বাংলাদেশে জরুরি চিকিৎসা সেবা: একটি নাগরিক পর্যালোচনা

মোঃ গালিব মেহেদী খান
Published : 5 Sept 2012, 10:14 AM
Updated : 5 Sept 2012, 10:14 AM

চিকিৎসাসেবা পাওয়া মানুষের একটি মৌলিক অধিকার। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট ছাড়াও বেশ কিছু কারণে জনগণের এই মৌলিক অধিকারটি আজো পূরণ করা সম্ভব হয়নি। সরকারি-আধাসরকারি উন্নয়ন সংস্থাসমূহ এবং এনজিওগুলো এক্ষেত্রে একযোগে সেবার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে না এলে সকলের জন্য চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণ আদৌ সম্ভব কিনা সন্দেহ। কেননা চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণে আমাদের দেশে পর্যাপ্ত ডাক্তার, দক্ষ নার্স ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব অনেক বেশি। সেই সাথে আমাদের অসচেতনতা রোগীদের দুর্ভোগের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ। এমন অনেক শিক্ষিত লোকও দেখা যায় যারা জানেনই না কোন রোগের বিশেষায়িত হাসপাতাল কোনটা। এবং তার অবস্থানটাই বা কোথায়। সকলকে এমএলএফএফ ডিগ্রীধারী হতে হবে এ কথা আমি বলছি না। তবে স্বাস্থ্য সচেতনতা, প্রাথমিক চিকিৎসা জ্ঞান, কোন রোগের বিশেষায়িত হাসপাতাল কোনটা এবং তার অবস্থান সম্পর্কিত জ্ঞান যে অনেক ভোগান্তির হাত থেকে রক্ষা করতে পারে তা সকলেই মেনে নিতে বাধ্য। এ সম্পর্কিত জ্ঞান নিঃসন্দেহে বাঁচিয়ে দিতে পারে অনেক মূল্যবান প্রাণ।

আমাদের আশেপাশে বা চলার পথে নানা দুর্ঘটনা ঘটে । এই দুর্ঘটনা কবলিত মানুষদের পাশে দাঁড়ানো একজন সুনাগরিকের কর্তব্য । তবে এই পাশে দাঁড়ানোটা যদি হয় আন্তরিকতাপূর্ণ এবং ফাস্ট এইড জ্ঞানসম্পন্ন তবেই তা হয় যথার্থ। ডাক্তার আসার পূর্ব পর্যন্ত সময় আহত বা আক্রান্ত ব্যক্তির আরোগ্যের পথ সুগম করা এবং অবস্থার অবনতি না ঘটে সে মত ব্যবস্থা করাই প্রাথমিক চিকিৎসা। এক্ষেত্রে কিছু বিষয় অবশ্যই মনে রাখা প্রয়োজন।

যেমন:
* ব্যক্তির আহত হওয়ার কারণ।
* প্রাথমিক চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা।
* দ্রুত নিকটস্থ নিরাময় কেন্দ্রে নেয়া।

এ পর্যন্ত ঠিক আছে। প্রতিদিন অসংখ্য নতুন রোগী আসছে, রোগীকে সহযোগিতা করার মত অজ্ঞ-বিজ্ঞ দুই ধরনের লোকও পাওয়া যাবে। তারা কাছাকাছি কোন নিরাময় কেন্দ্রে নিয়েও যাবেন। সমস্যার শুরুটা হয় এরপর থেকে। আমাদের একটা জাতীয় চরিত্র হল আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত অন্যের স্বার্থের বেলায় আন্তরিক, যতক্ষণ না তার সাথে নিজ স্বার্থের সংযোগ ঘটে। আর এ কারণেই সমস্যার শুরু হয় কেননা এর পরবর্তী ধাপগুলোই কারো না কারো স্বার্থসংশ্লিষ্ট।

সরকারী নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে রয়েছে অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি। বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে শুধুই বাণিজ্য। উভয়ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত সেবা।

