আলোচনায় মুখরিত খালেদা জিয়ার ভারত সফর এবং বাংলাদেশের মানুষের উঠে দাঁড়ানোর রাজনীতি

ফারুক আহমেদ
Published : 3 Nov 2012, 06:33 PM
Updated : 3 Nov 2012, 06:33 PM

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা হিসেবে বেগম খালেদা জিয়া ভারত সফরে গিয়েছিলেন।তাঁর এই সফর বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ।সরকারের মন্ত্রী, ক্ষমতাসীন দলের , বিরোধি দলের লোকজন , বাম-ডানের লোকজন , বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ,গবেষক, কূটনীতিক সবাই এই আলোচনায় মুখর ।দুটি দেশের মধ্যে কূটনীতিক, রাজনৈতিক, বাণিজ্যিকসহ নানা বিষয়ের পারষ্পরিক সম্পর্ক নিয়ে এক দেশ থেকে অপর দেশে শুধু সরকারী দলের নেতাদেরই নয় বিরোধী দলের নেতাদেরও সফর এক স্বাভাবিক ব্যাপার ।ভারত বাংলাদেশের প্রতিবেশি দেশ হিসেবে এই সফর আরো বেশি স্বাভাবিক। কিছুকাল আগে বেগম খালেদা জিয়া চীন সফরেও গিয়েছিলেন । স্বাভাবিকভাবেই এখনকার আলোচনায় সেই চীন সফরও স্থান পাচ্ছে ।

এসব আলোচনায় সুনির্দিষ্ট কোন বিষয় সেভাবে না থাকলেও গভীর(!) এবং জটিল বিষয় থাকছে । বিশ্লেষণের পর বিশ্লেষণ চলছে ।সরকারি লোকজনের অনেকেই এই সফরকে আগে থেকেই অর্থহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন কেউবা আবার শিষ্টাচার বহির্ভুত কথা বলে বসেছেন । সেসব নিয়েও আলোচনা জোরদার হচ্ছে ।কেউ কেউ আবার আলোচনা এমনভাবে করছেন যাতে ভারত সরকারের ওপর তাঁদের এক ধরনের অভিমান ফুটে উঠছে এবং এ ক্ষেত্রে তাঁরা কোন দেশের নাগরিক পূর্ব পরিচয় না পেলে তা বুঝা কঠিন হচ্ছে।কেউ বলছেন বি.এন.পি তার ভারত নীতি বদলেছে আবার কেই বলছেন ভারতই তার নীতি বদলেছে ।

ভারত বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ এবং তিনদিক থেকে ঘিরে থাকা প্রতিবেশী ।উপরন্তু অর্থনৈতিক, সামরিক সব দিক দিয়েই ক্ষমতাধর এক প্রতিবেশী দেশ ।এসব দিক দিয়ে বিবেচনায় বাংলাদেশের মানুষের সমাজ জীবনে এবং অর্থনীতিক জীবনে ভারতের গুরুত্ব থাকা স্বাভাবিক ।আবার ভারতের কাছেও বাংলাদেশ নানা দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ।তবে বাংলাদেশের সকল মানুষের ওপর ভারতের প্রভাব এবং গুরুত্ব এক রকম নয় ।একদিকে আছেন ব্যাপক সাধারণ মানুষ যাঁদের আর্থ সামাজিক জীবনে ভারতের প্রভাব এবং গুরুত্ব এক রকমের । অপরদিকে আছেন শাসক শ্রেণির লোকেরা যার মধ্যে সরকারি , বিরোধী দলীয় এবং তাদের বিভিন্ন শরীক সহযোগিরা পড়ে তাদের কাছে ভারতের গুরুত্ব আরেক রকম ।একইভাবে ভারতের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে সেখানকার শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজ্যের সংগ্রামরত মানুষের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব যেমন তার সাথে সেখানকার শাসক শ্রেণির কাছে বাংলাদেশের গুরুত্বের পার্থক্য
আছে ।

