‘সৃষ্টি’ স্বাধীন সত্তা নয়, সময়ের ধারাবাহিকতায় যুক্ত এক একটি অংশ মাত্র

মোঃ গালিব মেহেদী খান
Published : 8 Nov 2017, 02:16 AM
Updated : 8 Nov 2017, 02:16 AM

ধরুন আপনাকে টাইম ট্রাভেল করে পাঁচ বছর পিছিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হল। আপনি কি করবেন? একই ঘটনাসমূহের পুনরাবৃত্তি করবেন নাকি আপনার জীবনে নতুন কোন ঘটনা যুক্ত হবে? মোটেই না, সেক্ষেত্রেও আপনার জীবনটা একই ধারায় চলবে যেমনটি এখন চলছে। কিছু বিয়োজিত হবে না কিছু যুক্তও হবে না। অনেকটা পূর্ব থেকে প্রোগ্রামিং করে দেয়া একটি যন্ত্রের মত আপনি বারংবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাবেন। আসলে আপনি সেটা করতে বাধ্য, কারণ আপনি নিজেও সময়ের অংশমাত্র। আপনার সাথে জড়িয়ে আছে আপনার পাওয়া সময়ে ঘটে যাওয়া সকল বস্তুগত এবং অবস্তুগত বিষয় সম্পৃক্ত ঘটনাপ্রবাহ। যার উপরে দাড়িয়ে ভবিষ্যৎ রচিত হবে আর সেটাও নির্ধারিত। যদিও আমরা তা জানতে পারি না।

সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই যে ধারাবাহিকতা, এর সাথে সম্পৃক্ত মানুষ থেকে অণুজীব পর্যন্ত। একটি প্রাণঘাতী জীবাণু পর্যন্ত এই ধারাবাহিকতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কাজেই সে ধারাবাহিকতা রক্ষা করতেই আপনি পুনরায় একই ঘটনাসমূহের পুনরাবৃত্তি করতে বাধ্য। নয়ত সৃষ্টি জগত সুশৃঙ্খলভাবে তার শেষ নিয়তি অবধি পৌঁছুতে সক্ষম হবে না। সৃষ্টি জগতের নিয়মের ব্যত্যয় ঘটবে। আর সেটা কোনোভাবেই প্রকৃতি মেনে নেবে না।

সৃষ্টি জগতে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে সৃষ্টি ধ্বংস হতে বাধ্য। এমন কি এই সৃষ্টি জগতের বয়সসীমা পর্যন্ত নির্ধারিত! যা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় প্রমাণিত। সৃষ্টি জগতে বিদ্যমান প্রতিটি বস্তুর কার্যকারিতা রয়েছে আর তা ছকবদ্ধ। প্রতিটি বস্তুর শুরু আছে, শেষ আছে। কোন কিছুই অবিনশ্বর নয়। এমন কি প্রতিটি বস্তুর রয়েছে আলাদা ধর্ম যার বাইরে তার কোন কার্যকারিতাই থাকে না।

তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, সৃষ্টি কি আসলেই স্বাধীন সত্তা? নাকি সময়ের ধারাবাহিকতায় যুক্ত এক একটি অংশ মাত্র। যে কেবল পূর্ব নির্ধারিত ক্রিয়া কর্মই সম্পাদন করে চলেছে অবিরাম অর্থাৎ সৃষ্টি সময়ের ক্রীড়নক মাত্র?

