নির্বাচন কমিশন কি গ্লানিমুক্ত হতে পারবে

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 21 August 2011, 02:28 AM
Updated : 11 Dec 2015, 02:20 AM

আসন্ন পৌর নির্বাচন কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতি জমে উঠেছে। প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আবার নিজেদের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের জন্য মুখোমুখি হয়েছে। শুরু হয়েছে অভিযোগ পাল্টা-অভিযোগের পালা। নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হবে কিনা সে প্রশ্নও সামনে আসছে। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলো যেমন এই নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে নিজেদের জনপ্রিয়তার পরীক্ষায় নামছে, তেমনি নির্বাচন কমিশনকেও তাদের সক্ষমতার পরীক্ষা দিতে হবে। ৩০ ডিসেম্বর ৭টি বিভাগের ২৩৫টি পৌরসভায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিছুটা তাড়াহুড়া করেই এই নির্বাচনের আয়োজন করা হয়েছে।

আমাদের দেশে নির্বাচন মানেই উৎসব। জাতীয় কিংবা স্থানীয় সব নির্বাচনেই মানুষের উৎসাহ ও আগ্রহ প্রবল। সে জন্যে পৌর নির্বাচন ঘিরে ইতোমধ্যেই দেশজুড়ে উৎসবের আমেজ তৈরি হয়েছে। এবারই প্রথমবারের মতো রাজনৈতিকভাবে দেশে পৌর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলের প্রতীক নিয়ে মেয়র পদে লড়বেন বিভিন্ন দলের মনোনীত প্রার্থীরা। রাজনৈতিকভাবে মেয়র পদে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার কারণে এবার পৌর নির্বাচন ভিন্ন মাত্রা ও গুরুত্ব পেয়েছে। এই নির্বাচন কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে, বিএনপি নামক বড় রাজনৈতিক দলটি একটি সুযোগ পেয়েছে নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর।

এতদিন আমাদের দেশে স্থানীয় সরকার নির্বাচন সরাসরি দলীয় ভিত্তিতে হত না। এক ধরনের নির্দিলীয় চরিত্র বজায়ে রাখার চেষ্টা হত। যদিও স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে হওয়ার পক্ষে এবং বিপক্ষে যুক্তি আছে। তবে এবার সরকার তেমন কোনো যুক্তিতর্কের সুযোগ না দিয়ে অনেকটা একতরফাভাবেই দলীয় ভিত্তিতে পৌর নির্বাচনে আইন করেছে। সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপিও এ নিয়ে তেমন একটা বাদ-প্রতিবাদ করেনি। প্রায় ৭ বছর পর পৌর নির্বাচন সামনে রেখে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আবার পরস্পরের মুখোমুখি হচ্ছে। শক্তিপরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। দুই দলের দুই জনপ্রিয় নির্বাচনী প্রতীক নৌকা ও ধানের শীষ নিয়ে কর্মী-সমর্থকরা ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে ভোট প্রার্থনা করবেন, দলীয় প্রার্থীকে জেতানোর চেষ্টা করবেন।

এই নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটবে না কিংবা বিএনপিও সরকার গঠনের সুযোগ পাবে না। তারপরও দুই দলই এই নির্বাচনকে মর্যাদার লড়াই হিসেবেই নেবে এবং দলীয় প্রার্থীদের জয়যুক্ত করার জন্য আদা-জল খেয়ে মাঠে নামবে। পৌর নির্বাচনে যদি অধিকাংশ আসনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীরা জয়লাভ করে তাহলে তারা যেমন তাদের জনপ্রিয়তা অটুট থাকার দাবি করবে এবং বলার সুযোগ পাবে যে, বিএনপিকে দেশের মানুষ প্রতাখ্যান করেছে– তেমনি বিএনপির বেশি সংখ্যক প্রার্থী বিজয়ী হলে তারাও দাবি করবে যে, সরকারের জনবিচ্ছিন্নতা বেড়েছে, কাজেই অবিলম্বে জাতীয় নির্বাচন দিয়ে সরকারকে নতুনভাবে জনপ্রিয়তা পরীক্ষা দিতে হবে। পৌর নির্বাচন ক্ষমতা বদলের নির্বাচন না হলেও জাতীয় রাজনীতিকে কিছুটা প্রভাবিত করার পরিস্থিতি তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলেই মনে হয়।

