শিশু অধিকারের কথা বলি অথচ অহরহ শিশুদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে চলেছি

মোঃ গালিব মেহেদী খান
Published : 6 July 2012, 05:45 AM
Updated : 6 July 2012, 05:45 AM

আমাদের সমাজে শিশু নির্যাতনের যত ঘটনা ঘটে তার বেশিরভাগই পারিবারিক-ভাবে। আমি তাদের মনো:দৈহিক উভয়বিধ নির্যাতনের কথা বলছি। সবচেয়ে আশংকার বিষয়টি হল এই নির্যাতনের অনেকটাই করা হয় নির্যাতন নয় ভেবে এবং তাদের ভাল হবে এই চিন্তা থেকে। আর তা করা হয় তার সবচেয়ে বড় নির্ভরতার জায়গা থেকে। যা তাকে করে তুলছে একদিকে মিথ্যেবাদী, নির্দয়, হিংস্র অন্যদিকে ভিতু, পরনির্ভরশীল সর্বোপরি অন্তর্মুখী। যা কারোই কাম্য নয়। আজ আমরা মানুষ নয় তৈরি করছি দ্বায়িত্বজ্ঞানহীন কিছু যন্ত্র মানব। আমরা শিশু অধিকারের কথা বলি অথচ নিজেরাই অহরহ তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে চলেছি ।

একটি শিশুর মন এক উর্বরা জমির মত যা রোপণ করবেন তাই জন্মাবে। সে যা দেখবে তাই শিখবে। আপনার সরল মনে হাস্যোচ্ছলে বলা মিথ্যে কথাটা সে শিখছে। সাধারণত মা তাকে খাওয়ানোর সময় কথা দিচ্ছেন এটা দেব ওটা দেব বা শিশুর পছন্দের কোথাও নিয়ে যাব বলে। পরে আর দিচ্ছেন না বা নিয়ে যাচ্ছেন না। শিশুটি আশাহত হল; সেই সাথে সে জানল তার মা মিথ্যেবাদী। আর সেও এরপর থেকে মিথ্যে বলা শুরু করে। তার মনে মিথ্যের বীজটি কিন্তু আপনিই বপন করে দিলেন। অথচ আপনি একটু সচেতন হলেই এই মিথ্যেটা এড়াতে পারতেন। তার সাথে এমন কোন ওয়াদা করুন যা আপনি রক্ষা করতে পারবেন এবং আপনার ওয়াদা রক্ষা করুন। তা যত ছোটই হোক না কেন? আপনার কাছে তা যত ছোটই মনে হোক না কেন আপনার শিশুটির কাছে তার মূল্য অনেক। আর তাই সে আপনার দাবী মিটিয়েছে। যদি কখনো সে কোন মিথ্যের আশ্রয় নেয় আপনি তাকে সৎ সাহসে বলতে পারবেন। তোমার মামনি কখনো মিথ্যে বলেনা। আর আপনি যদি সচেতন না হন তাহলে সেও কখনো বলে বসতে পারে তুমি তো আমার সাথে মিথ্যে বল। আপনি লজ্জা পাবেন।

আপনার শিশুকে একটি ভাল স্কুলে ভর্তি হতে হবে, তাকে প্রথম স্থান অধিকার করতে হবে। তাকে নাচ শিখতে হবে, গান শিখতে হবে, তাকে বড় হতে হবে। এই হতে হবের পাল্লায় পরে তার চিঁড়েচেপটা অবস্থা। সে হারিয়ে ফেলছে অসম্ভব সুন্দর তার শৈশব।

আমি দশ বছরের একটি বাচ্চার দৈনন্দিন জীবনের চিত্র তুলে ধরছি। যার মা তাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে সকাল সাতটায় স্কুলে পাঠান দুপুর ১২টায় স্কুল ছুটি হলেও বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় ২টা। বিকেল ৩টায় নাচের স্কুল, বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। এরপরেই আবার ৬:৩০মিঃ প্রাইভেট টিউটর। যিনি তাকে পড়াবেন রাত ৯টা অবধি। ভাবুন একজন পূর্ণবয়স্ক লোকের পক্ষেও কি এইভাবে ছকে বাধা জীবন যাপন সম্ভব? এই শিশুটি তার নিজের জন্য একটু সময় বের করতে পারে না। যখন সময় মেলে তখন রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভর করে ছোট্ট দেহে। তার খেলনা আছে তাও শোকেস বন্দি। সে ক্লান্ত দেহে বিছানায় শুয়ে খেলনাগুলি দেখতে দেখতেই ঘুমিয়ে পড়ে আর কখনোবা বড়জোর তার প্রিয় খেলনাগুলি বিছানায় নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতেই হারিয়ে যায় ঘুমের রাজ্যে। কোনও কারণে ঘুম না এলে মা এসে তাগাদা দেন তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড় সকালে উঠতে হবে। দেখুন তো আপনার সন্তানের দৈনন্দিন জীবনের সাথে এই দিনপঞ্জি কতখানি মিলে যায়?

