ভাষার বিকৃতি: হীনম্মন্যতায় ভোগা এক মানসিক ব্যাধি?

রাজু আলাউদ্দিন
Published : 28 Feb 2017, 05:12 AM
Updated : 28 Feb 2017, 05:12 AM

The corruption of man is followed by the corruption of language–Ralph Waldo Emerson

বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের গর্বের কোন শেষ নেই, আবার নিজের ভাষাকে অপমানেও আমাদের কোনো জুড়ি নেই। যে ভাষার জন্য আমরা শহীদ হয়েছি সেই ভাষাই যথেচ্ছ ব্যবহারের দায়িত্বহীনতার মাধ্যমে তার ঘাতক হয়ে উঠেছি। পুরো বিষয়টি জাতীয়তাবাদের দ্বৈতরূপ সম্পর্কে হোর্হে লুইস বোর্হেসের উক্তিরই সমধর্মী হয়ে উঠেছে: "যিনি শহীদ হওয়ার জন্য প্রস্তুত তিনি জল্লাদও হতে পারেন এবং তোর্কেমাদা(স্পেনে ইনকুইজিশনের যুগে অত্যাচারী যাজক–লেখক) খ্রিষ্টের অন্য রূপ ছাড়া আর কিছু নন।" আর এই জল্লাদের ভূমিকায় এখন জনগন ও রাষ্ট্র একই কাতারে সামিল হয়েছে।

একটি সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত অভিব্যক্তিপূর্ণ ভাষা গড়ে উঠতে হাজার হাজার বছর লাগে। আর একটি ভাষার গড়ে ওঠার পেছনে থাকে শত সহস্র মানুষের অবদান যারা শব্দ ও শব্দার্থের জন্ম দিয়ে ভাষাকে সমৃদ্ধ করে। আর লেখকরা এসে এই শব্দ ও শব্দার্থের সীমা বাড়িয়ে দেন বা নতুন নতুন অর্থের ব্যঞ্জনায় দীপিত করে তোলেন ভাষাকে।

কিন্তু আমাদের অজ্ঞতা, অবহেলা, স্বেচ্ছাচার ও দায়িত্বহীনতার কারণে এই সম্মিলিত অর্জনকে আমরা বিকৃত করছি প্রতিনিয়ত।

অনেকেই বলেন ভাষা কোন স্থির বিষয় নয়, নদীর মতো পরিবর্তিত হতে বাধ্য। অবশ্যই তা পরিবর্তিত হবে, কিন্তু বিকৃত নয়। আমরা স্বেচ্ছাচার ও অবহেলার মাধ্যমে একে বিকৃতও করে তুলতে পারি, প্রবহবান নদীতে রাসায়নিক বর্জ ও জঞ্জাল ফেলে একে দুষিতও করতে পারি, যেভাবে বুড়িগঙ্গা নদীকে আমরা করেছি।
ভাষা স্থির কোন বিষয় নয় বলেই তা প্রতিনিয়ত বদলায়। আর বদলায় বলেই শব্দে ও অর্থে বৈচিত্র ও বিস্তার লাভ করে। কিন্তু ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার কারণে পরিবর্তন এক জিনিস আর দায়িত্বহীনতার কারণে বিকৃতি ঘটানো আরেক জিনিস।

ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে একেবারে অর্থনৈতিক প্রয়োজনে বা প্রয়োজন মেটানোর লক্ষ্যে যোগাযোগ তৈরির জন্য সৃষ্টি হয়েছে পিজিন (Pidgin) ভাষা। এটা সৃষ্টি হয়েছে সাধারণত বিদেশি বণিক বা ক্রেতা-বিক্রেতাদের সাথে বিদেশি ভাষায় অক্ষম স্থানীয় জনগোষ্ঠির ভাববিনিময়ের কারণে। পিজিন হচ্ছে প্রতিপক্ষের ভাষা না বুঝবার অক্ষমতা থেকে উভয় ভাষার মিশ্র রূপ যা ব্যকরণসম্মত কোনো বিধির তোয়াক্কা না করেই গড়ে উঠেছিল ১৮ ও ১৯ শতকে। গড়ে উঠতে হয়েছিল বাণিজ্যিক বিনিময়ের স্বার্থে। আজ সে বাস্তবতা নেই। নেই সে প্রয়োজনও। কিন্তু আজ সক্ষম ও সম্পন্ন ভাষার একই জনগোষ্ঠি যখন অপ্রয়োজনে ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে কথা বলেন তখন তার ব্যাখ্যা আমি খুঁজে পাই না। কেউ যেন মনে না করে বসেন যে আমি বাংলায় বিদেশি শব্দ প্রবেশের বিপক্ষে। মোটেই তা নয় আমি বরং ভাষার বিস্তার ও সমৃদ্ধির স্বার্থে অবশ্যই বিদেশি শব্দ প্রবেশের পক্ষে। তাছাড়া আমি পক্ষে বা বিপক্ষে না থাকলেও নানান বাস্তবতার কারণে তা প্রবেশ করবেই। অতএব পক্ষে বিপক্ষে থাকা না থাকা দিয়ে তাকে রোধ করা যাবে না, রোধ করার প্রশ্নই ওঠেনা। আমি এ ব্যাপারটা জেনেই ভাষায় বিকৃতির প্রশ্নটা এখানে তুলছি। দুতিনটি উদাহরণ দিয়েই এখন বলতে চাই আমি কাকে বিকৃতি বলে অভিহিত করতে চাইছি।