২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এই নির্বাচনেই বিএনপি ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে মানুষের সামনে হাজির হচ্ছে। তাই এই নির্বাচন বিএনপির জন্য একটি বড় ধরনের পরীক্ষা। গত ৭ বছরে জাতীয় রাজনীতিতে যেমন অনেক উত্থান-পতন হয়েছে, তেমনি বিএনপিও সাংগঠনিকভাবে বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। বিশেষ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেয়া এবং আন্দোলনের নামে সহিংসতা-নাশকতায় জড়িয়ে বিএনপি নানা প্রশ্ন ও বিতর্কের মুখে পড়েছে। সারা দেশে নাশকতার অভিযোগে বিএনপির অসংখ্য নেতা-কর্মীর নামে মামলা হয়েছে। কেউ গ্রেফতার হয়েছেন, কেউ আত্মগোপনে আছেন। কেউ-বা রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। দলের সর্বস্তরেই স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। প্রশাসনের বৈরি মনোভাবের কারণে বিএনপির পক্ষে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করা দুরূহ হয়ে পড়েছে।

এই অবস্থায় পৌর নির্বাচন বিএনপিকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিয়েছে। পরিস্থিতি খুব একটা অনুকূল না হলেও নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণের সুযোগ নিয়ে দলের নেতা-কর্মীরা একদিকে যেমন সাধারণ মানুষের কাছে যেতে পারবেন, তেমনি দল পুনর্গঠনের কাজও এগিয়ে নিতে পারবেন। জয়লাভের আশা নিয়ে নয়, সাধারণ মানুষের সঙ্গে গত প্রায় দুই বছরে দলের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, তা কমানোর ইচ্ছা থেকেই পৌর নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, 'সুষ্ঠু হবে না জেনেও গণতন্ত্রের স্বার্থে পৌর নির্বাচনে অংশ নিয়েছে বিএনপি'।

দুর্জনেরা অবশ্য বলছেন, মির্জা আলমগীর যদি 'গণতন্ত্রের স্বার্থে' না বলে দলের স্বার্থে বলতেন তাহলেই সেটা বেশি উপযুক্ত হত। কারণ বিএনপি পৌর নির্বাচনে অংশ না নিলে দলের অস্তিত্ব রক্ষা কঠিন হয়ে পড়ত।

পৌর নির্বাচনের ফলাফল কী হবে, আওয়ামী লীগ বেশি সংখ্যক পৌরসভা দখলে রাখতে পারবে, না কি বিএনপি আওয়ামী লীগকে টেক্কা দিবে সে আলোচনার চেয়ে এখন সামনে এসেছে পৌর নির্বাচন কেমন হবে সে প্রশ্ন। নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আবার সহিংস হয়ে উঠবে কি না সে প্রশ্ন কোনো কোনো মহল থেকে উঠছে। নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হবে কি না, ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন কি না সেটা এখনই নিশ্চিত করে বলা যায় না। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেই দিয়েছেন, নির্বাচনের নামে প্রহসনের আয়োজন করা হচ্ছে। এই নির্বাচনকে তিনি 'লোক দেখানো' বলেও অভিহিত করেছেন।

নির্বাচন সম্পর্কে বিএনপি যতটা নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে অন্যরা নিশ্চয়ই ততটা নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করছেন না। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে পৌর নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছে ২০টি দল। এছাড়াও নিবন্ধিত নয় অথবা নিবন্ধন হারিয়েছে (জামায়াতে ইসলামী) এমন দলের প্রার্থীরাও স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। একটি ভালো নির্বাচনের পূর্বশর্ত হল, সব দলের অংশগ্রহণ এবং ভোটারদের পছন্দের প্রার্থীদের ভোট দেয়ার সুযোগ।

পৌর নির্বাচনে দেশে সক্রিয় প্রধান প্রায় সবগুলো দলই অংশগ্রহণ করছে। এখন যেটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন সেটা হল, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা এবং ভোটারদের যাকে খুশি তাকে ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। নির্বাচন কমিশন কি কাজটি যথাযথভাবে করতে পারবে না?