নিরাময় কেন্দ্রগুলো যেমন সরকারি বেসরকারি দুইভাগে বিভক্ত তেমনি তাদের সেবার ধরনটাও দুই রকম। যদি সরকারি হয় তাহলে দেখবেন। জরুরী বিভাগে চিকিৎসক নেই। যদি থেকেও থাকে পর্যাপ্ত সরঞ্জামাদি নেই। যদি তাও থেকে থাকে দেখবেন তা পরিচর্যার অভাবে অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। নিরাময় কেন্দ্রটি যত বেশি প্রত্যন্ত এলাকায় হবে এই যদিগুলোর আবশ্যকতাও তত বেশি হবে। যেমন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আর কুলাউড়া-সিলেট ও ছাতক রেলওয়ে হাসপাতালের (যেখানে তিন হাসপাতালের দায়িত্ব একজন চিকিৎসকের কাঁধে।) চিত্র এক নয়। আপনি যদি অসীম ধৈর্যের অধিকারি হন তাহলে অপেক্ষা করুন। নিশ্চয়ই চিকিৎসক মহোদয়কে একসময় পাবেন। আল্লাহ চাহে তো আপনার রোগী ততক্ষণ পর্যন্ত বেচে থাকলে কমবেশি সেবাও পাবেন। এখানে লক্ষণীয়; সরকারি নিরাময় কেন্দ্রে সাধারণ চিকিৎসকের দেখা পাওয়া যত কঠিন একটু সিনিয়র বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেখা পাওয়া তুলনামূলক ভাবে তার চেয়ে সহজ। যে কারণে রোগী একবার টিকে গেলে সাধারণত সুস্থ হয়েই ফিরে যেতে সক্ষম হন। যদিও হামেশাই তার সেবা প্রদানকারী সঙ্গীটি সাথে অন্য রোগ নিয়ে বাড়ি ফিরেন।

ঠিক এর উলটো চিত্র বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে। যেন সরকারী নিরাময় কেন্দ্রগুলোর যেসব অসহ্য যন্ত্রণা এড়ানোর জন্য রোগীরা বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্রগুলোর দ্বারস্থ হয় তারা সেগুলো মাথায় রেখেই তাদের নিরাময় কেন্দ্রগুলো সাজায়। এখানে পরিচ্ছন্ন ফ্রেশরুম/টয়লেট পাবেন, মিষ্টি হাসিমুখের সেবিকা পাবেন, পাবেন প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা সামগ্রী, এমনকি চিকিৎসকও। যা পাবেন না তা হল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। আর তাই নিশ্চিত থাকুন প্রাথমিক চিকিৎসা এখানে আপনি পাবেন। যদিও সে সেবার সাথে বিলের অংকের মিল খুঁজে পাবেন না সারা জীবন ঘেঁটেও। কারণ আমাদের দেশের বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্রগুলো কখনো সেবার মানসিকতা নিয়ে গড়ে ওঠেনা। এখানে সেবা একটি পণ্যের নাম। আপনি চাকচিক্য দেখে যে মোড়কটি কিনছেন তা ফানুশ মাত্র । আর যে সেবা পাচ্ছেন তা ফ্রি। এখানে প্রবেশ-মাত্রই অপ্রয়োজনে হলেও অন্তত দু/একদিন অবস্থান এবং দু/চারটি টেস্ট বাধ্যতামূলক। যদিও তা প্রকাশ্য নয়। এত ভাল আয়োজন এত বিলাস ব্যসন দু একদিন থেকে গেলেই বা কি! রথ দেখা, সাথে কলা বেচা আর কি। বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্রগুলোর চিকিৎসকরা যেমন ভাবতেই পারেন না অপারেশন ছাড়া স্বাভাবিক ডেলিভারি (প্রসব) সম্ভব। তেমনি তাদের সাধারণ জ্ঞানটুকুও লোপ পায় রোগী দেখে। শরীরে জ্বর দেখলে লক্ষণ না জেনেই টাইফয়েড বা ম্যালেরিয়ার টেস্ট দিতেও তাদের বাধে না। যদিও এ সমস্যাটা সরকারি –বেসরকারির মধ্যেই সিমাবদ্ধ নয়। এটা এখন জাতীয় সমস্যা। এর সাথে যে পারসেন্টেজের ব্যাপার আছে তা ভুলে গেলে চলবে কেন? তাছাড়া বেশিরভাগ বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্র গড়েই ওঠে ডায়াগনোসিস সেন্টারের বর্ধিত কলেবর হিসেবে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ রোগী বা তার স্বজন জানতেও চান না চিকিৎসক কি টেস্ট দিলেন। তারা জানতে চান টেস্ট রিপোর্টটা কি হল। আমি এমন ঘটনাও দেখেছি। চিকিৎসক টেস্ট করতে বলেছেন। রোগী যখন জানতে চেয়েছেন এটা কিসের টেস্ট। চিকিৎসক বলছেন টাইফয়েড। রোগী বলছে আমার তো টাইফয়েডের লক্ষণই নেই। তখন ঐ চিকিৎসক নাছোড়বান্দা রোগীকে পুনরায় পরীক্ষা করে ঐ টেস্টটির প্রয়োজন নেই বলে জানালেন। রোগী তো অসহায়! কি বলবেন?
আজকাল পত্রিকার পাতা উলটে স্বাস্থ্যখাতের খুব স্বস্তিকর খবর না পেলেও; অস্বস্তিকর খবর তেমন একটা যে নেই এটাও যে অনেক খানি স্বস্তির তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিছুদিন পূর্বে সংবাদকর্মীরা সরকারি হাসপাতালের অবস্থা এবং সেবার মান নিয়ে যেভাবে উচ্চকিত হয়েছিলেন তার প্রভাবে হোক আর সরকারের সদিচ্ছায় হোক বর্তমান অবস্থা কিছুটা ভাল বলেই প্রতীয়মান হয়। তথাপি মেনে নেয়ার সংস্কৃতিতে আমাদের সরকারি নিরাময় কেন্দ্রগুলো আমাদের যা যা মেনে নিতে বাধ্য করছে:

