করুণার দান নয়, ঈদে ভালবেসে উপহার দিন পথ শিশুদের

তানজির খান
Published : 19 June 2016, 04:18 PM
Updated : 19 June 2016, 04:18 PM

আমাদের সমাজের নানা প্রান্তরে ছড়িয়ে আছে অভাবী মানুষ। রাস্তাঘাটে ফুটফুটে পথ শিশুরা ঘুরে বেড়ায় পেটে ক্ষুধার জ্বালা নিয়ে, গায়ে ছেঁড়া জামা চড়িয়ে। পথচারী কারো কাছে হাত পাতে 'দুইডা ট্যাহা দ্যান" বলে। কারো দয়া হলে দেয় না হলে 'যা ফোট' বলে ধমক দিয়ে তারিয়ে দেয়। বেশীর ভাগ সময়ই নগর জীবনে সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা এসব পথ শিশুদের দিকে কেউ ফিরে তাকায় না। অবহেলা আর করুণা নিয়ে ওরা বেঁচে থাকে আমাদেরই চারপাশে। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ১৯৪৭ সালে তার ছাড়পত্র কবিতায় লিখেছিলেনঃ

এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংস্তুপ-পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব-তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি—
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।

আজ ২০১৬ সালেও কি আমরা শিশুদের জন্য বাসযোগ্য করে পৃথিবী গড়ে তুলতে পেরেছি? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খায় হয়তো আমাদের সবার মনেই। সবাই হয়তো কিছু একটা করতে চাই শিশুদের জন্য, সমাজের জন্য। কিন্তু কতজন আমরা সত্যিকারে রাস্তায় নেমে মানবতার পাশে এসে দাঁড়িয়েছি, শিশুদের মুখে হাসি ফুটিয়েছি? কিছু মানুষ আছে যারা নিরবে মানুষের পাশে, মানবতার পাশে, এসে দাঁড়ায়।পাবনা এডওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্র নবীতা স্মরণ তেমনি একজন ব্যতিক্রমি মানুষ যিনি কিনা ২০১০ সাল থেকে পথ শিশুদের পাশে এসে দাড়ান। ঈদে নিজে,পরিবারের পরিজন ও পরিচিত মানুষের সাহায্য নিয়ে নতুন জামা কিনে দেন পথ শিশুদের জন্য।

এই লেখাটি লেখার সময় যখন তার সাথে যোগাযোগ করি তখন তিনি বলেন ''কি হবে পত্রিকায় লিখে? আমি অনেক ছোট, পড়শোনা করছি, পত্রিকায় লেখার মত কোন বড় কাজ করতে পারিনি এখনো। সবাই পথ শিশুদের ঈদকে দশটা সাধারণ মানুষের ঈদের মতই আনন্দময় করে তুলুন, এই আমার চাওয়া।''

তিনি হয়তো নিজেও জানেন না কত বড় কাজ করছেন তিনি। নবীতা স্মরণকে দেখা গেছে কুমিল্লার তনু হত্যার বিচার চেয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে, অচেনা মানুষের রক্তের প্রয়োজনে রক্ত যোগার করতে। তাই তার কর্মকান্ড পাবনার মানুষের অজানা নয়।

জানতে চাইলে নবীতা স্মরণ বলেন "২০১০ সাল থেকে আমি আর আমার বন্ধু আহসান হাবীব পথ শিশুদের জন্য কিছু করব বলে ভাবি। সেই থেকে ঈদের সময় পথ শিশুদের জন্য নতুন জামা-কাপড় কিনে দেই। কখনো কখনো পরিচিত অনেকেই আমাদেরকে স্বেচ্ছায় অর্থ দিয়ে সাহায্য করেন।তাদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই এবং তাদের শুভেচ্ছা উপহার পৌছে দেই পথ শিশুদের কাছে। আমারা হাসি দেখতে চাই সবার মুখে, তারা যেন সবার মত ঈদ উদযাপন করতে পারে সেই চেষ্টা করি।তাদের মুখে হাসি ফুটলেই দেশের মুখে হাসি ফোটে।"

২০ রোযার মাঝে নিজেদের অর্থের সাথে আগ্রহী পরিচিত জনদের অর্থসহ একটি তহবিল গঠন করেন এবং পরবর্তিতে তা দিয়েই পথ শিশুদের মুখে হাসি ফোটান।

