রাষ্ট্র তার সেবায় সর্বোচ্চ মেধাবীদের বেছে নিক

মোঃ গালিব মেহেদী খান
Published : 16 April 2018, 04:17 AM
Updated : 16 April 2018, 04:17 AM

ক'দিন ধরে দেশে নতুন আন্দোলনের ঢেউ উঠেছে, 'চাকরিতে কোটা সংস্কার করতে হবে'। আবার জেগে উঠেছে শাহবাগ। দাবি আদায়ের পাদপীঠ হয়ে ওঠা শাহবাগ আবার দেখতে পেল একটি দাবি নিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত জনতার ঢল। কোটা নিয়ে এদেশের মানুষের মধ্যে বহুদিন ধরেই এক ধরনের চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছিল। কারণ এটা হচ্ছে একটি ঘোষিত বৈষম্য, যা হয়ত একটা সময়ের প্রেক্ষাপটে ভীষণ প্রয়োজন ছিল, কিন্তু কালক্রমে তা হয়ে ওঠে মেধার অপচয় আর বৈষম্যের উদাহরণ।

'কোটা সংস্কার' দাবিটা কেবলমাত্র শিক্ষার্থীদেরই দাবি ছিল না। তা আমরা বুঝতে পারি অসংখ্য অভিভাবকদের অশংগ্রহণ থেকেই। সব থেকে লক্ষণীয় বিষয়, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের পরেই যারা সব থেকে লাভবান হতেন সেই নারীদের অংশগ্রহণ এই আন্দোলনকে বেগবান করতে অনন্য ভূমিকা পালন করেছে। গণমাধ্যমের খবর বলছে, এই দাবির সাথে একমত হয়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধার সন্তানও এতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছে, যা এই আন্দোলনকে একটি যৌক্তিক ভিত্তি দিয়েছে। একটি পর্যায়ে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকেও এই দাবির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে দেখেছি।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আমরা সব সময়ই দেখেছি সাধারণ মানুষের ইচ্ছাকে সমর্থন জানিয়ে যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশব্যাপী চলা ছাত্র আন্দোলনের এক পর্যায়ে গত বুধবার (১১ এপ্রিল) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে এক অনির্ধারিত আলোচনায় কোটা পদ্ধতি সম্পূর্ণ তুলে দেয়ার ঘোষণা দেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, "কোটা নিয়ে যখন এতকিছু, তখন কোটাই থাকবে না। কোনো কোটার দরকার নেই। কোটা পদ্ধতি তুলে দিলাম। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সবাই চাকরিতে আসবে। আর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের চাকরির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হবে।" পরদিন সকালে প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন করে আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা।

অন্যদিকে 'আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান' সংগঠনের নেতারা মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ জানায়। তাদের ধারণা, মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত পুনর্বহাল না করা হলে একাত্তরের পরাজিত শক্তিরা জয়ী হবে। কিন্তু এটা তাদের ভুল ধারণা। কোটা পদ্ধতি তুলে দিলে মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করা হবে না। মুক্তিযোদ্ধাদের যে সম্মান জাতির জনক দিয়েছেন সেটা চিরকাল অব্যাহত থাকুক এটা আমরা সবাই চাই। মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া বীর সেনানীরা ও তাদের সন্তান-সন্ততিরা বংশ পরম্পরায় ভাল থাকুক, স্বাচ্ছন্দ্যে থাকুক, সম্মানের সাথে বাঁচুক সেটা সবাই চায়। এ নিয়ে কারো মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব নেই।
তাদের সুযো-সুবিধা আরও বাড়িয়ে দেয়া হোক। তাদের বিভাগীয় শহরগুলোতে, প্রয়োজনে রাজধানীতে একাধিক ফ্ল্যাট দেয়া হোক। তাদের ভাতা দ্বিগুণ করে দেয়া হোক। কিন্তু কোটাভুক্ত করে চাকুরি কেন দিতে হবে? তারা চাকুরি নিবেন নিজেদের যোগ্যতায়। যাতে কেউ তাদের অনুকম্পা করা হয়েছে বলে ছোট করতে না পারে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত যুগান্তকারী। আজকের বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহার। এ দেশের মানব সম্পদকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হবে। এখানে আবেগ দিয়ে বিচার করলে চলবে না। পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠীর জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা যেতেই পারে। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের স্বাচ্ছন্দ্যে রাখতেও রাষ্ট্র অনেক কিছু করতে পারে, কিন্তু তাদেরকে এভাবে কোটাভুক্ত করে মেধার অপচয় রাষ্ট্র করতে পারে না।

একজন বাবা তার সযত্নে গড়া প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব লটারির মাধ্যমে নির্ধারণ করে যে কোন এক সন্তানের হাতে তুলে দেন না। কিংবা তুলনামূলকভাবে অযোগ্য হওয়ায় পিছিয়ে পড়া সন্তানটিকে এগিয়ে নেয়ার মানসে তার হাতে তার সযত্নে গড়া প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব তুলে দেন না। বাবা দায়িত্বটি তুলে দেয়ার জন্য প্রথম থেকেই তার মেধাবী সন্তানটিকে বেছে নেন। তাকে সেভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন, আর এক সময় সব থেকে যোগ্য তার সেই সন্তানের হাতেই প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব তুলে দেন, যাতে তার প্রতিষ্ঠানটির উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি ঘটে এবং তার সন্তানেরাও সবাই ভালো থাকে। তাতে কেউ সে বাবাকে অবিবেচক বলে না, বরং সুবিবেচক বলেই স্বীকার করে নেয়।
একই বিবেচনায় রাষ্ট্রও কি তার সেবায় সর্বোচ্চ মেধাবী সন্তানদের বেছে নেবে না? নাকি রাষ্ট্র কারো 'ব্যক্তিগত সম্পদ' নয় বলে বিবেচনার পারদটা উল্টোমুখী হবে?