আজকাল প্রধানত শহরে, গ্রামেও তার অভিঘাত অল্পমাত্রায় হলেও পৌঁছেছে বাংলার সাথে ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলার খাসলত। কাচা হাতে তৈরি টেলিভিশনের বস্তাপচা নাটকগুলোতে তো আছেই, আছে উৎকট ও উদ্ভট রূপে রেডিওগুলোতে। সিনেমাও এই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই। আছে টক শোগুলোতে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে। "তুমি ওনাকে inform করলে ভালো হয়।" কিংবা "আমার planটা একটু different।" অথবা "তোমার কিন্তু ব্যাপারটা Avoid করা উচিৎ।"

উপরের এই তিনটি বাক্য সাধারণ নমুনা হিসেবে তুলে ধরা হলো। প্রথম বাক্যটিতে inform শব্দটি ব্যবহারের মাধ্যমে বক্তা 'জানানো' অর্থ বুঝাতে চাচ্ছে। দ্বিতীয় বাক্যটিতে 'plan'-এর মাধ্যমে 'পরিকল্পনা' বুঝাতে চাচ্ছে আর এই বাক্যে ব্যবহৃত আরেকটি ইংরেজি শব্দ different-এর মাধ্যমে 'ভিন্ন' কিছু বুঝাতে চাইছে। ইংরেজির পরিবর্তে যদি বাংলা শব্দগুলো ব্যবহৃত হতো তাহলে বাক্যগুলোর অর্থ বুঝতে আমাদের কোনো অসুবিধা হতো কি? মোটেই না। কখনো কখনো কোনো বক্তার পাঁচ ছয়টি বাক্যের মধ্যে হয়তো একটি গোটা বাক্যই বক্তা ইংরেজিতে বলছেন। কার সাথে বলছেন? বলছেন বাংলাভাষী অপর পক্ষের সাথে–আলাপে আলোচনায়। এই প্রবণতা তথাকথিত শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যেই বেশি। বাংলার সাথে ইংরেজি শব্দ বা বাক্য মিশিয়ে বলার পেছনে কী ধরনের মনস্তত্ত্ব কাজ করে তা বুঝতে পারলেই ইংরেজি শব্দ বা বাক্য প্রয়োগের কারণগুলো আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এক. একটু হুশিয়ার হলেই আমরা লক্ষ্য করবো যে ইংরেজি শব্দ বা বাক্য প্রয়োগের মাধ্যমে চেতনে বা অবচেতনে বক্তা তার শ্রেণিস্তরের জানান দিচ্ছেন। দুই. বাংলা ভাষার তুলনায় ইংরেজিতে তিনি পারদর্শী বা কম পারদর্শী নন–তার জানান দেওয়া। তিন. নিজের ভাষার প্রতি অবজ্ঞা ও অবহেলা। চার. যেহেতু তার শ্রেণির অন্যরাও এভাবেই কথা বলে, ফলে তা শুনে অভ্যস্ত হওয়ার কারণে অন্ধ অনুকরন থেকেও সে এটা করতে পারে। কোনো রকম প্রয়োজন (পিজিন ভাষার ক্ষেত্রে যে প্রয়োজনের কথা বলা হয়েছে।) ছাড়াই ভাষাকে এভাবে বিকৃত করার প্রবণতা অন্য কোনো জাতির মধ্যে আছে কিনা সন্দেহ।
যদি একটু অনুসন্ধান করা যায় তাহলে দেখা যাবে এই নতুন প্রজন্ম ভাষার এই বিকৃতিকরণের প্রবণতাটি সে পেয়েছে বাবা-মার প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ উৎসাহে, কারণ বাবা-মা সন্তানকে বাংলায় ততটা নয়, যতটা ইংরেজি শিক্ষায় পারদর্শী দেখতে চান। বাবা-মার এমনটা চাওয়ার কারণ, বাংলা ভাষাটি সুন্দর ও নির্ভুলভাবে শিখলে এর কোনো আর্থিক ভবিষ্যত নেই। অতএব ইংরেজি ছাঁচে সন্তানকে তৈরি করা তাদের জন্য অবশ্যকর্তব্য হয়ে দাড়ায়।

