পোশাক শিল্পের কর্ণধারদের চোখে সেলাই মেশিন আর সেলাই দিদিমণির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই!

মোঃ গালিব মেহেদী খান
Published : 13 Dec 2012, 02:55 PM
Updated : 13 Dec 2012, 02:55 PM

বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে পোশাক শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা অত্যন্ত জরুরী। আর এই শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখতে জরুরী এর সাথে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের নিরাপত্তা বিধান। আমাদের দেশে যারাই যখন ক্ষমতায় আসেন তারা ক্ষমতায় আরোহণের পূর্বে থাকেন সাধারণ মানুষের ভাবনায় মশগুল। ক্ষমতায় আরোহণের পরে থাকেন অসাধারণ মানুষের ভাবনায় মশগুল। ফলে যাদের শ্রমে ঘামে এ দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরে তাদের বঞ্চনার কথা তারা বেমালুম ভুলে যান। তা মনে করিয়ে দিতেই শ্রমিকদের নামতে হয় রাস্তায়। আন্দোলনের মুখে সরকার বাধ্য হন মালিক পক্ষকে নিয়ে শ্রমিকদের সাথে বসতে। আমাদের দেশে আইন আছে নীতিমালা আছে। আছে নীতি হীন উদ্যোক্তা। যা নেই তা হল অনিয়ম দেখার কেউ। এ দেশে পোশাক শিল্প কারখানা গুলিতে চলছে এক ধরনের দাসপ্রথা। যেখানে নিয়ত দাসত্বের অমানবিক চিত্রটি শৈল্পিক ভাবে উপস্থাপনের অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। তথাপিও মাঝেমাঝেই তার শরীর থেকে এই মেকি আবরণ টুকু খসে পরে। তখন আমাদের চোখে কিছুক্ষণের জন্য বড় বেশি অমানবিক হয়ে তা ধরা পড়ে। তখন কর্তাব্যক্তিদের হাহুতাস সাধারণ মানুষের কষ্টের সাথে একাত্ম হতে চাওয়া কিংবা অর্থ দিয়ে মানুষ হত্যার দায় মেটানোকে মোটেই মানবিক মনে হয় না। বরং এটাকে এক ধরনের প্রহসন বলেই মনে হয়।

একটি প্রতিষ্ঠানের যিনি কর্ণধার, প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রতিটি শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব তারই। তিনি যেমন তার প্রতিষ্ঠানের সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। তেমনি প্রতিটি শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তা প্রদান, উন্নত কাজের পরিবেশ নিশ্চিতকরণ। সঠিক সময়ে প্রাপ্য মজুরী প্রদানের দায়িত্ব তারই।

তাজরীন ফ্যাশন এর মত এমন অমানবিক ঘটনা এ দেশে এই প্রথম নয়। এর আগেও বহুবার এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে। বিজিএমই'র হিসাব মতেই এমন অগ্নিকান্ডে ১৯৯০ থেকে এ ঘটনার পূর্ব পর্যন্ত ২১২ টি ঘটনায় ২৭৫ জন শ্রমিক অগ্নিদগ্ধ হয়ে মর্মান্তিক মৃত্যুবরণ করেছেন। অনেক কথা হয়েছে। প্রতিশ্রুতির জোয়ারে ভেসে গেছে স্বজন হারানদের আর্তনাদ। অবস্থার পরিবর্তন হয়নি এতটুকু।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন এটা নাশকতা। হতে পারে নাশকতা আবার দুর্ঘটনাও হতে পারে। আগুন বিভিন্ন কারণেই লাগতে পারে কথা হল যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল কিনা?

ঢাকার ব্যস্ত সড়কের পাশেই যেমন গার্মেন্টস কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে তেমনি এমন অনেক ঘিঞ্জি পরিবেশে এই কারখানা গড়ে উঠেছে যেখানে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এর গাড়ি প্রবেশ করতেও পারবে না। দেশে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এর আগুন নেভানোর সক্ষমতা মাত্র ৭/৮ তলা পর্যন্ত সীমিত। এর বেশি উচ্চতার প্রতিটি ভবনের নিজস্ব অগ্নি প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান রয়েছে। তা মানা হচ্ছে না মোটেই। এমনকি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এর পরিদর্শনকারী কর্মকর্তারা সরেজমিন তদন্ত শেষে ফায়ার লাইসেন্স নবায়ন না করা স্বত্বেও কারখানাগুলো তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখে কোন ব্যবস্থাগ্রহণ না করেই।

