ঢাকা নগরবাসীর একটি ‘বদভ্যাস’ যত্রতত্র মূত্র ত্যাগ করা। সন্দেহ নেই এটা সত্যিই একটি খারাপ কাজ। কিন্তু একে বদভ্যাস বলাটা কতটা সঙ্গত সেটা নিয়ে আমার প্রশ্ন রয়েছে। বদভ্যাস আমরা তাকেই বলি যা ইচ্ছে করলেই এড়িয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু এই সমস্যাটা কি মানুষ ইচ্ছে করেই করছে? নাকি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অনিচ্ছা স্বত্বেও বাধ্য হয়ে করছে?
২০১৫ সালের ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম সংক্রান্ত একটি ডকুমেন্টারিতে এ সমস্যা মোকাবেলায় একটি ‘স্মার্ট সমাধানের’ কথা বলা হয়েছে। সেখানে ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান বলছেন, “ঢাকার একটি গর্বের পরিচয় আছে, যা তাকে পবিত্র শহরের আমেজ দেয়। ঢাকা মসজিদের নগরী। এ শহরে আছে ১০ হাজারের বেশি মসজিদ। প্রতিটি মসজিদে পাবলিক টয়লেট সুবিধা রয়েছে। সেখানে যে কোনো মানুষ সহজেই তার জরুরি কাজটি সারতে পারেন। আরও আছে সিটি করপোরেশনের পাবলিক টয়লেট। মোবাইল টয়লেটের ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু এসব সুবিধা কতজনে নেন?”
তার মানে সুযোগ থাকা স্বত্বেও মানুষ সেটি গ্রহণ না করে এই অসদাচরণটি করছে। আসলেই কি তাই?
.
মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় হয়ত জানেন না, ঢাকার প্রায় প্রতিটি মসজিদের টয়লেটগুলি সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বন্ধ থাকে। জোহরের আজানের পরেই কেবল এই টয়লেটগুলি খুলে দেওয়া হয়। ঘন্টা খানেক বাদে আবার এগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর পরে আবার আসরের আজানের পরে খোলা হয়। ঠিক এভাবেই নিয়ম করে প্রতি ওয়াক্ত নামাজের আগে-পরে এগুলি খোলা থাকে। যে সময়টায় মূলত মুসল্লিরাই টয়লেটগুলি ব্যবহারের সুযোগ পান।
সমস্যা হল, প্রকৃতির ডাক তো আর নামাজের ওয়াক্ত অনুযায়ী আসে না। যে কোন সময়েই আসতে পারে। তাছাড়া মসজিদগুলোতে টয়লেটের সংখ্যাও নেহায়েত নগণ্য। এখানে আরও একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। আর তা হল, প্রায় দুই কোটি লোকের বাস এই মহানগরীতে। যার বেশির ভাগ মুসলমান হলেও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যাও কম নয়। তারা চাইলেই কি এসব টয়লেট ব্যবহার করতে পারেন?