সাধারণ ভাবনা হল, সৃষ্ট বস্তু স্বাধীন। তাদের ইচ্ছাধীন কর্মকাণ্ডে সময় নিজেকে সম্পূর্ণ করে সামনে এগিয়ে যায় মাত্র। এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে গেলে যে সমস্যাটা হয় তা হল- সৃষ্টি স্বাধীন হলে সৃষ্টি জগত তার নির্দিষ্ট নিয়মে চলতে পারবে না। সে ক্ষেত্রে পৃথিবীতে যখন যে প্রাণের সন্নিবেশ হওয়ার কথা তা হবে না। আবার যার সন্নিবেশ ঘটেনি তার ঘটার সম্ভাবনা দেখা দেবে। এটা অস্বাভাবিক। যা এই প্রকৃতি কখনোই মেনে নেয় না।

যেমন সৃষ্টির একটি স্বাভাবিক নিয়ম হল যার একবার বিলুপ্তি ঘটে তা আর ফিরে আসে না। আর সেটা মাথায় রেখেই মানুষ পরবর্তী পৃথিবীকে সাজায়। আমরা নিশ্চিতভাবেই ধরে নিয়েছি ডাইনোসরের আর আগমন ঘটবে না। এই নিশ্চয়তা আমরা পেয়েছি প্রকৃতির চিরায়ত নিয়ম ঘেঁটে। যদি সে নিয়মে ব্যত্যয় ঘটে তাহলে কি হতে পারে সেটা স্পিলবার্গ তার সিনেমায় দেখিয়েছেন। সেই বিভীষিকার মধ্যে আমরা পরে যেতাম। এ গেলো একদিক। আরেকটি বিষয় ভাবুন যদি হিটলার একজন দরদী মনের মানুষ হতেন। যদি সে সারা বিশ্বকে পদানত করার মরন খেলা না খেলত তাহলে কি হত? দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ হত না। বিশ্ব রাজনীতির এই রূপ দেখা যেত না। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব মোড়ল হতে পারত না। আজকের পৃথিবী হত সম্পূর্ণ অন্যরকম। তার থেকে বড় কথা যে মানুষগুলো মারা গেল যে পরম্পরা গুলো তৈরি হতে পারল না, সেগুলো তৈরি হত। কিন্তু সেটা তো হওয়ার নয়। হিটলার এমনটা করতে বাধ্য এটা প্রকৃতি কর্তৃক নির্ধারিত। সৃষ্টি স্বাধীন হলে সৃষ্টির কর্মকাণ্ডে প্রকৃতির চিরায়ত নিয়ম ক্ষণে ক্ষণে পালটে যেত। যা স্মরণকালে ঘটেনি আর আগামীতেও ঘটার সম্ভাবনা নেই।

আমরা খুব সাধারণ ভাবে দেখতে পারি, মানুষের জীবনে এমন অনেক ঘটনাই ঘটে যা সে ভাবতেও পারে না, আশা করে না। এমন এমন অবস্থা তৈরি হয়ে যায় যেখান থেকে একজন মানুষ হাজার চেষ্টা করেও বেরিয়ে আসতে পারে না। কারণটা কি? নিয়তি বলি বা পূর্ব নির্ধারিত প্রোগ্রামিং করা বলি বিষয়টা তো তাই দাঁড়ায়।

আপনাকে জীবনে এমন কিছু অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে যেখানে একেবারেই আপনার ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেনি। আবার আপনি চাইলেও সেখান থেকে বেড়িয়ে আসতে পারেন না। অতএব আমাদের পূর্বের সিদ্ধান্তেই ফিরে যেতে হচ্ছে, সৃষ্টি সময়ের ক্রীড়নক মাত্র। যদি তাই হয় তাহলে যে অপরাধ করছে তার দায় কতটা? সে প্রশ্নও তো থেকে যায়?

আবার দেখুন পৃথিবী বহু সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেছে সেটাও কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়মেই। পুরাতন সে সব সভ্যতা যারা গড়ে তুলছিলেন তারা কেন অমোঘ নিয়তিকে এড়াতে পারলেন না? যদি তা মানুষেরই নিয়ন্ত্রণাধীন হত। ধর্ম গ্রন্থের কল্যাণে আমরা এও জানি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধবে এবং পৃথিবী ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাবে। সে রকম আলামতও ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। পরিণতি জেনেও বিশ্ব কিন্তু সে দিকেই ধাবিত হচ্ছে। তাহলে কি ধরে নেব যে, সবই পূর্ব নির্ধারিত?