কেন এত অগ্নিকান্ডঃ

• অধিকাংশ পোশাক শিল্পের মালিক ফ্লোর ভাড়া করেই সেলাই মেশিন বসিয়ে দিয়েই টাকা উপার্জন শুরু করেন। যে সব ভবন এই শিল্পের জন্য উপযোগী নকশায় তৈরি হয়নি। যার বিদ্যুৎ প্রবাহের ব্যবস্থাও প্রয়োজন অনুযায়ী শক্তিশালী করা হয় না।
• বৈদ্যুতিক সংযোগ দেয়ার ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় নিম্ন মানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহৃত হচ্ছে ফলে সহজেই তা থেকে শর্টসার্কিট হয়ে আগুন লাগছে।
• এছাড়া বিদ্যুতের প্রবাহের তারতম্যের কারণেও কখনো কখনো শর্টসার্কিট হয়ে আগুন লাগতে পারে।
• পোশাক শিল্পে কর্মরত শ্রমিক কর্মচারীদের অসচেতনতাও কখনো কখনো এই ধরনের বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
• এমনকি শ্রমিক অসন্তোষের কারণে বা নাশকতা ঘটাতে কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবেও আগুন লাগিয়ে দিতে পারে। অসংখ্য ছোট ছোট পোশাক শিল্প শীর্ষ স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সাব-কন্ট্রাক্ট নিয়ে কাজ করে যেসব প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল, অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। এসব ভবনে থাকে না জরুরী ভিত্তিতে নেমে আসার সিঁড়ি পর্যন্ত।
• বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভবনের নিচতলা এবং সিঁড়ী ঘর গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
মোদ্দা কথা আগুন লাগার অনেক কারণই থাকতে পারে। প্রয়োজন যথেষ্ট নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ।

অগ্নিকান্ডে এত মৃত্যু কেনঃ

অগ্নিকান্ডে এত মৃত্যুই বলে দেয় পোশাক শিল্পের কর্ণধাররা একটি সেলাই মেশিন আর একটি সেলাই দিদিমণিকে একই চোখে দেখেন। একটি যন্ত্র অন্যটি যন্ত্র মানব। আর তাই তারা নির্দ্বিধায় প্রধান ফটকে তালা মেরে দেন। ফলে আগুন লাগা মানেই অবধারিত মৃত্যু।
• আগুন লাগার পর ভয়ে আতংকে সবাই যখন ছোটাছুটি করে একমাত্র বাহির দরজার কাছে আসে এবং দেখে সে দরজাটিও বন্ধ তখন তারা দিশাহারা হয়ে পড়ে। সেই হুড়োহুড়িতেই অনেকে চাপা পড়ে, অনেকে জ্ঞান হারায়। নিজের জীবন নিয়ে সবাই ব্যস্ত থাকায় যারা পায়ের নিচেয় চাপা পড়লো বা জ্ঞান হারাল তাদের দিকে ফিরে তাকাবার কারো সময় থাকেনা। ওরাই একসময় লাশে পরিণত হয়।
• কারখানা গুলোতে প্রশিক্ষিত অগ্নি নির্বাপক দলের অনুপস্থিতি এবং সরঞ্জামাদির অপ্রতুলতার কারণে সহজে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়না ফলে হতাহতের পরিমাণ বাড়ে।
• কারখানা থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য একে তো বিকল্প সিঁড়ী থাকে না। ভেতর থেকে যে সিঁড়ী থাকে তাঁর উপরের (সাদের) দরজা বন্ধ থাকে আর সিঁড়িগুলোর নিচের অংশ থাকে সাধারণত আগুনের উৎসমুখে(গোডাউন)।
• শ্রমিকদের জরুরী অবস্থা মোকাবেলা করার মত প্রশিক্ষণ দেয়া হয় না। কারখানায় থাকে না পর্যাপ্ত গ্যাস মাস্ক। এছাড়াও রয়েছে কার্যকরী এলার্ম সিস্টেমের অভাব, গেট ম্যানের গাফেলতি জনিত কারণ।

মৃত্যুর মিছিল রোধে করনীয়:

আমাদের দেশে পোশাক শিল্পে যেটুকু নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে তার পুরোটাই এর ক্রেতা গোষ্ঠীর চাপে। আর তাই এর বেশিরভাগই কাগজে কলমে। পোশাক কারখানাগুলোতে অগ্নিনির্বাপণের যথেষ্ট ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মালিকদের বাধ্য করতে হাইকোর্টের রুল দেয়া থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। অথচ এ দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরে যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে তাদের দেখভালের প্রতি বাড়তি মনোযোগ দেয়া সরকারের নৈতিক দায়িত্ব।