আমি বলছি না যে, কেউ তাদের বাধা দেন। সমস্যা হল, যতক্ষণ পর্যন্ত না এটা সকলের জন্য উন্মুক্ত বলে ঘোষিত হবে ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ চাইলেও মসজিদের টয়লেট ব্যবহার করতে পারেন না। একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তাকে বাধ্য করে মসজিদের টয়লেট ব্যবহার না করে রাস্তার পাশে বসে যেতে।
অন্যদিকে আমাদের আরেকটি বড় অংশ, নারীদের কথা তো ভাবনাতেই নেই হয়তো। পুরুষরা তো চাইলে লজ্জা হজম করে যত্রতত্র মূত্র ত্যাগ করতে পারেন, কিন্তু নারীরা তো পড়েন অসুবিধায়।

ঢাকায় যেখানে-সেখানে পাবলিকের প্রস্রাব করার ‘বদভ্যাস’ বন্ধ করতে প্রথমে দেয়ালে দেয়ালে লেখা হল ‘এখানে প্রস্রাব করবেন না’ কিংবা ‘প্রস্রাব করলে জরিমানা’ জাতীয় নির্দেশনা।
তবে তাতে লাভ হল না। কারণ একটাই। কাজটা কেউ শখের বসে করে না। নিতান্ত বাধ্য হয়েই করে। সুফল না পেয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয় আরবি ভাষার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করল। আরবিতে লেখা হল ‘হুনা মামনু আত্তাবুল’ বা ‘এখানে প্রস্রাব করবেন না’। তাতেও কি লাভ হলো? হলো না।
এখন কেউ রাস্তায় প্রস্রাব করতে বসলে আরবি ভাষায় লেখাগুলো তার চোখে পরে। সে অপ্রস্তুত হয়। আত্মগ্লানিতে দগ্ধ হয়। তারপরও অসহায়ের মতো বাধ্য হয়েই ‘নোংরা’ কাজটি করেন।
অথচ এর সহজ সমাধানটা কিন্তু মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় বলেই দিয়েছেন। দশ হাজার মসজিদ আছে। অর্থাৎ লক্ষাধিক প্রস্রাবখানা আছে। সেই সাথে আছে মোবাইল টয়লেট। আছে পাবলিক টয়লেট।
তাহলে আর সমস্যাটা রইল কোথায়? সমস্যা হল, মসজিদের ঐ লক্ষাধিক পাবলিক টয়লেট উন্মুক্ত নয়।
আমরা একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পাব ঢাকার সব থেকে জনবহুল এলাকা গুলিস্তান মাজার। যেখানে প্রতিনিয়ত কয়েক লাখ লোক যাওয়া-আসা করছে। সেখানে কিন্তু কোথাও প্রস্রাবের দুর্গন্ধ পাওয়া যায় না। ঠিক এভাবেই গুলিস্তানের আলু বাজার একটি জনবহুল এলাকা। সেখানে যে মসজিদটি অবস্থিত তার টয়লেটটি টাকার বিনিময়ে যে কেউ ব্যবহার করতে পারে বলেই এখানেও নেই কটু গন্ধ সমস্যা।
তবে নিউমার্কেট এলাকার দিকে দৃষ্টি ফেরালে পাবলিক টয়লেট কিংবা মসজিদের টয়লেট খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। ফলাফল হলো যেই মাত্র ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদ করা হলো অমনি সেটা উন্মুক্ত প্রস্রাবখানা হয়ে গেল। আগে সেখান থেকে চলতে গেলে মানুষের ভিড় সামলাতে হত। আর এখন নাক চেপে চলতে হয়।
আসল কথা হল আমরা তো আর কাউকে প্রস্রাব করা থেকে বিরত থাকতে বলতে পারি না। বলতে পারি নির্দিষ্ট স্থানে প্রস্রাব করতে। সেটা বলতে হলে অসংখ্য পাবলিক টয়লেট প্রয়োজন। এত স্থান কোথায়? কাজেই সহজ সমাধানটাকে কাজে লাগানোই উপযুক্ত। মসজিদের টয়লেট সংখ্যা বৃদ্ধি সাপেক্ষে সেগুলিকে উন্মুক্ত করে দেয়া জরুরি। একই সাথে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে সেটা প্রচার করতে হবে।
