জঙ্গীবাদ ইসলামী আদর্শের পরিপন্থী

মোঃ গালিব মেহেদী খান
Published : 24 Sept 2012, 09:13 AM
Updated : 24 Sept 2012, 09:13 AM

ইসলাম হল একটি একক, অনন্য ও স্বতন্ত্র মতাদর্শ! তাই, ইসলামকে নিছক একটি ধর্মীয় আদর্শ না বলে বরং ইসলামী আদর্শ বলাই ভাল। যদিও কতিপয় ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য (ইবাদতের বিষয়গুলো) হল ইসলামের প্রাণ। তথাপিও এটি একটি পূ্র্নাঙ্গ জীবন বিধান। যা ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের যে কোন সমস্যার দিক নির্দেশনা প্রদান করে। একটু খেয়াল করলে দেখা যায় পৃথিবীর অন্য সব ধর্মের মতাদর্শরা শান্তিপূর্ণভাবে নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলছে। ষড়যন্ত্র চলছে শুধুমাত্র ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে। পৃথিবীর সর্বত্রই চলছে এই ষড়যন্ত্র। যার কলকাঠি নাড়ছে ইহুদীরা। ব্যাবহার করছে খৃষ্টানদের। আর এর সাথে যোগ হয়েছে কিছু জ্ঞানপাপী মুসলিমের অতি উৎসাহী কার্যকলাপ। অথবা তারাও ব্যবহ্রিত হচ্ছে অদৃশ্য এক শক্তির। এটা একটা সাইকেল। যেখান থেকেই শুরু করুন না কেন। খুঁজতে গিয়ে আপনি একটাই কেন্দ্র পাবেন। আল কায়েদা থেকে শুরু করে সবগুলো সন্ত্রাসী সংগঠন। ১/১১ থেকে শুরু করে মুম্বাই হামলা। তালেবানের উত্থান কিংবা সাদ্দাম হোসেন গাদ্দাফি এরা কাদের সৃষ্টি? একটু তলিয়ে দেখুন। যখন যাকে প্রয়োজন তৈরি করা হয়েছে, ব্যাবহার করা হয়েছে এমনকি প্রয়োজন শেষে তাদের শেষ করেও ফেলা হয়েছে। ইসলামই একমাত্র ধর্ম যার আসলে কোন মিত্র নয়। কেন তা অন্য প্রসঙ্গ। আর তাই ইসলামের আবির্ভাবের শুরু থেকে এর বিরুদ্ধে অব্যাহত ভাবে ষড়যন্ত্র চলছে। আর তারই অংশ হিসেবে জিহাদের অপব্যাখ্যা করে ইসলামকে একটি সন্ত্রাসী মতবাদ বলে চালানোর চেষ্টা করা হয়। আর এ কাজে ব্যাবহার করা হয় অর্ধ শিক্ষিত অশিক্ষিত মুসলমানদের। যারা ভাষা ভাষা ধর্মীয় জ্ঞানের সাথে কিছু ভুল ব্যাখ্যায় প্রতারিত হয়ে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে নিজেদের অজান্তেই ইসলামের ক্ষতি করে চলেছে। প্রমাণ করছে ইসলাম একটি উগ্র মতবাদ। অথচ আমরা যদি ইসলামের আবির্ভাব থেকে শুরু করে ইসলামের স্বর্ণযুগ পর্যন্ত মূল্যায়ন করলে দেখতে পাব। ইসলাম প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে তার শান্তি বাদী, সাম্যবাদী এবং জনহিতৈষী মতবাদের মাধ্যমে। গুপ্তহত্যা, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বা চাপিয়ে দিয়ে নয়।

রসূল (স: ) তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় চরমভাবে নির্যাতিত হওয়া স্বত্বেও অশান্তির পথে হটেননি। বরং জনমত গঠন তথা চিন্তার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে একটা শক্তিকেন্দ্র বা নিউক্লিয়াস গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। তৎকালীন গোত্র তান্ত্রিক ব্যবস্থায় অধিকাংশ প্রভাবশালীর সমর্থন ও সহযোগিতার জন্য অপেক্ষা করেছেন এবং সফলও হয়েছেন। যিনি সারাজীবন মানুষের অধিকারের কথা বলেছেন, ভালবাসার কথা বলেছেন এবং ভালবেসেছেন। আজ তারই দোহাই দিয়ে চালানো হচ্ছে নিরীহ মানুষের উপর অতর্কিত আক্রমণ। ইদানীং বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলা করা হচ্ছে। হত্যা করা হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। সম্মানিত বিচারক থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ তাদের হত্যার স্বীকার হচ্ছে। এই সন্ত্রাসীরা নিজেদেরকে মুসলমান বলে দাবী করছে এবং এ হামলা গুলোকে ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ বলে প্রচার করছে। অথচ ইসলাম বলছে?