এই মুহূর্তে যে সব প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ জরুরী:

• একটি জাতীয় কমপ্লায়েন্ট কমিশন গঠন করা। যতদিন না এই কমিশন গঠিত হয়। ততদিন এসজিএস বা অনুরূপ স্বীকৃত বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ছাড়পত্র গ্রহণ প্রতিটি শিল্পকারখানার জন্য বাধ্যতামূলক করা।
প্রতিটি শিল্পকারখানায় ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সের সরাসরি তত্ত্বাবধানে কিছু সংখ্যক অগ্নিনির্বাপক কর্মীর সার্বক্ষণিক দায়িত্বপালন নিশ্চিত করা।
• পর্যাপ্ত সিসিটিভির ব্যবস্থা থাকা। প্রতি ফ্লোরেই যার একটা করে মনিটর থাকবে যাতে প্রতি ফ্লোরের সব কিছুই সবাই দেখতে পান। যাতে কারখানার যে কোন অংশে কোন সমস্যা হলে সাথে সাথেই সবাই সতর্ক হতে পারেন। এতে গুজবে সৃষ্ট দুর্ঘটনাও বহুলাংশে হ্রাস পাবে।
• প্রতিটি ফ্লোরে অন্তত একটি বড় জানালা লোহার গ্রিল না দিয়ে শুধুমাত্র গ্লাস দিয়ে তৈরি করা। যাতে তা ভেঙ্গে সহজেই বেড়িয়ে আসা যায়।
• ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সের সরাসরি তত্ত্বাবধানে প্রতি মাসে অগ্নিনির্বাপণ মহড়া নিশ্চিত করা।
• প্রতিটি শিল্পকারখানার উপরের অংশ (সাদ) সার্বক্ষনিকভাবে ব্যাবহার উপযোগী রাখা।
• প্রতিটি কারখানা থেকে এর গোডাউন নিরাপদ দূরত্বে প্রতিস্থাপন।
• প্রতিটি ফ্লোরের সকল অংশে সহজ পানি প্রবাহ নিশ্চিত করন।
• পর্যাপ্ত ফায়ার ডিস্টিংগুসার, বালতি, বালি ও জলের ব্যবস্থা।
• শ্রমিকদের তালাবন্ধ করে না রাখা।
• এলার্ম ব্যবস্থা জোরদার।
• প্রতিটি ফ্লোরে বাহির নির্দেশিকা সহ সুপরিসর বিকল্প সিঁড়ির ব্যবস্থা। যার দরজা বাইরে থেকে লাগানোর কোন ব্যবস্থা থাকবে না এবং ভিতরে থাকবে ছিটকিনি, যাতে থাকবে না কোন তালা লাগানোর ব্যবস্থা। বিপদে যা সহজেই এবং কারও সাহায্য ছাড়াই খোলা যাবে এবং সিঁড়ির শেষ মাথায় কোন গেট থাকবে না এবং এটা থাকবে মাটির এবং খোলা রাস্তার সাথে লাগোয়া। বিকল্প সিঁড়ির আশেপাশের জানালাগুলো যা দিয়ে ধোঁয়া বের হয়ে সিঁড়িকে দুর্ঘটনার সময় ব্যবহারের অনুপযুক্ত করে ফেলতে পারে তা বন্ধ করে দিতে হবে।

পরিশেষে প্রতিটি কারখানায় শ্রমিক কর্মচারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দাবি জানাব প্রতিটি শ্রমিক কর্মচারীকে জীবন বীমার আওতায় আনার। শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষা নিশ্চিত হলে শিল্প রক্ষা পাবে। সেই সাথে এগিয়ে যাবে দেশ। তবে, সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের অভাবে এবং কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা অপমৃত্যু ঘটাতে পারে অপার সম্ভাবনাময় এই খাতের। যার বিরূপ প্রভাব শুধু অর্থনীতিতেই পড়বে না। ডেকে আনবে ভয়াবহ সামাজিক বিপর্যয়ও।

kmgmehadi@yahoo.com

সহযোগীতায়ঃ জাহিদ হাসান (জাজাফী ), মোহাম্মদ জমির হায়দার বাবলা এবং সুকান্ত কুমার সাহা।