যাতে যে কেউ যে কোন সময়ে নির্দ্বিধায় সেগুলি ব্যবহার করতে পারে। প্রয়োজনে তা নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে হলেও। এতে করে নারীরাও আর সমস্যায় পড়বেন না। এটা যদি করা যায় দেখবেন রাতারাতিই সমস্যাটা দূর হয়ে গেছে।
সুযোগ সৃষ্টি না করে প্রতারণামূলক ভীতি প্রদর্শন আর যাই হোক স্মার্ট সমাধান হতে পারে না। স্মার্ট সমাধান হল সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা। আশা করছি বিষয়টা মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা ভেবে দেখবেন।
আইরিন সুলতানা বলেছেনঃ
পাবলিকট টয়লেট একটি সমস্যা। ফুটপাতে প্রস্রাবের দুর্গন্ধ একটি সমস্যা। তবে এই সমস্যা নিয়ে বলতে গিয়ে এর সাথে লেখক অথবা নাগরিক সাংবাদিক এমনকি নাগরিক হিসেবেও ন্যায় করেননি বলে মনে হয়েছে আমার। আর তাই মন্তব্য করতেই হল।
ধর্ম মন্ত্রনালয়ের ওই ডকুমেন্টারিটা ২০১৫ সালের, মানে ৩ বছর হয়ে গেছে। সেই ডকুকে রেফার করে এখন ধর্মমন্ত্রী বা ধর্ম মন্ত্রনালয়কে কিছু বলা মানে হল নিজে একেবারেই আপডেটেড না থাকা।
তিন বছর আগেই এই ডকু নিয়ে প্রচুর আলোচনা ও সমালোচনা হয়ে গেছে। আমার নিজেরও একটি লেখা ছিল সে সময় – আরবি নয়, ’গণশৌচাগার ম্যাটারস’
নিশ্চয়ই আমরা যারা লিখি, তারা লেখার আগে বা লেখার সময় কিছুটা হলেও চোখ-কান খোলা রেখে অনলাইন সার্চ নিয়ে লেখার বিষয়বস্তুর সম্পূরক ও সম্পর্কিত তথ্য-প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি জানার চেষ্টা করি এবং আগামীতেও করবো। তা না হলে সেটা বিষয়বস্তুর সঙ্গে ও পাঠকের সঙ্গে ন্যায় হয় না।
কিন্তু একে বদভ্যাস বলাটা কতটা সঙ্গত সেটা নিয়ে আমার প্রশ্ন রয়েছে। — পুরুষ ও নারীর প্রস্রাবের বেগ আলাদা হওয়ার কোনো কারণ নেই। নগরীতে অবশ্যই পাবলিক টয়লেট অপ্রতুল। কিন্তু সেটা যদি যাওয়া যায় তো পুরুষেরাই যেতে পারেন, নারীরা নয়। তাহলে যে নগরীতে লাখ লাখ নারী-পুরুষ চলাচলা করেন, সেখানে কেবল পুরুষেরাই খোলা জায়গায় বসে প্রস্রাব করে ফেলেন কেন?? নারী যদি প্রস্রাব আটকে রাখতে পারেন, তাহলে পুরুষেরও সেটা করতে পারে। সুতরাং, এটা বদভ্যাস নয়, এমন জাস্টিফিকেশন দাঁড় করানোটা মানা যাচ্ছে না।
এখন কেউ রাস্তায় প্রস্রাব করতে বসলে আরবি ভাষায় লেখাগুলো তার চোখে পরে। — আপনার লেখার এই অংশে এখন বলতে কী বোঝাচ্ছেন? এই ২০১৮ সালে?
দেয়াল লিখন তো কিছুদিন পর পরই মুছে আবার নতুন কিছু হয়। ওই আরবী লেখা ধর্ম মন্ত্রনালয়ও ওই সময়ের পরে লেখেনি। তাহলে ৩ বছর ধরে কোন দেয়ালে সেই আরবী রয়ে গেল সেই জায়গার নাম-ধাম দিতে হতো।
একই সঙ্গে দিতে হতো ওই আরবী লেখা ফুটপাত/রাস্তার ছবি। এই পোস্টে পুরনো ছবি ব্যবহার করা হয়েছে , সেটা ওই সময় গণমাধ্যমের তোলা, আপনার তোলা নয়।
মসজিদের টয়লেট সংখ্যা বৃদ্ধি সাপেক্ষে সেগুলিকে উন্মুক্ত করে দেয়া জরুরি। এই প্রস্তাবটি সচেতন চিন্তায় গ্রহণযোগ্য হওয়ার কথা নয়। একজন নাগরিক হিসেবে পাবলিক টয়লেটের দাবি হতে পারে। বিশ্বে আধুনিক পাবলেট টয়লেটের মত দেশেও কীভাবে তা করা যায়, সেই পরামর্শ হতে পারে।
মসজিদে গিয়ে প্রস্রাব করাটা কেমন সমাধান??? আর আমাদের সমাজে নারীরা মসজিদে যায় কি???