সুরা তওবা:৬: وَإِنْ أَحَدٌ مِنَ الْمُشْرِكِينَ اسْتَجَارَكَ فَأَجِرْهُ حَتَّى يَسْمَعَ كَلَامَ اللَّهِ ثُمَّ أَبْلِغْهُ مَأْمَنَهُ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لَا يَعْلَمُونَ (6) অর্থাৎ, আর যদি মুশরিকদের কোন ব্যক্তি আশ্রয় প্রার্থনা করে আপনার কাছে আসতে চায় তাহলে তাকে আল্লাহর কালাম শোনা পর্যন্ত আশ্রয় দিন,তারপর তাকে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছিয়ে দিন।

ইসলাম কোন নিরীহ লোককে হামলা ও আক্রমণ করে হত্যা করার অনুমতি দেয়নি বরং সন্ত্রাসীদের জন্য বিভিন্ন শাস্তি নির্ধারণ করে দিয়েছে।

ইসলাম জিহাদ বলতে বুঝায়:

জিহাদ আরবি শব্দ "জা হা দা" থেকে এসেছে। বাংলায় যার অর্থ "নিজ নফসের বিপরীতে অবস্থান নেয়া" যেমন কারো মদ খাওয়ার ইচ্ছে হল কিন্তু সে আল্লাহর ভয়ে খেল না। অথবা কোন রোজাদার ব্যক্তি ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর, তার খাওয়ার ইচ্ছে হল কিন্তু সামর্থ্য থাকা সত্যেও আল্লাহর ভয়ে খেল না। এটাই উত্তম জিহাদ। জিহাদে আকবর বা বড় জিহাদ হলও নফসের সাথে যুদ্ধ করা। অর্থাৎ কু রিপুকে দমন করে চলা।

জিহাদ মানে ঢাল-তলোয়ার নিয়ে শত্রু শত্রু খেলা নয় বরং আল্লাহর দ্বীনকে আল্লাহর জমিনে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টাই জিহাদ। আর তা যে কখনো অশান্তি সৃষ্টি করে করা সম্ভব নয় তা বলাই বাহুল্য। অমুসলিমরা জিহাদ বলতে পবিত্র যুদ্ধকে বোঝায় তা ঠিক নয়।

সহি হাদিস থেকে জানা যায়:

মুহাম্মদ (স: ) বলেছেন হযরত আয়েশা (র: ) আল্লাহর রসুল মোহাম্মদ (স: ) কাছে জানতে চান যে, আমি কি যেহাদে যেতে পারি, রসুল(স: ) বলেন আপনার জন্য সব থেকে ভালো যেহাদ হল হজ্ব করা। (সহী বুখারি ভলিউম ৪, হাদিস নং ২৭৮৪)

মহানবীর আরেকটা হদিস থেকে জানা যায়, এক লোক আল্লাহর রসুল মোহাম্মদ (স: )এর কাছে জানতে চান যে, আমি কি জেহাদে যেতে পারি, তখন রসুল(স: ) জানতে চান, আপনার কি মা-বাবা আছেন? লোকটা জানালো আছে, তখন রসুল(সঃ )তাকে বলেন আপনার জন্য সব থেকে ভালো যেহাদ হোল আপনার মা বাবার খেদমত করা। (সহি বুখারি ভলিউম ৮, হাদিস নং ৫৯৭২)

অন্য আরেকটা হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে, এক লোক আল্লাহর রসুল(স: )এর কাছে জানতে চান সব থেকে উত্তম যেহাদ কোনটা, তখন রসুল(স: )বলেন যদি কোণও লোক কোনও জালেম বাদশার বিপরীতে একটা হজ্ব কথা বলে সেটাই সব থেকে উত্তম যেহাদ।

আসলে মুসলিমদেরকে সন্ত্রাসী বানানো পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোরই ষড়যন্ত্র। আমরা মুসলমানরা অন্ধের মতো চলছি। আত্মশুদ্ধির প্রচেষ্টাই যে শ্রেষ্ঠ জেহাদ। সেই জিহাদের দিকে আমাদের নজর নেই। ইসলাম আত্মহত্যা সমর্থন করে না। আত্মহত্যাকারী এবং নিরপরাধ কোন ব্যক্তিকে হত্যাকারী অনন্তকালের দোজখই। আল্লাহ বলেন যদি কেউ কোণও নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করে সে যেন সমস্ত দুনিয়ার মানুষকে হত্যা করল। যদি কেউ কোণও মানুষকে সাহায্য করে সে যেন সমস্ত দুনিয়ার মানুষকে সাহায্য করলো।

