ব্লু হোয়েল এবং অভিভাবকদের উদাসীনতা

মোঃ গালিব মেহেদী খান
Published : 12 Oct 2017, 07:13 AM
Updated : 12 Oct 2017, 07:13 AM


আমি আমার ছেলেকে দিনে বহুবার বলি, তোমার মত ভাল ছেলেই হয় না। এতে তার দুষ্টুমির মাত্রা বাড়ে না। বরং সে কথা শোনে। সে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। সে তার সাধ্যাতীত চেষ্টা করে।

আপনিও আপনার সন্তানের প্রশংসা করুন। অন্যকেও প্রশংসা করতে বলুন তার মধ্যে প্রশংসার ক্ষুধা সৃষ্টি করুন। প্রশংসার মাধ্যমেই তাকে কথা শোনানোর চেষ্টা করুন। এমনও হয় মাঝে মাঝে সে সাধারণ কোন একটা কাজ করে প্রশংসা পেতে ছুটে আসে বাবার কাছে। আমি তার থেকেও বেশি এক্সাইটমেন্ট প্রদর্শন করে তাকে প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়ে দিতে চেষ্টা করি। তার মানে কিন্তু এই না যে আমি তাকে শাসন করি না। প্রয়োজনে শাসনও করি। হয়ত তার একটা কাজ করা উচিৎ সে করছে না। আমি তাকে বলি, এক থেকে তিনি গুনব তুমি এর মাঝে কাজটি শুরু করবে। সে তিন গুনতে না গুনতেই অনিচ্ছাসত্ত্বেও কাজটি শুরু করে অথচ এই ছেলেকেই মেরেও কোন কাজ করানো যায় না।

যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি আপনার সন্তানের গায়ে হাত না তুলবেন ততক্ষণ পর্যন্ত সে মার কে ভয় পাবে। মার খাওয়ার লজ্জা পাবে যা আপনার সন্তানের শাষণ করাকে সহজ করে দেবে। সন্তানকে খারাপ, দুষ্টু এ সব বলে বলে তাকে নির্লজ্জ, বেহায়া বানিয়ে ফেলবেন না। তাকে বকা দিলে সেও মুখে মুখে তর্ক করবে, তাকে মারলে তার ভয় কেটে যাবে। সে আপনার কোন কথাই শুনবে না। অতএব তাকে ভালবাসুন। মা-বাবা হিসেবে আপনি অবশ্যই তাকে ভালবাসেন সে ভালবাসাটা তাকে বুঝতে দিন। তার প্রশংসা করুন তাতে সে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে। সে যদি বলে এটা আমি করতে পারব না আপনি তাকে অভয় দিন। বলুন তুমি পারবে। তোমার সে ক্ষমতা আছে তুমি চেষ্টা করে দেখ।

আপনার সন্তানের হাত দিয়ে মানুষকে সাহায্য করুন। সে দান করতে শিখবে। আপনার আজকের ছোট্ট শিশুকে তার বড় বেলায় আপনি তাকে যেভাবে দেখতে চান সেভাবে আপনাকেই গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষক কিংবা অন্য কারো উপরে নির্ভর করলে ভুল করবেন।

আপনার সন্তান শিশু থেকে কৈশোরে পা রাখছে আর ক্রমশ আপনার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে আপনি কি খেয়াল করছেন? এতদিন যে শিশুটি তার বাবার বুকে মুখ গুজে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ত আপনি তাকে এখন বড় হয়েছ বলে আলাদা বিছানায় তুলে দিয়েছেন। সে যে একাকিত্বে ভুগছে সেটা লক্ষ্য করেছেন? সে ভাবতে শুরু করেছে মা-বাবা এখন আর আমাকে ভালবাসে না। সে দিন দিন হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ছে। এমনিতেই এই বয়সটায় তাকে আবেগ ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তার উপরে তাকে ক্রমশ প্রিয়জনের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে হচ্ছে। সে তো বিপথগামী হবেই।

এসময় সে বন্ধু খোঁজে, সে অবলম্বন খোঁজে। মা-বাবার থেকে আর ভাল অবলম্বন কে হতে পারে? সেও এতদিন ধরে সেটাই জানত কিন্তু যখন থেকে মা-বাবা কেবল শাসন করতে শুরু করল, তাকে একাকী করে দিল। যখন থেকে না বুঝিয়ে কেবল বিধি নিষেধের দেয়াল তুলে দিতে শুরু করল তখন থেকেই সে ভাবতে শুরু করল মা-বাবা পুড়নো ধ্যান-ধারণার মানুষ। তারা কম বোঝে। এমন কি এখন আর তারা তাকে আগের মত ভালও বাসেন না। কাজেই সে বন্ধু খুঁজতে শুরু করল বাইরে আর এখন তো হাতেই আছে অনলাইনে বন্ধুত্বের হাতছানি। যা তাকে সম্পুর্ন ভিন্ন একটি জগতে নিয়ে যায়। যা তাকে আপনার থেকে ক্রমশঃ দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। দায়টা কিন্তু অভিভাবক হিসেবে আপনারই।