• দুর্নীতি।
• অপর্যাপ্ত নার্স।
• পর্যাপ্ত চিকিৎসকের অভাব।
• পদোন্নতির ব্যবস্থা না থাকা।
• চিফ মেডিকেল অফিসারের পশ্চাতমুখী চিন্তাধারা।
• এবং সঠিক পরিকল্পনার অভাব আর অদক্ষ ব্যবস্থাপনা।
• কর্মরত চিকিৎসকদের পেশাগত উন্নয়নের সুবিধা না থাকা।

এমতাবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তন, ভেজাল ভোগ্যপণ্য গ্রহণ, রাসায়নিক প্রযুক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার পাল্টে দিচ্ছে রোগ-ব্যাধির ধরণ। মানুষ বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগছে। নেই পর্যাপ্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।

আমাদের এমন অনেক সরকারি নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে যেখানে একই ডাক্তার ডায়াবেটিক, গাইনী, হৃদরোগসহ সকল রোগের চিকিৎসা দেন বা দিতে বাধ্য হন। তাদের অবস্থা অনেকটা কবিরাজদের মতো।

এর পেছনে সবচেয়ে বড় যে কারণ বা একমাত্র যে কারণটি বিদ্যমান তা হল অব্যবস্থাপনা। বাংলাদেশ বিমান, বাংলাদেশ রেলওয়ে, পাট শিল্পের মত এ দেশের অনেকগুলি সম্ভাবনাময় খাতের মতই স্বাস্থ্য সেবা খাতেও অর্থ, সুযোগ, সম্ভাবনা সব নষ্ট হয়ে যায় দুর্নীতি, পরিকল্পনা আর আন্তরিকতার অভাবে। যে সব ছাত্র-ছাত্রী এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি হয় তারা নিঃসন্দেহে দেশের সেরা মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী। এই সম্ভাবনাময় মেধাগুলোর পেশাদারিত্বের উন্নয়ন করা, বিশেষজ্ঞ হওয়ার পথ প্রসস্থ করা এখন সময়ের দাবি। একজন এমবিবিএস পাশ ডাক্তার অবশ্যই অধিকার রাখেন; কর্ম দক্ষতা, প্রশিক্ষণ আর উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের মাধ্যমে ভবিষ্যতে সহকারী প্রফেসর, প্রফেসর হওয়ার মাধ্যমে নিজেকে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার। অবশ্যই অধিকার রাখেন কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ পাওয়ার। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি তারা নিয়তই অধিকার বঞ্চিত হচ্ছেন প্রতিকারহীনভাবে। যেন এগুলো দেখারই কেউ নেই।

