জলের বুকে হারাতে থাকা ঢালচরে

তানভীর হাসান সৈকত
Published : 13 Feb 2012, 08:21 AM
Updated : 22 June 2021, 03:11 PM

দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের উপকূলীয় এলাকাগুলো অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয় ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে। সোশ্যাল মিডিয়া, ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট  মিডিয়ার মাধ্যমে প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো সম্পর্কে জানতে পারি। তখনই দুর্গত মানুষের জন্য কিছু করার তাড়না অনুভব করি। শিক্ষার্থী হিসেবে যেহেতু খুব বেশি কিছু করার সামর্থ্য নেই তাই আমরা খোঁজ নিতে থাকি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জনপদ কোনটি। তখনই জানতে পারি যে অতিমাত্রায় জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলার দুর্গম ও বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ঢালচরে অসংখ্য পরিবার হারিয়েছে তাদের ঘর। সংকটে রয়েছে নিরাপদ পানি ও খাদ্যের। সেখানকার স্থানীয় মানুষের সাথে যোগাযোগ করে আমাদের মনে হয় জায়গাটা বেশ দুর্গম ও কোনও সাহায্য-সহযোগিতা ওখানে পৌঁছেনি। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নেই আমাদের সীমিত সামর্থ্য নিয়েই ঢালচরে যাওয়ার। 

এ বছরের ২৮ মে তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮ জন শিক্ষার্থী নিয়ে গঠিত আমাদের টিম ঢালচরের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ে। আমাদের সীমিত সামর্থ্যের আয়োজনে সাথে ত্রাণ সহায়তা দিয়ে পাশে দাঁড়ায় পরিবর্তন ফাউন্ডেশন। সন্ধ্যায় সদরঘাট থেকে লঞ্চে চাপি। পরদিন ভোরে পৌঁছাই চরফ্যাশনের বেতুয়ায়। সেখান থেকে দুই ঘণ্টার অটোরিক্সায় যাত্রা শেষে আমরা পৌঁছাই কচ্ছপিয়া ঘাটে। কচ্ছপিয়া ঘাট থেকে ট্রলারে চেপে দুই ঘণ্টা যাত্রা শেষে দুপুর নাগাদ আমাদের ট্রলার পৌঁছে মেঘনা নদীর মোহনায় ছোট্ট দ্বীপ ঢালচরে। ঝড়ে দৃশ্যমান ট্রলারঘাট বলে কিছুর আর অস্তিত্ব নেই তখন।

শরৎচন্দ্র লিখেছিলেন, "…তবে রাক্ষসী সাতশ' নয়, শতকোটি; উন্মত্ত কোলাহলে এদিকেই ছুটিয়া আসিতেছে৷ আসিয়াও পড়িল৷ রাক্ষসী নয়— ঝড়৷ তবে এর চেয়ে বোধ করি তাদের আসাই ঢের ভালো ছিল৷" ঢালচর পৌঁছে মনে হলো- আসলেই যেন ঝড় আসার চেয়ে রাক্ষসী আসাই ভালো ছিল। লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে পুরো জনপদ; ঘরবাড়ি আর জীবনযাত্রা।

যাত্রার গল্প থেকেই হয়তো অনুমান করা যাচ্ছে কেমন দুর্গম এই জনপদ। স্থানীয় কিছু তরুণের সহায়তায় আমাদের জন্য এক মাদ্রাসায় থাকার ব্যবস্থা হয়। ওইদিন দুপুরের পর আমরা বেড়িয়ে পড়ি ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির স্বরূপ দেখতে। শুরুতেই একটা ধাক্কা খাই আমরা। যেমনটা শুনে গিয়েছিলাম তারচেয়েও সঙ্গিন অবস্থা। দ্বীপ ক্রমশ ভাঙতে ভাঙতে এমনিতেই বিলীন হওয়ার পথে, তাই সব ঘরবাড়িই নদীর কাছে। ঝড়ের প্রভাবে অধিকাংশ ঘর বাড়িই ক্ষতিগ্রস্ত। কিছু বাড়ির ঘরের টিন উড়ে গেছে, তো কিছু বাড়ির ভিটা বানের পানিতে ক্ষয়ে গেছে, আর কিছু বাড়ি তো সম্পূর্ণই ভেঙে গেছে। 

