যদিও নির্বাচনটা স্থানীয় সরকার নির্বাচন তথাপিও প্রথমবারের মত দলীয় প্রতীক থাকাতে এবং বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্বাচনটি আওয়ামীলীগ এবং বিএনপি উভয় দলের কাছেই অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। দুই দলের প্রধান নেতৃত্ব এবং প্রথম সারি থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের নেতাদের ঘুম হারাম করা দেখে সহজেই অনুমিত হয় যে দল দুটি নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে কতটা মরীয়া।
এটা কোন বেফাঁস মন্তব্যের সময় নয় কিংবা কোন হঠকারী সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় নয়। কেননা তার সরাসরি প্রভাব পরবে ভোটের হাওয়ায়। কাজেই সে হিসেবে উভয় দলেরই অনেক হিসেব নিকেশ করে মন্তব্য করার কথা।
অথচ আমরা অবাক হয়ে লক্ষ করলাম এই সময়ে কোন কারণ ছাড়াই বিএনপি নেত্রী মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করলেন। আর তার দুদিন পরেই তার নেতা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের দেশপ্রেম এমনকি তারা শহীদ কিনা সে ব্যাপারেও সন্দেহ পোষণ করে বিবৃতি প্রদান করলেন।
একজন বলে বসলেন মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলাই অনুচিত।
একটু লক্ষ করলেই আমরা দেখতে পাই বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বিতা কাগজে কলমে আওয়ামীলীগের সাথে হলেও এখন প্রকাশ্যেই তা হয়ে দাঁড়িয়েছে 'মুক্তিযুদ্ধ'।
কিন্তু কেন?
এই নির্বাচনী হাওয়ার মধ্যেও এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে বিএনপি কেন কুতর্ক জুড়ে দিল?
তাহলে কি তারা মনে করছে এতে তারা অধিক মানুষের অনুকম্পা লাভ করবে? যা তাদের ভোটের বাক্স ভড়তে সহায়তা করবে। তাহলে তো দাঁড়াচ্ছে যে, এ দেশের অধিকাংশ মানুষই বাংলাদেশের স্বাধীনতায় অবিশ্বাসী অথবা পাকিস্তানের অনুরক্ত!
তা যে নয় তা যে কেউ কোন গবেষণা ছাড়াই বলে দিতে সক্ষম হবে। আর বিএনপিরও তা অজানা নয়। তাহলে তারা কেন এ সময়ে এই ঝুঁকিটা নিতে গেল?
আমরা সময়টিকে শুধু নির্বাচনী সময় বলে একদিকে দৃষ্টিপাত করলে একটি গোলকধাঁধার মধ্যেই পড়ে যাব। আমাদের এর কারণ খুঁজতে হলে তাকাতে হবে পেছনে। সময়টা নির্বাচনের হলেও অলক্ষ্যে তার থেকেও বড় এক এজেন্ডা এসে দাঁড়িয়েছে বিএনপির সম্মুখে। যেটাকে উপেক্ষা করার মত সাহস বা ইচ্ছা কোনটাই তাদের নেই। কাজেই আপাত দৃষ্টিতে আত্মঘাতী মনে হলেও এমন বক্তব্য রাখতে তারা বাধ্য।
আমরা কেন ভুলে যাই পাকিস্তানের হাই কমিশন একটি স্বীকৃত কূটনৈতিক জোন। কিন্তু বাংলাদেশে তাদের আসল ফ্রন্টটি পরিচালিত হয় জামায়াতে ইসলামের মাধ্যমে। কাজেই বিএনপিকে দৃশ্যমান কিছু একটা করতেই হবে। স্পষ্ট অবস্থানটি গ্রহণ ছারা তাদের সামনে আর কোন পথই খোলা নেই। কেননা ইতিমধ্যেই নানা কারণে জামায়াত বিএনপিকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছে। সে সন্দেহ দূর করাটাও তাদের জন্য অনেকটা জরুরী।
আমি শতভাগ নিশ্চিত সরকার জামায়াত নিষিদ্ধের উদ্যোগ নিলে বিএনপি চুপ করে থাকবে না। সেটা তারা চাইলেও পারবে না।
