পারিবারিক নির্যাতন ও আমাদের অন্তঃসারশূন্য ভাবনা

মোঃ গালিব মেহেদী খান
Published : 8 Nov 2012, 07:18 PM
Updated : 8 Nov 2012, 07:18 PM

পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই চলে আসে নারী নির্যাতনের প্রসঙ্গ। সুপ্রাচিন কাল থেকে নারী নির্যাতিত হয়ে আসছে যার শুরুটা পরিবার থেকেই । কিন্তু পারিবারিক নির্যাতন শুধুমাত্র নারী নির্যাতনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর বহুমাত্রিক দিক রয়েছে। একটি পরিবার যেমন নারী-পুরুষ-শিশু নির্ভরশীলদের সমষ্টিতে গড়ে ওঠে তেমনি নির্যাতিত মানুষটিও যে সব সময়ই নারী হবে এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। আবার নির্যাতন যে শারীরিকই হতে হবে এমনও নয় বরং শারীরিক নির্যাতনের থেকে পরিবারে মানসিক নির্যাতনই বেশি চলে। পরিবারের আশ্রিত বা নির্ভরশীলরা, বিশেষ করে পরিবারের বয়োবৃদ্ধ সদস্য গন কখনোই আমাদের আলোচনায় আসেন না। আলোচনায় আসে না পুরুষের নির্যাতিত হওয়ার কথাও। অথচ বাস্তবতা হল পরিবারের আশ্রিত বা নির্ভরশীলরা, বিশেষ করে পরিবারের বয়োবৃদ্ধ সদস্যগণ সব থেকে বেশি নিগৃহীত হন, মানসিক নির্যাতনের শিকার হন এবং এদেরকে কেন্দ্র করেই পারিবারিক অশান্তির সূচনা।

আমাদের সমাজে নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত এই পাঁচ শ্রেণীর মানুষের বাস। এদের প্রত্যেকের জীবন প্রণালী যেমন আলাদা তেমনি দৃষ্টিভঙ্গিও। আর এই দৃষ্টিভঙ্গিই নির্ধারণ করে ঐ পরিবারের কোন সদস্য নির্যাতিত হবে। বা আদৌ হবে কিনা। একটি সময় ছিল যখন নারীকে দেখা হত বোঝা স্বরূপ। যা পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর মাঝে এখনও বর্তমান। যেখানে নারী এবং কন্যা শিশু অহরহই বঞ্চিত হচ্ছে। স্বীকার হচ্ছে বিভিন্ন নির্যাতনের।

নিন্মবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলো শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বিনোদন সব দিক দিয়েই পিছিয়ে থাকে। যা এই পরিবারগুলোর সদস্যদের সুশীল হওয়ার পথের প্রধান অন্তরায়। এদের দৃষ্টিভঙ্গিও নিবর্তনমূলক। এরা পরিচালিত হয় পুরাতন-জীর্ণ ধ্যান ধারনার দ্বারা। এইসব পরিবারে সাধারণত একচেটিয়া বৈষম্যের স্বীকার হন নারী এবং কন্যা শিশু এবং বয়োবৃদ্ধ। তবে এই ধরনের পরিবারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এখানে বৈষম্যের স্বীকার হলেও বয়োবৃদ্ধের আশ্রয় জোটে অনায়াসে। প্রকৃতপক্ষেই এরা পুরুষ শাসিত। এখানে তালাক, শারীরিক নির্যাতন এসব স্বাভাবিক একটি বিষয়।

মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ক্ষেত্রে পারিবারিক নির্যাতন ভিন্ন মাত্রা পায়। এখানে সাধারণত নারী পুরুষ উভয়ই শিক্ষিত এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কর্মজীবী হওয়ার ফলে তারা স্বাধীনচেতা হয়। অধিকার আদায় ও আধিপত্য বিস্তার জনিত দ্বন্দ্বই এই সদস্যদের প্রধান সমস্যা। সেই সাথে কর্মজীবনের সুবাদে এবং অতি উৎসাহী প্রতিবেশীদের কল্যাণে কখনো কখনো পরিবারে অনাহুত হিতৈষীর অনুপ্রবেশ ঘটতে দেখা যায়। যারা কূহেলিকাপূর্ন দ্বন্দ্বের পালে অনুকূল হাওয়ার যোগান দিয়ে তাকে স্পষ্ট করে তোলে। এই পরিবারগুলোকে কখনো মনে হয় পুরুষ শাসিত পরিবার কখনো বা নারী। সময় ভেদে এই সব পরিবারের কর্তৃত্ব বদলও হয়। এই দ্বন্দ্বের ফলে যে অনলটি প্রজ্বলিত হয়। তার ধূমায়িত ক্রোধ, এর প্রতিটি সদস্যকে অহর্নিশ করে যন্ত্রনাদগ্ধ। কিন্তু পথ পায় না উত্তরণের। কারণ এই অনল যেমন একজন ইচ্ছে করলেই প্রজ্বলন করতে পারে না তেমনি একজন ইচ্ছে করলেই নেভাতেও পারে না। প্রয়োজন সকলের ঐকান্তিক চেষ্টা, সহমর্মিতা। যার অবর্তমানে হ্রাস পায় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারিবারিক বন্ধনের দৃঢ়তা।

দেখা যায় এ সব পরিবারের সদস্যরা-

• অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পরছে।
• মাদকাসক্ত হয়ে পরছে।
• সংসার ভেঙ্গে যাচ্ছে।

এদের সন্তানরা-

• অনেক সময় একাকীত্বে ভোগে।
• বখাটে পনায় মেতে ওঠে।
• মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে।
• কেউ কেউ আত্মহত্যা পর্যন্ত করে বসে।

এই শ্রেণীর মানুষের কাছে সামাজিক অবস্থান একটি বড় বিষয়। তারা এক ধরনের আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে চায়। আর তা যে কোন মূল্যে ধরে রাখাই তাদের ধ্যান জ্ঞান। ফলে এই সব পরিবারের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল সদস্যই তালাককে এড়িয়ে চলে। ব্যক্তিগত সুখ শান্তির চেয়ে তাদের কাছে সামাজিক সম্মান অক্ষুন্ন রাখা অনেক বেশি জরুরী।

এরা অনেক বেশি সংবেদনশীল বলে সন্তানের ভবিষ্যৎ ভেবে এক ছাদের নিচে থেকে আলাদা জীবন যাপন করলেও সংসার টিকিয়ে রাখে। অদ্ভুত ব্যাপার হল একটু ছাড় দিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারলেও আত্নঅহমীকায় সেই ছাড়টুকু না দিয়ে সমগ্র জীবনটাকেই তারা দূর্বিষহ করে তোলে।

উপরোক্ত কারণে পারিবারিক যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। তা বংশ পরম্পরায় ছড়িয়ে পড়ছে। কারণ সন্তান; জীবনের ঊষালগ্নে মা-বাবা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কাছ থেকে যা শেখে, তা লালন করে সমগ্র জীবন। আর তারই প্রতিফলন ঘটে তার ব্যক্তি জীবনে।

সত্যিকার অর্থে মানিয়ে চলা ও মেনে নেয়ার সংস্কৃতিতে চলে মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের দৈনন্দিন জীবন। যিনি বা যারা তা পারেন না, তারাই নিপতিত হন এই অনল গর্ভে। এখানে কেউ দগ্ধ হন, কেউ দগ্ধ করেন। আর কেউ কেউ তাতে ঘি ঢালেন। দগ্ধ হওয়া মানুষটি পুরুষ না নারী তা নির্ভর করে আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব, মানসিক দৃঢ়তা এবং তাঁর কৃত কর্মকাণ্ডের উপর। মোটকথা এক সময় যে পরিবার ছিল মন জুড়ানোর সর্বোত্তম স্থান আজ তা একটি প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ন প্রতিকুল যুদ্ধক্ষেত্র। যার বলি হচ্ছে অনাগত ভবিষ্যৎ, একটি প্রজন্ম।
উচ্চবিত্ত শ্রেণীর বিষয়টি একটু ভিন্ন। সাধারণত এর সদস্যরা স্বনির্ভর, স্বাধীনচেতা, উন্নত পরিবেশে মানুষ। তাঁরা কেউ কারো উপরে নির্ভরশীল নন বলে তাদের মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্বটাও কম। মতের মিল না হলে আলাদা হয়ে যাওয়া খুব স্বাভাবিক একটি বিষয় বলেই পারিবারিক কলহের আবর্তে তাদের পরে থাকতে হয় না। এই পরিবারের সন্তানরা বেড়েও ওঠে আত্মনির্ভরশীল হয়ে এবং উন্নত পরিবেশে।

