তৃতীয় ধারার রাজনীতি: প্রয়োজন ও বাস্তবতা

মোঃ গালিব মেহেদী খান
Published : 14 August 2017, 08:50 AM
Updated : 14 August 2017, 08:50 AM

আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির বাইরে একটি আকর্ষণীয় আস্থাভাজন এবং সর্বোপরি সত্যিকার অর্থেই দেশ হিতৈষী রাজনৈতিক শক্তির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। শুধুমাত্র চাহিদা বললে ভুল হবে বলা উচিৎ আওয়ামী লীগ বিএনপির বাইরে স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি দুর্নীতিমুক্ত একটি উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাতে পারে এমন একটি শক্তির জন্য দলকানার বাইরে একটি বিশাল জনগোষ্ঠী বহুদিন ধরে চাতকের ন্যায় অপেক্ষা করে আছে।

সাধারণ মানুষের এই আকাঙ্ক্ষার কথা এ দেশের চতুর রাজনীতিবিদদেরও অজানা নয়। আর সেকারণেই আমরা মাঝে মাঝেই দেখতে পাই আওয়ামীলীগ-বিএনপির দলছুট নেতাদের মহা সমারোহে নতুন দল গঠনের হিড়িক। তাঁরা ভাবেন আওয়ামীলীগ-বিএনপির বিরুদ্ধে বিষদ্গারই বুঝি জন তুষ্টি লাভের মোক্ষম উপায়। তাঁরা এটা একটিবারও ভাবেন না কদিন আগেও তিনি ঐ দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন আর কেবল স্বার্থের সংঘাতেই দল থেকে বেড়িয়ে এসেছেন অথবা বের হয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন। অতএব তাঁর সকল কথাই যে অন্তঃসার শূন্য এটা বুঝতে জনসাধারণের খুব একটা বেগ পেতে হয় না।
এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি থেকে ডাক সাইটের অনেক নেতাই বেড়িয়ে এসেছেন কেউ অন্য দলে যোগ দিয়েছেন কেউ কেউ আলাদা দল গঠন করেছেন কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে আশা জাগাতে প্রত্যেকেই ব্যর্থ হয়েছেন। যার পেছনে মূলত দুটি কারণ এক, এদের কেউই দুর্নীতি বিরোধী বা জনসাধারণের পক্ষ গ্রহণ করে দল থেকে বেড়িয়ে আসেন নি। যা তাকে জনসাধারণের কাছে আস্থার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে। দুই, আশ্চর্যজনক বিষয় হল দল থেকে বেড়িয়ে এসে এক সময় আবার সেই দলেরই লেজুড়বৃত্তি করে এরা নিজেদেরকে কেবল ব্যর্থ লোভী রাজনীতিবিদ হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে প্রথম দিকে তাদের উচ্চাভিলাষী কথামালায় বিভ্রান্ত হয়ে মানুষ কিছুটা আশাবাদী হলেও এখন আর তাদের নতুন দল বা জোট গঠনের ঘোষণা জন মানসে সামান্যতম আশার সঞ্চার করে না।

এরশাদের সম্মিলিত জাঁতীয় জোট কিংবা বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বে  জোট। বাম দলগুলোর জোট অথবা ইসলামিক দলগুলোর আলাদা জোট প্রত্যেকেরই শেষ গন্তব্য হয় আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি এটা সবার জানা। আর তাই যদি হয়, তাহলে আর তাদেরকে সমর্থন যুগিয়ে লাভটা কী? ঘুরে ফিরে তো সেই একই কথা হয় আওয়ামীলীগ অথবা বিএনপি। যারা দল দুটির থেকে নিষ্কৃতি পেতে চাইছে তাঁরা তো এদের বাইরে আর যেতে পারল না। এই সহজ বিষয়টি যে আমাদের রাজনীতিবিদগণ বোঝেন না তা নয়। তাঁরা খুব ভাল বোঝেন। তারপরেও কেন ঘার সোজা করে উঠে দাড়িয়ে বলেন না যে আমাদের সমর্থন করুন আমরা কোন অবস্থাতেই আওয়ামীলীগ বা বিএনপির সাথে আপোষের রাজনীতি করব না? আমরা নতুন ধারার রাজনীতির সূচনা করব।