ছয়মাসের মধ্যে পাকিস্তান তাদের হাই কমিশন থেকে দুই জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ বিরোধী গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ছাড়া সাকা-মুজাহিদের ফাঁসি নিয়ে পাকিস্তানের উদ্ধত্যপুর্ন আচরণ ও তার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। সব কিছু মিলিয়ে স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক এতটা খারাপ অবস্থায় আর কখনোই পৌঁছে নি। এ অবস্থায় তারা যে বাংলাদেশে বন্ধুহীন নয় সেই বার্তাটা দেয়া বিএনপির জন্য অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছিল। আর সে কারণেই বিএনপিকে এই ঝুঁকিটা নিতে হয়েছে। এতে করে তারা আরেকবার প্রমাণ দিল যে পাকিস্তানকে তাদের কতটা প্রয়োজন। আর সেই প্রয়োজনের কাছে বাংলাদেশের স্বার্থ, অহংকার এ সবই কতটা তুচ্ছ! তবে তারা এও জানে এ দেশের আবেগ তাড়িত মানুষের এ সব খুব বেশী সময় মাথায় থাকে না। আর সেটাই তাদের একমাত্র ভরসা। বেগম জিয়া জনসাধারণকে বিএনপির প্রার্থীদের ভোট দিতে বললেন, শান্তি-নিরাপত্তা আর উন্নয়নের জন্য! এর থেকে বড় উপহাস আর কি হতে পারে। অথচ তিনি সেটাই বললেন। কেননা তিনি জানেন এ দেশের মানুষের রয়েছে ভুলে যাওয়ার অসম্ভব ক্ষমতা। দুই বছর সময়টা তো একেবারে কম নয়। কাজেই পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে পরের বিভীষিকাময় নৈরাজ্যের কথা এতদিনে সাধারণ ভোটারদের ভুলে যাওয়ারই কথা!
বিএনপি নেত্রী এমনই এক সময় মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করলেন যার দুদিন আগেই পাকিস্তান একাত্তরের গণহত্যাকে অস্বীকার করেছে। শহীদের সংখ্যা যদি কমানো যায় তাহলে তো স্বাভাবিক ভাবেই অপরাধের মাত্রাও কম করে দেখানো সম্ভব হয়। সে হিসেবে বেগম জিয়ার সন্দেহ পোষণ পাকিস্তানের গণহত্যাকে অস্বীকার এর ধারাবাহিকতা রক্ষা ছার আর কি? আর ঠিক একই ধারাবাহিকতায় গয়েশ্বর রায় সব ধরনের শিষ্টাচারকে ছাড়িয়ে গিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের দিকে আঙ্গুল তুললেন।
তবে হ্যাঁ এত বড় ধৃষ্টতা দেখানোর সাহস তারা পেতেন না যদি না আগে থেকেই তাদের বশংবদ তৈরি করে রাখতে সক্ষম হতেন। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে তাদের চেলা চামুণ্ডার কোন অভাব এ দেশে নেই। আর নেই বলেই তারা এখনো বীর দর্পে চলার সুযোগ পান।
আর এ জন্য দায়ী আমাদের রাজনীতিবিদ সহ বুদ্ধিজীবীরাই। এতদিন ধরে তারা নির্দিষ্ট কয়েকজন মানুষের একাত্তরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলাকে নাজায়েজ করে রেখেছেন। কেন?
আমাদের নতুন প্রজন্ম'র মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যেকের ভূমিকা জানার অধিকার রয়েছে। নতুন প্রজন্মকে দিনের পর দিন মিথ্যে ইতিহাস শেখানোর দায়ে কাউকেই জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়নি।
দিনের পর দিন এ দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষ বাস্প ছড়ানোর দায়ে তার কুশীলবদের শাস্তির আওতায় আনতে এ দেশের রাজনীতিবিদগণ বরাবরই ব্যর্থ হয়েছেন।
একাত্তরের সব মুক্তিযোদ্ধাদের এক কাতারে স্থান দেয়া হয়েছে; অথচ তাদের মধ্যেরই কেউ কেউ পনের আগস্টের ঘটনার জন্য দায়ী। যারা পনের আগস্টের খুনি, যারা সে ঘটনার পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন তারাও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাই বলে কি তারাও পরম পূজনীয়?
কেন এ দেশে ঘোষকের আবরণে মিথ্যে নেতা সাজানোর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা সোচ্চার হলেন না? আপনারা কি ভুলে গেছেন যে একাত্তরে কার ডাকে সারা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তাহলে কেন নতুন প্রজন্মকে প্রতারিত করা হল? আর আপনারাও নিশ্চুপ হয়ে রইলেন?