সমাজের এই এলিট শ্রেণী বাস করে তাদের নিজস্ব জগতে। যার সাথে অন্য চারটি শ্রেণীর মানুষের পার্থক্য অনেক। তারা একদিকে যেমন সাধারণ সামাজিক ব্যবস্থা দ্বারা প্রভাবিত হন না অন্যদিকে তেমনি একে খুব বেশি প্রভাবিতও করেননা। ফলে সামাজিক কাঠামো নির্ধারণ, এর সমস্যা ও তাঁর প্রভাব জনিত যন্ত্রণার স্বীকার হন সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অন্যান্য চারটি শ্রেণী। উচ্চবিত্তদের তা খুব একটা স্পর্শ করে না।

একদা যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও দায়িত্ববোধ, ভালবাসা এবং সৌহার্দের উপর ভিত্তি করে পরিবার গড়ে উঠেছিল। আজ ক্রমশই তা হারিয়ে যেতে বসেছে এবং সে যায়গা দখল করে নিয়েছে স্বার্থপরতা, লোভ, ঈর্ষা, অশ্রদ্ধা, অভদ্রতার মত মানুষের জাগতিক দোষসমূহ। আর তাঁরই ফলশ্রুতিতে আমরা দেখতে পাই। যৌথ পরিবারের মত রক্ষাকবচটি সমাজ থেকে বিলুপ্ত প্রায়। স্বামী-স্ত্রীর ছোট্ট সংসারেও খুনসুটির যায়গায় নিত্য কলহ। দুজনেই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত অধিকার আদায়ের। মাঝে পরে ছোট্ট অবোধ শিশুটি ভুগছে নিরাপত্তাহিনতায়। শিখছে কলহ-বিবাদ। স্থায়ী ক্ষতের সৃষ্টি করছে সমাজ ব্যবস্থায়।

একদিকে সহজ সরল অবলা নারী যেমন যৌতুকের বলি হচ্ছে তেমনি অহরহ নারী কর্তৃক প্রতারিত হচ্ছে সহজ সরল ভাল পুরুষমানুষটি। এমনও শোনা যায় প্রবাসী স্বামীর তিল তিল করে নিজেকে নিঃশেষ করে উপার্জিত অর্থ স্ত্রী আত্নসাত করে অন্যের ঘরণী হয়েছেন। আবার কেউ স্বার্থের দ্বন্দে স্বামীকে ফাসিয়ে দিয়েছেন নারী নির্যাতন মামলায়।

আমার এক নিকটাত্মীয়, তাদের পছন্দের বিয়ে। ভদ্রলোক মধ্য আয়ের একটি চাকুরী করেন সংসারে অভাব নেই বললেই চলে। তাদের একটি পূত্র সন্তান। কিন্তু সংসারে শান্তি নেই। সমস্যা হল তাঁর স্ত্রী তাঁর মাকে একদমই সহ্য করতে পারেন না। যদিও মা তাঁর সাথে থাকেন না, তথাপিও মাঝে মাঝে বেড়াতে আসেন এটাও তাঁর স্ত্রীর সহ্য হয়না। এমনকি তিনি এলে সংসারের খরচ বেড়ে যায় এটাও তাঁর বড় অভিযোগ। অথচ স্ত্রী কুলের কেউ না কেউ সব সময়ই তাঁর বাসায় থাকেন। ভদ্রলোক এক সময় এ নিয়ে অনেক ঝগড়া ঝাটি করেছেন কোন ফল হয়নি। তালাক দিতে চেয়েছেন ছেলের মুখের দিকে চেয়ে দিতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত একই বাড়িতে থেকেও আলাদা থাকেন। এখন স্ত্রী বলছে তাঁর নাকি শারীরিক সমস্যা আছে। আর ভদ্রলোক বলছেন আমি বিপত্নীক। আমি জানি না এই স্বার্থপরতায় কে লাভবান হলেন। এখানে একজন নারী প্রতিকার হীন নির্যাতন করে চলেছেন একইসাথে একজন পুরুষ এবং একজন নারীকে। অথচ একটু সহনশীলতা পারত ভিন্ন চিত্র উপস্থাপন করতে।