এই মুহূর্তে পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় সমস্যা এই জিহাদের নামে সন্ত্রাসবাদ। ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলামকে কিছু কিছু লোক তাদের স্বার্থে ব্যবহার করে আসছে মোহাম্মদ সঃ এর তিরোধানের পর থকেই যে ধারা আজো অব্যাহত রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ইসলামকে ব্যবহার করে ৩০ লাখ মানুষ হত্যা করা হয়েছে। আর এর পেছনে যে অশুভ শক্তিটি কাজ করছে তার ব্যাপ্তি বিশ্ব ব্যাপী। এরা ইসলামকে একটি সন্ত্রাসবাদী মতাদর্শ বলে পরিচিত করার প্রয়াসেই লিপ্ত। প্রত্যন্ত এলাকার মাদ্রাসাগুলোতে শিশুদের দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে জঙ্গি বানানোর যে কারখানাগুলো তৈরি করা হয়েছে তা কোন নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ডে নয়। সমগ্র বিশ্ব ব্যাপী ইসলামের বিরুদ্ধে মানুষের ঘৃণা জাগ্রত করার প্রয়াস মাত্র।
একদিকে দাউদ হায়দার,তসলিমা নাসরিন,হুমায়ুন আজাদ,কার্টুনিস্ট আরিফদের উত্থান অন্যদিকে জঙ্গিবাদের উত্থান এবং পহেলা বৈশাখের উৎসবে বোমা হামলা। একই সুতোয় গাথা। এটা একধরনের ইঁদুর-বিড়াল খেলার মত। যে খেলাটা ইসরাইল যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়ে বহুদিন যাবত খেলাচ্ছে। আমরা অনেক ভাগ্যবান এক জাতী যারা শত আবেগপ্রবণ ও ধর্মপ্রাণ হলেও অনেক বেশি সচেতন। আর তাই এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রকারীরা চেষ্টার ত্রুটি না করলেও এখন পর্যন্ত এ দেশটাকে আরেকটি আফগানিস্তান বানানো সম্ভব হয়নি।
আজকের এই সময়ে এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রকারী এবং জ্ঞানপাপী কিছু মুসলিমের ছোবল থেকে এ দেশ তথা ইসলামের সুমহান মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে তরুণ প্রজন্মকেই সঙ্ঘবদ্ধ হতে হবে। জঙ্গিবাদ থেকে মুক্তির দাবিটা সচেতন সমাজের দাবি।

পদক্ষেপগুলি গ্রহণ খুবই জরুরী:

মাদ্রাসা শিক্ষার একটি শাখা হচ্ছে হিফয। যেখানে শুধুমাত্র পবিত্র কুরানকে আরবি ভাষায় মুখস্থ করান হয়। যাকে যুগপযোগী করা একান্ত প্রয়োজন।
মাদ্রাসার অন্যান্য শাখার পাঠক্রমও যুগপযোগি নয়।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য একটি সময় পর্যন্ত ধর্মকে আবশ্যিক করা হলেও বর্তমান পাঠক্রম শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় ধর্মী‍য় জ্ঞান প্রদানে অক্ষম।
জঙ্গিবাদের থাবা আজ অশিক্ষিত অর্ধ শিক্ষিত পার হয়ে সর্ব্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে অধ্যয়নরত এমনকি উচ্চশিক্ষিতদেরও কব্জা করতে শুরু করেছে। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। ধর্মী‍য় জ্ঞানের অভাবই এই সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছে। মৌলবাদের হাত থেকে রেহাই পেতে হলে ধর্মীয় জ্ঞান চর্চার বিকল্প নেই।
মসজিদে ইমাম হচ্ছেন আমাদের ইসলামি বিশ্বকোষ। এই বিশ্বকোষই যে মোডারেট নয় এবং অসংখ্য ভুলে ভরা সে খবর আমরা রাখি না। প্রায় প্রতিটি মসজিদের ইমামকে অন্য ধর্ম নিয়ে বিষোদ্গার করতে দেখা যায়, এটা উগ্রবাদকে উৎসাহিত করছে। মসজিদের ইমামরা অনেক বেশি প্রভাব বিস্তারে সক্ষম ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের উপর। তাই তাদেরকেই সর্বাগ্রে সচেতন করে তোলা উচিৎ। মসজিদ ইসলামের সূতিকাগার আমরা এখান থেকেই পারি জঙ্গিবাদ সহ ইসলাম বিরোধী সকল কার্যকলাপ রুখে দিতে। উদ্যোগ নিতে হবে সরকারের পাশাপাশি সচেতন সব মহলের।
আমাদের সকলেরই উচিৎ মসজিদের ইমাম কেন্দ্রিক ইসলামি বিশ্বকোষ থেকে মুখ ফিরিয়ে ইসলামি ফাউন্ডেশন মুখি হওয়া।
আমাদের হাতের কাছের সহি হাদিসের বই চোখের সামনে মেলে ধরতে পারি। পারি বাংলায় কুরান পড়তে। কুরআনের তাফসির পড়ে বোঝার চেষ্টা করতে এর গুরহ তত্ত্ব। পারি আমাদের সন্তানদের সাথে ধর্মীয় অত্যাবশ্যকীয় বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করতে। আর এ সবই পারে ইসলামি জঙ্গীবাদ নামের অপশক্তির হাত থেকে ইসলামকে রক্ষা করতে।

kmgmehadi@yahoo.com