এবার বলুন পড়ালেখার নামে আমরা কি তাদের উপর অত্যাচার করছি না? তাদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে এটা যেমন ঠিক সেই সাথে তাদের মানসিক বিকাশের সুযোগও করে দিতে হবে। সুযোগ দিতে হবে খেলাধুলা আর আনন্দোল্লাসের।

সব মা বাবাই আশা করেন তার সন্তান প্রথম স্থান অধিকার করবে। এটা তারা বুঝতে চান না যে, সবার সব ক্ষমতা থাকে না। গাধা পিটিয়ে মেরে ফেলা যায়, মানুষ করা যায় না। প্রচলিত এই কথাটার ব্যাপ্তি অনেক। আমরা শুধু নেগেটিভ অর্থেই কথাটি ব্যবহার করি। অথচ এর থেকে সত্য আর হয় না। সবার মস্তিষ্ক একই রকম কর্মক্ষম নয়। সব ধরনের চাপ সবাই একইভাবে গ্রহণ করতে পারেনা। একজন মানুষ স্বেচ্ছায়, তার ভালোলাগা থেকে অসম্ভব কোন কিছু করে ফেলতে পারেন। সেই একই কাজ যদি তার উপর চাপিয়ে দেয়া হয়, তাহলে আর তা করা তার পক্ষে আদৌ সম্ভব হয় না। তার কারণ বাড়তি চাপ নিতে হলে ভালোলাগা থাকতে হয়। যা বাড়তি চাপের যন্ত্রণাকে লাঘব করে। আমাদের শিশুদের উপর প্রতিনিয়ত যে চাপ আমরা বাড়িয়েই চলেছি তা কি তারা ভালোলাগা থেকে গ্রহণ করছে? শিক্ষা ব্যবস্থা যদি ভীতিকর হয় তা হয়ত মুখস্থ করা সম্ভব, আত্মস্থ করা নয়।

বাচ্চাদের পড়ালেখা দেখভালের দায়িত্বটা সাধারণত পালন করেন মা। আর তাই মা হয়ে যাচ্ছেন বাচ্চাদের কাছে শাসক। কারণ একটাই; আর তা হল মাত্রাতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ। যা সে নিতে পারছে না। অথচ মা প্রতিনিয়ত চাপ প্রয়োগ করেই যাচ্ছেন। মায়ের প্রতি শিশু সন্তানের যে নির্ভরতা তা ক্রমশই কমে আসছে, জেঁকে বসছে ভয়। ইদানীং দেখা যায় বাচ্চাদের কাছে মা বাবা নয় তাদের প্রিয় হচ্ছে একটু দূরের আত্মীয় স্বজন। কারণ জানতে চাইলে তারা বলে "মা বাবা শুধু বলে এটা করনা ওটা করনা, পড়ালেখা কর। মামা-চাচ্চুরা তো শুধু আদর করে"। একটি শিশু অনুযোগ করে যখন বলে-

আব্বু আমায় একটুও ভালবাসেনা, যখনই বাসায় আসে তখনই বলে হোম ওয়ার্ক করেছ?

তখন বড় ভয় হয়; আমরা শিশুদের মনে মা বাবার কি চিত্র একে দিচ্ছি? এই শিশুরাই কি একদিন বড় হয়ে এই নির্দয়তার প্রতিশোধ নেবে না। আরও বেশি নির্দয় হয়ে? এ ক্ষেত্রে একজন ভূক্তভোগী কি বলছে দেখুন- (একটি লেখার উপর করা কমেন্ট হুবহু তুলে দেয়া হল)

আমার ছোটবেলার কোনও মধুর স্মৃতি নেই । এটা আমার জন্য ভয়ংকর একটা স্বপ্ন । আর এই স্বপ্নই আমি এতোগুলো বছর বয়ে বেড়াচ্ছি । এর জন্য দায়ী আমার আম্মা । এখনও আম্মাকে প্রায় বলি " আমি তোমাকে কোনোদিন ক্ষমা করবো না – তুমি আমার শৈশব কেড়ে নিয়েছ।" ছোটবেলায় আম্মা বলতো তার নাকি চারটা চোখ । দুইটা তার সাথে থাকে আর দুইটা আমাকে ফলো করে। আমিও বেকুব বহুদিন এই কথা বিশ্বাস করেছিলাম। যখন ভুল ভাঙল ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে।

