মন্ত্রী মহোদয় মানুন আর নাই মানুন- আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা মোটেই মানসম্পন্ন নয়

মোঃ গালিব মেহেদী খান
Published : 20 Jan 2017, 01:58 AM
Updated : 20 Jan 2017, 01:58 AM

শিক্ষার মান নির্ধারণ নিয়ে যখন আমাদের খোদ শিক্ষামন্ত্রীই দ্বিধান্বিত তখন এ প্রশ্ন উঠতে বাধ্য যে, আসলে আমরা শিক্ষা বলতে কি বুঝি? আর আমাদের শিক্ষার উদ্দেশ্যই বা কি?

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মনিটরিং ইভালুয়েশন উইং কর্মশালায় অংশ নিয়ে মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রী মহোদয় বলেন, "গত ৫০ বছর ধরে শুনছি, শিক্ষার মান কমে গেছে। বিষয়টি যদি সত্য হতো, তাহলে এতদিনে মান বলে কিছুই থাকতো না। তারপরও যারা মান নিয়ে কথা বলছেন, তারা যদি মানের মাপকাঠি নির্ধারণ করে দিতেন, সেটিকে সামনে রেখে আমরা এগিয়ে যেতাম।" (কালের কণ্ঠ ১৮/১/১৭)

মন্ত্রী মহোদয়ের কথায় এটা স্পষ্ট যে, তিনি আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট। আর যারা শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তাদের প্রতি তার আহ্বান তারা যেন মানসম্পন্ন শিক্ষার মাপকাঠি নির্ধারণ করে দেন। আসল কথা হল বর্তমান শিক্ষার মান নিয়ে মন্ত্রণালয় ব্যতীত সকলেই অসন্তষ্ট।

আসুন দেখি শিক্ষা ব্যবস্থায় আমাদের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা কি। আমাদের সংবিধানে দ্বিতীয় ভাগে "রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি" অংশে বলা হয়েছে,

অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা
১৭৷ রাষ্ট্র
(ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য;
(খ) সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছা প্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য;
(গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য; কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন৷

আমাদের চলমান শিক্ষা ব্যবস্থা যে সংবিধানের সাথেই সাংঘর্ষিক তা সংবিধানের (ক) উপধারাতেই স্পষ্ট। এখানে বলা হয়েছে একই পদ্ধতির শিক্ষা ব্যবস্থার কথা অথচ চলছে চর্তুমুখি। আমি সে আলোচনায় যাচ্ছি না। যেহেতু আমরা আলোচনা করছি শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে। কাজেই এখানে দ্বিতীয় উপ ধারাটিই আলোচ্য।

দ্বিতীয় উপ ধারায়(খ) বলা হয়েছে, সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছা প্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য;

এই একটি বাক্যে আমরা আমাদের শিক্ষার উদ্দেশ্যের সাথে মিল খুঁজে পাই বিশ্বের তাবৎ শিক্ষাবিদ এবং মনিষীদের নিরূপিত শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে।

সক্রেটিসের ভাষায় 'শিক্ষা হল মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশ।' এরিস্টটল বলেন 'সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হল শিক্ষা'। আর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় 'শিক্ষা হল তাই যা আমাদের কেবল তথ্য পরিবেশনই করে না বিশ্ব সত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে।

এসব মনীষীদের কথার মর্মার্থ একটাই। আর তা হল, শিক্ষা এমন একটি প্রক্রিয়া যা একজন মানুষের অন্তর্নিহিত গুণাবলীকে বিকাশের ব্যবস্থা করে এবং যা অর্জনের মাধ্যমে একজন মানুষ উৎপাদনশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন। ইংরেজি education শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ educare বা educatum থেকে। যার অর্থ to lead out অর্থাৎ ভেতরের সম্ভাবনাকে বাইরে বের করে নিয়ে আসা বা বিকশিত করা।
বিষয়টি ঠিক তাই; একজন মানুষ যে শক্তি যে সামর্থ্য নিয়ে জন্ম লাভ করেন সেই সুপ্ত শক্তিকে বের করে আনাই হল শিক্ষার উদ্দেশ্য।
আপনি চাইলেই কাউকে বিজ্ঞানী হিসেবে তৈরি করতে পারবেন না চাইলেই একজন মানুষকে কবি বা সাহিত্যিক এমনকি নেতা হিসেবে গড়ে তুলতে পারবেন না। যে বিষয়ে শ্রেষ্ঠত্বের স্বাক্ষর রাখেন সেই প্রতিভাটা তার অন্তর্নিহিত।
ঠিক একইভাবে একজন শিক্ষার্থী সব বিষয়ে পারদর্শী হবে না। কোন না কোন বিষয়ে সে অন্যদের থেকে ভাল করবে। আমরা কি তার সেই অন্তর্নিহিত শক্তির খোজ নেই? নেই না। আমরা একজন শিক্ষার্থীর উপরে আমাদের মত করে নানান বিষয় চাপিয়ে দেই। অথচ যা প্রয়োজন কিন্তু দেই না সেটি হল নৈতিক শিক্ষা।

আমরা জ্ঞান অন্বেষণের বদলে শিক্ষার্থীদের উপর একটি প্রতিযোগিতা চাপিয়ে দেই। যার ফলে জ্ঞান অর্জন করার থেকে তার কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে ভাল ফল লাভ করা। সে তখন পাঠ্য বই ছেঁড়ে সিলেবাসের পেছনে ছুটতে শুরু করে। সেই ক্ষুদ্র সিলেবাস থেকে সে যা শিখল সেটুকুনও আবার সে ধারণ করে না। ব্যক্তি জীবনে তার অনুশীলন করে না। কেবল মুখস্থ করছে আর পরীক্ষা কেন্দ্রে গিয়ে উগড়ে দিয়ে আসছে। এতে করে সে ভাল ফল লাভ করছে ঠিকই কিন্তু কর্মক্ষেত্রে গিয়ে সে পেছনে পড়ে যাচ্ছে। কারণ সে যা শিখেছে তা না তার ব্যক্তিগত জীবনাচরণে প্রভাব ফেলতে পারছে না তাকে কর্মোপযোগী করে তুলছে। এরাই জিপিএ ৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থী যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়। মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে মান সম্পন্ন এই শিক্ষার্থিদের কাছ থেকে দুছত্র মৌলিক লেখা তো দূরের কথা। দুটি কথাও নিজের ভাষায় বলানো দুস্কর। সেটা কি আপনি জানেন?

মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়, শিক্ষার মান নির্ধারনের জন্য আপনাকে কারো কাছ থেকে পরামর্শ নিতে হবে না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বচ্চ ডিগ্রীধারীদের ডেকে এনে নিজেই পরীক্ষা করে দেখুন। দুটো প্রশ্ন করুন। একটি বিষয়ের উপর নিজস্ব মতামত তুলে ধরতে বলুন। সহজেই বুঝতে পারবেন তাদের শিক্ষার দৌড়। এর প্রমাণ আমরা পাই নিম্নের জরিপের ফলাফলে।
বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট-এর ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। প্রথম আলো মার্চ ০২, ২০১৪

এর বিপরীতে আরেকটি তথ্য জেনে নেয়া যাক, প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, বিনিয়োগ বোর্ডের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে ১২ হাজারের মতো বিদেশী। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তার সাথে কথা বলে জানা যায়, দেশে বর্তমানে অন্তত ১২ লাখ বিদেশী নাগরিক রয়েছেনে, যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। বিদেশীদের কর্মসংস্থানের দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে তৈরি পোশাক শিল্প খাত। কম্পোজিট টেক্সটাইল মিল, ওভেন ও নিটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি, সুয়েটার ফ্যাক্টরি, বায়িং হাউজ, মার্চেন্ডাইজিং কোম্পানি প্রভৃতিতে কাজ করছেন প্রায় ১০ লাখ বিদেশী। এ ছাড়া বিভিন্ন বহু জাতিক কোম্পানি, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল পাওয়ার স্টেশন, আন্তর্জাতিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, ফ্যাশন হাউজ, খাদ্য উৎপাদন ও বিপণন কারী প্রতিষ্ঠান, মোবাইল ফোন কোম্পানি, বিজ্ঞাপনী সংস্থা, নানা ধরনের পার্লার এমনকি শো রুমের কর্মচারী হিসেবেও কাজ করছে অনেক বিদেশী। এদের বেশির ভাগই ভারতীয়। এ ছাড়া রয়েছে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ইউরোপ-আমেরিকার নাগরিকও।নয়া দিগন্ত ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ আর এর প্রধান কারণটাই হল আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা। এ তো গেল কর্মক্ষেত্র উপযোগী করে গড়ে তুলতে না পারার গল্প।

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কি আমাদের সন্তানদের ব্যক্তি জীবনেও একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার মত করে প্রণীত? আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী কজন শিক্ষার্থী আমাদের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত রাষ্টীয় মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সঠিক ব্যাখ্যা জানেন? আমাদের কজন শিক্ষার্থী দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সচেতন হয়ে বেড়ে উঠেছেন। একজন আদর্শ নাগরিককে ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনের নৈতিক, মানবিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে শিক্ষার যে ভূমিকা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কি তা পূরণ করতে নুন্যতম ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে?

এক কথায় এর উত্তর হচ্ছে, না। স্বাধীনতার প্রায় অর্ধ শতক বছর পরে এসেও আমাদের স্বাধীনতা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তির সাথে লড়াই করতে হচ্ছে। সঠিক ধর্মীয় শিক্ষার অভাবে আমাদের শিক্ষিত যুব সমাজের এক অংশ ভিড়ে যাচ্ছে জঙ্গিবাদে! মানবিক শিক্ষার অভাবে আমরা হরণ করে চলেছি সংখ্যালঘুর অধিকার। নিতি নৈতিকতার অভাবে রাজনীতিতে দুর্বিত্তায়নের মাত্রা ভয়াবহ। এসব নিশ্চয়ই নৈতিক, মানবিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ শিক্ষার পরিচায়ক নয়।

শুরু করেছিলাম মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রীর একটি উক্তি দিয়ে। শেষও করছি মন্ত্রী মহোদয়ের প্রতি একটি নিবেদন রেখে। মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়, কারো কাছ থেকে আপনাকে শিক্ষার মান নির্ধারনের মাপকাঠি চেয়ে নিতে হবে না। আপনার মন্ত্রণালয় শুধু এটা নিশ্চিত করুক আমাদের সন্তানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে তাই শেখানো হবে যা তাদেরকে জ্ঞান, দক্ষতা ও কর্মানুরাগ বৃদ্ধি করে কর্মোপযোগী করে গড়ে তুলতে পারে। আমাদের সন্তানেরা নৈতিক, মানবিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ শিখে প্রকৃত মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে। এ দেশের বিপুল জনগোষ্ঠী জনশক্তিতে রূপান্তরিত হবে।

যতদিন না পর্যন্ত সেটা সম্ভব হচ্ছে আপনি স্বীকার করুন আর নাই করুন আমরা এই শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আঙ্গুল তুলবই। আমরা লক্ষ লক্ষ জিপিএ ৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থী চাই না আমরা লক্ষ লক্ষ মানবিক বোধ সম্পন্ন দক্ষ জনশক্তি চাই।

kmgmehadi@gmail.com