একটি দেশের সরকারই হোক আর বিরোধী দলীয়ই হোক কোন নেতার অন্য দেশে সফর নিশ্চয়ই কোন আত্নীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া নয় যে, সেখানে খোশ গল্পের মধ্য দিয়ে যাই সামনে আসলো তাই নিয়ে কিছু আলোচনা হলো। সেখানে অবশ্যই আলোচনার সুনির্দিষ্ট বিষয় থাকতে হয় । দেশের জনগণের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্ব করার অর্থ হলো সেসব সুনির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর আলোচনায় যুক্তি-তর্ক থাকতে হয় ।সকল বিষয়ে নিঃশর্ত সহমত পোষণ করা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করা নয় ।বাংলাদেশের নেতাদের সফরে জনগণের প্রতিনিধিত্বের কোন কিছু দেখা যায় না ।খবরে এবং আলোচনায় যেসব বিষয় জানা যাচ্ছে তার মধ্যে একটি বিষয় হলো খালেদা জিয়া সেখানে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ক্ষমতায় গেলে ভারতের কোন বিচ্ছিন্নতাবাদীকে বাংলাদেশে আশ্রয় প্রশ্রয় দেবেন না । সে তিনি তাঁর রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক বিবেচনায় বলতেই পারেন । কিন্তু এর মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের আনন্দের বার্তা কি আছে ?এদিকে খালেদা জিয়ার এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রনালয়ের দায়ীত্বপ্রাপ্ত একজন মন্ত্রী বলে বসলেন যে , খালেদা জিয়ার এই কথায় নাকি প্রমাণ হয়ে গেল তারা যখন ক্ষমতায় ছিল তখন ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে ।হতে পারে এই মন্ত্রীর কথা ঠিক ।তা নিয়ে বিতর্ক করায় বাংলাদেশের জনগণের কোন স্বার্থ নেই ।কিন্তু মন্ত্রীর কথায় তিনি কোন্ দেশের মন্ত্রী তা বুঝা এদেশের মানুষ ছাড়া অন্য কোন দেশের মানুষের পক্ষে কঠিন হয় । এ দেশের নাগরিকের কাছে যা বুঝা সম্ভব তা হলো এ যেন গুরুর নতুন শিষ্য গ্রহনে বাধা দিয়ে পুরাতন এবং বর্তমান শিষ্যের বলে ওঠা –' ও নয় আমিই গুরু তোমার প্রকৃত শিষ্য'।ভারতের সাথে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত এমনই নতজানু এবং ভগ্ন অবস্থা । এখানে ভারতই এককভাবে নীতি নির্ধারক হিসেবে থেকে গিয়েছে সব সময় এবং এখনও তাই থাকছে।

