনে গোপনে সবার বাসাতেই হালুয়া রুটি হয়েছে তা ঢাকার রস্তায় ম ম খাবারের গন্ধ শুকেই কিছুটা আন্দাজ করেছি। (কারো কারো বাড়ী নাও হতে পারে)
এসব বিতর্কের মাঝে আমার আগ্রহ ভিন্ন জায়গা। আমি বেশ কয়েক বছর আগে শবে বরাতে হালুয়া রুটির প্রচলণ কেন হলো সেই ভাবনা ভেবেছিলাম।
১৮ শতকের একদম শেষের দিকে জন্ম নেয়া, কিছুদিন আগে গত হওয়া আমার দাদির কাছেও জেনেছি সেও জন্মসূত্রে এই রেওয়াজ পেয়েছিল। এটা ধরে নেয়াই যায় আমাদের বহু সামাজিক বা জাতীয় অনুষ্ঠান জন্ম নেয়ার আগে শবে বরাতের সাথে হালুয়া রুটি যুক্ত হয়েছিল। আশির দশক হতে পহেলা বৈশাখে পান্তা ইলিশ প্রচলনের বহু আগে তো বটেই, ধারণা করি সম্রাট আকবরের বাংলা সন আবিস্কারেরও আগে এর প্রচলণ হয়েছিল।
আমার মনে হয় হালুয়া রুটি প্রচলনে সবচেয়ে বেশী কাজ করেছে বাঙালীর আর্থসামাজিক অবস্থা। সামান্য দুধ,চিনি দিয়ে এটা করা যায়। তাই শহর থেকে গ্রাম এর প্রচলন হয়েছে খুব গতির সাথে।
ইসলামে শবে বরাতের অবস্থান দূর্বল সেটা তথ্য উপাত্ত সহ আমার কাছে আছে। তবুও যারা ধর্ম মানে তারা কেউ শবে বরাত পালন করে না বা হালুয়া রুটি খায় না, এ কথাটি যেমন সত্য না আবার যারা হালুয়া রুটি খায় তারাই ধর্ম মানে এটাও সত্য না।
বিতর্ক যাই থাকুক দিবসটির মূল্য আছে বাস্তবতায়। ধরুন একজন পাপিস্ট যে অপকর্ম সব করে, ধর্ম পালন করে উৎসব কেন্দ্রীক, সে যদি উৎসব ও হালুয়া রুটি কেন্দ্রীক এই শবে বরাতে নামায শেষে মধ্য রাতে একা একা বাড়ি ফেরার সময় প্রতিজ্ঞা করে অনেক তো হলো আর না, এখন ভাল হয়ে যাব। তবে কি আল্লাহ অসন্তুষ্ট হবে? একজন প্রতিদিন অন্যের যাতে উপকার হয় সেই কাজ করে, নিয়মিত নামায পড়ে এবং হালুয়া রুটি কেন্দ্রীক এই দিনে সে যদি চিন্তা করে কিছুই তো করিনি, কাল থেকে আরো বেশী কিছু করব মানুষের জন্য, সৃষ্টিকর্তাকে দু’বার বেশি ডাকবো- তবে কি তার অন্যায় হবে? বাস্তবতায় কিন্তু এমন ঘটনা আছে। অনেকেই প্রতিজ্ঞা ভেঙেছে এটা নিশ্চিত কিন্তু প্রতিজ্ঞা করেছিল ভাল হয়ে যাবে এটাও সত্য। এই প্রতিজ্ঞা একদিন হলেও তাকে অসৎ কাজ থেকে দূরে রেখেছে।
তবে দিবসটি আমার কাছে তাৎপর্যপূর্ণ ভিন্ন কারনে, অন্তত এই দিনে গরীব মানুষ দুইটা ভাল খায়। বছরের ৩৬৫ দিনের মাঝে দুই ঈদ ছাড়া সর্বস্তরের বাঙালী মুসলমানের একসাথে খাবার বিলি করার ঘটনা আর এক দিনই ঘটে, তা হলো শবে বরাতের দিন। যারা প্রকৃতই দয়ালু তারা তো সারা বছরই দেয়, কিন্তু এই দিনে অনেক খারাপ মানুষও ক্ষুধার্তকে খাবার দেবার মত ভাল কাজটা করে।
দেশে অঘোষিতভাবে কিছু জাতীয় অনুষ্ঠান আছে সেগুলোতে কিন্তু সর্বস্তরের মাঝে খাবার বিলি করার রেওয়াজ নেই। যেমন থার্টি ফার্স্ট নাইট পালন ও ভালবাসা দিবস পালন। ১৪ ফেব্রুয়ারী আমরা ভালবাসা দিবসে প্রিয় মানুষ নিয়ে ঘুরি খাই-দাই কিন্তু কোন ক্ষুধার্তকে খাবার দেই না। খেয়াল করলে বুঝতে পারবেন। ইংরেজি বর্ষ বরনে তো নয়ই। এই দিন দুটি ঘিরে বিজনেস করে পুজিপতিরা। যেমনঃ কার্ড,ফার্স্ট ফুড, ড্রিংকস, হাবিজাবি। জায়গায় জায়গায় উপমহাদেশের বিখ্যাত শিল্পীদের গান হয়। আকাশচুম্বী দামের টিকেটের বিনিময়ে দর্শকরা উপভোগ করে। ব্যবসাটা হয় যাদের অর্থ আছে তাদেরই হাতে। কিন্তু শবে বরাতের চিত্র ভিন্ন এই দিনে মুদি দোকানিরা ব্যবসা করে। চিনি,সুজি,দুধ, গরম মসলা, কিচমিচ এসব বেচবে আর দিন শেষে কিছুটা স্বস্তি পাবে। আপনি মানুন বা না মানুন অর্থনীতিতে হালুয়া রুটির গুরুত্ব আছে।
শবে বরাতের সামাজিক মূল্যও ফেলে দেবার মত নয়। দিনটি ঘিরে সবাই সবার কুশলাদি জানছে। এতে নিশ্চিত বন্ধন শক্ত হয়। শহুরে জিবনে পাশের ফ্লাটের অপরিচিত কাকা,কাকী, ভা্ই,ভাবীর সাথে পরিচয় হয়। অন্তত কোন হঠাৎ আসা বিপদে আমরা “শুনুন” না ডেকে সরাসরি ‘ভাই/কাকা/মামা’ বলে সম্বোধন করতে পারি।
অধিকন্তু এই দিনে হালুয়া রুটির সাথে আমিষও পায় অনেক দরিদ্র মানুষ। কেউ পেট পুরে খেয়ে ঘুমাচ্ছে, এইটা ভাবলেই আমার ভাল লাগে। একটা দিন, হোক না সে স্রেফ একটা দিন, তবুও তো একজন হত দরিদ্র মানুষের ভাতের চিন্তা নেই। ভাবলেই মনের মাঝে শান্তি শান্তি লাগে।
নিতাই বাবু বলেছেনঃ
ভেবেছিলাম চলে যাসি তানজির খান দাদার বাড়িতে, হালুয়া রুটি বেশ মজা করে খাবো!! কিন্তু আর আসা হলো না!! এখন কপাল থাপরাই বসে বসে ৷ ধন্যবাদ দাদা ভালো থাকবেন ৷
তানজির খান বলেছেনঃ
হাহাহাহাহা দাদা আমি ঢাকা থাকি একা একা। আশীর্বাদ করেন যেন আগামীতে আমার ঘরে কেউ আসে তখন আপনাকে নেমন্তন্ন করে খাওয়াবো। 😀 😀
নিতাই বাবু বলেছেনঃ
হায়রে কপাল আমার!! ভাবলাম কী, আর হলো কী? কি আশ্চর্য কাণ্ডকারখানা!! এখনো বি…………আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ জানাই দাদা ৷
তানজির খান বলেছেনঃ
দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারবেন না দাদা! দায়িত্ব নিয়ে কোন রূপবতী,গুণবতী নারীর দায়িত্ব ঘাড়ে তুলে দিন আমার! 😀 😀
সৈয়দ আশরাফ মহি-উদ্-দ্বীন বলেছেনঃ
`কেউ পেট পুরে খেয়ে ঘুমাচ্ছে, এইটা ভাবলেই আমার ভাল লাগে। একটা দিন, হোক না সে স্রেফ একটা দিন, তবুও তো একজন হত দরিদ্র মানুষের ভাতের চিন্তা নেই। ভাবলেই মনের মাঝে শান্তি শান্তি লাগে’।
অসাধারণ বলেছেন তানজির ভাই। অনেক অনেক শুভ কামনা।
তানজির খান বলেছেনঃ
সৈয়দ ভাই, আপনার জন্যেও শুভকামনা রইল ভাই। আসলে আমরা মনে করি এখন কেউ না খেয়ে থাকেনা, কিন্তু এই ধারণা ভূল। অনেক মানুষ আছে যারা এখনো না খেয়ে থাকে। একদিন পৃথিবী হবে ক্ষুধাহীন সেই স্বপ্ন দেখি।
কাজী শহীদ শওকত বলেছেনঃ