কারণ একটাই, দুঃখজনক সত্য হল আমাদের রাজনীতিবিদগণের লক্ষ একটাই আর তা হল ক্ষমতার হালুয়া রুটির ভাগ গ্রহণ। দেশকে ভালবাসা দেশকে উন্নয়নের শিখরে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় তাদের নেই। তাঁরা কেবল নিজেদের ভাগটাই ভাল বোঝেন। প্রত্যেক নির্বাচনের আগে তাঁরা জোট গঠন করেন, উদ্দেশ্য একটাই। কিছু লাভের ব্যবস্থা করা। আর তাতে তাঁরা যথেষ্ট সফলও হন যদিও জন মানস থেকে চিরতরে হারিয়ে ফেলেন সম্মানের জায়গাটুকু। তাতে তাদের কি কিছু এসে যায়? বোধ হয় না। যদি এটা তাদের বিবেচনায় থাকত তাহলে নিশ্চয়ই কেউ কেউ নিজেদের একটা আলাদা অবস্থানে নিয়ে যেতে পারতেন।
তাদের এই ব্যর্থতা আওয়ামী লীগ-বিএনপিকে আরও বেশী স্বেচ্ছাচারী করে তুলেছে। দল দুটি এখন এমন একটি অবস্থায় পৌঁছুচ্ছে যে এক দল আরেক দলকে ধ্বংস করাই প্রধান এজেন্ডা বানিয়েছে। এই যে এক দলের বিরোধী পক্ষকে নিঃশেষ করার মানসিকতা এর পেছনে দায়ী এই সব দল ছুটদের লেজুড়বৃত্তি এবং মাথা উঁচু করে না দাঁড়াতে পারা।

এ দেশের মানুষ নেতৃত্ব নির্বাচনে বর বেশী অসহায় হয়ে পড়েছে। যদি তাঁরা স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি বলে দাবীদার দলটিকে সমর্থন দিতে শুরু করে তাহলে তৃণমূল নেতৃত্বের স্বেচ্ছাচারিতায় চরম অসহায় হয়ে পড়ে। অদ্ভুত কোন এক কারণে দলটি কখনোই তাঁর তৃণ মূলকে শাসন করে না। ক্ষমতার অপব্যবহার তাদের এখন মজ্জাগত। আর সেটা যে প্রতিনিয়ত দলটিকে জন মানসে বিরক্তির উদ্রেক করছে দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের সেদিকে ভ্রুক্ষেপই নেই।

আর একটি দল তো নিজেদের দুর্নীতির জনক বলেই প্রতিষ্ঠিত করে ছেড়েছে। তাঁর সাথে যোগ হয়েছে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ। এই যখন অবস্থা তখন সাধারণ মানুষ তো আকুল আগ্রহে অপেক্ষা করবেই নতুন রাজনৈতিক শক্তির। কিন্তু কোথায় সেই মহানায়ক?

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ সামরিক একাডেমির প্রথম ব্যাচের শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষনে বলেছিলেন-

মনে রেখ,
মুখে হাসি বুকে বল, তেজে ভরা মন
মানুষ হইতে হবে মানুষ যখন।
মাঝে মাঝে আমরা অমানুষ হয়ে যাই।
এত রক্ত দেয়ার পর যে স্বাধীনতা এনেছি, চরিত্রের পরিবর্তন অনেকের হয়নাই।

এখনও ঘুষখোর, দূনীতিবাজ, চোরাকারবারী, মুনফাখোরী বাংলার দুঃখী মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। দীর্ঘ তিন বৎসর পর্যন্ত এদের আমি অনুরোধ করেছি, আবেদন করেছি, হুমকী দিয়েছি চোরা নাহি শুনে ধর্মের কাহিনী। কিন্তু আর না, বাংলার মানুষের জন্য জীবনের যৌবন আমি কারাগারে কাটিয়ে দিয়েছি।

এ মানুষের দুঃখ দেখলে আমি পাগল হয়ে যাই। কাল যখন আমি আসতেছিলাম ঢাকা থেকে, এত দুঃখের মধ্যে না খেয়ে কষ্ট পেয়েছে, গায়ে কাপড় নাই, কত অসুবিধার মধ্যে তারা বাস করতেছে। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ লোক দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে আমাকে দেখবার জন্য, আমি মাঝে মাঝে প্রশ্ন করি তোমরা আমাকে এত ভালবাসো কেন?

কিন্তু সেই দুঃখী মানুষ দিনভরে পরিশ্রম করে, তাদের গায়ে কাপড় নাই, তাদের পেটে খাবার নাই, তাদের বাসস্থানের বন্দোবস্ত নাই, লক্ষ লক্ষ বেকার, পাকিস্তানিরা সর্বোস্ব লুটে নিয়ে গেছে, কাগজ ছাড়া আমার জন্য কিছু রেখে যায় নাই। বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে আমাকে আনতে হয়, আর এই চোরের দল আমার দুঃখী মানুষের সর্বনাশ করে এরা লুটতরাজ করে খায়।

আমি শুধু ইমার্জেন্সী দেই নাই, এবার আমি প্রতিজ্ঞা করেছি যদি পঁচিশ বছর এই পাকিস্তানি জালেমদের বিরুদ্ধে জিন্নাহ থেকে আরম্ভ করে গোলাম মোহাম্মদ, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, আইয়ুব খান, এহিয়া খানের বিরুদ্ধে বুকের পাটা টান করে সংগ্রাম করে থাকতে পারি, আমার ত্রিশ লক্ষ লোকের জীবন দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারি তাহলে পারবোনা? নিশ্চয়ই ইনশাআল্লাহ পারবো, এই বাংলার মাটি থেকে দূর্নীতিবাজ, এই ঘুষখোর, মুনাফাখোরী, এই চোরচালানীদের নির্মূল করতে হবে।