খালেদা জিয়ার পক্ষের , বিপক্ষের এবং মধ্যখানের সকল আলোচকের আলোচনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আগামী নির্বাচনে এই সফরের প্রভাব ।এই সব আলোচনার গতি প্রকৃতি থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে ,বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় কারা বসবে তা নির্ধারণের ক্ষমতা এখনও বাংলাদেশের মানুষ অর্জন করতে পরেননি । অনেক রক্তের বিনিময়ে , নারী-পুরুষ সহ আপামর জনতার অনেক ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হলেও তা থেকে প্রাপ্ত অধিকার সাধারণ মানুষ পাননি ।শুধুমাত্র ভোট দিতে পারাকেই রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন বুঝায় না । জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতা বলতে বুঝায় সেই ক্ষমতা যার দ্বারা রাষ্ট্রের পরিচালক নির্ধারণের সর্বময় ক্ষমতা জনগণের হাতে থাকবে ।মুখে গণতন্ত্রের কথা বলা হলেও এবং ভোটের কথা বলা হলেও শাসক শ্রেণির দলগুলোও মনে করে না ক্ষমতায় বসানোর মালিক সম্পূর্ণরূপে জনগণ ।এটা ঠিক যে পাথর সরানোর কাজটি জনগণই করে থাকেন বা তাদের দিয়ে করানো হয়ে থাকে । কিন্তু তা সরানোর সকল নকশা এবং আয়োজক অন্যরা । এ বিষয়টি শাসক শ্রেণির নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে সবাই জানেন । আর জানেন বলে প্রতিটি নির্বাচনের পর যারাই পরাজিত হন তারাই কিন্তু এখন আর ভোট কারচুপিরও অভিযোগ তোলেন না । তারা এখন অন্যদিকে আঙ্গুল তোলেন ।২০০৯ সালে মহাজোটের নামে মূলতঃ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসার পর প্রধান মন্ত্রী শেখ হাছিনা বহুবার একথা বলেছেন যে , ভারত সহ বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী প্রতিষ্ঠানের সাথে দেশ বিরোধি কতকগুলো চুক্তি না করার জন্যই ২০০১ সালের নির্বাচনে তাঁরা পরাজিত হয়েছিলেন ।আবার ২০০৯ সালের নির্বাচনে যখন বি.এন.পি'র নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের ভরাডুবি ঘটল তখন খালেদা জিয়ার বক্তব্যও ছিল অনুরূপ । তিনি বহুবার বলেছেন ভারতের টাকায় এবং ভারতের প্রভাবেই আওয়ামী লীগের নের্তৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসতে পেরেছে ।শাসক শ্রেণির লোকেরা যখন এ ধরনের কথা বলেন তখন জনগণের কোন রকমের রাজনৈতিক ক্ষমতার তাঁরা তোয়াক্কা করেন না । বাংলাদেশের শাসন কার্যের পরিচালক নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক কাজটি জনগণের দ্বারা সংগঠিত হওয়াটা যে এক মস্ত বড় ধোঁকাবাজির ব্যাপার তা শাসক শ্রেণির লোকেরা খুব ভালভাবেই জানেন । আর জানেন বলেই তারা এ ধরণের কথাবার্তা বলতে কোন অসুবিধা বোধ করেন না ।

বর্তমানে খালেদা জিয়ার ভারত সফরকে কেন্দ্র করে আলোচনা যে গতিতে চলছে তাতেও বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতাহীনতা আবারো ফুটে উঠছে । এইসব আলোচনার মধ্য দিয়ে আবারো তারাই প্রমাণ করছেন বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক স্বার্বভৌমত্ব বলে কিছু নেই ।এখানে রাজনৈতিক আধিপত্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ,ভারত, চীন সহ সাম্রাজ্যবাদী দেশ এবং প্রতিষ্ঠানসমূহের । তাদের নানা রকমের ডিজাইন অনুসারে ক্ষেত্র প্রস্তুত করে নির্বাচনের সময় এদেশের জনগণের মাধ্যমে শুধুমাত্র পাথর সরানোর কাজটি করিয়ে নেওয়া হয় ।এসব জানেন বলেই শাসক শ্রেণির লোকদের কাছে জনগণ অপেক্ষা এসব মুরুব্বিরা এতই বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে এসব নিয়ে কথা বলার সময় জনগণের কোন হিসাবই তাদের কাছে স্থান পায় না ।

