আসলে প্রতিবন্ধী কে বা কারা?

মোঃ গালিব মেহেদী খান
Published : 26 Jan 2013, 06:19 PM
Updated : 26 Jan 2013, 06:19 PM

পুলিশ নিরীহ কিশোরকে উন্মত্ত কিছু অমানুষের হাতে ছেড়ে দিচ্ছ, যারা জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত কুকুরের ন্যায় হিংস্র নির্বোধ আর নর খাদক হয়ে উঠেছে। ছয় সাতজন ছাত্রকে হত্যা করার পৈশাচিক উল্লাসে মাতছে সমগ্র গ্রামবাসী। প্রকাশ্যে রাস্তায় শত শত মানুষের সামনে বিশ্বজিৎরা নির্মম হত্যাকাণ্ডের স্বীকার হয়। একের পর এক নারী-শিশু ধর্ষিতা হয়, খুন হয়। বিয়েতে অস্বীকৃতি জানানোয় খোদ রাজধানীতেই এসিড সন্ত্রাসের স্বীকার হয়ে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে উপনীত ইডেনের ছাত্রী। কর্মস্থলে প্রথমে ধর্ষিতা পড়ে হত্যাকাণ্ডের স্বীকার হন চিকিৎসক। প্রেমিকাকে হত্যা করে লাশ টুকরো টুকরো করে ফেলা হয় কমোডে। এগুলো কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা আমাদের সমাজের চলমান চালচিত্র।

প্রকাশ্যে শতাধিক জনতা পুলিশের সামনে মানসিক প্রতিবন্ধীকে পিটিয়ে মেরে ফেলছে। এমনকি মৃতদেহকে নিয়ে চালায় তাণ্ডব। কখনো মৃতদেহ আগুনে ঝলসে দেয়া হয়। কখনো মৃতদেহের উপর চালান হয় ছুরি। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে আসলে প্রতিবন্ধী কে বা কারা?

অসংখ্য মানুষ ঘটনাস্থলে উপস্থিত-
• কেউ এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশগ্রহণ করছে।
• কেউ হাসিমুখে দাঁড়িয়ে দেখছে এই বর্বরতা।
• কেউবা মোবাইলে ভিডিও করছে ।

প্রতিবাদ করার কেউ নেই। কিসের এত জিঘাংসা? কেন এই বর্বরতা?

অসহায় একজন মানুষ! যে নাকি গুছিয়ে কথাও বলতে পারেনা, তাকে এতজন মিলে নিছক গুজবের কান দিয়ে এভাবে হত্যা করছে, কিন্তু কেন? কেন বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে? আমাদের বুদ্ধি বিবেচনার আর কি কিছুই অবশিষ্ঠ নেই? একেবারেই লোপ পেয়েছে মনুষ্যত্ব? তবে কারা প্রতিবন্ধী?

মর্জিনারা, না যে সমাজ মর্জিনাদের নিরাপত্তা দিতে চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে সেই সমাজ? আজ যখন অটিজম নিয়ে এত কথা হয় তখন মর্জিনাদের এই পরিণতি নতুন প্রশ্নের জন্ম দেয়। আর তা হল সত্যিই কি আমরা অটিজম শিশু বান্ধব, নাকি তাদেরও ব্যাবহার করছি আত্ম প্রচারণায়।

পুলিশের সামনে নিরস্ত্র মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। পুলিশ কোনও পদক্ষেপ তো নেয়ই না বরং জানা সত্বেও প্রকৃত আসামীদের বাদ দিয়ে চার/পাঁচশো অজ্ঞাত মানুষের নামে থানায় মামলা করছে। যাতে ঐ হত্যাকাণ্ডের বিচারও সঠিকভাবে সম্পাদন অসম্ভব হয়ে পড়ে। মূল আসামীদের আড়াল করার এই হীন ষড়যন্ত্র যারা করছে তারা কি সুস্থ?

আমরা সবাই অসুস্থ হয়ে পরেছি। তাই সুস্থ ধারার চিন্তা করতে পারছি না। আমরা বর্বর হয়ে গেছি তাই মগজ নয়, বল প্রয়োগকে বেছে নিয়েছি। আমাদের চিকিৎসা প্রয়োজন।

শিক্ষার নামে আজ আমরা ব্যবসা শিখছি। নৈতিকতার স্থলে নীতি হীনতা। ভালবেসে নয়, আজ আমরা আঘাত করেই বেশি আনন্দ পাই। দায়বদ্ধতার শিক্ষা আমাদের ঘটে আজ আর বিন্দুমাত্রও অবশিষ্ট নেই। তাই সব ছন্নছাড়া বাউণ্ডুলে হয়ে গেছি। নিজেকে ছাড়া কাউকে নিয়ে ভাবার একটুকুও ফুরসৎ নেই। স্নেহ-মমতা বা অনুকম্পার মত মানবিক গুণাবলী হাড়িয়ে আজ আমরা হিংস্র, বিবেক বর্জিত পশু। যারা কারণে-অকারণে আচরে কামড়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে চায় অন্যকে। যারা জোড় করে প্রতিপক্ষ বানায় শিকারকে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় এমন সামাজিক অবক্ষয় নতুন কিছু নয়। এমন মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ পূর্বেও বিভিন্ন লোকালয়ে ছিল। যারা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস অনিবার্য করে তুলেছিল। আমরা কি তবে সেই দিকেই ধাবমান?