আমাদের দেশে অতীতে প্রায় সব নির্বাচন কমিশন নিয়েই কম-বেশি বিতর্ক হয়েছে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচন করা কারও পক্ষেই সহজ নয়। তাছাড়া শুধু নির্বাচন কমিশনের সততা ও দৃঢ়তা একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে পারে না। এটা তখনই সম্ভব হয় যখন অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী আইন ও বিধি যথাযথভাবে মেনে চলে।

তবে নির্বাচনী আইন ও বিধি কঠোরভাবে মেনে চলতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের বাধ্য করার কাজটি নির্বাচন কমিশনেরই করার কথা। আমাদের দেশ এখন রাজনৈতিকভাবে এতটাই বিভাজিত যে কারও পক্ষেই পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান থেকে দূরে থাকা খুবই কঠিন কাজ। রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, কেউ কারও ভালো দেখে না। ছোটখাটো ত্রুটি-দুর্বলতাগুলোও অহেতুক বড় করে দেখার প্রবণতা অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যা ও জটিলতা তৈরি করে।

নির্বাচনে যারা জয়লাভ করে তারা নির্বাচন কমিশনের কোনো সমালোচনা না করলেও পরাজিত পক্ষ সবসময় নির্বাচন কমিশনকে গালাগাল করে থাকে। বেগম খালেদা জিয়া বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে 'ব্যর্থ ও অথর্ব' বলে অভিহিত করেছেন। অথচ এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত সিলেট, রাজশাহী, বরিশাল এবং গাজিপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা জয়লাভ করেছিলেন। তখন অবশ্য বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়নি যে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি। বর্তমান নির্বাচন কমিশন শেখ হাসিনার 'পদলেহী' হলে বিএনপির সমর্থিত প্রার্থীরা কীভাবে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন সে প্রশ্নের কোনো সন্তেুাষজনক ব্যাখ্যা বিএনপির কাছ থেকে পাওয়া যায় না।

ঢাকা এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে অংশ নিয়ে শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ের মাঠ ছেড়ে দিয়েছিল বিএনপি এবং ওই দুটি নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হয়নি বলে অভিযোগ করেছে। ভোটের দিন আকস্মিকভাবে ভোট বর্জনের ডাক দিয়ে বিএনপি খুব রাজনৈতিক সুবিবেচনার পরিচয় দেয়নি। ভোট বর্জন করা সত্ত্বেও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা যে পরিমাণ ভোট পেয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত ভোটে থাকলে ফলাফল কী হত সে প্রশ্ন তখন উঠেছিল। আকাশে মেঘ জমলেই বৃষ্টি হয় না। বিএনপির মেঘলা আকাশ দেখেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে ধরে নেয়ায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিল।

আসন্ন পৌর নির্বাচনেও কি বিএনপি তেমন কিছু করতে চায়? নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বলে আগে থেকেই অভিযোগ তুলে বিএনপি একটি ক্ষেত্র তৈরি করে রাখছে। কেউ কেউ মনে করছেন, নির্বাচনে জয়লাভের সম্ভাবনা না দেখলে শেষ মুহূর্তে মাঠ ছেড়ে দেওয়ার কৌশল হিসেবেই বিএনপি নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আগেভাগেই তোপ দেগে রাখছে। এখন নির্বাচন কমিশনকে সবার কাছে বিশ্বাসযোগ্য একটি নির্বাচনের আয়োজন করে এটা প্রমাণ করতে হবে যে, তাদের সম্পর্কে বিএনপির উত্থাপিত অভিযোগ অসত্য এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কমিশন কি এই সক্ষমতা দেখাতে পারবে?

নির্বাচন কমিশনের মধ্যে এক ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাজ করে বলে মনে হয়। কশিনার হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করছেন তারা অতীতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যোগ্যতার সঙ্গেই দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের কারও অতীত কর্মজীবন প্রশ্নবিদ্ধ নয়। তাহলে নির্বাচন কমিশনে তারা যোগ্যতা ও দক্ষতার পরিচয় কেনো দিতে পারবেন না?

