অর্থনীতির সাদামাটা হিসেবের আড়ালে ভারতকে ‘ট্রানজিট’ প্রদানের তাৎপর্য

তারিক মাহমুদ
Published : 23 August 2011, 10:59 AM
Updated : 23 August 2011, 10:59 AM

নিরাপত্তা সহযোগিতা ও আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের সমীকরণ এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি

আন্তঃরাষ্ট্রিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে 'নিরাপত্তা সহযোগিতা' এমন এক অগ্রগণ্য বিষয়, যার উপর ভিত্তি করে মৈত্রী সম্পর্ক রচনার মাধ্যমে প্রভূত ছাড় এবং সুবিধা আদায় করে নিয়েছে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো, এমন ভুরি ভুরি উদহরণ আছে। নিরাপত্তা চাহিদার কাছে আয়তনে ছোট-বড়, একে অপরকে পছন্দ-অপছন্দের বিশেষ কোন মূল্য নাই; এটা আবেগের জায়গা নায়, ফলে সময়ে স্বার্থহানি কিংবা অসংগত আচরণও প্রয়োজনীয় ঐক্যের ক্ষেত্রে বাঁধা হয়ে থাকে না। সবাই চাইবে সর্বোচ্চটা আদায় করে নিতে, তাই বলে সবটাই দিয়ে দেয় না কেউ। সবটা না দিয়েও, খুব অল্পতেই অনেক জোরালো সম্পর্ক স্থাপনের উদাহরণও ইতিহাসে আছে। 'নিক্সনে'র সাথে 'মাও জে দং' খুব বেশি কিছুর বিনিময় করেননি, তথাপি তারা যুগান্তকারী সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। ইদানিং বাংলাদেশ ইনডিয়ার সম্পর্ক 'এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে পৌঁছেছে', 'এক নতুনতর উচ্চতায়' নিয়ে যাবার জন্য কাজ চলছে – এমন প্রচার গণমাধ্যমগুলোতে দেখা যাচ্ছে। এবং এটি যে অতিরঞ্জন নয় তার আভাসও পাওয়া যাবে 'আনন্দবাজারে'র ০৬-০৭-২০১১ সংখ্যায়, পত্রিকাটি বলছে, "দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষায় ঢাকাকে দিল্লির প্রয়োজন ষোলো আনার উপর আঠারো আনা।" ইঙ্গিতটি গুরুত্বপূর্ণ।

সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি পাল্টাচ্ছে দ্রুতগতিতে। একদিকে চায়নার উত্থানই নয়, পাকিস্তানের বিপর্যস্ত দশা, ভারতের সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতা বৃদ্ধি; অন্যদিকে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের উদ্যোগ; এই পরবর্তী পরিস্থিতির মূল্যায়নের ওপর নির্ধারিত হবে এই অঞ্চলের জিওপলিটিক্যাল হিসাব-নিকাশের সূত্র-সমীকরণ। যে যার প্রস্তুতি ও পররাষ্ট্রনীতি গুছিয়ে নিচ্ছে এই সমীকরণ মাথায় রেখে। অবস্থা দৃষ্টে একমাত্র বাংলাদেশকেই মনে হচ্ছে অবশিষ্ট এবং দিকচিহ্নহীন। বরাবরের মত, নতুন এই পরিস্থিতির মাঝে অনির্ধারিতই রয়েছে আমাদের জাতীয় লক্ষ্য, নিরাপত্তা দর্শন এবং রাজনৈতিক পরিকল্পনা। যে উপযুক্ত সম্ভাবনা বাংলাদেশের ছিল দক্ষিণ এশিয়ায় শক্তি ভারসাম্য নির্ধারণের ক্ষত্রে, তা কাজেই লাগানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টাও শাষক শ্রেণীর মাঝে দেখা গেল না; আগেও দেখা যায় নাই। ভূ-রাজনীতির নতুন নতুন পরিস্থিতি ও পরিবর্তিত বাস্তবতা থেকে সৃষ্ট বিভিন্ন ঘটনার আলোকে নিজেদের শক্তিমত্তা ও সম্ভাবনার সদ্ব্যবহার, নিজেদের হাতে থাকা সুবিধা ও সবলতার পর্যালোচনা, সংশ্লিষ্ট অপরাপর রাষ্ট্রের দুর্বলতার মূল্যায়ন এবং অন্যদের প্রয়োজন কাজে লাগিয়ে নিজেদের হাতে থাকা কৌশলগত সুবিধাকে সর্বোচ্চ মাত্রায় ব্যবহার করার প্রচেষ্টা আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে অনুপস্থিত।

দক্ষিণ এশিয়ার পলিটিক্যাল সমীকরণ এবং ভারতীয় প্রবনতা

গত ১০-১২ বছরের বিশ্ব পরিস্থিতিতে এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতা আগের চাইতে বিস্তৃত হয়েছে, এবং বলা যায় 'মার্কিন-ভারত অক্ষশক্তি'র কারণে ইনডিয়ার স্বার্থই এখন মার্কিন স্বার্থে রুপান্তরিত হয়েছে। বিশেষ করে ৯/১১ পরর্বতী বিশ্বব্যবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কতৃক 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে'র ডাক পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নিজের উপযোগী নিরাপত্তা সহযোগী খুজে নিতে তৎপর। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় এই যুদ্ধের প্রভাব গত এক দশক ধরেই বিদ্যমান। ইনডিয়া স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম ২০ বছর দুই ব্লকের বাইরে 'জোট নিরপেক্ষ' পররাষ্ট্রনীতি, পরবর্তী ৩০ বছর দক্ষিণ এশিয়ায় 'সোভিয়েতের নিরাপত্তা সহযোগী'র ভূমিকায় এবং এই পুরো ৫০ বছর পিছনে ফেলে ২০০০ সালের দিকে এসে ইউএসএ'র সাথে গাঁটছড়া বেধে দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিনিদের প্রধান মিত্র উঠে। বিল ক্লিনটনের সফর ইনডিয়া-ইউএসএ সম্পর্কের চরিত্র বদলে দেয়। ইনডিয়ার প্রভাবশালী পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক ও নিরাপত্তা তাত্ত্বিক 'রাজা মোহান' উল্লেখ্য করেন, অবশিষ্ট যে প্রথাগত দ্বিধা এবং স্নায়ুযুদ্ধজাত অবিশ্বাসের রেশ তারা বয়ে বেড়াচ্ছিল ভুত তাড়ানির মতো, ২০০১ এসে তা দূর হয়ে যায়। একে অপরকে 'প্রাকৃতিক মিত্র' বলে ঘোষণা করে। উল্লেখ করতে হয় ইউএসএ ইতোমধ্যেই প্রাণান্তকর চেষ্ঠা করেছে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এক দশকের নাস্তানাবুদ যুদ্ধকে দ্বিতীয় ধাপে নামিয়ে এনে প্রধান ফোকাসটা সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দী বিশ্ব শক্তি হবার দাবিদার 'চায়না'র দিকে সরিয়ে আনতে।

ইতোমধ্যে শ্রীলংকার পররাষ্ট্রনীতি ইনডিয়া থেকে বহুদূরে সরে গেছে। এবং বল যায় হামবানটাটা বন্দর চায়নাকে ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে বদলে দিয়েছে ব্লু-ওয়াটার সমীকরণ। নেপালে মাওবাদীরা সশস্ত্র সংগ্রামের পন্থা থেকে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে ফিরে রাষ্ট্র ক্ষমতার চরিত্রের পরিবর্তনে সহ ইনডিয়া-নেপাল সর্ম্পকের ঐতিহাসিক মোড় যথাসম্ভব ঘুরিয়ে দিয়েছে। এদিকে মায়ানমার খুব দৃঢ়ভাবে অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে চায়না বলয়ের মধ্যে থেকে নিজেদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একঘরে অবস্থাকে কার্যত অকার্যকর করে রাখার নীতি অনুসরণ করছে। যদিও চেষ্টা চলেছে তবুও পাকিস্তানের সাথে ব্যাপক ও নানাবিধ বিরোধের মীমাংশা অতি দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়ার সম্ভবনা নাই। আর এইখানেই ইনডিয়ার কাছে বাংলাদেশের গুরত্ব অপরিসীম। কারণ হলো, ইনডিয়ার চারপাশে তাদের নিরাপত্তা সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত কোন মিত্র নাই। এ অঞ্চলে বাংলাদেশ তাদের জন্য কেবল প্রয়োজনীয়ই নয়, বরং অপরিহার্য। নিজেদের নিরাপত্তা সহযোগিতার জন্য উপায়হীন ভাবেই বাংলাদেশের কাছে তাদের আসতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে তারা প্রায় নিরুপায়।

ভৌগলিক অবস্থান এবং ইনডিয়া-বাংলাদেশ সম্পর্কের ঐতিহাসিক পর্যালোচনা

বর্তমান ইনডিয়ার একটি অংশের অবস্থা ভৌগোলিক ভাবে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন সাবেক পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মত। অবশ্য সাত রাজ্যের সঙ্গে দিল্লির অবস্থাটা সেই মাত্রায় বিপজ্জনক না হলেও নিরাপত্তা ও অন্যান্য বিবেচনায় যোগাযোগের একটা বড় সমস্যা তাদের জন্মাবধি রয়েছে। বর্তমান অবস্থায় শিলিগুড়ির কথিত চিকেন নেক অংশটি কোন কারণে কাটা পড়লে সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সাত রাজ্য দিল্লি থেকে সাবেক পাকিস্তানের দুই অংশের মতোই পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পরবে। তাছাড়া বর্তমান অবস্থাতেও বিদ্রোহ কবলিত সাত রাজ্যের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ ব্যয়বহুল, বিপজ্জনক এবং সামরিক কৌশলগত বিবেচনায় ঝুঁকিপূর্ণ। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভেঙে দুটো আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র 'ভারত' ও 'পাকিস্তান' প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ভারতের শাসকশ্রেণী তাদের গুরুতর এই সমস্যার সমাধানে নানারকম কৌশল প্রয়োগ করে চলেছে। এই প্রকিৃয়ায় ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে পরে। 'ভারত বাংলাদেশের মিত্র' – কথাটা এই কারণেই আমাদের এইখানে বহুল প্রচারিত। কথাটা হয়তো শুনতে ভালো, কিন্তু এর অর্থ কি? ভারতের শাষক শ্রেনী আর তার জনগণ যে এক নয় – বরং 'ভারত আমাদের বন্ধু' অতিশয় অপরিচ্ছন্ন কায়দায় এই কথাটা বলে শুধু আধিপত্যবাদী ও সম্প্রসারণবাদী নয়, ভারতের সাম্রাজ্যবাদী প্রবণতাও আড়াল করে আমদের এইখানে ভারতীয় শাসক শ্রেনীর আধিপত্য কায়েমের শর্ত তৈরি করা হয়। এই আধিপত্য শুধু সাংস্কৃতিক নয়, এটা অর্থনৈতিক এবং সীমান্তে কাটাতারের বেড়া নির্মাণ, বিএসএফ কতৃক বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা, পুশ-ইন প্রচেষ্টা, যৌথ জরিপের নামে সিলেট সীমান্তে ভূমি দখলসহ ইত্যাদি নানান ঘটনার মধ্যে দিয়ে সামরিকও বটে।

রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক নিখাদ রাজনৈতিক। আমাদের মুক্তিসংগ্রামে ভারতের সহযোগিতা ভারতীয় শাসক শ্রেনীর কাছে ছিল ভবিষ্যত আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তার ও সম্প্রসারণের জন্য দরকারি। বর্তমান পুঁজিতান্ত্রিক গ্লোবালাইজেশনের যুগে ভারতীয় অর্থনীতির পুঁজিতান্ত্রিক রূপান্তর রাষ্ট্র ও পুঁজিপতি শ্রেনী স্বার্থের অভিন্ন সর্ম্পক গড়ে তুলেছে। ফলে বাংলাদেশে যারা বন্ধুত্বের এমন ঘোষণা দেয়, তারা ভারতীয় জনগণ নয়, শাসক শ্রেনীর সাথে বন্ধুত্বের কথাই বলে। বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের জনগণের প্রতি ভারতের শাসক শ্রেনীর সাধারণ নীতি হলো আঞ্চলিক অধিপতির। পাকিস্তান ভাঙুক এবং নিজের সীমান্তের চারপাশে কতিপয় দুর্বল ও মেরুন্ডহীন দাসমূলক রাষ্ট্র থাকুক – এটা ভারত তার নিরাপত্তার জন্যই জরুরী মনে করে। এছাড়াও ভারতের আঞ্চলিক আধিপত্যকে ক্ষুদ্র প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর প্রতি আচরণ দিয়ে বিচার করলেই চলবে না, তার নিজের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের স্বাধীনতা সংগ্রামী জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অব্যাহত দমন, পীড়ন, লড়াই এবং সামরিক দখলদারিত্বকেও হিসেবে রাখতে হবে। এই দমন, পীড়ন ও সামরিক আগ্রাসন মজবুত করার জন্য এবং বাংলাদেশকে তাতে ব্যাবহার করা জন্য 'ট্রানজিট' গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কোন জাতীয় আলোচন ও ঐক্যমত ছাড়াই, কাউকে কিছু না জানিয়ে, জনগণকে প্রায় অন্ধকারে রেখে, বর্তমান আওয়ামী লিগ সরকার কৌশলগত হিসাবনিকাশের নির্ধারক এতবড় সম্পদটি ইনডিয়ার হাতে তুলে দিচ্ছে। বিনিময়ে তারা ক্ষমতায় থাকার নিশ্চয়তা পেয়েছেন মনে হতে পারে, কিন্তু ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সেই বাস্তবতাকে ক্রমশ জটিল করে তুলছে।

