বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ এখন সময়ের দাবি

তৌহিদুল আলম
Published : 2 April 2018, 07:11 PM
Updated : 2 April 2018, 07:11 PM

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বর্তমান বিশ্ব এখন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। পৃথিবীর অনেক দেশের জীবন ও জীবিকা এখন হুমকির সম্মুখীন। মানুষের অপরিকল্পিত কর্মকাণ্ডের ফলে নিঃসৃত বিভিন্ন গ্যাস যেমন কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড ইত্যাদি  যা গ্রীন হাউস গ্যাস নামে পরিচিত, বায়ুমণ্ডলে আটকা পড়ে পৃথিবীকে ক্রমশ উত্তপ্ত করে তুলছে।

মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যে জীবাশ্ম জ্বালানি যেমন- কয়লা, যানবাহনে ব্যবহৃত জ্বালানি যেমন- গ্যাস ও ডিজেল এবং শিল্প কারখানায় কাঁচামাল থেকে পণ্য উৎপাদনের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলেই এই গ্রীন হাউস গ্যাসসমূহ নিঃসৃত হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে এই তাপমাত্রা আর সামান্য প্রাক শিল্পযুগের অর্থাৎ ১৮৫০-১৯০০ সালে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে যে তাপমাত্রা ছিল তার চাইতে ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেশি বৃদ্ধি পেলে এই শতাব্দীর মধ্যেই হিমালয়ের সমস্ত বরফ গলে যেতে পারে এবং মানুষকে বন্যা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, তাপপ্রবাহ ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মত চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন করে তুলবে।

এর মাঝেই আমরা ১.৩৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস পার করে ফেলেছি এবং গ্যাস নির্গমনও থেমে নেই। আর এ কারণেই ২০১৫ সালের প্যারিস সম্মেলনে ১৯৫ টি দেশ বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার প্রাক-শিল্পযুগের তাপমাত্রার চাইতে ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করতে একমত হয়েছে।

শিল্প কারখানা ও অন্যান্য উৎস হতে নিঃসৃত পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক কার্বন-ডাই-অক্সাইড সাগর, গাছ-পালা ও মাটির মাধ্যমে শোষিত হয়। নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন ও বন উজাড়ের ফলে এই শোষন মাত্রা অনেক কমে যাচ্ছে।ফলে তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়ছে এবং বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী ও খাদ্যশস্য বিলুপ্ত হচ্ছে। নদীর পানি শুকিয়ে গিয়ে জেলেদের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

সুতরাং এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির লাগাম (প্রাক-শিল্পযুগের তাপমাত্রার চাইতে বড়জোর ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস বাড়তে পারে, তার বেশি কোনক্রমেই নয়) টেনে ধরতে হলে আমাদেরকে জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে নবায়নযোগ্য শক্তি যেমন সৌর, বায়ু ও জৈবযৌগ ভিত্তিক উৎসের কথা চিন্তা করতে হবে।

পৃথিবীর অনেক দেশই এখন তাদের নিজেদের স্বার্থেই নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে এবং সেই লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের সাথে সাথে আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করছে। এমনকি জার্মানী, চীন, জাপান ও আমেরিকা এক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য শক্তির প্রতি তাদের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করার মাধ্যমে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।

এক হিসাবে দেখা গেছে, আমেরিকা ২০৫০ সালের মধ্যে তার সব অঙ্গরাজ্যের সর্বমোট বিদ্যুৎ চাহিদার ৮০ শতাংশ নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস থেকেই পূরণ করতে সক্ষম হবে।

তবে নবায়নযোগ্য শক্তির উপর নির্ভরশীলতা বাড়াতে হলে প্রথমেই এ প্রযুক্তি স্থাপনে সংশ্লিষ্ট খরচ কমাতে হবে।আশার কথা হল, দেশে দেশে বায়ু ও সৌরচালিত প্রযুক্তির খরচ ক্রমান্বয়ে কমছে।আফ্রিকা মহাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ এখন কম খরচে বাড়ীতে সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে।

নবায়নযোগ্য শক্তির বহুল ব্যবহার ছাড়া জীবাশ্ম জ্বালানীর উপর নির্ভরশীলতা একেবারে বন্ধ হবে না। কেউ কেউ শক্তির বিকল্প উৎস হিসেবে পারমাণবিক উৎপাদন ব্যবস্থাকে সুপারিশ করেছেন। কিন্তু এ ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন অনেক বেশি ব্যয়বহুল। এ ধরণের কেন্দ্র প্রযুক্তিগতভাবে ও অনেক জটিল এবং এর ব্যবস্থাপনা রাজনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র হতে যে বিষাক্ত বর্জ্যসমূহ নির্গত হয় তা চারপাশের পরিবেশ ও মানুষের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সূত্রপাত করে।

সুতরাং আবারো বলতে হয় নবায়নযোগ্য যেমন জৈবযৌগ, জলবিদ্যুৎ, সৌর ও বায়ুভিত্তিক শক্তির কথা; পরিবেশে যার প্রভাব খুবই সামান্য। খরচের দিক থেকেও এটি জীবাশ্ম জ্বালানী ও পারমাণবিক শক্তির চাইতে অনেক বেশি সাশ্রয়ী। আর তাই নবায়নযোগ্য শক্তির উত্তোরত্তর ব্যবহারের মাধ্যমেই কেবল আমরা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার কমাতে পারি।

এর সাথে আরো কিছু পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমেও আমরা এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি। যেমন – বনায়ন, বনাঞ্চল সংরক্ষণ, বৃহৎ পরিসরে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচী, কৃষিকাজে পরিমিত মাত্রার রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের পাশাপাশি জলবায়ু সহিষ্ণু কৃষি প্রযুক্তি অবলম্বন, তৃণভূমি সংরক্ষণ, ফসলের ক্ষেতে বৃক্ষরোপণ, এবং উপকূলীয় জলাভূমি ও ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সংরক্ষণ।

পরিতাপের বিষয় হল, বাংলাদেশ সরকার দেশের দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত বৃহৎ বনাঞ্চল সুন্দরবনের কাছে একটি ৩২০ মেঘাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করার মত একটি আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ফলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে!

তাছাড়া এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে ইতিমধ্যেই হুমকীর সম্মুখীন দেশটির দক্ষিন-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের হাজার হাজার স্থানীয় অধিবাসীর জীবিকাকে ধ্বংস করবে। আইপিসিসি'র একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২০ সালের মধ্যে এদেশের দক্ষিনাঞ্চল (যেখানে দেশের জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশের বাস) সম্পূর্ণরূপে বসবাসের অনুপযুক্ত বলে বিবেচিত হবে।

সুতরাং এখনই সময় সচেতন হবার আর উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পযুগের চাইতে ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেশির মধ্যে আবদ্ধ রাখার। নয়তো ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেয়ার কারণে এই পৃথিবী আমাদেরকে ক্ষমা করবে না!

উৎস:
[i] https://www.epa.gov/ghgemissions/sources-greenhouse-gas-emissions
[ii] http://www.heatisonline.org, দ্য গার্ডিয়ান, ৩০ আগস্ট ২০১৬
[iii] https://www.nature.com, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭
[iv] http://www.nrel.gov
[v] World Energy Perspective, http://www.worldenergy.org
[vi] The Answer to Climate Change Is Renewable Energy, Not Nuclear Power, http://www.huffingtonpost.com
[vii] http://naturalclimatesolutions.org
[viii] https://ejatlas.org