তারচেয়েও বড় কথা, প্রস্রাব সব ধর্মের মানুষই করে। এভাবে মসজিদের টয়লেট ব্যবহার করতে বলা তাই আপত্তিকর।
ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ব্লগের বর্ষপূর্তির যে আয়োজন হয়েছিল, সেখানে মেয়র এসেছিলেন। তিনি সেদিন পাবলিক টয়লেট নিয়ে বলেছিলেন। এমনকি ওই অনুষ্ঠান শেষে তিনি কোনো একখানে যাচ্ছে পাবলিক টয়লেট উদ্বোধনে এমনটিও বলেছিলেন।
আপনি সেই আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন। নাগরিক সাংবাদিক হিসেবে নগরপ্রধানের সঙ্গে মুখোমুখিতে এমন একটি নাগরিক সমস্যা নিয়ে যে কথা হলো, সেটা কোনোভাবেই এই লেখায় উঠে না আসাটা হতাশাজনক।
একই সঙ্গে যেটা বলা আবশ্যক ছিল তা হচ্ছে, গত ৩ বছরে ঢাকাতে বেশ কিছু ভাল ভাল পাবলিক টয়লেট হয়েছে। যেগুলোর কোনো কোনোটি এখনও চমৎকারভাবে মেইনটেইন করা হচ্ছে। এই উদ্যোগের কথা এই লেখায় অনুপস্থিত থাকায় লেখাটি না সমস্যাকে তুলে ধরায় জাস্টিফাই করতে পেরেছে, না এর সমাধানে।
নগর নাব্য – মেয়র সমীপেষুতে পাবলিক টয়লেট সংকট নিয়ে লেখাও গিয়েছিল। আপনি নগর নাব্য – মেয়র সমীপেষু সংগ্রহ করেছিলেন??
উত্তরার দিকে যেতে রেডিসন হোটেলের পর, যে ডিজিটাল ফুটপাত করার কথা ছিল, সেখানে ফাইভ স্টার মানের পাবলিক টয়লেট করার কথাও শোনা গিয়েছিল। ওদিকে এটার অবকাঠামোও করা হয়েছিল। হয়ত মেয়র আনিসুল হকের অসুস্থতা ও মৃত্যুর কারণে এবং ওইদিকের সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থগিত হয়ে যাওয়ায় এই প্রজেক্টটাও স্থবির হয়ে গেছে।
ধারনা করি চলতি পথে ওদিকটা দেখেছেন। নিউজে পড়েছেন। অথচ এ ধরনের কোনো তথ্য যা এই লেখায় যুক্ত হতে পারতো তা উঠে আসেনি।
চিন্তা চোখ-কান খোলা রেখেই আমরা করবো। কেবল ল্যাপটপ কেন্দ্রিক লেখালেখিটা চিন্তা নয়। বিশেষত, যখন লেখক ও নাগরিক সাংবাদিক হিসেবে এমন একজন লিখছেন যিনি অনলাইনে নতুন নন, এমনকি এই ব্লগেও নতুন নন।
মন্তব্যটা দীর্ঘ হয়ে গেল তাই দু:খিত। একটু চাছাছোলাও হয়ে গেছে, তবে যেহেতু পোস্টটিও সমালোচনামূলক ছিল, তাই আপনার সমালোচনাও তো হতেই পারে। শুভেচ্ছা।
মোঃ গালিব মেহেদী খান বলেছেনঃ
চাছাছোলা সমালোচনার জন্য আইরিন আপাকে অশেষ ধন্যবাদ।