একটি ধানে দুইটি চাল, আশার আলো

তৌহিদ উল্লাহ শাকিল
Published : 3 Feb 2012, 07:55 AM
Updated : 3 Feb 2012, 07:55 AM

প্রতিদিন নানা হতাশার খবর শুনতে শুনতে যখন একেবারে হতাশ তখনি নিচের খবরট আশার আলো জালিয়ে দিল অনেক ।
হ্যাঁ রুপকথার গল্পের মতই সত্যি ঘটনা । এক ধানে দুই চাল । দিনাজপুরের বিরামপুরের অছিউদ্দিন একজন সাধারন কৃষক তার হাত ধরে এল একটি ধানের ভেতর থেকে দুই থেকে তিনটি চাল পাওয়া যাচ্ছে!তিনি নিজে এই ধানের চাষ করেন এবং বেশ ভালো ফসল ও পেয়েছেন । যদি ও এর আগে বিশ্বের চারটি দেশে এমন জাত পাওয়া গেছে তবে সেই সকল জাতের চেয়ে বর্তমানে উদ্ভাবিত ধানের জাওতটিকেই সেরা বলছেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনিস্টিউট ইরি।

বিরামপুর উপজেলা পরিষদের সামনে ছোট খাবারের হোটেল চালান অছিমুদ্দিন। পাশাপাশি করেন কৃষিকাজ। ২০০৯ সালের কথা। অছিমুদ্দিন বেড়াতে যান জয়পুরহাটের জামালগঞ্জ বাজার এলাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে। দিন-তারিখ মনে নেই। এক বিকেলে আত্মীয়ের বাড়ির পাশের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলেন তিনি। তাঁর পাশেই বসে চা খেতে খেতে গল্প করছিলেন স্থানীয় দুই কৃষক। তাঁদের গল্পের বিষয় তাঁর মনোযোগ কাড়ে। বুঝলেন, অচেনা জাতের ধান খুঁজে পাওয়ার বিষয় নিয়ে গল্প করছেন তাঁরা। সেই জাতের একটি ধান থেকে নাকি দুই থেকে তিনটি চাল পাওয়া যায়! একরাশ বিস্ময় নিয়ে তাঁদের গল্পের মধ্যে যেন ডুবে গেলেন অছিমুদ্দিন। শুনলেন, একজন অন্যজনকে বলছেন, 'এবার আমার আমন খেতে লম্বাজাতীয় কিছু ধানগাছ হয়েছে। দেখতে আগাছার মতো। পরে দেখি, সেগুলোতেও ধানের শিষ বের হয়েছে। তাই রেখে দিলাম। ধান পাকার পর দেখি, একটি ধানের ভেতর থেকে দুই থেকে তিনটি চাল বের হচ্ছে।'

গল্প শুনতে শুনতেই মনস্থির করে ফেলেন অছিমুদ্দিন। যে করে হোক, এই ধান সংগ্রহ করে নিজে চাষ করবেন। তাঁর আত্মীয়কে ধরে সেই কৃষকের কাছে নিজের ইচ্ছার কথা জানালেন। ওই কৃষক অচেনা জাতের ছয় থেকে সাতটি ধান দিলেন অছিমুদ্দিনকে। অছিমুদ্দিন অনেক কষ্ট করেও সেই কৃষকের নাম মনে করতে পারলেন না। তবে তাঁর উদারতার কথা ভোলেননি।

অছিমুদ্দিনের শুরু: নিজ বাড়িতে ফিরে বিরামপুর মহাবিদ্যালয়ের মাঠের পাশের একখণ্ড বীজতলায় আমন ধানের পাশাপাশি অচেনা সেই জাতের ধান কটি বুনলেন। কয়েক দিনের মধ্যে চারাও বের হলো। বীজতলা থেকে ওই চারা জমিতে রোপণ করলেন অছিমুদ্দিন। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে চারা। একটা পর্যায়ে দেখা গেল, আমনের অন্য জাতগুলোর তুলনায় অচেনা এই জাতের ধানের গাছগুলো বেশ খানিকটা লম্বা। অছিমুদ্দিন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকেন ধানের জন্য। এরপর থোকা থোকা ধান বের হলো। ধীরে ধীরে পাকাও শুরু হলো। অছিমুদ্দিনের যখন তর সয় না, তখন একদিন ধানের শিষ থেকেই কয়েকটি ধান নিয়ে খোসা ছড়ান। দেখেন, কোনোটির মধ্যে দুটি আবার কোনোটির মধ্যে তিনটি চাল। সেবার ওই কয়েকটি চারা থেকে কেজি খানেক ধান পান তিনি। এ খবর আশপাশে ছড়িয়ে যায়। উৎসাহী কৃষকেরা আসতে থাকে অছিমুদ্দিনের কাছে। পরের বছর চাষ বাড়ান তিনি। তিন শতকে ৩০ কেজির মতো ধান পান তিনি।

ছড়িয়ে পড়ে আশপাশে: প্রতিবেশী কৃষক অফিজ উদ্দিন, বিরামপুরের খানপুর ইউনিয়নের রতনপুর গ্রামের তোফাজ্জল হোসেন, জোতবানী ইউনিয়নের কচুয়া মির্জাপুর গ্রামের আবদুর রাজ্জাকসহ অনেকেই অছিমুদ্দিনের কাছ থেকে সেই ধান সংগ্রহ করেন।

অছিমুদ্দিন জানালেন, বিভিন্ন এলাকার অন্তত ২০ জন কৃষক তাঁর কাছ থেকে এই ধান নিয়ে যান। চাষ করেন। 'যা ধান হয়, তা উৎসাহী অন্য কৃষকেরা চাষ করবে বলে নিয়ে যান। তাই বাজারে এ ধান বিক্রি শুরু হয়নি। আমার ইচ্ছা, কৃষকদের হাত ধরে আশপাশের জেলাগুলোতেও এ ধানের চাষ ছড়িয়ে পড়ুক।' কৃষকের আগ্রহ আর নিজের ইচ্ছা সম্পর্কে এভাবে বলেন অছিমুদ্দিন।
তবে ধান কাটার আগেই খেত থেকে কিছু কিছু করে ধান চুরি হয়। তাই এবার এ জাতের ধান চাষই করেননি তিনি।

চাষ ও খরচ: কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এই জাতের ধানের চাষাবাদপদ্ধতি ও খরচ অন্য জাতের ধানের মতোই। বাড়তি কোনো পরিশ্রম নেই।
অছিমুদ্দিন জানালেন, অন্য জাতের ধানের চাষ করে বিঘাপ্রতি ১৪ থেকে ১৮ মণ ধান উৎপাদন করা সম্ভব। কিন্ত এই ধান বিঘাপ্রতি পাওয়া যায় আট থেকে দশ মণ।
'অছিমুদ্দিনের কাছ থেকে অচেনা সেই জাতের ধান এনে ১৫ শতক জমিতে চাষ করেছিলাম। চার মণের মতো ধান পেয়েছি। খরচ হয়েছে অন্য জাতের ধানের মতোই। কিন্তু ফলন কম।' বলছিলেন রতনপুরের কৃষক তোফাজ্জল। এই জাতের ধান নিয়ে গবেষণা করা হলে ফলন ভালো হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে আশাবাদী তোফাজ্জল।

কৃষক রাজ্জাক ও অফিজ উদ্দিন ২৭ শতক জমিতে এ জাতের ধানের আবাদ করেন। অফিজ উদ্দিন বলেন, 'এ ধানের চাল পোলাওয়ের চালের মতো। ফলন কম হলেও সমস্যা নেই। গবেষণা করে যদি এর মধ্যে পোলাওয়ের চালের গন্ধ দেওয়া যায়, তা ভালো দামে বিক্রি করা যাবে। তখন এই ধান চাষ করেও কৃষকদের লোকসানের আশঙ্কা থাকবে না। আর গাছ লম্বা বলে খড় অনেক বেশি পাওয়া যায়।'
কয়েকজন কৃষক জানালেন, এ ধানগাছের উচ্চতা প্রায় পাঁচ ফুট। তাই বর্ষাকালে কিছুটা নিচু জমিতেও চাষ করা সম্ভব। বড় ধরনের বন্যা ছাড়া এ গাছ ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা নেই। গাছের গোড়া সাধারণ ধানগাছের চেয়ে মোটা। তাই খেতে দীর্ঘদিন পানি জমে থাকলেও গোড়া পচে যাওয়ার ভয় থাকে না।

অছিমুদ্দিনের জামাই আতাবুল ২০১০ সালে ১০ কাঠা জমিতে এ ধানের চাষ করেন। কিন্তু বর্ষা শুরু হলে খেত ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা ভর করে তাঁর মাথায়। 'বর্ষার পানি খেতে জমতে শুরু করলে ক্ষতি হবে বলে ভয় পেয়েছিলাম। তবে পানি বাড়তে থাকলে গাছও বড় হতে থাকে। ধানগাছ লম্বা বলে পানি গাছের ডগা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। গাছের গোড়াও পচেনি।' বলছিলেন আতাবুল। 'এত দিন আমরা বইন্যারে ভয় পাতাম। এই জাতের ধান বইন্যারে ভয় পায় না।' মন্তব্য আতাবুলের।

চাল ও ভাত: কৃষক রাজ্জাক জানালেন, এ ধান দেখতে সাধারণ অন্য ধানের চেয়ে কিছুটা মোটা। তবে চাল সরু, একটু বাঁকাও। দেখতে কিছুটা কাটারিভোগ চালের মতো।
এই চালের ভাত খেয়েছেন এমন কয়েকজন জানালেন, চাল সরু বলে ভাতও সুন্দর ঝর ঝরে হয়। খেতেও ভালো লাগে।

অছিমুদ্দিনের মেয়ে পেয়ারা জানালেন, একেবারে সাধারণ চালের মতোই রান্না করতে হয়। এমনি রান্নার সময় পানির কম-বেশিও সেভাবে করতে হয় না।
যমজ চালের ধানের জাত বিশ্বের আরও চারটি দেশে পাওয়া গেছে। তবে বিরামপুরে পাওয়া জাতটি অন্যগুলোর চেয়ে উন্নত মানের। ধান গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) আশির দশকে চীন, ভারত, মালয়েশিয়া ও গায়ানায় এই জাতটি খুঁজে পেয়েছিল। ওই চার দেশে পাওয়া জাতগুলোতে মোট ধানের দুই থেকে পাঁচ শতাংশে ধানপ্রতি তিনটি চাল পাওয়া যায়। বিরামপুরের ধানে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ ধানে যমজ চাল পাওয়া যাচ্ছে। বিদেশের জাতে ৩০ শতাংশ ধানে দুটি করে চাল পাওয়া যায়। বিরামপুরের জাতে ৫০ শতাংশ ধানে দুটি চাল পাওয়া গেল।

ইরির বিজ্ঞানীরা এ নিয়ে গবেষণা করে দেখেছিলেন, এ ধরনের যমজ দানার জাতে এমন সব গুণ আছে, যা থেকে হাইব্রিড ধানের 'বন্ধ্যত্ব' দূর করা সম্ভব। হাইব্রিড বীজ কৃষক একবার কিনে চাষ করার পর তা থেকে আর বীজ হয় না। যমজ দানা ধানের সঙ্গে শঙ্কর করলে কৃষকেরাও হাইব্রিড ধান থেকে বীজ সংগ্রহ করতে পারবেন বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।

উচ্চফলনশীল জাতের (উফশী) মধ্যেও এই ধানের কৌলিক বৈশিষ্ট্য যুক্ত করা সম্ভব। এতে দেশের ধান উৎপাদন ব্যাপক হারে বাড়তে পারে।
বিজ্ঞানীরা আরও মনে করছেন, দিনাজপুরের বিরামপুরে অছিউদ্দিনের হাত ধরে চাষ হওয়া ওই জাতটি নিয়ে দ্রুত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।

তথ্যসূত্র ঃ ধান গবেষণা ইনিস্টিউট (ইরি) এবং দৈনিক প্রথম আলো ।