তানজির ভাই, দারুণ ভাবনা। কবিরা দরদী হয়; বুকে মায়া থাকে বেশি। কবিদের সাথে সাথে থেকে থেকে আমার মতো যারা তাদেরও ওই মায়ার আছর হয়েছে। কারণ ওরকমটি ভাবলে আমারও ভেতরে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগে। বুঝি, আপনি একটা কম্প্যাশনের জায়গা থেকে কথাগুলো বলেছেন। হ্যাঁ, এই দিনে দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষগুলো একটু ভালো খেতে পায়, নগদে কিছু হাতে পায়-এটা নিঃসন্দেহে ভালো। এবং খেয়াল করুন, আমরা এখন এমন ভাবতে বাধ্য হচ্ছি। কারণ আমরা জানি, দরিদ্রের প্রতি মানুষের স্বাভাবিক অনুকম্পাটা নেই। নিজের ভাগ্য খুলে যাবে –ধনীরাএই লোভ থেকে গরীবকে দিচ্ছে বলে ওরা কিছু পাচ্ছে। সওয়াবের লোভ অশোভন নিশ্চয়ই নয় ধার্মিকের কাছে। এবং যিনি কোনদিনই নামাজ পড়েন না তিনিও অন্তত একদিন বিশেষ প্রাপ্তির লোভে (সেটা গুনাহ মাফের, জিলাপি-মিষ্টি খাওয়ার কিংবা বেহেস্তে বিশেষ সিট রিজার্ভেশনের—যা-ই জোক না কেনো) তা নিঃসন্দেহে ভালো। তবে ভুয়া একটা উপলক্ষ্যকে এমন গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান করে এই যে ডামাডোল, এই যে দান-খয়রাত—সেটার চলন ভয়ঙ্কর হওয়ার যথেষ্ঠ সম্ভাবনা রয়েছে মূলত দুটি কারণে। প্রথমত, এতে গরীবের যে উপকার হচ্ছে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে তার কোনো সাস্টেনেইনেবিলিটি প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে না। একদিন গরীব খুব খাইলো গলা পর্যন্ত, কিন্তু তারপর? দানকারি ধনী লোকেরা কিন্তু দান্টান করে আরামে আছেন; ভেবে নিচ্ছেন, পাপটাপ মুছে গেছে…অতএব এবার আবার শুন্য থেকে যাত্রা (পাপের)। এই ভাবনার বিপরীতে ‘মাসুম হয়ে গেছি যেহেতু–তাইলে আর পাপটাপ করুম না’–এটাও আসতে পারে তবে সেটা বিরল তা গবেষণা না করেও বলা যায় কারণ স্বভাবের ক্ষণিক ব্যত্যয় যতো সহজ, স্বভাবের মূলোটপাটন ততোটা নয়। আমি নিশ্চিত, আপনি যদি খোঁজ নেন, দেখতে পাবেন, কথিত শবে বরাতের পরবর্তি এই সামনের কয়েকদিন ভিক্ষুকদের দৈনিক আয়ের ট্রেন্ড বরাতের এই রাতের আগের দিন অবধি যেরকম ছিলো তার থেকে ফ্লাকচুয়েট করবে। কারণ মাসুমগণ (!) এখন দানে অতোটা উৎসাহি নয়; এইমাত্রই তো তারা এতো আয়োজন করে নিজেকে পাপমুক্ত করলেন। দ্বিতীয়ত, এরকম একটা ভ্রান্তি বিলাস দিয়ে জনকল্যাণের প্রত্যাশায় একধরণের আবেগতাড়িত এস্থেটিক প্রশান্তি আমাদের থাকলেও (যেহেতু আমরা সাতেপাঁচে না থাকা অধুরন্ধর জনগণ, তাই দেশের এবং দশের কল্যাণ হলে নিজেদের অর্জন বলে ভাবতে শিখে যাওয়ার মতো অপরাধ করে করে বেঁচে আছি) এর মাধ্যমে আমাদের অজান্তেই আমরা অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছি। এই একই প্রক্রিয়ায়, ভন্ড পীরের উরসকে বিবেচনা করলেও অনেক জনগণের উপকারের বাস্তবতা চোখে পড়বে। এগুলো চলতে দিলে ধীরে ধীরে সত্যিকারের ধর্মানুভূতির স্ফূরণের কিংবা ঊন্মেষের বদলে ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার আরও জেঁকে বসবে এবং লাভের ধান পরে টিয়ায় খাবে।