অতিরিক্ত চাপ একজন আদর্শ চিকিৎসককেও অসহিশ্নু, অমনোযোগী করে তোলে। ফল ভোগ করে সাধারণ মানুষ। আর ঠিক এই সুযোগগুলিকেই কাজে লাগিয়ে চলছে স্বাস্থ্যখাতে ভয়াবহ প্রতারণা।

• হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ডাক্তারের পরিবর্তে চিকিৎসা দিচ্ছে হাসপাতালের পিয়ন আর ওয়ার্ডবয়, ঝাড়ুদাররা। ব্যান্ডেজ, সেলাইসহ বিভিন্ন অস্ত্রোপচার ও তারাই করছেন বলে পত্রিকায় প্রকাশ। রোগীরা থাকছে মৃত্যু ঝুঁকির আশংকায়। এমনকি মাঝে-মধ্যে তাদের অপচিকিত্সায় রোগীর অবস্থা জটিল হয়ে পড়লে দায় এড়াতে উন্নত চিকিৎসার নামে তাড়াহুড়ো করে পাঠিয়ে দেয়া হয় জেলা সদর বা অন্যান্য উন্নত হাসপাতালে।

• রোগী ধরা দালালদের দৌরাত্ম্য আজকাল এতটাই বেড়েছে যে জরুরী বিভাগে রোগীদের চেয়ে বহিরাগত দালালদের উপস্থিতিই বেশি দেখা যায়। এসব দালালদের খপ্পরে পড়ে পঙ্গু হাসপাতালের রোগী ভর্তি হচ্ছেন সাধারণ ক্লিনিকে। এমনকি হ্রিদরোগীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ঐ হাসপাতালের ডাক্তারেরই বাইরের ক্লিনিকে। এই দালালদের এখন একটি প্রাতিষ্ঠানিক পদ পদবী পর্যন্ত দেয়া হয়েছে। তারা বিভিন্ন নিরাময় কেন্দ্রের ভিজিটিং কার্ড বিহীন মাসিক বেতনভূক্ত কর্মচারী/কর্মকর্তা। তাদের একটি মাসিক লক্ষ্যমাত্রা দেয়া থাকে এবং তা অর্জনের ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে পদোন্নতি দেয়া হয়। এই কর্মচারী/কর্মকর্তাদের সাথে চুক্তি থাকে আপনার বাসার পাশের ঔষধের দোকান, ডায়াগনোসিস সেন্টার এবং ছোট ছোট ক্লিনিকের মালিক কর্মচারীর।

যারা নিয়মিতই আপনাকে পরামর্শ দেন কোন নিরাময় কেন্দ্রটি আপনার জন্য আদর্শ। কখনো কখনো দেখবেন তারা আপনাকে সাথে করেই নিয়ে যাচ্ছেন আপনার জন্য আদর্শ নিরাময় কেন্দ্রটিতে(!) মানব সেবার(?) মহান ব্রত নিয়ে।

ইদানিং জরুরি বিভাগে মুমূর্ষু রোগীদের তাৎক্ষনিক চিকিৎসা প্রদান বন্ধের কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।

এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে রোগীকে নিয়ে ঘুরতে গিয়ে পথে বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। সূত্রমতে মুমূর্ষু রোগীদের চিকিৎসা প্রদানে জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা হামলা ও ভাংচুরের কারণে ভীত সন্ত্রস্ত থাকেন ফলে তারা কোন ধরনের দায়-দায়িত্ব না নিয়ে সরাসরি সংশ্লিষ্ট বিভাগ কিংবা স্পেশালাইজড হাসপাতালে রেফার করে দেন। তাৎক্ষণিক চিকিৎসা না পাওয়ায় হতভাগ্য রোগীটি ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। অনেক রোগীকে সঙ্গে সঙ্গে অক্সিজেন কিংবা কোন জরুরি চিকিৎসা দিলে হয়তো রোগী জীবন ফিরে পেতে পারে। জরুরি বিভাগে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা সেবা দিলে কোন রোগীর জ্ঞান ফিরে আসে কিংবা অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। আবার চিকিত্সাবস্থায় রোগী মারাও যায়। অনেক রোগী মুমূর্ষু অবস্থায় জরুরি বিভাগে আসে। তখন কর্তব্যরত ডাক্তার রোগী রক্ষায় যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। ঐ সময় রোগী মারা গেলে অবহেলা কিংবা ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ তুলে চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীকে মারধর এবং ভাংচুর শুরু করার মত গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে অনেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা আগত মুমূর্ষু রোগীদের তাৎক্ষণিক চিকিৎসা সেবা প্রদান থেকে বিরত থাকছেন।

