ভারতে কৃষকদের আত্মহত্যা বিষয়ক সাক্ষাৎকারের তরজমা: “প্রতি ৩০ মিনিট”

তারিক মাহমুদ
Published : 3 August 2011, 06:40 AM
Updated : 3 August 2011, 06:40 AM

আমার নোট: 'ভারত' দক্ষিণ এশিয়ার এক পরাক্রমশালী রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভঙ্গুর অবস্থার পর এবং মার্কিন ভারত আঁতাত আরো সুদৃঢ় হওয়ার পর, এখন ভারতকে চ্যালেঞ্জ জানানো মত কোন দেশ এই অঞ্চলে নাই। তার শাসক গোষ্ঠী অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক শক্তি জোরে 'ভারত'কে 'সুপার পাওয়ার' হিসেব প্রতিষ্ঠিত করতে বদ্ধ পরিকর। আর এর ভেতরেই চলেছে এক বিরামহীন দু:সহ পরিস্থিতি, কৃষকদের ক্রমাগত আত্মহত্যা। ঘটনাটি দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসছে কিন্তু সরকারের কোন পদক্ষেপ নাই, মিডিয়াগুলোর কোন চেতনা নাই; তারা বরং 'গ্রেট ইন্ডিয়া'র স্লোগান তুলে দেশটির নিপীড়িত মানুষের আর্তনাদকে চাপা দিতে বদ্ধপরিকর। এই বিষয়ের উপরে করা ডকুমেন্টারি "নিরোস গেস্ট" সম্পর্কে ফেসবুক বন্ধু 'মনজুরুল হকে'র নোটটি বহু দিন আগেই পড়েছিলাম। তারপর ডকুমেন্টারিটি দেখার পর অত্যন্ত অসহায় বোধ করেছি শাসক ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ঐক্যবদ্ধ শক্তির কাছে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষরে বিচ্ছিন্নতার ভয়াবহ পরিণতি দেখে। তারপর ঘটনাক্রমে হাসান জাফরুল বিপুল ভাইয়ের কাছে থেকে এই সাক্ষাৎকারটি অনুবাদের দায়িত্ব লাভের মধ্যে দিয়ে এটি সম্পাদিত হয়। শাসক, শোষক ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বিরুদ্ধে এটি প্রচার ও মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস হিসেবে লেখাটি আরো ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশে ব্লগের বন্ধুদের জন্য শেয়ার করলাম।

আমরা যদি ভারতের কৃষকদের আত্মহত্যার দিকে ফিরে তাকাই, তবে দেখতে পাব গত ১৬ বছরে আড়াই লক্ষ কৃষক আত্মহত্যা করেছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতি ৩০ মিনিটে একজন করে কৃষক আত্মহত্যা করছে।

'সেন্টার ফর হিউমেন রাইটস্' এবং 'গ্লোবাল জাস্টিস এ্যাট এনওয়াইইউ ল স্কুল' একটি রিপোর্টে এই তথ্য প্রকাশ করেছে, যার শিরোনাম "প্রতি ৩০ মিনিট: কৃষক আত্মহত্যা, মানবাধিকার এবং ভারতের কৃষিসর্ম্পকিয় সংকট"।

ভারতের কৃষিখাত অর্থনৈতিক উদারীকরণের কারণে বিশ্ব বাজারে অধিকতর অরক্ষিত হয়ে পরেছে। রাষ্ট্রীয় পূর্ণগঠনে কৃষি ভর্তুকি প্রত্যাহার এবং বিশ্ব বাজারে ভারতের কৃষিখাত উন্মুক্ত করণ যার অন্তর্ভুক্ত। এই পূর্ণগঠন যেমন একদিকে অনেক কৃষকদের ব্যয় বৃদ্ধি করেছে, তেমন উৎপাদন এবং মুনাফা হ্রাসের কারণ হয়েছে।