আমাদের দেশের কিশোর সমস্যায় নতুন যুক্ত হয়েছে ব্লু-হোয়েল এর মত মরণ নেশা গেম। এ নেশায় কারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে একবার ভেবে দেখেছেন? একাকীত্ব যাদেরকে সারাক্ষণ ঘিরে রাখে। পরিবারের সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক যাদের নেই। উঠতি বয়সের কিশোর কিশোরীরা, যারা চায় পরিবারের সাহচর্য অথচ পায় না। যাদের সামনে কোন আদর্শ নেই, লক্ষ্য নেই। তারাই এ সব সমস্যায় বেশি জড়িয়ে পড়ছে। এরা আমার-আপনার, আমাদেরই সন্তান। তাদেরকে এই সব সমস্যা থেকে বের করে আনতে আমাদেরই উদ্যোগী হতে হবে।

আমরা যেন আমাদের সন্তানদের আরেকটু সময় দেই। তাদেরকে আরেকটু কাছে টেনে নেই। তাদের অলস সময়টাকে আনন্দময় করে তোলার চেষ্টা করি। সময়ের প্রয়োজনে তাঁরা আলাদা শোবে একটু দুরত্ব তৈরি হবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু সেটা যেন কোনভাবেই তাদেরকে একাকী করে না ফেলে। তারা যেন কোনভাবেই হতাশাগ্রস্থ না হয়ে পরে। তাদের নতুন বন্ধুদের খোঁজ রাখতে হবে। তারা অলস সময়টা কিভাবে কাটায় সে খবর রাখতে হবে। সর্বোপরি একটা আনন্দমুখর পারিবারিক পরিবেশ তাদের দিতে হবে। যদি সেটা করা যায় তাহলে, ব্লু-হোয়েল কেন, কোন নেশাই তাকে আচ্ছন্ন করতে পারবে না। দায়িত্বটা অভিভাবকদেরকেই নিতে হবে।

সমস্যা সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকলে তার সমাধানও সহজ হয়ে যায়। ব্লু হোয়েলের নির্মাতা সেন্ট পিটার্সবার্গ নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ফিলিপ বলেন, 'যেখানে মানুষ আছে সেখানে কিছু জীবন্ত বর্জও (মানুষ) আছে। ওইসব মানুষের সমাজে কোনো প্রয়োজন নেই। তারা হয় নিজেরা সমাজের জন্য ক্ষতি, না হয় তারা সমাজের ক্ষতির কারণ। আমি সমাজের ওইসব বর্জ্য পরিষ্কার করতে চাই।' তাহলে আমরা আমাদের সন্তানদের বলতে পারি যে তুমি যে এই গেমটি খেলছ তোমাকে কিন্তু সমাজের আবর্জনা হিসেবে ধরে নিয়ে খেলা হচ্ছে এবং তোমার ধবংসই তাদের উদ্দ্যেশ্য। এর নির্মাতা ফিলিপ নিজেও একজন মানসীক রোগী। কথা হল আপনি জানবেন কিভাবে যে আপনার সন্তান এমন একটি ভয়ঙ্কর খেলা খেলছে। জানতে হলে তার সাথে মিশতে হবে, তাকে সময় দিতে হবে। তার বন্ধু হয়ে উঠতে হবে। তবেই না সমাধানের চেষ্টা করতে পারবেন।

আপনার সন্তানের মাঝে যখনই কোন পরিবর্তন দেখতে পাবেন তার কারণ খুঁজে বের করুন। দেখবেন সমাধান সহজ কিন্তু আপনি নিজেই যদি উদাসীন থাকেন তাহলে তো সে উচ্ছন্নে যাবেই। তার হাতে স্মার্ট ফোন সহজলভ্য ইন্টারনেট তাকে নিয়ে যাচ্ছে নীল ছবির দুনিয়ায়। অচেনা অজানা তার অনলাইনের-অফলাইনের বন্ধুরা তাকে নিয়ে মেয়েদের টিজ করে। সে উপভোগ করে আপনি খোঁজ না রাখলে চলবে কি করে? একটা কথা মনে রাখবেন, অভিভাবক বনে যাওয়া যায় সহজেই, হয়ে ওঠাটা সহজ কাজ নয়।

পুনশ্চঃ আপনারা যারা ব্লগ সহ নানা মাধ্যমে লিখছেন। তাদের দায়িত্বটা বোধ হয় আরও একটু বেশি। অসেচতন অভিভাবকদের আপনারাই সচেতন করে তুলতে পারেন।