অনেক সময় মুমূর্ষু রোগীকে আইসিইউ ও সিসিইউতে ভর্তি করে চিকিৎসা সেবা দেয়ার সপ্তাহ খানেক কিংবা এক দুই দিন পর রোগী মারা যায়। ভুল চিকিৎসা অথবা চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ তুলে হামলা ও ভাংচুর করে বিল না দিয়ে রোগীর লোকজন চলে যায়। এটাও রোগীদের তাৎক্ষণিক চিকিৎসা সেবা প্রদান থেকে বিরত থাকার একটি কারণ বলে জানা যায়।
সবচেয়ে আশংকার বিষয় হল সোনা যাচ্ছে বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হামলা ও ভাংচুরের ভয়ে অচিরেই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অসুস্থ শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি না করানোর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। যদি এ খবর সত্যি হয় তাহলে যেদেশে গড়ে ২৫ লক্ষ লোকের বিপরীতে মাত্র একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সেদেশে রোগীদের ভোগান্তি যে আরও কতটা বাড়বে তা সহজেই অনুমেয়।

চিকিৎসকের অবহেলায় রোগী ক্ষতিগ্রস্থ বা মত্যুবরন করলে তার বিরুদ্ধে আইন আছে। আর আমাদের বিচার ব্যবস্থা নিশ্চয়ই এতটা খারাপ অবস্থায় চলে যায়নি যে আইন নিজেদের হাতে তুলে নিতে হবে। এ হামলা ও ভাংচুর বন্ধ না হলে মুমূর্ষু রোগীদের মৃতের সংখ্যা আশংকাজনক হারে বাড়বে তাতে সন্দেহ নেই। দায়ভার কে নিবেন? রাজধানীসহ সারাদেশে দুই সহস্রাধিক বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে। এদেশে গড়ে ২৫ লাখ লোকের জন্য মাত্র একজন চিকিৎসক। তারপরেও হাজার হাজার রোগী প্রতিদিন চিকিৎসা সেবা পেয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন। এটা সকলের মনে রাখা দরকার। মনে রাখা উচিৎ, কিডনি ও লিভার সংযোজন, বাইপাস সার্জারিসহ জটিল চিকিৎসা ও অপারেশন এখন এ দেশে সফলভাবেই হচ্ছে। যে অপারেশনে বিদেশে ৫০ লাখ থেকে কোটি টাকা ব্যয় হয় সেই অপারেশনই দেশে মাত্র কয়েক লাখ টাকায় করা হচ্ছে। যারা করছেন তারাও এই চিকিৎসক সমাজেরই অংশ। তাই দেশের সেবা খাতের দুরবস্থার জন্য দায়ী করতে হলে ঢালাওভাবে চিকিৎসকদের নয় দায়ী করা উচিৎ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে এই খাতের ব্যবস্থাপনার সাথে যারা সংশ্লিষ্ট তাদের। বিএমডিসি থেকে মন্ত্রণালয় চিকিৎসা প্রয়োজন সবগুলো সংস্থার। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ভুল চিকিৎসা ও অবহেলার অভিযোগে মাত্র তিনজন ডাক্তারের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করেছে বিএমডিসি। সরকার বিএমডিসি'র অ্যাক্ট সংশোধন করেছে। লাভ কি? সর্ষের মধ্যেই তো ভূত, ছাড়াবেন কি দিয়ে?