যার দরুন ক্ষুদ্র কৃষকরা হরহামেশায়ই ঋণের এমন জালে বাধা পরছে যা তাদের বেশিরভাগের জীবনকেই পুরোপুরি আশাহীনতায় পর্যবসিত করছে। তুলা চাষিদের মধ্যে এই আত্মহত্যার প্রবণতার গড় সবচাইতে বেশি। ভারতের অন্যান্য সব বাণিজ্যিক শস্যের মতই তুলা শিল্পের উপর বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানিগুলো জিনগতভাবে রূপান্তরিত (জেনিটিক্যালি মডিফাইড) তুলাবীজ চাষে প্রণোদনা দেয় এবং এতে দাম, মান ও সহজলভ্যতার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।

এই বিষয়ে 'সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটসে্‌'র বিভাগীয় প্রধান স্মিতা নারুলার সাথে আমাদের আলাপচারিতা।

এ্যামি গুডম্যান: আপনাদের প্রতিবেদনটি সম্পর্কে বলুন।

স্মিতা নারুলা: এই প্রতিবেদনে আমাদের প্রধান অনুসন্ধানের বিষয় হল মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়াবলী। মানবাধিকারের ক্ষত্রে ভারতে আমরা এক মহাকাব্যিক সংকটের মুখোমুখি। ভয়াবহভাবে এই সংকটের ভুক্তভোগী ভারতের কৃষকরা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। আমরা দেখি তাদের খাদ্য, পানিয়, উপযুক্ত জীবন-যাপনের অধিকার, এবং ফলদায়ক প্রতিকারের অধিকার পর্যন্ত ভয়াবহভাবে বিপর্যস্ত এই সংকটের কারণে। উপর্যুপরি এই ধরণের সংকট প্রতিবিধানে সরকারের মানবাধিকার সংক্রান্ত কঠোর আইনগত বাধ্যবাধকতার পরেও আমরা তার ব্যাপক ব্যর্থতা লক্ষ করি, একই সাথে যে সকল আত্মহত্যা সংগঠিত হচ্ছে তার যথাযথ কারণ অনুসন্ধানেরও কোন পদক্ষেপ নাই।

এ্যামি গুডম্যান: আমি আসলে বলতে চাচ্ছি, এই সংখ্যা তো অবিশ্বাস্য। প্রতি ৩০ মিনিটে একজন ভারতীয় কৃষকের আত্মহত্যা…

স্মিতা নারুলা: এবং বছরের পর বছর ধরে এটি চলছে। তবে এই বিপুল সংখ্যা দুইটি বিষয়কে দৃষ্টিগোচর করেনা। একটি হল, এই সংখ্যা সংকটের ভয়াবহতা পুরোপুরি ধারণে ব্যর্থ। যেটাকে ভারত সরকারের তথ্য ঘাটতি হিসেবে উল্লেখ করতে পারি। কৃষকদের সম্পূর্ণ অংশ এই কৃষক আত্মহত্যা পরিসংখ্যানের আওতাভুক্ত নয়, কারণ আনুষ্ঠানিক জমির মালিকানা তাদের নাই। তাদের মধ্যে আছে মহিলা চাষিরা, দালিত অথবা তথাকথিত নীচু শ্রেনীর কৃষকেরা এবং আদিবাসীরা অথবা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার কৃষকেরা। ব্যর্থ হয়েছে সরকারের কর্মসূচি এবং অনুদানসমূহ যা গ্রহণ করা হয়েছিলো বৃহৎ পরিসরে। শুধু তাই নয় এই ব্যর্থতা সময় মত ঋণ মকুফ, ক্ষতিপূরণ প্রদান থেকে শুরু করে সারা দেশব্যাপী এই আত্মহত্যার প্রধান কারণগুলোকে চিহ্নিতকরণ পর্যন্ত বিস্তৃত।

এ্যামি গুডম্যান: বিশ্বায়ন এবং এর প্রভাব কি করে কৃষকদের এই সংকটে ভূমিকা রাখছে, সেই বিষয়ে বলুন।

