বিদায়ের ক্ষণে কিছু কথা

তৌহিদ উল্লাহ শাকিল
Published : 11 March 2012, 07:28 AM
Updated : 11 March 2012, 07:28 AM

২০০৬ সালের ২৩শে নভেম্বর সৌদি আরবের রিয়াদে এসেছিলাম । এরপর থেকে একটানা পাঁচ বছর রিয়াদ ফুড ইন্ডাস্ট্রি কোম্পানীতে কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স ম্যানেজার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছি । এই দীর্ঘ সময়ের পথচলায় অনেক বাংলাদেশী এবং অন্যান্য দেশী মানুষের স্থে নিয়মিত পরিচিত হয়েছি । বাংলাদেশী বিভিন্ন কমিনিটির সাথে যুক্ত হয়েছি । বাংলাদেশী ভাইদের আমন্ত্রনে সৌদি আরবের বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি। আমার সাথে সকল পেশার সকলের সাথেই বেশ খাতির ছিল । ডাক্তার ইঙ্গিনিয়ার থেকে শুরু করে রাস্তায় ঝাড়ু দেওয়া বাংলাদেশীদের সাথে একসাথে আমি খবার খেয়েছি অনায়াসে । এতে করে সকলে আমাকে যেমন ভালোবাসত আমি ও তাদের কে তেমনি ভালোবাসতাম । এরপর আমি বেশ কিছু ব্লগে এবং আমার লেখা গল্পে কিংবা কবিতায় সৌদি প্রবাসি বাংলাদেশীদের সুখ দুঃখ সব নিয়ে বিস্তারিত লিখেছি কমবেশি।

সময়ের পথচলায় একদিন সবাইকে থেমে যেতে হয় । সত্যি কথা হল আমি কখন ও এই দেশকে আপন করে নিতে পারিনি । সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা পেলে ও বারবার বঞ্ছিত বাংলাদেশীদের কথা আমার মনে হত বারবার। যদি ও আমি সেইসকল বঞ্ছিত দের জন্য কিছুই করতে পারিনি ।তবু আমি চেস্টা করেছি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের । যে কোন বিপদে দেশিভাইদের সাধ্যমত সহযোগীতা করেছি । কাউকে কাউকে নিয়ে আমি সৌদি মহাকুমা(আদালতে) পর্যন্ত গিয়েছি তার নায্য পাওনার জন্য । আজ আমি স্বেচ্ছায় সব কিছু ছেড়ে দেশে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি । আমার মনে হয়েছে এভাবে বাইরে নয় , নিজের জন্য এবং নিজের দেশের জন্য কাজ করাটাই অনেক জরুরী। সেটা যত ছোটই হোক না কেন ।

সৌদি আরবে সবচেয়ে যে জিনিসটা আমাকে কষ্ট দিয়েছে সেটা হচ্ছে জাতিগত বৈষম্যে । একই পোস্টে কাজ করে যেখানে বাংলাদেশি শ্রমিক পায় মাত্র ৮০০ রিয়াল সেই একই পোস্টে কাজ করে অন্য দেশি মিসরিয়, সিরিয়ান,সুদানি তারা পায় ২৫০০ রিয়ালের উপরে । এছাড়া বাংলাদেশীদের নিয়ে অধিকাংশ সউদির মনোভাব অতি নিম্ন মানের । তারা ভাবে যারা সৌদি আরবে আসে তাদের মনে হয় থাকা খাওয়ার জায়গা নাই।

এছড়া সবচেয়ে খারাপ লেগেছে যখন দেখেছি রোদেলা দুপুরে পিচ ঢালা রাস্তায় কোন বাংলাদেশি ঝাড়ু দিচ্ছে । এই ভিসায় বাংলাদেশীদের না পাঠালেই বোধহয় ভালো হয় । এই জন্য অনেক বাংলাদেশি তার যোগ্য সন্মান পায়না । কাজ কাজই , কিন্তু সকল ক্ষেত্রে এই নীতি বাক্য মানহানির কারন হয়ে দাড়ায় ।

অন্যদিকে যারা কৃষি কাজের জন্য (মাঝরা) মরূদ্যানে কাজ করছে , তাদের জন্য ও বেশ খারাপ লাগত । দিনের পর দিন খুব ভোর থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত অমানুষিক কাজ করে বিনিময়ে সামান্য মুজুরি পাচ্ছে ।

এসবের মাঝে ও আশা জাগানিয়া হচ্ছে অনেক বাংলাদেশি ব্যাবসার সাথে জড়িত আছে । আমার মনে হয় সবচেয়ে ভাল অবস্থানে আছে ব্যাবসায়ীরা । এছাড়া উচ্চ পদস্থ কাজে যারা নিয়োজিত তারা সকলেই ভাল আছে বলে মনে হয় । সৌদি আরবের বেশির ভাগ ইন্ডাস্ট্রি তে বাংলাদেশি শ্রমিকরা দক্ষতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে । সবচেয়ে যে ব্যাপারটা আমাকে আনন্দ দেয় তা হল বাংলাদেশি পন্য এখন সৌদি আরবে খুব সহজেই পাওয়া যায় । বিশেষ করে প্রান এবং বিডি ফুডের ব্রান্ড প্রোডাক্ট গুলো এখন এই দেশে বেশ গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠেছে ।

কিছু ক্ষেত্রে কিছু বাংলাদেশি ভারতীয় এবং নেপালী ও শ্রীলংকান দের সাথে মিলে বেশ কিছু অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে । আর এতে করে পুরো বদনাম টা শুধু মাত্র বাংলাদেশের হচ্ছে । মিডিয়ায় বাংলাদেশি কারো সাথে আমার পরিচয় হয়নি । আমি অনেক খুজেছি কিন্তু কোন বাংলাদেশী কে এই দেশে সাংবাদিক হিসাবে কাজ করতে দেখি নাই । এতে করে অন্য দেশের সাংবাদিকরা নিজের দেশের অপকর্মের ভার ও আমাদের দেশের শ্রমিকদের উপর উঠিয়ে দেয় । এখানে বেশির ভাগ সাংবাদিক ভারতের কেরালা অঙ্গরাজ্যের এবং পাকিস্তানের । আমাদের সরকারকে এই দিকে খেয়াল দেওয়া উচিত বলে মনে করি ।
শ্রম বাজার হিসাবে বর্তমানে সৌদি আরব বেশ সুসংগঠিত । এখন বেতন বেশ ভালো । বেশির ভাগ কোম্পানিতে এখন শ্রমিকের সর্বনিম্ন বেতন ১৬০০ থেকে ২৫০০ পর্যন্ত। এই সম্ভাবনা ময় শ্রম বাজার নিজেদের দখলে নেওয়ার জন্য ভারত, পাকিস্তান, নেপাল অনেক চেষ্টা করছে । বাংলাদেশ সরকারকে এই দিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে । নয়তো সম্ভবনা ময় এই শ্রম বাজার আমাদের জন্য চিরতরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে । সম্প্রতি সৌদি আরবের একজন এই প্রথম দেশের বাইরে মানে আমাদের দেশে মধ্যরাতে খুন হয়েছে। সৌদি সরকার এই ব্যাপারে বেশ উদ্বিগ্ন ।

আমার এই দীর্ঘ সময়ের পথচলায় আমি আমার সকল পরিচিত বন্ধুদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি , মনের অজান্তে কোন ভুল করে থাকলে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন আশা করি । আর সক প্রবাসীকে একটাই কথ বলব
সব সময় চেষ্টা করবেন সৎ থাকতে এবং দেশের মানস্নমান বজায় রাখতে । আশা রাখি নিয়মিত লিখব তবে সেইসব লেখা হবে নিজের দেশের মাটিতে বসে । সকলের জন্য রইল অনেক অনেক শুভকামনা ।