পৌর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে কমিশনের কাছে কিছু আরজি জানানো হয়েছিল। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি চেয়েছিল নির্বাচন কয়েক দিন পিছাতে। আর আওয়ামী লীগ চেয়েছিল পৌর নির্বাচনী প্রচারণায় মন্ত্রী-এমপিদের অংশগ্রহণের সুযোগ। নির্বাচন কমিশন সবাইকে না বলেছেন। সব পক্ষকে না বলতে পারাটা নিঃসন্দেহে তাদের দৃঢ়তার পরিচয় বহন করে।

কিন্তু সব ক্ষেত্রেই দৃঢ়তা ও অনমনীয়তা সব সময় ভালো বলে মনে করাটাও যথার্থ নয়। সংরক্ষিত নারী আসনের প্রার্থীদের জন্য চুলা, চুড়ি, পুতুল, ফ্রক ইত্যাদি এমন কিছু প্রতীক বরাদ্দ করা হয়েছে যা নারীদের জন্য অসম্মানজনক। এসব প্রতীক বরাদ্দের মধ্য দিয়ে নারীদের প্রতি এক ধরনের বৈষম্যকেই প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন মহল থেকেই এসব প্রতীক বরাদ্দ নিয়ে তীব্র নিন্দা ও সমালোচনা করা হয়েছে। সরকারের মন্ত্রী এবং সরকারি দলের নারী নেত্রীরাও নির্বাচন কমিশনের এই ধরনের মানসিকতার প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি প্রশ্ন তুলেছেন মেয়েদের জন্য নির্বাচনী প্রতীক চুড়ি না হয়ে বিমান হল না কেন? তিনি এসব প্রতীক বরাদ্দের মাধ্যমে কমিশন তাদের সনাতনী চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন।

সব মহল থেকেই প্রতিবাদ ওঠার পর স্বাভাবিকভাবেই আশা করা হয়েছিল যে, নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করবে এবং জেন্ডার বৈষম্যকে প্রকটভাবে তুলে ধরে এমন সব প্রতীক নির্বাচনে আর ব্যবহার না করার ঘোষণা দেবে। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও এটাই সত্য যে, সময়-স্বল্পতার অজুহাত দেখিয়ে নারীদের জন্য বিতর্কিত প্রতীকগুলোই বহাল রাখার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। যা করেছি, ঠিক করেছি– নির্বাচন কমিশনের এই মনোভাব খুবই ক্ষতিকর। এটা তাদের প্রতি বিপুল জনগোষ্ঠীর বিরূপতাই বাড়িয়ে তুলবে। যে কমিশন নারীর প্রতি বিদ্বিষ্ট মনোভাব পোষণ করে সেই কমিশন প্রতিদ্বন্দ্বী সব প্রার্থীর প্রতি সমদৃষ্টি কতটুকু দিতে পারবে সে প্রশ্ন খুব সঙ্গত কারণেই সামনে আসবে।

আচরণ-বিধি ভঙ্গ করলে সবার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের দুর্বলতা দেখানোর সুযোগ নেই কমিশনের। ৯ ডিসেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনের প্রচারণা শুরু হয়েছে। প্রতীক নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হবে ১৪ ডিসেম্বর থেকে। এর মধ্যেই মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে বিধি ভঙ্গের অভিযোগ উঠেছে। তিন জনকে চিঠিও দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া, এইচ এম এরশাদসহ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী ২০টি রাজনৈতিক দলের প্রধানের কাছে আচরণ-বিধি মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। দেশের মানুষ আশা করছে আসন্ন পৌর নির্বাচন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠানের জন্য যা যা করণীয় নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে তার সবই করা হবে।

নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে একাধিক প্রার্থী। জয়লাভ করে একজন। কে জিতবে, কে হারবে সেটা দেখার দায়িত্ব কমিশনের নয়। তাদের কাজ হল প্রত্যেক ভোটার যাতে ভীতিমুক্ত পরিবেশে ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারে তার নিশ্চয়তা বিধান করা। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন যে বিতর্কমুক্ত হয়নি এটা অস্বীকার করে লাভ নেই। ৩০ ডিসেম্বরের পৌর নির্বাচন কি নির্বাচন কমিশনকে অতীতের সব গ্লানি থেকে মুক্ত করতে পারবে?

সময়ের চেয়ে এগিয়ে কিংবা পিছিয়ে থাকলে ঘটনাপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। নির্বাচন কমিশনকেও নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে সময়ের চাহিদা বিবেচনা করেই। যখন যেটা করা প্রয়োজন সেটা করতে বিহ্বলতা দেখালে জাতিকে নতুন বিতর্ক ও বিপদের মুখেই ঠেলে দেওয়া হবে।

বিভুরঞ্জন সরকার: সাংবাদিক, কলাম লেখক।