এরপরে আসুন শত চেষ্টার পরেও যখন সন্তান আশানুরূপ ফল করতে পারে না তখন মা বাবার অবস্থা এমন হয় যে, তারা এমনই এক ঘোর অমানিশার মধ্যে হারিয়ে গেছেন যেখান থেকে ফেরার কোন পথ নেই। একবারও ভাবছেন না শিশুমনে এর কতটা প্রভাব পরছে। এটা ভাবলেন না ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক এই শিশুটি যতটা পরিশ্রম করল তার বিনিময়ে সে কি পেল? ১০০ আসনের বিপরীতে ১০০০ শিক্ষার্থী চেষ্টা করেছে। কৃতকার্য তো ১০০ জনই হবে। বাকি ৯০০ জন অকৃতকার্য হবে এটাই স্বাভাবিক। এই অকৃতকার্যতার জন্য সে দায়ী নয়, দায়ী আমরা। কারণ এত কষ্ট স্বীকার করার পরেও একটা উন্নত শিক্ষার পরিবেশ আমরা তার জন্য নিশ্চিত করতে পারিনি। অথচ এই অকৃতকার্যতার জন্য তাকে প্রহার পর্যন্ত করা হয়। কথায় কথায় তাকে ধিক্কার জানায় তারই সবচেয়ে আপনজন। অসহায় সে বাধ্য হয়ে মুখ বুঝে সহ্য করে। যা ক্রমশ: তাকে করে তুলছে হিংস্র, অমানবিক যা আমরা টেরই পাচ্ছি না। আমরা তাকে মানবিকতার শিক্ষা দিতে পারিনি। আমরা শিশুমনে প্রথমেই একে দেই প্রথম স্থান অধিকার করতে হবে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, মিলিওনিয়ার হতে হবে। একবারও বলি না শিখতে হবে, জানতে হবে, বুঝতে হবে, বড় মানুষ হতে হবে, ভাল মানুষ হতে হবে। নিজের জন্যে নয় বড় হতে হবে অন্যের জন্যে, দেশের জন্যে।

এরপরে আসুন তার বিনোদনের জায়গায়। এখানেও নির্যাতন। সে তার ব্যালকনিতে দাড়িয়ে দেখছে শিশুরা বৃষ্টিতে ভিজছে, জলকেলি করছে, খেলছে। সে জানে ওদের সাথে বন্ধুত্ব করা যাবে না কারণ মা বলেছেন ওরা দুষ্ট, ওরা পচা প্রকারান্তরে এও বুঝিয়ে দিয়েছেন ওরা তোমার বন্ধু হওয়ার যোগ্য নয়। এই যে বিভাজন তার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হল তা সে বয়ে বেড়াবে সারাটা জীবন। সে নিজেকে গুটিয়ে রাখবে। ব্যাপৃত থাকবে নিজেকে নিয়ে।

তার বন্ধু কে? সে খেলবে কার সাথে? উত্তরে মা বলেন কেন তার কম্পিউটার আছে না, সে গেমস খেলুক। টেলিভিশনে কার্টুন দেখুক। খুব ভাল সমাধান! আপনার ছেলেকে কি আপনিই অন্তর্মুখী করলেন না?

আমি বলছি না আপনার সন্তানকে সবার সাথে ঘুরতে দিন। তবে এটা বলব, তাকে এমন একটা আবহ তৈরি করে দিন যাতে সে এর বিকল্প পায়। যখন তার জন্য আপনার মনের মত বন্ধু যোগার করে দিতে পারছেন না। তখন আপনি নিজেই তার বন্ধু হন। তাকে আরও বেশি সাহচর্য দিন। তাকে মানুষের সাথে মেশার সুযোগ করে দিন। কম্পিউটার বা কার্টুন তার বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম হতে পারে না। মানুষ হতে হলে মানবিক গুণসম্পন্ন হতে হলে তাকে মানুষের সাথেই মিশতে হবে।

শিশুদের নিয়ে আমাদের ভাবনার একটি উদাহরণ দেই আমারই একটি লেখার উপরে করা একটি মন্তব্য দিয়ে- হুবহু তুলে দেয়া হল-
শিশু কিশোররা মোটেও কোমল মতি না । শিশু কাল থেকে অপরের টা কেড়ে নিতে শিখে শক্তির বলে সেটা অনেকের মধ্যে বড়ো হলেও যায় না । শিশুরা ভণিতা করে না – যখন যেটা চায় সেটা নিয়ে নেয় ।

শিশুর কৌতূহলের বশে আনন্দের জন্য পিঁপড়া থেকে শুরু করে পশু পাখি মারে । সেখানে নৃশংসতার অভাব হয় না ।

শিশুদের নিয়ে মোটা-দাগে এই আমাদের ভাবনা। কতটুকু সঠিকভাবে আমরা তাকে লালন-পালন করছি প্রশ্নের দাবী রাখে। পরিশেষে বলব, আপনার শিশুর ধারণ ক্ষমতা সম্পর্কে সঠিক ধারনা লাভের চেষ্টা করুন। সে অনুযায়ী তার উপর চাপ প্রয়োগ করুন। শিশুর শৈশব কেড়ে নিবেন না। তাকে সবার আগে একজন ভাল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করুন। নিশ্চয়ই সে চেষ্টা করবে আপনার স্বপ্ন পূরণের। শিশুদের সাথে রুঢ় আচরন করবেন না। এটা তাদের কোমল মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করবে। আদেশ উপদেশ নয় তাদের প্রতি কোমল হন বোঝাতে চেষ্টা করুন সে উচ্ছ্বসিত থাকবে সহজে আপনার কথা শুনবে উদ্ধত হবে না। আপনার শিশুটি শুধুমাত্র আপনার নয়। সে এই সমাজের, এই দেশের। হতে পারে এই শিশুটিই হবে মানবতার কাণ্ডারি। এ দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার।