সাম্প্রদায়িকতা না অন্য কিছু?

মোঃ গালিব মেহেদী খান
Published : 18 Oct 2012, 09:57 AM
Updated : 18 Oct 2012, 09:57 AM

সাম্প্রদায়িকতা হচ্ছে এমন এক ধরনের মনোভাব যা এক বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্তির ভিত্তিতে অন্য এক ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং তার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধচারণ এবং ক্ষতিসাধনে উব্দুদ্ধ করে। এ ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি বিশেষের ক্ষতিসাধন করার মানসিক প্রস্তুতি সেই ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ, পরিচয় অথবা বিরুদ্ধতা থেকে সৃষ্ট নয়। ব্যক্তিবিশেষ এ ক্ষেত্রে গৌণ, মুখ্য হল সম্প্রদায়। সাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রে নিজের ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ এক জাতীয় আনুগত্যের গুরুত্ব থাকে অন্যদিকে অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ কাজ করে । কিন্তু কথা হচ্ছে কোন ধর্মই কি সাম্প্রদায়িকতা সমর্থন করে?
ধর্ম আসলে কি? এর উদ্দেশ্যই বা কি? পৃথিবীর প্রতিটি বস্তু একটি নির্দিষ্ট নিয়মে তাদের জীবন চক্র পার করে। যার ব্যত্যয় ঘটানোর ক্ষমতা দৃশ্যত মানুষ ছাড়া আর কারোরই নেই। আর তাই মানুষের জীবনকে পরিশীলিত করতে। অন্যের অনিষ্ট থেকে রক্ষা পেতেই কতগুলি বিধিবিধান আরোপিত হয়েছে যাকে আমরা ধর্ম বলি। পৃথিবীতে যতগুলি ধর্ম বিদ্যমান তার কোনটিই অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য ক্ষতিকারক নয়। সমস্যা হল আমরা ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনে আগ্রহী নই। জন্মসূত্রে পাওয়া ধর্ম নিয়ে কাটিয়ে দেই একটি জনম। একবার উকে দিয়েও দেখিনা কি লেখা আছে আমাদের অবশ্য পালনীয় গ্রন্থে। একবার চেষ্টা করিনা এর মর্মোদ্ধারের। ফলে অন্ধকারেই থেকে যাই আমার ধর্ম সম্পর্কে। আর এই সুযোগটিই গ্রহণ করে কিছু স্বার্থান্বেষী ধর্ম ব্যবসায়ী।
ধর্ম মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষকে জিঘাংসার হাত থেকে রক্ষা করে। একমাত্র ধর্মই পারে মানুষকে অমানুষ হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে। পৃথিবীকে আজো বাসযোগ্য করে রাখার ক্ষেত্রে ধর্ম প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছে। কোন ধর্মই গায়ের জোরে বা দাঙ্গা-হাঙ্গামার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি। এবং কোন ধর্ম প্রচারকই একে সমর্থন করেননি বরং তারাই নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বারবার।
বিশ্বে নানা সময়ে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পূর্বাপর পর্যালোচনা করলে দেখা যায়; যদিও এই দাঙ্গাগুলি ধর্মের দোহাই দিয়ে ঘটানো হয়েছে এবং একে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রূপদান করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আসল কলকাঠি যারা নাড়ছেন তারা এমন কোন ধর্মভীরু নন। এমনকি অনেকেরই নিজ ধর্মাচারের প্রতি রয়েছেন চরম উদাসীনতা। অথচ এই সব দাঙ্গায় তারাই থাকেন নেতৃত্বে। এই দাঙ্গা সমূহ যে কোন ধর্মীয় আনুগত্যের কারণে নয় তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। এটাকে আমরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা না বলে, বলতে পারি আধিপত্য বাদের দাঙ্গা। ধর্মকে আশ্রয় করে আধিপত্য কায়েম করাই এই সব দাঙ্গার মূল লক্ষ। যা বিংশ শতাব্দীতে এসে রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করেছে মাত্র। যার নিকট উদাহরণ। মোঃ আলী জিন্নাহ, যিনি ধর্মকে আশ্রয় করে রাজনীতি করছেন ঠিকই কিন্তু নিজে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতেন না। শোনা যায় তিনি নিজে ছিলেন নাস্তিক। মোটকথা এর মূলে ধর্মীয় আদর্শ কাজ করে না, কাজ করে স্বার্থের সংঘাত।
সাম্প্রদায়িকতার প্রসঙ্গ এলেই সবার আগে যে শব্দটি চলে আসে তা হল মৌলবাদ। মৌলবাদ শব্দটি ইংরেজি ফান্ডামেন্টালিজম শব্দের অনুবাদ। যার সাধারণ অর্থ হল মূলজাত। এখানে মূল শব্দটি দ্বারা ধর্ম বোঝানো হচ্ছে। মজার ব্যাপার হল যে ধর্মকে কেন্দ্র করে এর উৎপত্তি সে ধর্মটি কিন্তু ইসলাম নয়, সেটি হল খ্রিস্টধর্ম। খ্রিস্টান জগতে এই মৌলবাদ নিয়ে তর্কের শুরু ঊন বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে যা বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত প্রবল প্রতাপে তা চালু ছিলও। তর্কটি একটি প্রশ্নকে সামনে রেখে। প্রশ্নটি হল: "বাইবেলে যা লেখা আছে সে সব আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করে মান্য করতে হবে, নাকি পরিবর্তিত পৃথিবীর বাস্তব প্রেক্ষাপট ও মানব ইতিহাসের অগ্রগতির নিরিখে এবং যুক্তিবাদ প্রয়োগ করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পর মান্য করতে হবে?" স্বাভাবিকভাবেই মৌলবাদীরা আক্ষরিক অর্থের সব কিছু গ্রহণ করতে আগ্রহী। মোডারেটরা বাস্তব প্রেক্ষাপট এবং যুক্তিবাদ প্রয়োগ করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পর মানতে আগ্রহী। দ্বন্দ্বটা এখানেই। কিন্তু এটা ত ঠিক যে, সব ধর্মেরই কিছু মূল নির্দেশনা থাকে। আর তাকে বাদ দিলে ঐ ধর্মটিই হয়ে পড়ে অস্তিত্বহীন। সে হিসেবে যে কোন ধর্মীয় অনুসারীই মৌলবাদী। পবিত্র কুরআন এর বঙ্গানুবাদ পড়েই কেউ সঠিকভাবে ইসলামী অনুশাসন সম্পর্কে সঠিক ধারনা লাভ করতে পারবেন না। তা লাভ করতে হলে তাকে সহি হাদিস গ্রন্থ ইজমা, কিয়াস সম্পর্কেও সম্যক ধারনা রাখতে হবে। এটা কষ্টসাধ্য হওয়ায় আমরা এ পথে হাটি না। অন্ধকারে থাকি ধর্মীয় বিধিবিধান সম্পর্কে। এই সুযোগে বর্তমান পৃথিবীতে মৌলবাদ একটি নতুন ধারনা তৈরি করেছে। বা বলা যায় মৌলবাদকে এখন একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যাবহার করা হচ্ছে। এটি এমনই এক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে যার উভয় পাশই সমান ধারালো। আর তাই একে ব্যাবহার করা হচ্ছে রাজনৈতিক রূপে, বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বিস্তারে, এমনকি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের প্রয়াসে। আর তাই এর প্রায়োগিকতা স্থান কাল ভেদে ভিন্নতর। কিন্তু উদ্দেশ্য একই।
উদাহরণ স্বরুপঃ
ভারতের আসামে মুসলমান ও দক্ষিণ ভারতীয় লোকদের বিরুদ্ধে যে দাঙ্গাটি হয়েছিল তাকে শুধু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা না বলে একে আঞ্চলিকতা বাদী দাঙ্গা বলাই যুক্তিযুক্ত। এর উদ্দেশ্য ছিল মূলত আসামের বাংলাভাষী জনগণকে বাংলাদেশী বলে আখ্যায়িত করে তাদের আসাম থেকে বিতারন। অথচ প্রচার করা হোল এটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ৪৭ এর দেশভাগের পর থেকেই ভারতে হিন্দু-মুসলিম এবং শিখদের মধ্যে বহুবার জাতিগত দাঙ্গা হয়েছে। ১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ ধ্বংস, গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উল্লেখযোগ্য। এ সব দাঙ্গায় কয়েক হাজার মুসলমান নিহত হয়। এ দাঙ্গাগুলো কি শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে হয়েছে? মোটেই তা নয়? এর পেছনে কাজ করেছে আধিপত্য বাদ, ধর্মীয় উগ্রতা এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা আর তাই এই দাঙ্গাগুলো দমনে কখনোই প্রশাসন তাৎক্ষনিক উদ্যোগ নেয়না। এক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সর্বদাই ব্যর্থ হয়, এমনকি পরবর্তীতেও দাঙ্গা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে তেমন কোনও পদক্ষেপ নেয়া হয়না। এ দৃশ্যটি বিশ্বের সকল ভূখণ্ডে একইভাবে প্রতিফলিত হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে রামুতে সংগঠিত ভয়াবহ দাঙ্গাটির পোস্টমর্টেম করলে নতুন কোন তথ্য বেড়িয়ে আসবে না। এখানেও একই ধরনের কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়।
১। ফেসবুকে নিত্য এমন অনেক ছবি আপলোড করা হয়। সেটা নিয়ে দাঙ্গা শুরু হলে প্রায় প্রতিদিনই একটি করে দাঙ্গা বাধার কথা। ঐ অঞ্চলে কতজন লোক ফেসবুক ব্যাবহার করে তা সহজেই অনুমেয়।
২। এটা যদি শুধুমাত্র ধর্মীয় উগ্রবাদীদেরই কাজ হবে তাহলে প্রশ্ন হল তারা এতটা সু পরিকল্পিতভাবে কাজটি কি করে করতে পারল? তারা গান পাউডারই বা পেল কোথায়? আর সিমেন্টের ব্লগগুলিই বা কোথা থেকে এলো?
৩। বৌদ্ধ ধর্মগুরু বলছেন গত পঞ্চাশ বছরেও তারা এভাবে আক্রান্ত হননি। অর্থাৎ ১৯৭১ এও তারা এভাবে আক্রান্ত হননি। তাছাড়া সবাই জানে এরা একটি অহিংস সম্প্রদায়। এদেরকে কেন বেছে নেয়া হল?
৪। পুলিশ সব ঘটনা ঘটার পরেই উপস্থিত হন এটা নতুন নয়। বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থা কি কাজে যে ব্যস্ত থাকেন বোধকরি তারা তা নিজেরাও জানেন না। কিন্তু তাই বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রিমহোদয় ঘুরে আসার পরেই আবার একই ঘটনা ঘটা নতুন প্রশ্নের জন্ম দিবে এটাই স্বাভাবিক।
৫। যারা মন্দির ভাঙ্গার ফুটেজগুলো দেখেছেন তারা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন। তাদের কার্যকলাপে খুব কি ধর্মীয় উন্মাদনা চোখে পড়েছে? নাকি এখানে লুটপাটের চিত্রই বেশি ফুটে উঠেছে?
এমনি হাজার প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে যেতেই একে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলে চালিয়ে দেয়া হয়। আর যদি তাই হয় তাহলে এই দাঙ্গাটি এ জাতির জন্য এক অমোচনীয় কালিমা হয়েই থেকে যাবে। নটর ডেম কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয়ের কণ্ঠে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বরই ঝংকৃত হয়েছে। একই হতাশা সবার মনে। এটা নিয়ে কি রাজনীতি করা শোভন? বিরোধীদলের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি করা হল। তারা অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে রিপোর্ট দিয়ে দিলেন। যা বললেন, তা নতুন কিছু নয়। শোনা যায় তারা এই রিপোর্ট প্রভু-মহাপ্রভুদের দরবারেও পেশ করবেন। এতে প্রশ্ন বেড়েই চলে, সমাধান মেলে না।
সমাধান মিলবে তখনই যখন আমরা প্রকৃতপক্ষেই চাইব সাম্প্রদায়িকতার আড়ালে আধিপত্যবাদি, লুণ্ঠনকারীদের দমন করতে। আর যদি একে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে সযত্নে রেখে দেই তা হয়ত একদিন এ দেশটিকেই নরককুণ্ড বানিয়ে ছাড়বে। যার হাত থেকে কারোই রেহাই মিলবে না। প্রয়োজন এই নাশকতার সাথে জড়িত প্রত্যেককে আইনের আওতায় নিয়ে আসা এবং সুষ্ঠ বিচারিক প্রক্রিয়ায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। সেইসাথে আমাদের খুব দ্রুতই ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার ঘটানো প্রয়োজন। প্রয়োজন প্রতিটি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিবিড় পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা। ধর্মীয় জ্ঞানের অপ্রতুলতা এবং ভুল শিক্ষা বা অর্ধ শিক্ষাই ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির প্রধান কারণ। যাকে সব সময় সব দেশেই স্বার্থান্বেষী মহল ব্যাবহার করে আসছে।

kmgmehadi@yahoo.com