সমস্যার সমাধানে প্রস্তাবনা:
• সঠিকভাবে সরকারী ঔষধ সরবরাহ এবং বিলি নিশ্চিত করা ।
• ডাক্তারদের চাকুরীর বয়স এবং যোগ্যতা সাপেক্ষে প্রমোশনের ব্যবস্থা করা।

• প্রতিটি নিরাময় কেন্দ্রে অন্তত একজন পাবলিক রিলেসন্স অফিসার নিয়োগ।
• একই ডাক্তার দিয়ে যাবতীয় জটিল রোগের চিকিৎসার সনাতনী পদ্ধতি পরিহার।

• জেলা, উপজেলা, গ্রাম পর্যায়ে অবস্থানরত ডাক্তারদের শহরের তুলনায় বেশি সুযোগ সুবিধা প্রদান করা।
• প্রতিটি নিরাময় কেন্দ্রে পর্যাপ্ত সংখ্যক চিকিত্সক ,নার্স এবং মেডিক্যাল ইকুইপমেন্টের ব্যবস্থা করা।

• যেসব ব্যক্তিবর্গ হাসপাতাল পরিচালনা করেন তাদের দেশের বাইরে চিকিৎসা গ্রহণ নিষিদ্ধ করা উচিৎ।
• প্রতিটি ডাক্তারকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এফসিপিএস ও উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ হিসেবে তৈরি করা।
• সিভিল সার্জন অফিস থেকে প্রতিটি নিরাময় কেন্দ্র ক্লোজ মনিটরিং এর ব্যবস্থা গ্রহণ। যা আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে খুব সহজেই সম্ভব।
• হাস্যকর মনে হলেও বলব এলাকার প্রতিটি জনপ্রতিনিধি এবং সরকারী অফিসারদের স্থানীয় সরকারী নিরাময় কেন্দ্রগুলো থেকে চিকিৎসা গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা উচিৎ।
• অনতিবিলম্বে দেশে প্রয়োজনানুযায়ী মানসম্মত মেডিকেল কলেজ ও নার্সিং ইনষ্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা জরুরী। যেখান থেকে বেড়িয়ে আসবেন চিকিৎসক–নার্স যা আমাদের দেশের চিকিৎসক–নার্স এর ঘাটতি পূরণে করতে সক্ষম হবে।

কর্তব্যরত চিকিৎসক এবং এর পরিচালকদের এ পেশাটাকে মহৎ পেশা হিসেবে বিবেচনায় আনতে হবে। সেবা দিয়ে সম্মানি নিবেন এটাই স্বাভাবিক কিন্তু সুদের কারবারিদের মত সন্তানকে, রোগীকে আটকে রাখেন কি করে! এ সমাজ, এ দেশ আপনাদের কাছে কি কিছু দাবি করতে পারে না? কোন দায়বদ্ধতাই কি আপনাদের নেই?

আমরা লজ্জিত হই যখন দেখি যেসব ব্যক্তিবর্গ নিজেদের নিরাময় কেন্দ্রকে বিশ্বমানের বলে সারা বছর গলাবাজি করলেও নিজের স্বাস্থ্যসেবা নেয়ার সময় নিজেই নিজের হাসপাতালের উপর আস্থা রাখতে পারেন না। ছুটে যান ভিনদেশে। এদের কি তখন লজ্জা করেনা যখন বিদেশি হাসপাতালগুলোর থেকেও এরা বেশি চার্জ ধার্য করেন? অথচ সেবার মানের ব্যাপারে নিজেরাই আস্থাশীল নন। আমাদের জানতে ইচ্ছে করে এদের গায়ের চামড়া কতটা মোটা। চিকিৎসা তাদের কাছে সেবা নয় ব্যবসা।

স্বাস্থ্য বা চিকিৎসা সেবা পাওয়া নাগরিকের মৌলিক অধিকার । সরকারের দায়িত্ব স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা। সরকারী ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে রোগীরা সেবা নিতে আসেন মুলতঃ বিনামূল্যে মান সম্মত চিকিত্সার আশায় । গরীব রোগীদের শেষ আশ্রয়স্থল এই সরকারী হাসপাতাল। আর তাই প্রয়োজন যুগোপযোগী পরিকল্পনা গ্রহন এবং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে স্বাস্থ্য সেবা খাতের আমূল পরিবর্তন। আর তা এখনই।

kmgmehadi@yahoo.com
সূত্র: ইত্তেফাক, প্রথম আলো, দেশ তথ্য এবং অন্যান্য।