অধিকাংশ মানুষের জীবন-জীবিকা মাছ ধরা কেন্দ্রিক, মাছের মওসুম যেহেতু শুরু হয়নি এখনো তাই তারা দিনমজুর হিসেবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। যার মাথা গোঁজার ঠাঁইটাই নাই হয়ে গেছে তার ঘরে চুলা জ্বলার তো প্রশ্নই উঠে না। সকল জলাশয় ও টিউবওয়েল পানিতে ডুবে লবণাক্ত হয়ে যাওয়ায় নেই নিরাপদ পানি পান করারও সুযোগ। সত্যিকার অর্থে এক গ্লাস নিরাপদ পানি এখানে কতটা কষ্টসাধ্য, নিজের চোখে না দেখলে হয়তো কেউ বুঝতেই পারবে না। পুরো দ্বীপে দুইটি টিউবওয়েল শুধু ব্যবহারযোগ্য আছে। জোয়ারের পানিতে অনেকেরই গবাদি পশু ভেসে গেছে। সেটার পরিমাণ সামান্য হলেও ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সময়ে নিরাপদ পানির অভাবে লবণাক্ত জলাশয়ের পানি খেয়ে শত শত গরু-মহিষ কাতরাতে কাতরাতে চোখের সামনেই মারা যাচ্ছে। এ যে কী পিলে চমকে উঠা করুণ দৃশ্য তা না দেখলে বিশ্বাস করা কষ্ট! কিছু এনজিওর অফিস থাকলেও নেই কোনও কার্যক্রম। সরকারি কোনও সাহায্য পৌঁছতেও সময় লেগে যায় দিনের পর দিন। এসব দেখে হতাশ লাগতে থাকে আমাদের। ক্ষুদ্র সামর্থে ত্রাণ হিসেবে যেসব খাদ্য সামগ্রী নিয়ে গিয়েছিলাম তা খুবই অপ্রতুল মনে হতে থাকে।

সন্ধ্যায় আমরা স্থানীয় তরুণদেরকে একত্রিত করে আলোচনা করতে বসি কীভাবে কী করা যায়। কিছুটা দিশেহারা বোধ করা তরুণেরা আমাদের উৎসাহ, স্পৃহায় অনুপ্রাণিত হয়। তাদেরকে আমরা আমাদের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানালে ইতিবাচক সাড়া দেয় তারা। আমাদের পর্যবেক্ষণ ও তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মিলিয়ে আমরা কাজের একটা ম্যাপ করি। কোন পরিবারগুলো বেশি অসহায়, ঘর মেরামত করার সামর্থ্য নেই- সেগুলো বাছাই করি।

পরদিন থেকে আমরা নেমে পড়ি আমাদের দল নিয়ে। প্রথমেই যাই মাটি কাটা শ্রমিকদের সর্দার কাঞ্চন কাকার বাড়ি। ভিটে ক্ষয়ে গেছে তার বাড়ির৷ পার্শ্ববর্তী ক্ষেত থেকে আমরা মাটি কেটে ভিটে ভরাট করে দুই হাত পরিমাণ উঁচু করে দেই কাঞ্চন কাকার ভিটে৷ এ এক কাকতাল। যিনি মাটি কেটে ভিটা ভরাট করেন অন্যের বাড়ির, তার বাড়ির ভিটা ভরাট করে দিচ্ছি আমরা।

বিকালে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ি অসহায় পরিবারের কাছে খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দিতে৷ খোঁজ নিয়ে নিয়ে বাছাইকৃত সবচেয়ে দুস্থ পরিবারগুলোর দুয়ারে পৌঁছে দেই আমাদের উপহার৷ যার সবই নাই হয়ে গেছে তার কাছে কীভাবে এই ক্ষুদ্র সাহায্য নিয়ে যাবো সেটা ভেবে লজ্জায় পড়ে যাই। শহুরে আবরণের রুমালে কিছুক্ষণের জন্য লুকিয়ে নেই নিজের লজ্জাকে। পৌঁছে দেওয়া খাদ্য সামগ্রীতে থাকে নিত্যপ্রয়োজনীয় চাল, ডাল, তেল, লবণ, আলু, পেঁয়াজ, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, খাবার স্যালাইন, শুকনো খাবার আর শিশুখাদ্য।