আমিও আপনার মত বিষয়টিকে দেখি এবং পরক্ষণেই টের পাই, অন্যায়কারী রাজার রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে অত্যাচার আর জুলুমের দর্শক বা ভিক্টিম হয়ে থাকতে থাকতে প্রজাদের যেমন হয়, অর্থাৎ তারা তখন কোনো রকমে অন্যায়ের একটা হিতার্থ বের করতে পারলে যেনো আরাম লাগে, আমাদেরও হয়তো ওরকম হয়ে থাকবে। নিজেরা যেহেতু সমস্যা দূর করতে পারছি না, তো ওটাকে পজিটিভ ওয়েতে ফিলোসোফাইজ করে নিলে শান্তি পাওয়া যায়। আমিও আপাততঃ ওই শান্তিতেই আছি।
তানজির খান বলেছেনঃ
শওকত ভাই খুবই সুচিন্তিত মতবাদ কিন্তু আমি একমত নই আপনার সাথে। আমি আপনার পয়েন্টটা ধরতে পেরেছি। দেখুন এই একটা দিন না থাকলে কি হতো? ধরে নিন আগামী বার থেকে কেউ এই দিন পালন করবে না, সরকার ছুটি বন্ধ করবে তবে কি সব ঠিক হয়ে যাবে? যাবেনা। এই দিন মানবতা বিরোধী কিছু কি করা হয়? আমি দেখিনি আমার জীবনে। বাচ্চা পলাপানের কিছু নগন্য কিছু কর্মকান্ড ছাড়া, আমি আর কোন খারাপ কিছু দিখিনি। অর্থনীতিতে হালুয়া রুটির দাম আছে, ধর্মীয় ভাবে স্রষ্টার আরাধনা করছে,গরীব মানুষ দুইটা খাবার পাচ্ছে এগুলো কি খারাপ? বড় লোকের পকেট থেকে টাকা বেড় হয় না তা রাস্তায় রিক্সা ভাড়া দিতে দেখলে বোঝা যায়। পুজিপতির কাছ থেকে পুজিহীনদের হাতে এই দিনে কিছু টাকা আসে। সেটার একটা অর্থনৈতিক ভ্যালু আছে।
থার্টি ফার্স্ট বা ভালবাসা দিবসে কি আসে এমন? এসব দিবসের বিরোধী কিন্তু আমি নই। যার ইচ্ছে সে পালন করবে। আমিও যে করি না তা কিন্তু না। বাড়ীতে থাকলে ছোটভাইদের সাথে থার্টিফার্স্ট করি। সে যাই হোক, কিন্তু এসব দিনে কি গরীব মানুষ খাবার পায়? সবাই টাকা ঢেলে আসে ফার্স্ট ফুডে, বারে, ক্যাফেতে। স্টুডেন্ট লাইফে অনেক বন্ধুদের দেখেছি যা ইচ্ছে তাই করতে। আমি চিন্তা করেছি তারা কি করছে তা নয়, আমার চিন্তা তারা যা করছে তার অর্থনৈতিক মূল্য ও সামাজিক মূল্য কতটুকু এই বিষয়ে।
ধর্মীয়ভাবে আমি বিশ্বাসি মানুষ, অপরের বিশ্বাস বা অবিশ্বাস নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা নেই। সবাইকে শ্রদ্ধা করি। ধর্মীয় ভাবে দিবসটির অবস্থান দূর্বল হলেও মানুষ কিন্তু ভাল হতেই যায় এই দিনে। দোষের কিছু দেখিনা।
কিন্তু ফাইন্যান্স এর ছাত্র হয়ে আমি অর্থনীতির ফলাফল ভাবি। সামাজের অংশ হয়ে আমি যে কোন কাজের সামিজিক মূল্য বিবেচনা করি। সব মিলিয়ে আমি সমর্থন করি। নিতান্তই আমার চিন্তা ভাই।