'ট্রানজিট' সুবিধার মধ্য দিয়ে ভারত তার উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে পণ্য পরিবহনে ১২ থেকে ৮০ ভাগ পর্যন্ত খরচ কমাতে পারবে বলে বাংলাদেশের ট্যারিফ কমিশনের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, বাংলাদেশ তার যে প্রতিবেশীকে এত বড় দীর্ঘস্থায়ী সুবিধা দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রতি সে কতটা বন্ধুভাবাপন্ন। এক্ষেত্রে কেবল সীমান্তে কাঁটাতার নির্মাণের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, দুটি আলাদা রাষ্ট্র হলেও পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম সীমান্তে স্থানীয় জনপদের হাজার হাজার পরিবার আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েও দু-পাড়ে কৃত্রিমভাবে বিভক্ত। এসব বিবেচনা সত্ত্বেও ১৯৮৬ সাল থেকে ভারত বাংলাদেশের চারিদিকে কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার প্রকল্প নেয় এবং এ পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার কাঁটাতারের বেড়া স্থাপন সম্পন্ন করেছে। ২০০৯ সালের ৩০ ডিসেম্বরে এ সম্পর্কে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, দেশটি বাংলাদেশকে ঘেরাও করে ফেলার জন্য ৫২০৫.৪৫ কোটি রুপি অর্থ বরাদ্দ করেছে এবং সর্বমোট ৩৪৩৬. ৫৯ কিলোমিটার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। কোন ধরনের আইনগত প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে নয়, স্রেফ প্রশাসনিক উদ্যোগে ভারত বাংলাদেশকে ঘেরাও করে ফেলার এইরূপ একটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে, যার সঙ্গে কেবল তুলনা চলে ইসরায়েল কর্তৃক প্যালেস্টাইনী অঞ্চলের চারিদিকে দেয়াল নির্মাণের।

এছাড়াও ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ-এর গুলিতে প্রতিনিয়তই বাংলাদেশী নাগরিকদের মৃত্যুর খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিয়মিত প্রকাশিত হয়। মানবাধিকার সংগঠন 'অধিকার' এর "বার্ষিক মানবাধিকার রিপোর্ট ২০১০"-এর তথ্য অনুযায়ী গত ১০ বছরে বিএসএফ-এর হাতে ৮৪৮ জন বাংলাদেশী নাগরিক নিহত হয়েছে।

পেছন ফিরে দেখা বাংলাদেশ-ভারত ট্রানজিট

পণ্য চলাচলে ভৌগোলিক সহযোগিতার তিনটি রূপ রয়েছে – ট্রানজিট, ট্রানশিপমেন্ট এবং করিডর। এই তিন ব্যবস্থার ভিন্ন ভিন্ন তাৎপর্য রয়েছে। 'ট্রানজিট' বলতে নির্দিষ্ট একটি ভূমি বা জলপথ দিয়ে সুনির্দিষ্ট চুক্তি ও নিয়ম-নীতির ভিত্তিতে আন্তরাষ্ট্রীয় যাত্রী এবং মালপত্র পরিবহন বোঝায়। আপাতদৃষ্টিতে 'ট্রানজিট' শব্দটি প্রয়োগ করা হলেও ভারতকে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ যে সুবিধা দিচ্ছে তা সরাসরি বা স্থায়ী করিডর না হলেও পণ্য চলাচলের সমধর্মী সুবিধা। ট্রানজিটের মালামাল বা যানবাহন চলাচলকালে যদি বাংলাদেশী যানের চলাচল স্থগিত রাখতে হয় তবে তাকে 'করিডর' ধর্মী সুবিধাই বলতে হবে। সম্প্রতি আশুগঞ্জ দিয়ে ভারতীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালামাল পরিবহন কালে সেটাই ঘটেছিল। আন্তর্জাতিক পরিসরে এরূপ 'করিড'র সুবিধা সচরাচর কোন 'ল্যান্ডলক কান্ট্রি' পেয়ে থাকে। কিন্তু ভারত মোটেই 'ল্যান্ডলাক কান্ট্রি' নয়।

অন্যদিকে, সচরাচর 'করিডর' বলতে নির্দিষ্ট কোন ভূ-খন্ডের নিয়ন্ত্রণ অধিকারসহ তা অপর একটি দেশকে দেয়া বোঝায় এবং ভারতকে এ মুহূর্তে বিশেষ ভূ-খন্ডের নিয়ন্ত্রণ দেয়া না হলেও তা একতরফা ভাবে ব্যবহারের সুবিধা। আবার যেহেতু ভারত নিজ উদ্যোগে পণ্য পরিবহন করবে সেহেতু তাকে 'ট্রানশিপমেন্ট' বলারও সুযোগ নেই। সোজাসুজি বললে, বাংলাদেশের জল ও স্থল পথ ব্যবহার করে ভারত তার এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যেভাবে পণ্য পরিবহনের সুবিধা পাচ্ছে তাকে কোনভাবেই 'ট্রানজিট' বলা যাবে না।

বাংলাদেশের স্বধীনতার পর ১৯৭২ সালে ভারত-বাংলাদেশ নৌ-যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ১৯৭৪ সালে ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে পণ্য নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে উভয় দেশই একমত হয়। ১৯৮০ সালে চুক্তিটি নবায়ন করা হয়, যার ৭নং ধারাটি ছিল ১৯৭২ সালের বাণিজ্য চুক্তির পুনরুল্লেখ মাত্র। ঢাকায় ১৯৯৩ সালে 'সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে' স্বাক্ষরিত 'সাফ'টা চুক্তিতেও অনুরূপ কথা ছিল। ১৯৯৯ সালের জুন মাসে 'ট্রানজিটে'র বিনিময়ে ভারত ২৫ ক্যাটাগরির পণ্য শুল্কমুক্তের ঘোষণাও দেয়। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ওই বছরের ২৮ জুলাই মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে ভারতকে 'ট্রানশিপমেন্ট' সুবিধা দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলাদেশ-ভারত সচিব পর্যায়ে ২০০০ সালে দিল্লিতে বাণিজ্য আলোচনায় ভারতের পক্ষ থেকে 'ট্রানজিটে'র প্রস্তাব রাখা হয়। ভারতের বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী জয়রাম রমেশ ২০০৭ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ সফরকালে এক সংবাদ সম্মেলনে 'ট্রানজিটে'র ব্যাপারে জোর আবেদন জানান বাংলাদেশের কাছে। ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী ২০০৮ সালের ১০ জুলাই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. ইফতেখার আহমেদের সঙ্গে দেখা করে ভারতকে 'ট্রানজিট' সুবিধা দেওয়ার দাবি জানান। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে ভারত-বাংলাদেশ 'ট্রানজিট' দেওয়ার ব্যাপারে যৌথ ইশতেহারে স্বাক্ষর করেন।

ট্রানজিট, ট্রানশিপমেন্ট কিংবা করিডরের জন্য বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত

ট্রানজিট, ট্রানশিপমেন্ট কিংবা করিডার – যে সুবিধাই দেয়া হোক না কেন, এর জন্য বাংলাদেশের সড়ক ও রেল অবকাঠামো কতটা প্রস্তুত? প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা জানি, বাংলাদেশের বর্তমান সড়ক অবকাঠামো নিজস্ব পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের জন্য পর্যাপ্ত নয়। এমন অবস্থায় প্রতিদিন নতুন করে শত শত ভারতীয় পরিবহন একই অবকাঠামোয় প্রবেশ ফলাফল হবে ভয়াবহ। ইতিমধ্যে গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা গেছে, প্রতিদিন কমবেশি প্রায় ১৫ শত ট্রাক (প্রতিটি কমবেশি ১৫ টন) 'ট্রানজিট' বা 'করিডর' সুবিধা পেলে বাংলাদেশ অতিক্রম করবে। 'ট্রানজিটে'র জন্য যেসব রুটের প্রস্তাব করা হয়েছে সেখানে এখন গড়ে চলাচলকারী বাংলাদেশি পণ্যবাহী যানের সংখ্যা দৈনিক প্রায় ৭৫০টি; অর্থাৎ 'ট্রানজিটে'র পর নির্দিষ্ট রুটে দৈনিক গড়ে পণ্যবাহী যানের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ২ হাজার ২৫০টির মত; যা বর্তমান পরিমাণের চেয়ে তিনগুণ বেশি।

'ট্রানজিট' বা 'করিডরে'র সম্ভাব্য ৮ টি রুট নিয়ে ভাবনা-চিন্তা হচ্ছে বলে জানা যায়। বাংলাবান্ধা-তামাবিল এবং বাংলাবান্ধা-আখাউড়া ছাড়াও 'ট্রানজিট' বা 'করিডরে'র বাকি ছয়টি প্রস্তাবিত রুটের মধ্যে ঢাকাও অন্তর্ভুক্ত। সামগ্রিকভাবে এবং বিশেষভাবে ঢাকায় আমাদের বিদ্যমান সড়ক অবকাঠামো উপরোক্ত বাড়তি পণ্যবাহী যান চলাচলের জন্য মোটেও প্রস্তুত নয়। 'ট্রানজিট' সুবিধার আওতায় ভারত যেসব হেভি মেশিনারী পরিবহন করবে, তা সাধারণ ট্রাকের পরিবর্তে অনেক বড় বড় কনটেইনার ক্যারিয়ারে পরিবহন করা হবে। যেগুলোর মোড় পরিবর্তনেরও সুযোগ নেই বাংলাদেশের অনেক সড়কে এবং এগুলো যখন চলাচল করবে তখন পুরো সড়কে স্থানীয় যান চলাচল বন্ধ রাখতে হবে। সম্প্রতি আশুগঞ্জের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বিশাল আকৃতির ভারতীয় কনটেইনার ক্যারিয়ার যেহেতু বাংলাদেশের রাস্তায় চলাচলের অনুপযোগী সেকারণে বিপুল কৃষিজমি নষ্ট করে রাস্তাকে 'উপযোগী' করা হয়েছে। এমন সব জায়গা দিয়ে নতুন রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে যার কোন নিজেস্ব প্রয়োজনীয়তা ছিল না। কেবল ভারতীয় প্রয়োজনেই সেখানে স্থানীয় মানুষরা কৃষি জমি হাড়িয়েছেন।

'ট্রানজিট' অবকাঠামোর ব্যয়ভার আমাদের অর্থনীতির জন্য চাপ হয়ে উঠবে

বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যমান অবকাঠামো স্বীয় যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে অপর্যাপ্ত। এক্ষেত্রে ভারতীয় পণ্য চলাচলের জন্য একটি বিকল্প হতে পারে 'সময় সমন্বয়'; অর্থাৎ আমাদের যানের যখন চাপ কম থাকবে তখন তাদের যান চলতে দেয়া। সেক্ষেত্রেও দীর্ঘ রাস্তার অন্তত্য কয়েকটি স্থানে ভারতীয় যানের জন্য বিশাল জায়গা নিয়ে সুনির্দিষ্ট পার্কিং সুবিধা থাকা আবশ্যক হবে। এরূপ স্থাপনাগুলো নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং এর নিরাপত্তা কাঠামো পরিচালনার সঙ্গে বিপুল ব্যয়ভারের প্রশ্ন জড়িত। ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে এরূপ বিশাল পার্কিং স্থাপনা নির্মাণের বাস্তবতা কতটুকু? ভারতীয় যানবাহন বাংলাদেশ ভূখন্ড দিয়ে যাওয়ার সময় নিশ্চিত ভাবেই জ্বালানির প্রয়োজন পরবে। এদেশীয় যানবাহনগুলো যেসব জ্বালানী ব্যবহার করে তাতে সরকার ভর্তুকি দিয়ে থাকে। ভারতীয় যানবাহনগুলোও সেই ভর্তুকি প্রাপ্ত জ্বালানিই ব্যবহার না করলেও যদি জ্বালানী সরবরাহ করতে হয় তবে বিপুল পরিমাণ বাড়তি জ্বালানীর প্রয়োজন হবে। আমরা জানি বাংলাদেশ ইতিমধ্যে জ্বালানীর সংকটে ভুগছে।

সরকার ট্রানজিট বিষয় পর্যালোচনার জন্য যে 'কোর কমিটি' গঠন করেছে তার অভিমত হলো, ভারতীয়দের প্রত্যাশা মত পণ্য চলাচলের সুবিধা দিতে হলে বাংলাদেশকে জল, স্থল ও রেলপথের অবকাঠামো উন্নয়নে ৩৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে। এর মধ্যে রেলপথের জন্য ব্যয় হবে ১৭ হাজার কোটি টাকা, সড়কপথের জন্য প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা, নৌপথে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা, চট্টগ্রাম বন্দর উন্নয়নে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা, মংলা বন্দর উন্নয়নে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য স্থল বন্দর উন্নয়নে প্রায় ৫ শত কোটি টাকা।

গত কয়েক দশক ধরে ভারত তীব্রভাবে 'ট্রানজিট' সুবিধা চাইলেও ভারতীয় তরফ থেকে এ দেশের যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে তেমন কোন সহযোগিতা পাওয়া যায়নি, যেমনটি পাওয়া গেছে চীনের কাছ থেকে। সরাসরি কোন যোগাযোগ স্বার্থ না থাকা সত্ত্বেও চীন এ পর্যন্ত ৭-৮টি বৃহৎ ব্রিজ তৈরি করে দিয়েছে। ভারতের তরফ থেকে তেমন একটি দৃষ্টান্তও নেই বরং ২০১০ সালের আগস্টে ভারত 'ট্রানজিটে'র উপরোক্ত কাজে বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশকে বিরাট অংকের এক ঋণের বোঝা গছিয়ে দিয়েছে। ভারতের 'এক্সিম ব্যাংক' থেকে বাংলাদেশ এই ঋণ নিয়েছে। এক বিলিয়ন ডলারের এই ঋণ দিয়ে বাংলাদেশ ভারতীয় পণ্য পরিবহণের অবকাঠামো তৈরি করে দেবে, অথচ এই ঋণের সুদ-আসল সবই পরিশোধ করবে বাংলাদেশ! উপরন্তু ঋণের শর্ত হলো, অবকাঠামো নির্মাণ কাজে বাংলাদেশ যত ধরনের যন্ত্রপাতি ক্রয় করবে সবই ভারতে কাছ থেকে নিতে হবে। বাংলাদেশ ভারত থেকে যখন এই ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে ওই সময়ই 'দৈনিক কালের কন্ঠে'র ১ ডিসেম্বর ২০১০, খবর প্রকাশিত হয় যে, অব্যবহৃত পড়ে থাকায় বাংলাদেশের সঙ্গে ১৭৫ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করছে বিশ্ব ব্যাংক।

'ট্রানজিটে'র অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ভারত থেকে এক শত কোটি টাকা ঋণ নিলেও দীর্ঘদিন ধরে বলা হচ্ছিলো, উপরোক্ত এক বিলিয়ন ডলারে ভারত 'সহায়তা' হিসেবে দিবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের পরপরই দেখা গেল এটা আসলে 'ঋণ সহায়তা' এবং তা এমন ঋণ যা দিয়ে কথিত উন্নয়ন কর্মকান্ডের তাবৎ উপকরণও ঋণ দাতার কাছ থেকেই ক্রয় করতে হবে, অর্থাৎ এটা হলো 'সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট'। এই ঋণে আবার 'কমিটমেন্ট ফি' বলে এমন একটি ফি ধার্য আছে যার তাৎপর্য হলো নির্ধারিত সময়ে (এক বছর) এই ঋণ ব্যবহার না করলে তার জন্যও বাড়তি সুদ গুনতে হবে। যার কারণে এটাকে 'সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট' ছাড়াও 'টাইড লোন' হিসেবেও অভিহিত করা যায়।

'ট্রানজিটে' ভারত ও বাংলাদেশের লাভক্ষতির খতিয়ান

যেসব অঞ্চলের জন্য ভারত প্রধানত 'ট্রানজিট' চাচ্ছে – শিলিগুড়ি করিডর দিয়ে; বর্তমানে পণ্য পরিবহনে ভারতের খরচ হচ্ছে বছরে প্রায় একশত বিলিয়ন ডলার। 'ট্রানজিট' সুবিধা পেলে পণ্য পরিবহনে ভারতের খরচ সাশ্রয় হবে সর্বোচ্চ ৭৬ থেকে সর্বনিম্ন ১২ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পণ্য পরিবহনে ভারতের বাড়তি খরচ লাঘব হলেও বিনিময়ে বাংলাদেশ প্রায় কিছুই পাচ্ছে না; এইটা বাংলাদেশের তরফ থেকে মোটামুটি নিশ্চিত করা হয়েছে।

বর্তমানে আসামের চা প্রায় ১৪০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে কলকাতা বন্দরে এসে বহির্বিশ্বে রফতানি হয়; একই স্থান থেকে কোন যান ত্রিপুরা পৌঁছুতে পেরোতে হয় প্রায় ১৬৫০ কিলোমিটার। 'ট্রানজিট' সুবিধা পেলে আসাম ও ত্রিপুরার যানগুলো মাত্র ৪০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়েই গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। ভারতের অর্থনীতির জন্য এ এক বড় প্রাপ্তি। এতে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতীয় পুজির আধিপত্য আরো ব্যাপক ও সর্বগ্রাসী হবে। বিপরীতে বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারকদের অবস্থান 'ট্রানজিটে'র বিনিময়ে ভারতের কাছ থেকে যে কোন ধরণের ন্যায্য ফি আদায়ের বিপক্ষে। গত জুনে এনবিআর 'ট্রানজিটে'র এক ধরনের ফি নির্ধারণ করে এসআরও জারি করার মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে তা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। ওই এসআরও-তে এনবিআর প্রতি কনটেইনার পণ্যের জন্য ১০ হাজার টাকা এবং খোলা পণ্যের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ১ হাজার টাকা ফি ধার্য করেছিল। ভারতের বর্তমান মূল ভূখন্ড থেকে উত্তর-পূর্বে পণ্য পরিবহনে যে খরচ তার চেয়ে এনবিআর নির্ধারিত ফি অনেক কম হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারকদের শক্তিশালী একটি অংশ এরূপ ফি আদায়ে বিরোধীতা করে। এমন বিরোধিতার কারণেই নদী পথে ভারত বর্তমানে যে ট্রানজিট সুবিধা নিচ্ছে তার ফি বাড়ানোর চেষ্টাও স্থগিত হয়ে আছে দীর্ঘদিন। বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১০ সালের ২ নভেম্বর সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, 'ট্রানজিটের ওপর কোন শুল্ক ফি আরোপ করা হবে না।' তাঁর এই মন্তব্য বিস্ময়কর এ কারণে যে, গত এক যুগ ধরে একটি মহল গণমাধ্যমে 'ট্রানজিটে'র বিনিময়ে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয়ের গালগল্প শুনিয়ে আসছিলো।

পৃথিবীর যেসব দেশে 'ট্রানজিট' ব্যবস্থা রয়েছে, সেখানে 'ট্রানজিটে'র আয় সব সময়েই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মিসরের সুয়েজ খালকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। মিসর ১৯৫৬ সালে সুয়েজ খালকে জাতীয়করণ করে। এরপর থেকেই সুয়েজ খালের আয় দেশের প্রভূত উন্নয়ন কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। সুয়েজ খালে কোন জাহাজ প্রবেশ করলে, তার ওপর বেশ কয়েক ধরনের ট্যাক্স ও ট্রানজিট ফি ধরা হয়। যেমন ১০০০ টনের একটি জাহাজের জন্য খাল কর্তৃপক্ষকে প্রদান করতে হয় সব মিলিয়ে ৪০০০ মার্কিন ডলার। এই খরচের সঙ্গে বীমা খরচ যুক্ত করলে সুয়েজ খাল অতিক্রমে আরো বেশি মার্কিন ডলার গুনতে হয়। জাহাজের টনের পরিমাণের বৃদ্ধির সাথে সাথে ফির পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। প্রসঙ্গক্রমে 'সুয়েজ চ্যানেল অথরিটি'র এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, শুধু মাত্র জুলাই মাসে ১৫৫৪টি জাহাজ চলাচলের বিপরীতে ৪০৬.২ মিলিয়ন ডলার রেভিনিউ আদায় করেছে চ্যানেল কর্তৃপক্ষ। অথচো প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মশিউর রহমান ভারতকে 'ট্রানজিট' সুবিধা প্রদান থেকে কোন ধরণের ফি বা মাশুল আদায়ের ঘোরতর বিরোধী। তিনি এও বলেছেন, 'ট্রানজিটে'র বিনিময়ে কোন ধরণের অর্থ চাওয়া এক ধরণের অসভ্যতা হবে। অপরদিকে ট্যারিফি কমিশন বলেছিলো, 'ট্রানজিটে'র বিনিময়ে বাংলাদেশ অন্তত্য ১১ ধরণের মাশুল দাবি করতে পারে।