বাবা-মা এখন আর সন্তানদেরকে বাংলা ভাষায় কোন কিছু পাঠে খুব একটা উৎসাহিত করতে চান না। চান না তার সন্তান বাংলা সাহিত্য দর্শন ইতিহাস ইত্যাদি পড়ুক। না-চাইবার কারণ এসব বিষয়ে পাস করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরুনোর পর মোটা অংকের কোন চাকরী তো দূরের কথা, আদৌ কোন চাকুরী পাবে কিনা তারই কোন নিশ্চয়তা নেই। রাষ্ট্রের শাসকবর্গ ও নেতারা ভাষা ও জাতির সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব করেন এবং গর্ব করতে সবাই উপদেশও বিতরণ করেন, কিন্তু রাষ্ট্র নামক চাষের ক্ষেত্রটিকে কথিত বিষয়ের বীজতলা না বানিয়ে সেখানে বুনে যান ইংরেজি ভাষার সাথে সম্পর্কিত বাণিজ্যিক বিষয়গুলো। বাংলাদেশে এখন অসংখ্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, সেগুলোতে বাণিজ্যিক বিষয়গুলো জিরাফের মতো উচু হয়ে আছে। বাংলাভাষা ও বাংলা সাহিত্য বেসরকারি এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নির্লজ্জভাবে অবহেলিত। রাষ্ট্র নিজেই এই অবহেলার সুযোগ করে দিয়েছে এতে কোন সন্তেহ নেই। রাষ্ট্র এমন একটি সমাজ তৈরি করে দিয়েছে যেখানে ইংরেজি জানা ও আরবী জানা লোকেরা মর্যাদায় আসীন, কারণ এদুটো ভাষারই রয়েছে প্রায়োগিক মূল্য; একটি উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে, আর অন্য ভাষাটির মূল্য ও মর্যাদা রয়েছে মধ্যবিত্তের লেজের অংশ থেকে শুরু করে নিম্নবিত্তের বিশাল পরিধি জুড়ে। ধর্মানুভূতির সুযোগে আরবী গরীব লোকদের মাঝে জায়গা জুড়ে নিয়েছে, আর ইংরেজি উচ্চ ও মধ্যবিত্তের মধ্যে জায়গা জুড়ে আছে উপার্জনের বিরাট প্রলোভন হিসেবে। বাংলা ভাষার অস্তিত্ব এ দুয়ের মাঝখানে জেরবার।

উনিশ শতকে কোলকাতায় ইংরেজির মোহে যখন বাবু সমাজ আচ্ছন্ন তখন ইংরেজি শিক্ষা ও জ্ঞান বিজ্ঞানে সুশিক্ষিত ঔপন্যাসিক "বঙ্কিমচন্দ্র 'বঙ্গদর্শন' পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন বাংলা ভাষায় জ্ঞান চর্চার দরজা খুলে দেবার জন্য। কারণ তিনি জানতেন দেশের উচ্চ আর নিম্নশ্রেণির মধ্যে যদি ভাষাগত ভেদ থাকে তাহলে দুই শ্রেণিতে সহৃদয়তা জন্মাবে না। সেই কারণে তিনি জানিয়েছিলেন, we ought to disanglicise ourself. ইংরেজি জানা আর না-জানা মানুষের মধ্যে ভেদকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় জাতিভেদ। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীও অনুরূপ ভাবনার অংশিদার ছিলেন। অথচ উদারীকরণ, ভুবনায়নের দৌলতে আমাদের দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য ভীষনভাবে বেড়ে চলেছে। সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে চলেছে ইংরেজি জানা আর না জানা মানুষের মধ্যে দূরত্ব। ইংরেজি ফরফরিয়ে বলতে না পারা মানুষ আজ হীনম্মন্যতার ব্যর্থতাবোধে ভোগে।" (অশ্রুকুমার শিকদার, হাসান আজিজুল হক সম্পাদিত বঙ্গ বাংলা বাংলাদেশ, সমর প্রকাশন, ফেব্রয়ারি বইমেলা ২০১২ পৃ:৯০)

আজকে স্বভাষীদের সাথে বাঙালির ফরফরিয়ে ইংরেজি বলা বা বাংলার সাথে ইংরেজি মিশিয়ে বিকৃত ভাষায় কথা বলা কি হীনম্মন্যতায় ভোগা এক মানসিক ব্যাধি?

আর্টস-এ প্রকাশিত রাজু আলাউদ্দিনের অন্যান্য প্রবন্ধ:
বোর্হেস সাহেব