নবীতা স্মরণ আরো বলেন "আমরা চাই সুবিধাবঞ্চিত বা পথশিশু শব্দটি বিলুপ্ত হয়ে যাক। এই কোমল মতি শিশুদের আমরা কিছু দান করতে চাই না। আমরা চাই তাদের উপহার দিতে। আর তাই ঈদে এই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শুরুটা হোক নতুন জামা দিয়ে। প্রতিটি ঈদ সবার জন্য বয়ে আনে অনাবিল আনন্দ। শপিং সেন্টার গুলোতে দেখা যায় উপচে পড়া ভীর। নতুন পোষাক ছাড়া কি ঈদ হয়! শুধু তাই নয়, পোষাক কিনেই লুকিয়ে রাখার চেষ্টা। কেউ দেখলে পুরোনো হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের চারপাশে এমন অনেক সুবিধাবঞ্চিত শিশু আছে যাদের ঈদ কাটে জরাজীর্ন পোষাকেই। আমরা তাদের নিয়ে ভাবি না। অনেকেই তাদের দেখেও না দেখার ভান করে বিরক্তি নিয়ে পাশ কাটাই। অথচ এরাও সমাজের একটা অংশ। এদেরও পাবার ইচ্ছা আছে কিন্তু পেরে ওঠে না। ওরা না হয় পারে না, তাই বলে কি আমরাও পারব না তাদের নতুন কিছু দিয়ে খুশি করতে? অবশ্যয়ই পারি। হোক না সেটা অল্প কিছু মানুষের জন্য। এই শিশু গুলোর জন্য তাই আমাদের ক্ষুদ্র একটি উদ্যোগ এটা। একটি শিশুর মুখের হাসি আমাদের কাছে অনেক দামি।যাদের জীবনে ঈদের আনন্দ আসি আসি করেও ধরা দেয় না,সেই মানুষগুলোর সাথে ঈদের আনন্দ খানিকটা ভাগাভাগি করে নিতে আমাদের এই এগিয়ে আসা।"

নবীতা স্মরণের কথা যত শুনি ততই মুগ্ধ হই। তার সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে  সোহাগী জাহান তনু হত্যার বিচার চেয়ে পাবনায় আন্দোলন গড়ে তোলার সময়। সে ও তার বন্ধুরা মিলে বিশাল এক মানব বন্ধন করে পুরো পাবনা শহর জুড়ে। আজ আবার যখন জানতে পারলাম সে পথ শিশুদের ঈদকে আনন্দময় করে তোলার জন্য সর্বাত্নক চেষ্টা করে যাচ্ছে তখন তার প্রেচেষ্টা জানার ইচ্ছে আর দমাতে পারলাম না।

নবীতা স্মরণের প্রত্যাশা সবাই নিজ নিজ এলাকায় এভাবে এগিয়ে আসবেন, অন্তত একজন পথশিশুর মুখে হলেও হাসি ফোটাবেন।কেউ যদি এই মহৎ কাজে অংশগ্রহণ করতে চায় আপনার সাথে তবে কিভাবে করবে, এমন প্রশ্নে নবীতা স্মরণ জানান 'আমি একান্তভাবে বিশ্বাস করি ভাল কাজ করবার জন্য কোন মাধ্যম প্রয়োজন নেই। সবাই নিজে থেকেই পাশের বিত্তহীন শিশুদের মুখে হাসি ফোটাবেন, তাহলেই সুন্দর সমাজ গড়ে উঠবে। তবুও যদি কেউ সময় সুযোগের অভাবে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও করতে না পারেন তবে তার শুভেচ্ছা উপহার পৌছে দিতে পারব পথ শিশুদের কাছে। এ জন্য ০১৬৭৫-৪৭১২৭৬ নাম্বারে যোগাযোগ করতে পারেন আগ্রহী অথচ ব্যস্ত মানুষজন।'

তরুণ তাজা প্রাণ নবীতা স্মরণের মত সবাই যদি দেশ ও দশের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য এভাবে এগিয়ে আসেন তবে সোনার বাংলা হতে আমাদের খুব বেশী অপেক্ষা করতে হবেনা, এটা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়।

ব্যক্তিগত ভাবে আমি সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছি "করুণার দান নয়, ঈদে ভালবেসে উপহার দিন পথ শিশুদের।"