হিসেবটা তো জলের মতই সহজ। জিয়ার ডাকেই যদি সেদিন মুক্তিযুদ্ধ হত তাহলে জিয়া একজন সেক্টর কম্যান্ডার হয়েই থাকতেন না। অন্তত মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক হতেন। আর তা ছাড়া আপনারা কি এটা বলতে চান যে, একজন সেক্টর কমান্ডারের ডাকে সারা দিয়ে সেদিন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরেছিলেন। আর তাও আবার আমাদের মেনে নিতে বলছেন? এই প্রজন্ম যে অতটা বেকুব নয় তা কি বিএনপির আজকের দুর্দশা দেখেও বুঝতে পারছেন না?
এ দেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে এ জাতির যাদেরকে ভাবার কথা আজ তারাও অকারণ কুতর্কের বিরুদ্ধে চুপ করে আছেন। আর এই চুপ করে থেকে নিজেদেরকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। আপনারা বেশ ভালই বুঝতে পারছেন এই কুতর্কটি করাই হচ্ছে পরাজিত শক্তির পক্ষ হয়ে। আজ যখন শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে প্রশ্ন তোলা হল যে, তারা কেন চাকুরীরত ছিলেন কেন সরকারী বেতন নিলেন। তার উত্তর কি আপনাদের কাছে ছিল না? মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেই কি তারা সেদিন প্রশাসনের মাঝে থাকেন নি? ইতিহাস কিন্তু তাই বলে। আর আপনাদেরও তা ভুলে যাওয়ার কথা নয়। এই যে প্রতিবাদ না করে চুপ করে রইলেন, এতে করে কি সহযোদ্ধাদের প্রতি সুবিচার করলেন? অগ্রজদের মতিভ্রমের এ লজ্জা আজ অনুজদেরও মাথা হেট করে দেয়।
একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল তাকে পূর্ণতা দানের জন্য প্রয়োজন ছিল অর্থ নৈতিক মুক্তি, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা, মেধা ও মননের স্বাধীনতা। অনেক বাধা বিপত্তি স্বত্বেও কাঙ্ক্ষিত সেই অর্থনৈতিক মুক্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছুতে সক্ষম হলেও আমরা অনেকখানি পিছিয়ে পরেছি সাংস্কৃতিক আর মেধা ও মননের লড়াইয়ে। যার ফলে অবাক বিস্ময়ে বিশ্ব লক্ষ করছে এ জাতী যেন স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ভুলে ক্রমশ পরাধীনতায় মোহাবিষ্ট হয়ে পরছে।
আজ আমরা আমাদের সন্তানদের লেখাপড়ার শুরুটাই করছি বিদেশী ভাষায়। অথচ বিশ্বে আমরাই একমাত্র জাতী যারা ভাষার জন্য লড়াই করেছি। রাজপথে রক্ত ঝরিয়েছি, প্রাণ দিয়েছি। বিদেশী পণ্যের প্রতি আমাদের মোহ তো সৃষ্টিছাড়া। এমনকি পাকিস্তানী ক্রিকেটার ছাড়া আমাদের লীগ পূর্ণতা পায় না। ভারতীয় অভিনেতা-অভিনেত্রী ছারা আমাদের একটি ছোট্ট ইভেন্টও জমে ওঠে না।
আমাদের এই হীনমন্যতা দেশিয় সংস্কৃতির চর্চার অভাব এবং মননের দেউলিয়াত্বকেই নির্দেশ করে।
একটি দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা মানেই প্রকৃত স্বাধীনতা নয়। রাজনৈতিক স্বাধীনতার সাথে সাথে অর্থ নৈতিক মুক্তি, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা, মেধা-মননের স্বাধীনতাও সমান জরুরী। বলা যায় এ গুলো হচ্ছে স্বাধীনতার এক একটি উপাদান। যার সবগুলো অর্জিত হলে পরেই একটি জাতি নিজেকে স্বাধীন বলে গর্ব করতে পারে। আজো বাংলাদেশীদের পাকিস্তান প্রীতি শুধুমাত্র যে মননের বৈকল্য তাই নয় একই সাথে একাত্তরের শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানিও বটে। কেননা আজো তারা এ জাতীর কাছে কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা তো চায়ইনি এমনকি একইভাবে এখনো ষড়যন্ত্রের জাল বুনেই চলেছে।
অথচ তাদেরই হয়ে লড়াই করে এ দেশেরই একটি বৃহৎ দলের নেতা। তারপরেও সে আশা করছে দেশের আশি ভাগ লোকই তাকে সমর্থন করে! এ দায় শুধুই তার, আমাদেরও কি অনেকখানি নয়?
kmgmehadi@gmail.com