• দেশের কর্ণধাররা ক্ষমতার মোহে মত্ত।
• সমাজপতিরা আখের গোছাতে ব্যস্ত।
• ভাল কথার ব্যবসা রমরমা।
• শিক্ষক-ছাত্র আদর্শহীন লেজুড়বৃত্তিতে মগ্ন।
• বিচার পায় না অসহায়।
• অভিযুক্ত দোর্দণ্ড প্রতাপে ঘুরে বেড়ায়।
• অভিভাবকহীন সাধারণ মানুষ চরম উৎকণ্ঠায় পার করছে অসহ্য এক সময়।
• থানা মামলা সাজায় বিবাদীকে রক্ষার কৌশল অবলম্বন করে।
• ডাক্তার ময়না তদন্তের নামে মিথ্যে প্রতিবেদন দাখিল করে।
• অভিযুক্তের হুমকিতে ঘরছাড়া হয় বাদী। সবাই দেখলেও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের খুঁজে পায়না।
• হত্যা, গুম, ক্রসফায়ার নিত্য নৈমিত্তিক।
• ছাত্র নেতাদের এসিডে ঝলসে যায় শিক্ষক।

এ সবই কি এক সূত্রে গাথা নয়?

জন নেত্রী-দেশনেত্রী-পল্লী বন্ধু-সৎলোক কিংবা সুশীল সমাজ। সমাজের এই পচন সারাবেন কে? কার আছে সেই সময়? তাছাড়া এ রোগ সারানোর মহৌষধ আমাদের কাছে কি আদৌ আছে? থাকলেও তাঁর প্রায়োগিক ক্ষমতা বা সদিচ্ছা কতটুকু আছে সেটাও আলোচনার দাবী রাখে। কারণ যারা এর প্রায়োগিক ক্ষমতা সম্পন্ন এবং যাদের উপর এর দায়ভার বর্তায় তারাই যদি কোন না কোনভাবে এর প্রাদুর্ভাবের জন্য দায়ী হন তাহলে তাদের দ্বারা এর প্রতিকার কতটা সম্ভব?

কথাটা এ জন্যই বলছি, আজ আমাদের সমাজের এই যে অস্থিরতা, সর্বগ্রাসী অবক্ষয়। এর পেছনে বহুবিদ কার্যকারণ বিদ্যমান।বিশেষত-

• সুশাসনের অভাব।
• মূল্যবোধের অবক্ষয়।
• রাজনৈতিক অস্থিরতা।
• সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা।
• সবকিছুতেই রাজনীতিকরণ।
• আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দান।
• সর্বোপরি সমাজের প্রতিটি স্তর থেকে অপরাধীদের ব্যবহার এবং বাঁচানোর চেষ্টা।

এ সবই আমাদের সমাজের অসাধারণদের সৃষ্ট। কোনটাই সাধারণ মানুষের আয়ত্তাধীন নয়। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় এর সমাধানের আশা করাও বাতুলতা মাত্র। প্রয়োজন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ। দেশের প্রতিটি মানুষের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। যে রাষ্ট্র যন্ত্র এই নিরাপত্তা বিধানে অক্ষম তাঁর ধ্বংস অনিবার্য। যারা এই রাষ্ট্র যন্ত্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত এ ব্যর্থতার দায়ভারও তাদের। আমরা সাধারণ মানুষ নিরাপত্তা চাই। ভাল কথা বলার লোক চাই না। চাই ভাল কাজ করার লোক।

দলীয় লোকজন উপাধি দিলেই প্রকৃত দেশপ্রেমিক হওয়া যায় না। সাধারণ মানুষই একজন নেতাকে অবিসংবাদিত বলে আখ্যায়িত করে। ভালবাসা দিয়ে সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করে। তবে তা অর্জন করতে হয় নিজেকেই। আর তা সাধারণের পাশে এসে দাঁড়িয়ে, বংশবদদের চাটুকারিতায় নয়। আমাদের বর্তমান নেতা-নেত্রীরা তা অনুধাবন করেন বলে মনে হওয়ার কোন কারণ নেই। আর তাই সমাজের প্রতিটি স্তর থেকে আজ রব উঠেছে প্রকৃত সমাজ সংস্কারক চাই। চাই প্রকৃত দেশপ্রেমিক নেতা। চাই আইনের শাসন। চাই দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, বন্ধ হোক লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি। আমরা পেশিশক্তি নির্ভর রাজনীতি মুক্ত সুস্থ ধারার রাজনীতি চাই। যে রাজনীতি অপরাধীদের ব্যবহার এবং বাঁচানোর চেষ্টা করবে না। যে রাজনীতি শুধুমাত্র ক্ষমতারোহনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয়ে হবে প্রকৃতই জনকল্যাণমুখী।

kmgmehadi@yahoo.com