স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর থেকে এ পর্যন্ত সংসদে বিরোধী অবস্থানে যে দলই থেকেছে তারা কখনোই সংসদের ভিতরে বা বাইরে জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোন বিষয়ে জনগণকে সংগঠিত করে কোন আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি ।কি নিয়ে তারা দাঁড়াবে ?জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রশ্নে ,জনগণের সম্পদের প্রশ্নে,শিল্প, কৃষি, কর্মসংস্থান , শিক্ষা , জনস্বাস্থ্য সহ জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সকল প্রশ্নে শাসক শ্রেণির সরকারে থাকা এবং না থাকা অংশের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই ।আর নেই বলেই রাজনৈতিক অস্তিত্ত্ব ধরে রাখতে সরকারী এবং বিরোধী উভয় অংশকেই এমন সব ইস্যু আমদানি করতে হয় যাতে রাজনীতির মাঠও গরম থাকে আবার নিজেদের বিরুদ্ধেও না দাঁড়াতে হয় । এ নিয়ে মুরুব্বিরাও কিছু কিছু ইস্যু সরবরাহ করে থাকে এবং তাদের ডিজাইন অনুসারে জনস্বার্থ বহির্ভূত ইস্যু তৈরী করা হয়ে থাকে ।খালেদা জিয়ার ভারত সফর এবং তা নিয়ে শাসক শ্রেণির জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু জনগণের দিক দিয়ে দেখলে আসার আলোচনা-সমালোচনাকে এ দিক দিয়ে দেখা যেতে পারে ।

স্বাধীনতার পর থেকে এদেশের জনগণ তাঁদের শ্রমে প্রচুর সম্পদ সৃষ্টি করেছেন ।দেশে বিদেশে অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাঁদের গড়ে তোলা সম্পদের চেহারা এদেশে দেখা যায় নানাভাবে । বাংলাদেশের অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে । বহু মানুষের দিন বদলে গিয়েছে ।কিন্তু কাদের সৃষ্ট সম্পদে কাদের দিন বদলে গিয়েছে?দুই একটি হলমার্ক সামনে এলেও এমনই বা এর চেয়েও বেশি লুটপাটের অসংখ্য হলমার্ক জনগণের পাঁজরের ওপর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ।বাইশ পরিবারের পরিবর্তে বাইশ লক্ষ বেপরোয়া পরিবারের সৃষ্টি হয়েছে ।তারাই সবকিছু লুটপুটে বাংলাদেশের চেহারা পাল্টে দিয়েছে ।জনগণের ঘর অন্ধকার থাকলেও শহরগুলোকে আলোঝলমলে করা হয়েছে ।বিরাট বিরাট শপিং মল দাঁড়িয়ে আছে হাড় জিরজিরে মানুষগুলোর বুকের পাজরের ওপর ।শাইনিং বাংলাদেশ!গরীব হাড্ডিসার শিক্ষকেরা রাস্তায় পড়ে সরকারের পুলিশের লাঠিপেটায় প্রাণ দিলেও বিপুল ব্যায়ের শিক্ষা(?)প্রতিষ্ঠান তার ঝলমলে মাথা শুধুই উপরের দিকে তুলছে। শাইনিং বাংলাদেশ!!নদীগুলো দখল হয়ে গিয়েছে প্রায় সবই ততদূর পর্যন্তই যতদুর পর্যন্ত প্রকৃতি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি ।সমুদ্র সৈকত দখল করে গড়ে তোলা হচ্ছে তারকা খচিত বিশাল বিশাল হোটেল । যেখানে সমুদ্রের পানি এসে আছড়ে পড়ে সেসবের বেলকুনিতে। কেউ কেউ পা ডুবিয়ে উপভোগ করতে পারে গোটা সমুদ্রকেই ।শাইনিং বাংলাদেশ!!!

এভাবে ফিরিস্তি দিতে গেলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা খরচ হবে তবুও ফিরিস্তি শেষ হবে না ।এখন প্রশ্ন হচ্ছে শাসক শ্রেণির এই ঘেরাটোপে এদেশের মানুষ আর কতকাল আটকে থাকবে ?এর থেকে বের হওয়ার উপায় কি ?নিজেদের শক্তি গড়ে তোলা ।রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করা ।রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন না করলে নিরানব্বই পার্সেন্টকে এক পার্সেন্টের কাছেই সর্বদা বন্দি থাকতে হয়। রাজনৈতিক ক্ষমতায় উঠে দাঁড়ানো ছাড়া বাংলাদেশের মানুষের সামনে আর কোন পথ নেই ।