'ট্রানজিট'-এর অন্যান্য ক্ষয়-ক্ষতি এবং ঝুঁকিসমূহ

পরিবেশগত ক্ষতি: বাংলাদেশ ঘণবসতিপূর্ণ একটি দেশ এবং এখানকার পরিবেশ বিবিধ কারণে ইতিমধ্যে বিপন্ন। এর উপর 'ট্রানজিট' কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে এখানে বাড়তি পরিবেশগত জটিলতা তৈরি হবে। ইউরোপে 'সুইজারল্যান্ড' পার্শ্ববর্তী দেশসমূহকে 'ট্রানজিট' সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে পরিবেশগত ক্ষতি মূল্যায়নে তাদের 'আল্পাস পার্বতে'র কেমন ক্ষতি হবে সেটাও শুল্ক নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। অথচ বাংলাদেশ দেশের ৮-১০টি রুট দিয়ে ভারতকে 'ট্রানজিট' দিচ্ছে পরিবেশগত বিষয়গুলোতে সুনির্দিষ্ট স্টাডি ছাড়াই।

বলাবাহুল্য, 'ট্রানজিটে'র কারণে সম্ভাব্য পরিবেশগত ক্ষতি লাঘবের জন্য কিংবা তার পুনর্বাসনের জন্য ভারত কোন ভূমিকা রাখবে কি না তা 'ট্রানজিট' প্রক্রিয়া টিকিয়ে রাখার ক্ষত্রে ভবিষ্যতের এক বড় প্রশ্ন। কারণ যতই দিন যাবে জনগণের মাঝে এর পরিবেশগত ক্ষতি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। যেমন, আশুগঞ্জের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সেখান থেকে আখাউড়া হয়ে ভারতের আগরতলায় হেভি মেশিনারি পরিবহনে (যা ওডিসি বা ওভার ডাইমেনশনাল কনসাইনমেন্ট নামে পরিচিত) সড়ক সম্প্রসারণের জন্য ঠিকাদারী পাওয়া ভারতীয় কোম্পানি 'এবিসি কনসট্রাকশন' এমনভাবে তাড়াহুড়ো করে ৪৯ কিলোমিটার সড়ক সম্প্রসারণ করেছে, যার ফলে পার্শ্ববর্তী একটি খাল চিরতরে ভরাটসহ পানি নিষ্কাষণ ব্যাবস্থা নষ্ট হয়ে গেছে এবং এর মধ্যদিয়ে ঐ এলাকায় ইতিমধ্যে স্বায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও অতিরিক্ত যান চলাচলের কারণে কার্বণ নির্গমনের উপর এর নতুন প্রভাব পরবে। একইভাবে বিশ্ব ঐতিহ্য ক্ষেত্র হওয়া সত্ত্বেও 'ট্রানজিটে'র স্বার্থে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে রেললাইন বসানো এবং মংলা বন্দরকে ব্যবহার করে ঐ রেললাইন দিয়ে ভারতীয় পণ্য ব্যবহারের কথাও প্রস্তাব আকারে উত্থাপিত হয়েছে।

স্বাস্থ্য ঝুঁকি: ইউরোপ, মধ্য এশিয়া এবং বিশেষ করে আফ্রিকার অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, 'ট্রানজিট' কার্যক্রমের অনুষঙ্গ হিসেবে নতুন করে ব্যাপক স্বাস্থ্য সমস্যার আবির্ভাব ঘটে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রতিদিন যদি নতুন করে শত শত যানবাহন চলাচলের তার ফল হিসেবে কিছু স্বাস্থ্য সমস্যার আবির্ভাব প্রায় অনিবার্য। এক্ষেত্রে অবধারিতভাবে এইডস সমস্যার কথা চলে আসে। ভারতে ইতিমধ্যে ছয় মিলিয়ন এইডস রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। এ সংখ্যা বিশ্বের যে কোন দেশের চেয়ে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের বিষয় হলো, ভারতে সবচেয়ে এইডস উপদ্রুত তিন প্রদেশই বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে – মিজোরাম, মনিপুর, নাগাল্যান্ড। ভারত বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে যে ট্রানজিট সুবিধা চাচ্ছে তার এক দিকেই রয়েছে উপরোক্ত তিনটি প্রদেশ। আরো বিপদের ব্যাপার হলো ট্রানজিটের প্রধান যে উপাদান ট্রাক – তার চালকরাই ভারতে সবচেয়ে বেশি এইডস বহন করে চলেছে।

চোরাচালান ও মাদক সমস্যা: ইউরোপ, মধ্য এশিয়া এবং আফ্রিকার 'ট্রানজিট' কার্যক্রমের অভিজ্ঞতায় এটি স্পস্ট, এরূপ বাণিজ্যিক কার্যক্রমের মাধ্যমে চোরাচালান ও মাদকের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। ভারতের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ইতিমধ্যে চোরাচালান কবলিত। 'ট্রানজিট' সেক্ষেত্রে আরো বাড়তি সমস্যা তৈরি করবে। এবং তার মোকাবেলায় কিরূপ পদক্ষেপ নেয়া হবে সে সম্পর্কেও কোন বক্তব্য নাই। এ প্রসঙ্গে উলেখ্য, ভারত থেকে ফেনসিডিল পাচার রোধ বাংলাদেশের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। ফেনসিডিল বাণিজ্যকে ভারতীয়রা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। বাংলাদেশের সীমান্ত-সংলগ্ন গ্রামগুলোয় এ পর্যন্ত ১৩২টি ফেনসিডিল কারখানা শনাক্ত করা গেছে। এ বিষয়ে বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর তরফ থেকে ইতিমধ্যে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর কাছে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হলেও প্রতিকার পাওয়া যায়নি। ফেনসিডিল কারখানাগুলোর মধ্যে কেবল পশ্চিমবঙ্গেই আছে ৫২টি। 'ফ্যামিলি হেলথ ইন্টারন্যাশনাল নামক সংস্থা'র স্টাডি অনুযায়ী বাংলাদেশে কেবল মাদক পাচারের মাধ্যমে ভারতীয়দের আয় ৩৪৭ কোটি রুপি। অন্তত ৩২ ধরনের মাদক ৫১২টি পয়েন্ট দিয়ে ভারত থেকে এ দেশে ঢুকছে। এ ধরনের সমস্যার মোকাবেলায় সড়ক ও রেলপথে পণ্য পরিবহন কার্যক্রমে যে স্ক্যানিং অবকাঠামো রয়েছে তা অতি অপ্রতুল। 'ট্রানজিট' শুরু হলে বাড়তি স্ক্যানিং অবকাঠামো স্থাপিত হবে কি না এবং স্ক্যানিং স্থলগুলো কোথায়, কোন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হবে সে বিষয়েও এখনো কোন সুনির্দিষ্ট বক্তব্য জানা যায়নি।

বহু দ্বিপক্ষীয় সমস্যা অমীমাংসিত রেখে আলোচনার টেবিলে 'ট্রানজিট'