আমিও প্রতিজ্ঞা নিয়েছি, তোমরাও প্রতিজ্ঞা নাও।
বাংলার জনগণ প্রতিজ্ঞা গ্রহন করুক।

এই প্রতিজ্ঞা কি আজকের আওয়ামী লীগের নেতারা নিতে পারবেন? যে বঙ্গবন্ধুর নামে তাঁরা বৈতরণী পার হন সেই বঙ্গবন্ধুকে আসলে তাঁরা কতটুকু ধারন করেন তা বঙ্গবন্ধুর এই ভাষনের অংশবিশেষের সাথে মেলালেই দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৯৭৪ থেকে ২০১৭ দীর্ঘ সময় পার হয়ে এসেও কি এতটুকু পরিবর্তন এসেছে? বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, "এখনও ঘুষখোর, দূনীতিবাজ, চোরাকারবারী, মুনফাখোরী বাংলার দুঃখী মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে।" সাথে যুক্ত করা যায় এদের প্রত্যেকে ক্ষমতাশীলদের মদদপুষ্ট। আওয়ামীলীগ কিংবা বিএনপি ক্ষমতায় যারাই থাকুক না কেন?
বঙ্গবন্ধুর মত কথা বলার ক্ষমতা রাখেন বা মনে প্রাণে ধারণ করেন এমন একজন নেতাও কি আমাদের সামনে আছেন? নেই। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। এ জাতীর দুর্ভাগ্য।

আর তাই এ দেশে বর্তমান নেতাদের দ্বারা যত জোটই গঠিত হোক না কেন শেষ পর্যন্ত তা কোন কাজে আসবে না। আমাদের চাই এমন নেতা যিনি সত্যিকারের বিপ্লবী। যিনি কেবল দেশকে নিয়ে ভাবেন, দেশের মানুষকে নিয়ে ভাবেন । বঙ্গবন্ধুর মত অত বড় মাপের না হন অন্তত তাঁর অনুসৃত নীতিতে চলার সাহস রাখেন এমন নেতৃত্ব চাই। যার কাছে দলের নেতা কর্মীর ভাল মন্দের আগে বিবেচ্য দেশের মানুষের ভাল মন্দ। আমাদের নেতারা চাঁদাবাজি বন্ধে পদক্ষেপ নেন না তাহলে তাদের নেতা কর্মীরা কি খাবে এই ভেবে। পুলিশের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেন না বিরোধী পক্ষকে সামলাতে তো পুলিশ লাগবে, এই ভেবে।

নেতা কর্মীরা নিজ নিজ এলাকার রাজা। ইলেকট্রিক বাইক থেকে শুরু করে ট্রাক, চাঁদাবাজির হাত থেকে নিস্তার নেই কারো। নেতারা কি জানেন না কারা করে এই চাঁদাবাজি? জানেন, ব্যবস্থা নেন না। কারণ একটাই, এ দেশে বলপ্রয়োগের রাজনীতি চলে। আর সে বলপ্রয়োগের জন্য চাই ক্যাডার। বিনিময় ছাড়া সময় মত ক্যাডার পাবেন কোথায়? সাধারণ মানুষের সবথেকে বড় বিপদটাই এখানে। সর্বত্রই মাসলম্যানের দৌড়াত্ম। সবাই জানেন অথচ সবাই চুপ।

আজ অবধি এ দেশে কোন রাজনৈতিক দল কি এদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছে? নামেনি। নামার কোন সম্ভাবনাও নেই।

বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আদর্শিত(!) আমাদের অর্থমন্ত্রী মহোদয় ঘুষকে জায়েজ করতে এর নামকরণ করেছেন স্পীড মানী। তাঁর কাছে দেশের চার হাজার কোটি টাকা লোপাট কোন বিষয়ই না। যদিও তাঁর ব্যক্তিগত একাউন্টের চার লক্ষ টাকা লোপাট হলে সেটা কোন বিষয় হত কিনা সেটা তিনি বলেন নি। পুঁজিবাজার কেলেঙ্কারিতে শত শত ব্যবসায়ী সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসলেন কি হল তাতে? যে মরেছে সে মরেছে দায় নীল না কেউই।

এরপরেও কিন্তু মানুষ রাস্তায় বের হয় না। হাজারটা ইস্যু থাকা স্বত্বেও এ দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা কিন্তু বেগম জিয়ার ডাকে সারা দিয়ে শাপলা চত্বরে সমবেত লেবাস ধারী ধর্মীয় নেতাদের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। কারণ, একটাই এদের সবাইকেই চেনা হয়ে গেছে।

এখন প্রয়োজন সেই হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। ভালমন্দ তো পরে আগে তাঁর মোহনীয় সুরে বিভোর তো হই। তারপরে যদি আরেকবার প্রতারিত হই সেও ভাল। আওয়ামী লীগ বিএনপি তো অন্তত নিজেদের শোধরানোর একটা চেষ্টা করবে। আত্নরক্ষার্থে হলেও আত্নসমালোচনা করতে শিখবে একে অন্যকে ধ্বংসের পথ পরিহার করে নিজেদের রক্ষায় ব্যাপৃত হবে।