স্মিতা নারুলা: অবশ্যই। মূলত, চাষিদের আত্মহত্যার নিকটতম কারণ হচ্ছে কৃষি ঋণ। এই ঋণের মূল কারণ হল দুই দশক যাবত ভারতের বাজার উদারনীতি, যার ফলাফল যুগপৎ ভাবে কার্যকর। পয়লা, কৃষি ক্ষত্র থেকে সরকারের নিজেকে প্রত্যাহার, যা ভর্তুকি ও দারিদ্র ঋণের অধিগম্যতা হ্রাস করেছে। অপর্যাপ্ত জলসেচে ব্যবস্থা এবং যে সকল চাষিদের প্রয়োজন তাদের বেশির ভাগেরই নাগালের বাইরে এটা। এবং একই সময়ে, এটি বাণিজ্যিক ফসলের চাষাবাদে উৎসাহ প্রদান করেছে, তুলা যার অন্যতম উদাহরণ।

একই সাথে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগীদের কাছে বাজার উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে, যার ফলে ভারতীয় কৃষকরা ভয়াবহভাবে বিপন্ন। আর এর সাথে এখন যুক্ত হয়েছে বিদেশী বহুজাতিকেরা, যারা শিল্পখাতগুলের উপর প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছে। তার মধ্যে তুলা শিল্প অন্যতম। তুলার জন্য যা অধিক প্রয়োজনীয়, সেটিও তাদের নিয়ন্ত্রণের আওতায়। বিশেষভাবে তুলার ক্ষেত্রে ভারতে জিনগতভাবে রূপান্তরিত বিটি তুলাবীজের ব্যাবহার খুবই কার্যকর ভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে, যেটা এখন পুরো সেক্টরটিকে পদদলিত করছে। কৃষকের ব্যয়, মুনাফা এবং উৎপাদনের বিপরীতে এই বীজের মূল্য, মান ও প্রাপ্তি এক অস্বাভাবিক আঘাত যা তাদেরকে ঋণ গ্রহণের ভয়াবহ পরিণতির দিকে ধাবিত করছে। এবং মর্মান্তিক ভাবে তাদের মধ্যে অনেকেই যারা কীটনাশক কিনতে ঋণ নিয়েছিলো, ঋণের চক্র থেকে পালাতে না পেরে সেই বিষ পান করে আত্মহত্যা করছে।

এ্যামি গুডম্যান: তারা কীটনাশক পান করছে!

স্মিতা নারুলা: এটা সত্যি। এই পরিসংখ্যানের নি:সন্দেহে ভয়াবহ – প্রতি ৩০ মিনিটে একজন। আমাদের মাথা থেকে বিষয়টি ঝেড়ে ফেলা কঠিন। কিন্তু তার চাইতেও বেশি কিছু এই প্রতিবেদনে আছে, আর তা হল ট্রাজেডির পাশাপাশি সংখ্যাগুলোর এক মানবিক আকার প্রদান। এখন দুটি ঘটনার উল্লেখ করে আমরা মানবিকতায় ফেরত আসার চেষ্টা করতে পারি। ভিদারভা, মাহারাষ্ট্রে এমন কৃষক আছেন যাদেরকে দেখা যায় এই সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে এবং এই দেশের তুলা উৎপাদনের কেন্দ্রবিন্দুতে। এখন আত্মহত্যা করার আগে কৃষকেরা 'সুইসাইড নোট' লিখছেন প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির বরাবর, এই আশায় যে তাদের কথাগুলো মানুষের কাছে পৌঁছুবে এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য করবে।

এরপর আপনি নন্দ ভান্ডারির মত কৃষক পাবেন, যে বিঁধব এবং তার স্বামীকে হারায় ২০০৮ এ। ফলস্বরূপ, তাকে তার ১০ এবং ১২ বছর বয়সের শিশুগুলোকে স্কুল থেকে এনে কৃষিকাজে লাগাতে বাধ্য হয়েছে। তাদের সাত একর জমি আছে, এবং এক বছর প্রত্যেক দিন সেই জমিতে কঠোর পরিশ্রম করার পরেও তার বাৎসরিক আয় ২৫০ ডলারের বেশি নয়। সে হয়তো সরকারী অনুদান পায়, কিন্তু তার পুরোটাই চলে যায় সুদী মহাজনের পেটে, যার কাছে থেকে তার স্বামী ঋণ নিয়েছিলো, কারণ দেশে কোন দরিদ্র ঋণের ব্যবস্থা নাই। এবং এখন সে তার পরিবারের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য লড়াই করছে।

এ্যামি গুডম্যান: জিনগতভাবে রূপান্তরিত বীজ এবং মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ব্যাপারে বলুন।

স্মিতা নারুলা: জিনগতভাবে রূপান্তরিত বীজ, আচ্ছা। বিটি তুলাবীজ হল এমন বীজ যা এখন সমগ্র তুলাশিল্পকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এবং এই বীজ নিশ্চয়তা দেয় নিজের ভেতরই এমন এক বিষ উৎপন্ন করার যা ভারতের তুলা চাষে ক্ষতিকর সাধারণ কীটপতঙ্গগুলোকে হত্যা করে। বিটি তুলাবীজের যে দুটি জিনিস প্রয়োজন ইতিমধ্যেই ভারতের ক্ষুদ্র কৃষকেরা তা সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে, যেগুলো বাজারজাত করছে মানসান্টো এবং অন্যান্য বহুজাতিকগুলো। আর প্রয়োজনীয় জিনিস দুটি হল – টাকা ও পানি। বিটি তুলাবিজের দাম সাধারণ বীজের তুলনায় দুই থেকে দশগুণ বেশি এবং চাষে সাধারণ বীজের তুলনায় পরিপূর্ণ উৎপাদনে পানি লাগে অনেক অনেক বেশি। রঙিন বিজ্ঞাপনে (এগ্রেসিভ মার্কেটিং) প্রলুব্ধ হয়ে কৃষকেরা প্রতিনিয়তই চড়া সুদে মহাজনদের কাছে থেকে ঋণ নিয়ে এই বীজ কেনে এই আশায় যে, এতে তাদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। কিন্তু যেখানে ভারতের ৬৫ শতাংশ তুলা খামার বৃষ্টিপাতরে উপর নির্ভরশীল এবং যেখানে নাই জলসেচের ব্যবস্থা, ফলে পর্যাপ্ত ফলন হয়না। এরসাথে অনাবৃষ্টির আধিক্য অনেক কৃষকের ক্ষত্রেই এমনটি ঘটে। ফলে তারা ঋণের এই জাল আরও জড়িয়ে পরছে। তাদের পর্যাপ্ত উৎপাদন নাই। তারা এই চক্র কয়েক মরশুম পুনরাবৃত্তিও করে। এবং অন্তিম মুহূর্তে, তারা সহজেই পতিত হচ্ছে এমন এক দুষ্টচক্রে যেখান থেকে বার হয়ে আসতে পারছে না, এবং কীটনাশক পান করছে নিজেদের হত্যা করার উদ্দেশ্যে। এবং…

এ্যামি গুডম্যান: চূড়ান্তভাবে, কি করা প্রয়োজন?

স্মিতা নারুলা: অনেক কিছুই করার আছে যা সরকার করতে পারে, ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করা। যেমনটা আমি আগেই বলেছি, সরকার ব্যর্থ হয়েছে সমস্যা যথাযথ নিয়ন্ত্রণে আনতে। এখনে মধ্যস্থতার ব্যর্থতাও আছে। ঋণ মকুফ কর্মসূচি, যা সরকার গর্বের সাথে মানবাধিকার পরিষদের কাছে উল্লেখ করছে, তা বেশির ভাগ কৃষকের কাছেই পৌঁছেনি, অনেকেই এর আওতার বাইরে ছিলো, এবং সরবরাহ খুবই অপর্যাপ্ত। আরো আছে সাংগঠনিক বিষয়। সরকারের উচিত মানবাধিকারকে কৃষিনীতির কেন্দ্র রাখা, এবং প্রয়োজন বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা যা করা হচ্ছে না। বরং দেশব্যাপী আরো আরো জিএম শস্য অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। যেখানে এত এত কৃষকের জীবন ইতিমধ্যেই ধ্বংস হয়ে গেছে।

সূত্র:
০১। পর্যালোচনা পত্রিকা "বিবধ" এর জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত।
০২। "নিরোস গেস্ট" নামের তথ্য চিত্রটির সর্ম্পকে ফেসবুক বন্ধু 'মনজুরুল হকে'র নোটের লিংক।
০৩। "নিরোস গেস্ট" ডকুমেন্টারির
ভিডিওর লিংক।