এভাবে ধারাবাহিকভাবে আমরা ভিটা ভরাট করি কবির, সেলিম, শরীফ সহ ৬ পরিবারের। ভিটা ভরাট করে দিলেও অর্থাভাবে পারিনি কাউকে ঘর পুনঃনির্মাণে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় টিন কিনে দিতে। এক বেলায় ভিটা ভরাট করি, তো পরের বেলায় খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দেই। ১৩০ পরিবারের কাছে পৌঁছে দিয়েছি আমাদের সামগ্রী। নারীদের প্যাড ব্যবহারের বিষয় নিয়ে কোনো পুরুষ কথা বলাটা আমাদের সমাজে এখনও একটা ট্যাবু। সামগ্রিক বিবেচনায় আমাদের মনে হয় স্থানীয় নারীরাও হয়তো আমাদের কাছ থেকে স্যানিটারি প্যাড নেওয়ার ব্যাপারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন না। তাই আমরা স্থানীয় কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে নারীদের জন্য প্যাড পৌঁছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। আমরা ১০০ পরিবারের জন্য এক বক্স করে খাবার স্যালাইন ও নারীদের জন্য রিইউজেবল প্যাড পৌঁছে দেই কমিউনিটি ক্লিনিকে।

এ জনপদে কেউ অসুস্থ হলে নেই অ্যাম্বুলেন্স সেবা। স্থানীয় কমিউনিটি ক্লিনিকের নেই ন্যূনতম প্রয়োজনীয় অবকাঠামো। প্রয়োজন অনুপাতে নেই ওষুধপত্র, খাবার স্যালাইন কিংবা পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট। সংকট রয়েছে চিকিৎসক আর নার্সের। ক্রমশ বিলীন হতে থাকা দ্বীপ রক্ষায় নেই কোনো পদক্ষেপ। দ্বীপ বিলীন হয়ে গেলে এমানুষগুলো কোথায় যাবে, কীভাবে থাকবে- এনিয়ে নেই কোনো পরিকল্পনা৷ দেশের নাগরিক হিসেবে প্রাপ্য মৌলিক অধিকার পূরণের কোনো বালাই নেই। আমার শহুরে সত্ত্বায় মাঝে মাঝে দ্বিধা জেগেছে এরা আসলে এদেশেই আছেন কিনা!

শুধু ঢালচরের নয় বরং দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের অসংখ্য গ্রামের একই চিত্র। দুর্যোগের সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেন এরা। আমি মনে করি উপকূলীয় অঞ্চল নিয়ে সরকার ও উন্নয়ন কর্মীদের আলাদা করে ভাবনার প্রয়োজন আছে। 

এক সপ্তাহ ঢালচরে অবস্থান করাকালীন যে অফুরান ভালবাসা, উষ্ণতায় আমাদেরকে গ্রহণ করেছেন সেখানকার বাসিন্দারা, আন্তরিকতার আলিঙ্গনে আমাদেরকে যে মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে নিয়েছেন- তার প্রকাশ ভাষায় সম্ভব নয়। প্রতিটি মানুষ যেভাবে অকৃত্রিম হাসি দিয়ে আমাদেরকে আপন করে নিয়েছেন, এর চেয়ে বড় আপ্যায়ন কিছু হতে পারে না। ক্ষুদ্র সহযোগিতায় এদের কৃতজ্ঞতার ভার অনেক। বিদায় বেলায় কাঞ্চন কাকাদের অশ্রুসজল আলিঙ্গন আর প্রাণভরা দোয়াই আমাদের প্রাপ্তি, চলার পথের পাথেয়। 

নিত্য ক্ষয়িষ্ণু ঢালচরকে বাঁচানোর জন্য জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাই।