ইভটিজিং এবং আমাদের ভূমিকা

মোঃ গালিব মেহেদী খান
Published : 20 May 2012, 06:07 PM
Updated : 20 May 2012, 06:07 PM

ইভটিজিং যে এখন সামাজিক ব্যাধিতে রুপ নিয়েছে সে ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। আমরা যদি এর সঠিক কারন নির্নয় না করে এলোমেলো চিকিৎসা দেয়া শুরু করি তাহলে এর প্রভাব কমবে না বরং আরো বেশি সংক্রামিত হবে। হচ্ছেও তাই। অনেকটা এইডস প্রতিরোধকল্পে নেয়া জন্ম নিরোধক সরবরাহের ব্যবস্থার মত। এখানে দোষারোপের অবকাশ নেই। এর জন্য দায়ী কম বেশি আমরা সবাই। আমাদের মগজে ধরছে পচন। আমরা সবাই স্বার্থান্ধ হয়ে গেছি। নিজেকে নিয়েই আমাদের পৃথিবী।

আমার পাশের ফ্লাটে কে থাকে তা আমরা জানি না। প্রতিবেশী বলে যে একটা শব্দ আছে তাই যেন ভূলে গেছি। তারপরে আবার দায়িত্ব পালন! এ কথাগুলো অপ্রাসঙ্গিক নয়। কারন মানুষ সামাজিক জীব। সমাজকে নির্মান করা হয়েছিল মানুষের আর্থ সামাজিক নিরাপত্তার খাতিরেই। আজ প্রযুক্তির উন্নয়নের যুগে এসে আমরা ভাবতে শুরু করেছি আমরা প্রত্যেকেই স্বনির্ভর। এই সমাজ আমাকে কিছু দিতে পারে না বরং স্বাধীনতা খর্ব করে। তাই আমরা এড়িয়ে যাই সামাজিক দায়বদ্ধতা। ভূলে গেছি সামাজিক মূল্যবোধ। আমরা একটি পরিবারকে যদি এভাবে কল্পনা করি, ধরুন একটি পরিবার। যেটি গড়ে উঠেছে বাবা-মা, ভাই-বোন, দাদা-দাদী, চাচা-চাচী এবং চাচাত ভাই-বোনদের নিয়ে। যাকে আমরা যৌথ পরিবার বলে জানি। যেখানে সবাই একে অপরের প্রতি দায়বদ্ধ। একজন অন্যজনকে লেখাপড়ায় সাহায্য করে, বড় ছোটকে আদর করছে প্রয়োজনে শাষন করছে। তারা একসাথে খেলছে, আনন্দ করছে। যাদের আনন্দের সবচেয়ে বড় উপকরন তাদের পারস্পরিক বন্ধন। হাসি-ঠাট্টায় মেতে থাকা। পরিবারের কোন ছেলে বাহিরে কোথায় যায়, কার সাথে মিশছে, কি করছে এটা লক্ষ করার জন্য এই পরিবারের আছে কয়েক জোড়া বিশ্বস্ত চোখ। এই পরিবারের কোন মেয়েকে তার প্রেমিকের বাড়িতে গিয়ে আত্নহত্যা করতে হয়নি কারন কেউ কোন অনৈ্তিক সম্পর্কে জড়ায়নি। সে সু্যোগও সে পায়নি। কেননা এখানে শুধুমাত্র কয়েক জোড়া বিশ্বস্ত চোখই যে আছে তাই নয়, আছে তার অনেকগুলি হিতাকাঙ্ক্ষীও। এই পরিবারের কোন ছেলে রাস্তায় ইভটিজিং করে না কারন প্রথমত তাকে তার আপন এবং চাচাত বোনদের দ্বায়িত্ব নিতে হয়। একত্রে বসবাস এর ফলে মেয়েদেরকে পন্য বা আনন্দ উপকরণ হিসেবে না দেখে মানুষ বা বন্ধু হিসেবে দেখতে শিখেছে। এছাড়াও ঐযে কয়েক জোড়া বিশ্বস্ত চোখ যা তাকে সবসময়ই তটস্ত করে রাখে। এই পরিবারের কোন পূত্রবধু নির্যাতিত হন না বা নিহত হন না কারন ঐ পর্যন্ত কোন ঘটনা ঘটার আগেই পরিবারের সদস্যরা সমাধান করে ফেলেন। এখানে একজন ভূল করলে অন্যজন তার ভূল ধরিয়ে দেন। এখানে কেউ কাউকে অন্যায় কোন কাজে প্ররোচিত করলে অন্যজন তাকে নিবৃত্ত করেন। এখানে কেউ কারো প্রতিদ্বন্দি নয় একে অপরের পরিপুরক। আর তাই একজন কর্তা গত হলে তার পরিবারের সদস্যরা অথই সাগরে পড়েনা। এই যে পরিবারটির কথা বললাম এটা হয়ত আমার দৃশ্যকল্প মাত্র কিন্ত একবার ভাবুন তো আপনি বা আর একটু পুরাতন যারা, তারা কি এমন কোন পরিবারেরই সদস্য ছিলেন না?

আজকের এই গ্লোবালাইজেশনের যুগে সমগ্র মানব জাতিকেই যেখানে একটি পরিবারের কাঠামোতে আসা উচিৎ সেখানে আমরা একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠিই পারছি না একটি কাঠামোর মধ্যে আসতে। শুধুমাত্র আমাদের সংকির্নতা আর আমাদের স্বার্থান্ধতার জন্যে। আমরা যদি ভাবতে পারতাম সবাই এক। যদি সজাগ থাকতাম আমাদের দায়বদ্ধতা সম্পর্কে তাহলে মিরপুরের হযরত আলীকে হয়ত এভাবে প্রান দিতে হত না। দেখুন সেদিন হযরত আলী কিন্ত একা ছিল না তার সাথে আরো ক'জন ছিল। যদি তারা সবাই একটি করে ইটও হাতে নিয়ে দাড়াত তাহলে হয়ত দুবৃত্তরা গুলি ছোড়ার সাহসই পেত না। এবং তাদের ধরাও সম্ভব হত। এরপরে আসুন আমরা আমাদের সন্তানদেরকে কি শিখাচ্ছি? আমার সন্তান দেখছে আমি তার দাদা-দাদীকে অবহেলা করছি। আমরা তাকে বৃদ্ধাশ্রমে অথবা গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে সস্তির নিশ্বাস ফেলছি। পারিবারিক, সামাজিক মূল্যবোধ এবং দায়বদ্ধতার পাঠ তার পাঠ্য বই থেকে শুরু করে ব্যবহারিক জীবন থেকে কতটুকু শিখতে পারছে? আমাদের ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, সিনেমা, নাটকে ভালবাসা বা প্রেমকে এমনভাবে চিত্রিত করা হচ্ছে যেন ভালবাসা বলতে দুটি নর-নারীর বোঝাপড়া, আর তাদের আবেগ উচ্ছাসে ভেসে যাওয়াকেই বোঝায়। এটা যেন শুধুমাত্র দু'টি নারী-পুরুষের স্বপ্নের পৃথিবী ভাঙ্গা-গড়ার গল্প বই আর কিছু নয়। আর এটাকে এমনভাবে চিত্রিত করা হচ্ছে যেন এটা ছারা কারো জীবন পূর্নাঙ্গ হয় না। আর তাই ভালো খারাপ সব শিক্ষার্থীরই অন্যতম লক্ষ হচ্ছে জীবনের পূর্ণাঙ্গতা(!)পাওয়া। সে লক্ষে তারা কত কিইনা করছে। এই হিরো হওয়ার প্রবনতা তাদের বিকৃত মনোজগৎ গড়ে তোলে। একটু খেয়াল করে দেখবেন। তারা যা করছে তা কিন্ত তাদের উদ্ভাবিত নয় কোন না কোন সিনেমা বা নাটকে তারা যা দেখছে। ঠিক তাই করছে। যারা আমাদের মিডিয়া অঙ্গনে কাজ করছেন তাদের কাছে আমার অনুরোধ সেলুলয়েডের পর্দায় ভালবাসাকে এতটা ছোট ফ্রেমে বন্দি করবেন না। তাহলে সন্তানের প্রতি মা-বাবার, মা-বাবার প্রতি সন্তানের, বোনের প্রতি ভাইয়ের, মানুষের প্রতি মানুষের। দেশের প্রতি নাগরিকের যে সম্পর্ক তাকে কি বলবেন? শুধুই দায়িত্ববোধ?

ভালবাসা শব্দটিকে যদি মহিরুহুর সাথে তুলনা করি তাহলে দায়িত্ববোধ তো তার একটি শাখা মাত্র। ভালবাসা একটি শক্তির প্রতিশব্দ। যে শক্তি কাজ করেছে পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে শুরু করে সভ্যতার শিখরে পৌছান অবধী। যে শক্তি আজো পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে রেখেছে। ভালবাসা শ্বাশ্বত, চিরন্তন। পূতঃ-পবিত্র। যদিও উদ্দেশ্য যাকে নিয়তই কুলষিত করে। আজ আমরা ভালবাসাকে লালসা চরিতার্থের উপায় হিসেবে ধরে নিয়েছি। ভাবুন; রমনাপার্ক, কোন ভার্সিটির ক্যাম্পাস, টিএস সি অথবা যে কোন পাবলিক প্লেসে আপনার বোন বা মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে বেড়িয়েছেন। আশেপাশে যা দেখছেন তাতে কি স্বাচ্ছন্দবোধ করছেন? ভালবাসা কি মানুষকে নিরাভরণ হতে শেখায়? ধর্মীয় অনুশাসন না হয় বাদই দিলাম মানুষের সাধারন বিবেকও যদি কাজ করত নিশ্চয়ই মানুষ এত বেহায়া হতে পারে না। বেলাল্লাপনা আজ লজ্জাকে গিলে খেয়েছে। প্রেমিক-প্রেমিকার পবিত্র প্রেম আজ রবীন্দ্র, নজরুল এর কাব্যে ঠাঁই নিয়েছে।

আজকাল টিভি নাটকের অন্যতম উপজীব্য বিষয় হল বিবাহ পূর্ব জৈবিক সম্পর্ক। এছাড়া হাতের কাছে অবাধ ইন্টারনেট। সাইবার ক্যাফের বদ্ধ ঘর। পর্নগ্রাফির অবাধ সরবরাহ। এর থেকে মুক্ত থাকা তো অনেকটা পানিতে ডুব দিয়ে জল স্পর্শ না করার মত। আজ আমরা যৌনতাকে ভালবাসার খোলসে মুড়ে করছি যথেচ্ছ ব্যবহার। ধর্মীয় মূল্যবোধ, সামাজিক অনুশাসন সব কিছুই ভেসে গেছে তথাকথিত আধুনিকতার জোয়ারে। যা আমাদের নিয়ে যাচ্ছে আইয়ামে জাহিলিয়ার যুগে। এই লেখা পড়ে কেউ হয়ত বলবেন এর বিরুদ্ধে কঠিন আইন করা উচিৎ। আমি তার সাথে দ্বিমত পোষন না করেও বলব লাভ নেই। শুধুমাত্র আইন করে যদি সমস্যার সমাধান হত। তাহলে মানুষ মানুষকে খুন করত না। কেউ বলবেন মেয়েদের পর্দার কথা। আমি তার সাথেও দ্বিমত পোষন না করেও বলব, লাভ নেই। কারন সব নারী যদি কাল থেকে দরজায় খিল এঁটেও বসে থাকে তবু দুবৃত্তরা নিষ্ক্রান্ত হবে না। যতক্ষন না তার দৃষ্টিভঙ্গী বদলাবে। যতক্ষন না নারী নিজেকে পন্য বানানো বন্ধ করবে। যতক্ষন না পারিবারিকভাবে এদেরকে শিক্ষিত করে তুলবেন। নারী নির্যাতন কোথায় না হচ্ছে। সমাজের সর্ব্বনিন্ম শ্রেনী থেকে শুরু করে সর্বোচ্চশ্রেণী। গলদটা কোথায়? আসলে এই ব্যাধিটা আমাদের মগজের। যা সারতে হলে ধোলাইটাও করতে হবে মগজকে। আর ফিরে যেতে হবে আবহমান বাঙ্গালীর ঐতিহ্য আর অহমের কাছে। যেখানে মানুষ একে অপরের। যেখানে মানুষ একত্রে হাসে, একত্রে গা্য়, একত্রে কাঁদে, একত্রে বাঁচে। একত্রে বাধে সুখের নীড়। যেখানে মানুষ প্রান খুলে হাসে। অপরের দুঃখে কাঁদে, যেখানে মানুষ বন্ধুর কোলে মাথা রেখে নির্ভার হতে পারে।