ট্রানজিট, ট্রানশিপমেন্ট কিংবা করিডর – যে সুবিধাই দেয়া হোক না কেন, তার ভিত্তি অবশ্যই হতে হবে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা। 'ট্রানজিট'রূপী সুবিধার বিনিময়ে বাংলাদেশও সমমানের কিছু বাণিজ্যিক সুবিধা পাবে – এমনটিই প্রত্যাশিত। এক্ষেত্রে ভারতের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের বাড়তি প্রবেশের ব্যাপার যেমন আছে তেমনি আছে নেপাল, ভূটান, পাকিস্তান ইত্যাদি দেশে বাংলাদেশি পণ্য পরিবহনের সুবিধাপ্রাপ্তির প্রশ্ন। ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা অন্যান্য সমস্যা যেমন সমুদ্রসীমা নির্দিষ্টকরণ, স্থল সীমানা চিহ্নিতকরণ, সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক নির্বিচারে বাংলাদেশীদের হত্যা, আন্তঃদেশীয় নদীগুলোর পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়া, ফারাক্কা ও টিপাইমুখ বাঁধের প্রতিক্রিয়াও বাংলাদেশের জন্য গুরুতর উদ্বেগের বিষয়।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার বাণিজ্যিক ব্যবধানের বিষয়টি উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ২০০৭-০৮ অর্থবছর থেকে ২০১০-১১ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশ আমদানি-রপ্তানি তালিকা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ আমদানি করে ৩৩৮ কোটি ৩৮ লাখ ডলারের পণ্য যার বিপরীতে রপ্তানি করে ৩৫ কোটি ৮০ লাখ ডলারের পণ্য। এ সময় বাণিজ্য ঘটতি দাঁড়ায় ৩০২ কোটি ৫৭ লাখ ডলার। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ আমদানি করে ২৮৬ কোটি ৩৬ লাখ ডলারের পণ্য যার বিপরীতে রপ্তানি করে ২৭ কোটি ৬৫ লাখ ডলারের পণ্য। বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় ২৫৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ২০০৯-১০ অর্থবছরে বাংলাদেশ আমদানি করে ৩২১ কোটি ৪৬ লাখ ডলারের পণ্য, যার বিপরীতে রপ্তানি করে ৩০ কোটি ৪৬ লাখ ডলার সমমূল্যের পণ্য। বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় ২৯০ কোটি ৯৯ লাখ ডলার। সর্বশেষ প্রাপ্ত হিসাবে গত (২০১০-১১) অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ ভারত থেকে আমদানি করেছে ৯৩ কোটি ৬৬ লাখ ডলারের পণ্য। বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ৯ কোটি ২০ লাখ ডলারের পণ্য। দুই দেশের মাঝে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৮৪ কোটি ৪৫ লাখ ডলার। এই বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কোন্নয়নের পথে অন্যতম অন্তরায় হয়ে আছে। আনুষ্ঠানিক বাণিজ্যের সঙ্গে চোরাই পথে আসা পণ্যের হিসাব করলে ঘাটতির পরিমাণ আরও অনেক বেড়ে যাবে। কয়েক বছর আগে বিশ্বব্যাংকের দেয়া এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে ভারত থেকে আসা ৮৩ শতাংশ পণ্য আসে চোরাই পথে। এর পরিমাণ ৬৩১ মিলিয়ন ডলার। মূলত ভারতে রক্ষণশীল বাণিজ্য নীতির কারণে ঘাটতির পরিমাণ বাড়ছে।

বলা হচ্ছে, 'ট্রানজিট' স্রেফ একটি অর্থনৈতিক প্রসঙ্গ, এর সঙ্গে রাজনৈতিক বিবেচনাগুলো যুক্ত করা অনুচিত হবে। কিন্তু বিশ্ব পরিসরের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রীয় বন্ধুত্বের বাস্তব পটভূমি ছাড়া এবং দেয়া-নেয়ার মনোভাব ছাড়া অর্থনৈতিক সহযোগিতা খুব বেশি এগোয় না। দীর্ঘদিনের পুরানো দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলোর মীমাংসা স্থগিত করে এবং আড়ালে রেখে 'ট্রানজিট' সুবিধা দেয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের দিক থেকে জাতীয় স্বার্থসম্মত নয়। কোনরূপ দরকষাকষি ও অর্থনৈতিক বিবেচনাকে বাদ দিয়ে ভারতে 'ট্রানজিট' বা 'করিডর' সুবিধা দিয়ে দেয়ার পক্ষে যারা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের একটি 'যুক্তি' দেন, 'বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিধি বিধানে'র আলোকেই ভারতের এইরূপ সুবিধা প্রাপ্য। এক্ষেত্রে আসলে সত্য-মিথ্যার মিশেল ঘটানো হচ্ছে। প্রথমত, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কথিত বিধি (অ্যার্টিক্যাল ৫) অনুযায়ী কেবল 'ল্যান্ড-লক' (অন্যদেশ দ্বারা বেষ্টিত, বন্দরহীন) দেশগুলোর জন্যই প্রতিবেশী কর্তৃক 'ট্রানজিট' সুবিধা দেয়ার সুপারিশ রয়েছে এবং এই বিধানও এখনো চূড়ান্ত ভাবে অনুমোদিত হয়নি। অর্থাৎ বিধানটি অনুমোদিত হলেও ভারতের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে না। কারণ ভারত কোন 'ল্যান্ড-লক' দেশ নয়। উপরন্তু ভারত নিজে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম 'ল্যান্ড-লক' দেশ নেপালকে কখনো ট্রানজিট সুবিধা দেয়নি। যে কারণে নেপাল বহুপূর্বে বাংলাদেশের কাছ থেকে 'ট্রানজিট' সুবিধার নীতিগত সম্মতি পেলেও ভারতের বৈরিতায় তা আজো কার্যকর করতে পারেনি।

উপরোক্ত ধাঁচে সত্য-মিথ্যার ধূম্রজাল সৃষ্টি করেই নব্বইয়ের দশকের শেষার্ধে তাড়াহুড়ার মধ্য দিয়ে এবং জনগণকে অন্ধকারে রেখে বাংলাদেশ গঙ্গার পানির হিস্যা নিয়ে একটি চুক্তি করেছিল ভারতের সাথে। কিন্তু দীর্ঘ এক যুগ শেষে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ সেক্ষেত্রে চুক্তিতে কথিত পানি পায়নি। ভারত-বাংলাদেশ অতীতের সকল দ্বিপক্ষীয় চুক্তির অভিজ্ঞতাই এ রকম হতাশাজনক। এরকম নানান বিষয় অমীমাংসিত রেখেই ট্রানজিট প্রদানের ফয়সালার মাধ্যমে শাসক শ্রেনীর নতজানু অবস্থান জনগণের কাছে পরিস্কার।