বলা হয় একটি মেয়ে বিয়ের পরে তাঁর মা বাবাকে ছেরে আসে তাঁর স্বামীর বাড়ীতে। স্বাভাবিকভাবেই মেয়েটির এই ত্যাগের মূল্য দেয়া উচিত। কিন্তু এখন তো তা হচ্ছে না বরং বিয়ে করে উভয়ে মিলে স্বার্থপরতার মহড়া দিয়ে আলাদা সংসার সাজাচ্ছে। সেখানে প্রবেশাধিকার মিললেও থাকার অধিকার মা-বাবারও মেলে না। যারা একটু উদার তাদের কাছে দু,চারদিনের আতিথিয়তা মেলে সত্য কিন্তু এর বেশি কিছু নয়। তাতে কি পারিবারিক নির্যাতন কমেছে? কমেনি বরং বেড়েছে। স্বামী-স্ত্রীর ছোট্ট সংসারেও খুনসুটির জায়গায় লেগে আছে নিত্য কলহ। দুজনেই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত অধিকার আদায়ের। মাঝে পরে ছোট্ট অবোধ শিশুটি ভুগছে নিরাপত্তাহীনতায়। শিখছে কলহ-বিবাদ। স্থায়ী ক্ষতের সৃষ্টি করছে সমাজ ব্যবস্থায়।

আজ সর্বত্র যে সামাজিক অস্থিরতা বিরাজ করছে তাঁর মূলে রয়েছে এই পারিবারিক অস্থিরতা। পারিবারিক কাঠামো যে সব মানবিক গুণাবলির উপর দাঁড়িয়ে থাকে তাতেই ঘুণ ধরেছে।
যে শ্রদ্ধাবোধ বয়োবৃদ্ধকে দিত সম্মান, নিশ্চিত নির্ভরতা। এমনকি কর্তৃত্বও। তা এতটাই ক্ষীণ হয়ে এসেছে যে, তা এখন কর্তৃত্ব তো দূরের কথা সংসারে নিজের জায়গাটুকুও আগলে রাখতেও সক্ষম হচ্ছে না।

একইভাবে শ্রদ্ধা বিহীন ভালবাসা দানা বাধে না। ঠুনকো প্রেমের জোড়াতালির সংসারে উভয়ই পরবাসী।
সন্তান বঞ্চিত হচ্ছে সুস্থ পরিবেশ থেকে। হয়ে পড়ছে নিরাপত্তা হীন, অশুভ শক্তির হাতে হয়ে পড়ছে জিম্মি।

দায়িত্ব-মমত্ববোধের বালাই নেই, তাই সংসারে আশ্রয় জোটে না নির্ভরশীলদের। বেচে থাকার নিরন্তর প্রচেষ্টায় লিপ্ত সবাই যে যার মত। মাথার উপরে নেই নির্ভরতার ছায়া। এরপরেও আমরা কি করে একটি সুস্থ সমাজের আশা করি!

হয়ত অচিরেই দেখব একা ফ্লাটে মরে পড়ে আছে কেউ। ভাগীদার ব্যস্ত সম্পত্তির ষোলআনা বুঝে নিতে। মৃতের সৎকারে প্রাণান্ত আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম।

এটা কি মানুষের জীবন?
দায়িত্বজ্ঞান হীন শুধুই ভোগ!
শুধুই প্রাপ্তির কড়ি গোনা!
হবে হয়ত। তবে…………
শত ব্যস্ততার মাঝেও কখনো কখনো ঠিক দাঁড়াতে হয় বিবেকের কাঠগড়ায়।
তখন লজ্জায় নুয়ে পড়া নয়, যেন উচ্চ থাকে শির।

kmgmehadi@yahoo.com