অর্থনীতির সাদামাটা হিসেবের আড়ালে 'ট্রানজিটে'র তাৎপর্য

এটা পরিস্কার, দুইহাজার দশ সালে এসে ইনডিয়া 'ট্রানজিটে'র আদলে যে 'করিডর' চাইছে তার ধরণ, প্রকৃতি ও প্রয়োজন আগের যে কোন সময়ের চাইতেই আলাদা। অর্থনীতির সাদামাটা হিসাব আমলে নিয়েও বলা যায় তা প্রধানত তাদের উত্তরপূর্বাঞ্চলের ভূ-খন্ড টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্র তৈরির আবশ্যিক চাহিদা। দশকের পর দশক প্রবল সামরিক উপস্থিতি দিয়ে অভ্যন্তরীণ সংহতি টিকিয়ে রাখা হয়েছে। বিদ্রোহী দলগুলার উপর রাজনৈতিক-সামরিক চাপ প্রয়োগ ও সমঝোতায়া বাধ্য করার নীতিতে বাংলাদেশকে কাছে পাওয়া তাদের জন্য একান্তই দরকার। বিরোধ মীমাংসাসহ রাজনৈতিক ফয়সালায় বাংলাদেশ সংযমী এবং দূরদর্শী ভূমিকা পালন করতে পারত। কিন্তু মধ্যস্থতাকারী না হয়ে শাসক শ্রেনীর কৈাশল হয়ে গেল অন্যের হয়ে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। ইনডিয়ার নিরাপত্তা রক্ষীদেরকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে গ্রেফতার এবং অপহরণের অবাধ সুযোগ দেওয়া। উত্তরপূর্বাঞ্চলে দীর্ঘদিন আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়ের সশস্ত্র সংগ্রামে নিয়োজিত দলগুলোর প্রতি ইনডিয়ার নতুন মনোভাব এবং করণীয়ও ঠিক হয়েছে এই পরিপ্রেক্ষিতকে সামনে রেখে। বাংলাদেশকে তাদের নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করাটা মূলত এই দিকটা সামলানোর জন্য। কিন্তু আড়াল হিসাবে সেখানকার সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা এবং ট্রানজিটকে খুব সুচারুভাবে সামনে আনা হয়েছে।

এরফলে অবস্থা কি রুপ হবে তা মোটামুটি অনুমান করা যায়। সেই সাথে উইকিলিকসের উদ্ধার করা বার্তা ছাড়াই প্রকাশ্যে পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর মুখনিঃসৃত বাণী থেকেই আমরা বুঝতাম, বাংলাদেশের প্রতি ভারতের মনভাব। তার উপর পাওয়া গেল সরাসরি ইনডিয়ান প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর বক্তব্য। "তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, অন্তত ২৫ শতাংশ বাংলাদেশি জামায়াতে-ইসলামির সমর্থক এবং তারা তীব্র ভারতবিরোধী" – এই মন্তব্যে বাংলাদেশের কতভাগ লোক ইনডিয়া বিরোধী, অতএব মৌলবাদী সেই সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসেবনিকেশ নিয়ে আলোচনার পর মন্তব্যটি সরিয়ে নেওয়া হলেও, হিসেবে রাখা প্রয়োজন এটি প্রত্যাহার করা হয়নি। নিজ দেশের সম্পাদকদের কাছে তিনি বাংলাদেশের প্রতি ইনডিয়ার মনোভাবই নয় বরং সম্পর্কের ধরণ এবং ইনডিয়ার অবস্থানও ব্যাখা করেছেন। নিজেদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক স্বার্থের জন্য বিনিয়োগকৃত এক বিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তাকেই আখ্যা দিয়েছেন অভূতপূর্ব উদারতা আর সদয় আচরণের পরাকাষ্ঠা হিশাবে। শুধু তাই না, একমাত্র যে প্রতিশ্রুতিটুকু গত দেড় বছর আমাদের প্রধানমন্ত্রীর খাতায় বারবার দেখানো হয়েছে, সেই তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি বিষয়ে মনমোহনের মন্তব্য, এরকম কিছু একতরফা ছাড় দেয়া যায় কিনা ভাবছেন তারা। অভিন্ন নদীতে আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত পানি পাবার ন্যায্য অধিকারকে ইনডিয়া বলছে তাদের পক্ষ থেকে 'দয়া প্রদর্শন'। প্রাকৃতিক উৎসের উপর আমাদের প্রাপ্য অধিকারটাকে বহুদিন থেকে তারা কূটনৈতিক দেনদরবার এবং দরকষাকষির বিষয়বস্তু বানিয়ে রেখেছে।

গণতান্ত্রিক সংগ্রামে বাংলাদেশের জনগণকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে

আহমদ ছফা বহু আগেই বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে শাসক শ্রেনীর ভূমিকাকে 'স্বাভাবিকের চাইতে একটু অধিক যেতে বাধ্য হয়েছিলো' বলে মন্তব্য করেছিলেন। তিনি লিখেছেন, নেতৃবৃন্দ কখনো স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে পারেন নি যে বাংলাদেশে স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রসত্তার জন্ম হতে চলেছে এবং তারা সে সংগ্রামের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আর এই ভাবেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পায়ে হেটে সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয় ভিক্ষা করতে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়। শাসক শ্রেনীর মেরুদন্ডহীনতায় সেই ভিক্ষাবৃত্তি থেকে জনগণ আজো বেড় হয়ে আসতে পারলোনা। জাতীয় সম্পদ বহুজাতিকের হাতে তুলে দেওয়া, ভারতকে ট্রানজিট প্রদানসহ ইত্যাদি পরিস্থিতি স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও রাজনৈতিক জানগোষ্ঠী হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্বকে হুমকির মুখোমুখি করেছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশের নিয়তি কোন দিকে? আহমদ ছফাই সেই নিয়তির নির্দেশ করেছেন, "…বাংলাদেশকে এমন একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার দিকে ধাবিত হতে হবে, যা অনিবার্যভাবেই ভারতীয় বৃহৎ ধনিকশ্রেণীর শোষণ থেকে ভারতের শোষিত এবং নির্যাতিত জনগোষ্ঠীসমূহকে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং আর্থিক দাবির প্রতি সজাগ করে তুলবে। সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে ভারতের নির্যাতিত জাতিসত্তাসমূহের সামনে বাংলাদেশকেই সর্বপ্রথম প্রেরণার দৃষ্টান্ত সরবরাহ করতে হবে। এটাই বাংলাদেশের নিয়তি।" ফলে শাসক গোষ্টির ক্রমাগত ব্যার্থতা এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ভেতর থেকে নতুন রাজনৈতিক দিশা হাজির করবে। জনগণের সঙ্গে জনগণের মৈত্রীর প্রশ্নে দৃঢ় ও আন্তরিক থেকে বাংলাদেশের জনগণই উপমহাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।

সহায়ক গ্রন্থ ও রচনা সূত্র:
০১। বেহাত বিপ্লব ১৯৭১; সম্পাদক: সলিমুল্লাহ খান। ফেব্র"য়ারী ২০০৭, অন্বেষা প্রকাশন।
০২। গণপ্রতিরক্ষা; লেখক: ফরহাদ মজহার। ফেব্র"য়ারি ২০০৬, ঐতিহ্য।
০৩। ইনডিয়া-বাংলাদেশ সর্ম্পক: মনমোহনের সফরে ম্যাজিক অসম্ভব। লেখক: মুসতাইন জহির।
০৪। ট্রানজিট: বহু প্রশ্নের উত্তর প্রয়োজন। সম্পাদনায়: ট্রানজিট স্টাডি গ্রুপ।

নোট: লেখাটি পর্যালোচনা পত্রিকা 'বিবিধ' এর আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত।